শাবান-রমজান ১৪৩১   ||   আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০১০

আইন-শৃঙ্খলাঃ আতঙ্ক সৃষ্টি কাম্য নয়

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করাই পুলিশবাহিনীর দায়িত্ব। পুলিশবাহিনীতে নিয়োজিত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা এ দায়িত্ব পালনে অবশ্যই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার চেষ্টা করেন। দায়িত্বহীনতা ও অসততা থেকে তাদের দূরত্ব বজায় রাখার কারণে পুলিশের মাধ্যমে এখনও সমাজে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালিত হয়। কিন্তু পুলিশের কিছু সংখ্যক সদস্যের দুর্নীতি, অতিশয় ক্ষমতা চর্চা, আইন ও শাসনের মাঝে ভারসাম্য রক্ষায় ব্যর্থতার কারণে বার বার গোটা পুলিশবাহিনীকে বদনামের ভাগী হতে হয়েছে। অতীতেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। গত ২৮ জুন থেকে ১ জুলাইয়ের মধ্যে বাবুল, মিজানুর রহমান ও মজিবর রহমানের পুলিশি হেফাযতে মৃত্যুর ঘটনা মিডিয়ায় ঝড় তুলেছে এবং উচ্চ আদালত থেকে নতুন নির্দেশনার উপলক্ষ সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলোও উদ্বেগ জানিয়েছে। সংবাদপত্রগুলোতে এ বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে। উচ্চ আদালত পুলিশি হেফাযতে সামপ্রতিক কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে তদন্দ করতে স্বরাষ্ট্র সচিবকে নির্দেশনা দিয়েছেন। উচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ বিষয়ক তদন্ত কমিটিতে পুলিশের কোনো সদস্য থাকতে পারবেন না। অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে থাকলেও আগে এসব ক্ষেত্রে তদন্তের দায়িত্ব পালন করত পুলিশ। কিন্তু এবার আদালতের সিদ্ধান্তে সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করার পথ বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পুলিশের প্রতি অনাস্থা এবং পুলিশের ইমেজ ঘাটতির ঘটনাটি বড় হয়ে সামনে এসেছে। সমপ্রতি মানুষ গুম, রিমাণ্ডে নির্যাতন, গুপ্তহত্যা ইত্যাদির অভিযোগও জোরালোভাবে ওঠছে এবং এসব ক্ষেত্রে অভিযোগের আঙুল যাচ্ছে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকেই। আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রাখার কাজটি যাদের পেশা তাদেরই একটি অংশের বিরুদ্ধে যদি একের পর এক মারাত্মক অভিযোগ ওঠতে থাকে তাহলে তাৎক্ষণিক সংকটে পড়ে নাগরিক সাধারণ নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য যাবেন কাদের কাছে? এর আগে বেশ কিছু দিন ধরে এ ধরনের কিছু অভিযোগ ওঠেছিল র্যা বের কোনো কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে, কোনো কোনো ঘটনায়। পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা আগের অভিযোগগুলো এ পর্যায়ের ছিল না। এখন পুলিশের সদস্যরাও যদি মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে নিজেদেরকে দায়মুক্ত ও জবাবদিহিতাশূন্য মনে করতে শুরু করেন তাহলে পুলিশ-বিষয়ে জনমনে গভীর আতঙ্ক দানা বেঁধে ওঠবে। অথচ তাদের কাজ তো আতঙ্কবাদীদের দমন করে মানুষের মাঝে স্বস্তি দেওয়া, আতঙ্ক তৈরি করা তাদের কাজ নয়। পুলিশি হেফাযতে কেউ গেলে মৃত্যু তো দূরের কথা, তিনি যেন বিচারবহির্ভুত কোনো আচরণেরই শিকার না হন-সেটা নিশ্চিত করাও পুলিশ সদ্যসের দায়িত্ব। বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, এমন ঘটনা ঘটতে পারে কয়েকটি কারণে। এক. রাষ্ট্রপরিচালকদের আচরণে পুলিশের কেউ কেউ যদি মনে করার সুযোগ পান যে, তাদের ক্ষমতার সীমাটি আইনের আওতা-বহির্ভুত এবং কাউকে ধরে এনে তারা যাই করেন না কেন, তার জন্য কোনো জবাবদিহিতার প্রয়োজন নেই তাহলে এমন ঘটনা ঘটার অবকাশ তৈরি হয়। দুই. যদি উপরস্থদের কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতদের মনে রাজনৈতিক স্বার্থ-সুবিধার প্রশ্নটি বড় করে জায়গা করে নেয় তাহলেও এমনটি বেশি ঘটতে পারে। বিশ্লেষকরা আরো অনেক কারণের কথাই বলতে পারেন। কিন্তু আমরা মনে করি, দু-দশজনের ভুল আচরণের দায় গোটা বাহিনী নিতে পারে না। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে ব্যস্ত, এই বাহিনীর ইমেজ ও আস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আতঙ্ক, অনীহা, হতাশা ও দূরত্বের চোখে তখন তাদের মূল্যায়ন করার মাত্রা বেড়ে যাবে। এটা পুলিশ বাহিনী কেবল নয়, গোটা দেশের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠবে। দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্যই বদনাম কুড়ানো সদস্যদের ব্যাপারে গোটা পুলিশবাহিনীর গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা দরকার। ময়লা-আবর্জনা মুছে ফেলে স্বচ্ছ ইমেজ নিয়ে জনগণের পাশে পুলিশের সাহায্যকারী হাত সক্রিয় হলে দেশেরই কল্যাণ হবে। সে কল্যাণ সাধনের দায় ও সুযোগ দুটোই বেশি পুলিশ বাহিনীর কর্তাব্যক্তি ও সদস্যদের।

 

advertisement