শাবান-রমজান ১৪৩১   ||   আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০১০

হুজুগঃ কাজ ও অবস্থান ভুললে কি চলবে?

এদেশে হুজুগ বা হাওয়ার কোনো শেষ মাত্রা চিহ্নিত নেই। যখন যেদিকে হুজুগ ওঠে মনে হয় দলে দলে মানুষ সেদিকেই ছুটতে থাকে। উল্টো দিকে আর কাউকে দেখা যায় না। এমনকি থেমে থাকা মানুষদেরও ভালো চোখে দেখা হয় না। সবেমাত্র শেষ হওয়া বিশ্বকাপ ফুটবল চলার সময় এ প্রবণতাটি আরেকবার সামনে এসেছে। এসেছে আরোও কিছু বিষয়েও। ফুটবল এখন এদেশে প্রায় না দেখা একটি খেলা। খেলার দৃষ্টিতে দেখলেও ধরা পড়ে, ফুটবলে বাংলাদেশের কোনো জায়গা নেই। এর দর্শক সংখ্যাও এখন কম। কিন্তু যেই বিশ্বকাপ শুরু হল মনে হল এদেশে ফুটবলের পাগল সবাই আগে থেকেই ছিল। এখন যেন সেই পাগলামি আর দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। হুজুগ তো হুজুগ, তার সঙ্গে মিডিয়ার বাতাস! ফুটবল নিয়ে কেউ চার পৃষ্ঠা, কেউ আট পৃষ্ঠা, কেউ ভিন্ন পত্রিকাই প্রকাশ করল। আবার কেউ কেউ বিশাল বিলবোর্ড করে জানান দিল, ফুটবল নিয়ে তাদের জ্ঞান অন্যদের চেয়ে বেশি। কুইজ, প্রতিযোগিতা, হাসি-কান্না, ঝগড়া-তর্ক আর বিশাল বিশাল পতাকা। একটি মিডিয়াও বলল না, এত বাড়াবাড়ি দৃষ্টিকটু, এত অপচয় ঠিক না। এদেশের প্রেক্ষাপটে কেউ যদি বলে, সবার উপরে হুজুগ সত্য তাহলে উপর নাই’-তাহলে তাকে সবচেয়ে সঠিক রস-মন্তব্যকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। এখানে হুজুগের মূল্যই সবচেয়ে বেশি, বাস্তবতার নয়। ষোলই ডিসেম্বর আর ছাব্বিশে মার্চে দেশজুড়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে। পহেলা বৈশাখে শহর-নগরে বাসন্তি রঙের শাড়ি আর সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির মহড়া হয়। মিডিয়াগুলো লেখে, সবাই দেশপ্রেমে উজ্জীবিত, নিজস্ব সংস্কৃতিতে আলোকিত। কিন্তু এক বিশ্বকাপে যে ক’ হাজার বিশালায়তন বিদেশি পতাকা দেশের আকাশে উড়ে তার দশমাংশ সাইজের স্বদেশি পতাকা দেশের আকাশে কখনো উড়তে দেখা যায় না, জেনেও মিডিয়ার পণ্ডিতরা একটুও নাক কুচকান না। তারা এই বিদেশি পতাকার দৈর্র্ঘ্য-প্রস্থ বাড়তে আরো সম্পূরক তথ্য সরবরাহ করে দায়িত্ব পালন করেন। এদেশে কোরবানির মওসুমে, হজের মওসুমে বুদ্ধির ঢেকুর তুলতে তুলতে উপদেশ খয়রাত করা হয়-সওয়াবের নামে অপচয় ঠিক না। নফল হজ, নফল কুরবানি না করে সে টাকা দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু বিশ্বকাপের বাহারি পতাকায় কয়েকটি টেক্সটাইল মিলের এক বছরের উৎপাদন সমান কাপড়ের মূল্য বাতাসে উড়তে থাকলেও কোনো উপদেশ চেয়েও পাওয়া যায় না। আসলে হুজুগ আর মতলবের অদ্ভুত হাত ধরাধরির কালচার আমরা আত্মস্থ করেছি। গত মে মাসের শেষ দিকে মূসা ইবরাহীম নামের এক তরুণের এভারেস্ট আরোহণের খবর প্রচার হয়। বাংলাদেশের এই তরুণ এভারেস্ট চূড়ায় উঠতে সক্ষম হয়েছেন। তার পর্বত আরোহণের পথে ছিল অনেক ঝুঁকি ও শঙ্কা। তিনি একটি সাহসী কাজ করেছেন। বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের ক্ষেত্রে এটি প্রথম ঘটনা। এতসব কিছুর পরও তার এ ঘটনাটিকে কি এভারেস্ট বিজয় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? কোনো পর্বত বা গ্রহ-নক্ষত্র বিজয় কাকে বলে? প্রথম একজন গিয়ে বিজয় বা আবিষ্কার করার পর পরবর্তীতে যাওয়া হাজার জনের প্রত্যেকেই কি বিজয়ী হিসেবেই আখ্যা পেতে পারেন? জানি না, এরপ সংজ্ঞায়নের পদ্ধতিটা কী? কিন্তু এক্ষেত্রে দেখলাম দেশের প্রধান মিডিয়াগুলো ব্যানারহেড করে, লিড করে বিষয়টি নিয়ে কত মাতামাতিই না করল! এখনও এর জের চলছে। এডভেঞ্চারের চূড়ান্ত কিছু করে এডভেঞ্চারিজমের প্রতি তরুণদের আকৃষ্ট করার কোনো প্রয়োজন কী বাংলাদেশে আছে? এ দেশে এমনিতেই তো নানা ধরনের অর্থহীন এডভেঞ্চারিজমের যন্ত্রণা চলছে। মানুষের কল্যাণে লাগে এমন কোনো কিছুর অগ্রসরতার ঘটনা এদেশে কমে যাচ্ছে। পাটের জিন আবিষ্কারের ঘটনা অবশ্য এদেশের জন্য ইতিবাচক ঘটনা। অথচ এ জাতীয় ঘটনার প্রচার ও উৎসাহ সৃষ্টিতে দেখা যায় মিডিয়া কৃপণ হয়ে যায়। প্রযুক্তি, কল্যাণ, চিকিৎসা, সেবা, উন্নয়ন, ত্যাগ, মানবিকতা ও ইতিবাচকতার ক্ষেত্রগুলোতে সাফল্যের কোনো অনুসন্ধান ও তৃষ্ণা আমরা হারাতে বসেছি। হুজুগের কেন্দ্র হয়ে যাচ্ছে অর্থহীনতা, বিনোদন, অপচয়, এডভেঞ্চার। প্রশ্ন হওয়া উচিত, জাতীয় চেতনা ও প্রবণতার পথ নির্ণয়ে এ গুলো কতোটা ইতিবাচক? বাস্তবতা হচ্ছে এদেশে ইতিবাচক কোনো ক্ষেত্রেও যদি প্রচারণা বেশি হয় তখন সেটা তার যথার্থ জায়গা অতিক্রম করে একটা হুজুগে অবস্থানে গিয়ে পৌঁছে যায়। তখন অস্বস্তি সৃষ্টি হতে থাকে। নেতিবাচক বা অর্থহীন ক্ষেত্রে তো নয়ই, এই ইতিবাচক ক্ষেত্রের হুজুটাও সমর্থনযোগ্য নয়। এসব হুজুগ, হুজুগ আক্রান্ত প্রতিটি মানুষকে যেমন তেমনি একটি জাতিকেও তার আসল কাজ থেকে বহু বহু দূরে ঠেলে দেয়। ভুলিয়ে দেয় নিজের কাজ ও গুরুত্বের মাপকাঠি। বিশ্বকাপ খেলা শেষ হওয়ার দু’দিন পর পথে হেঁটে হেঁটে যেতে দেখলাম, খোলা চা স্টলে বসে কয়েকজন ক্লান্ত রিকশাওয়ালা ফুটবল নিয়ে গল্প করছেন। একজন তো জগত-জীবনের প্রতি বড়ই বিতৃষ্ণা ও হতাশা ব্যক্ত করে বললেন, বুঝলাম না, রেফারি কেন্‌ নেদারল্যান্ডের এক খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখিয়ে বের করে দিল। আর গোল করার সময় অফসাইডটা দেখল না! এভাবে তো দুনিয়া চলতে পারে না।’ বাংলাদেশের একজন রিকশাচালকের এই জগতব্যাপী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে বুঝে নিন, হুজুগ আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। মিডিয়ার বাতাস পেয়ে হুজুগ আর হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো বন্ধ না হলে এ জাতির ডিজিটাল ঘড়িতে ১২ টা বেজে যাবে ভোর রাতেই।

 

advertisement