শাবান-রমজান ১৪৩১   ||   আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০১০

হাদীস ও আছারের আলোকে বিত্‌র নামায - ৩

মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ লুধিয়ানভী রাহ.

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) হযরত উম্মে সালামা রা. উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা. থেকে ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে এগারো রাকাত নামায পড়তেন। তবে বয়সের কারণে যখন কমযোরী এসে গেল তখন সাত রাকাত বিতর পড়তেন। كان يصلي من الليل إحدى عشرة ركعة فلما كبر وضعف أوتر بسبع. (নাসায়ী ১/২৫১; তিরমিযী ১/৬০) এই বিবরণ উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা.-এর বিবরণের অনুরূপ। এই হাদীসের রাবী ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকেও বিতরের হাদীস বর্ণনা করেন। ঐ রেওয়ায়েতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আট রাকাত নফল ও তিন রাকাত বিতর পড়তেন। উভয় রেওয়ায়েতের বিষয়বস্তু এক, পার্থক্য শুধু এইটুকু যে, আলোচ্য রেওয়ায়েতে পূর্ণ নামাযকে বিতর বলা হয়েছে। এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম তিরমিযী রাহ. ইসহাক ইবনে ইবরাহীম রাহ.-এর নিম্নোক্ত বক্তব্য বর্ণনা করেছেন। ‘এই হাদীসের অর্থ হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে বিতরসহ তেরো রাকাত নামায পড়তেন। এখানে সালাতুল লাইলকে বিতরের সাথে তুলনা যুক্ত করে পুরো নামাযকে বিতর বলা হয়েছে।’ إنما معناه أنه كان يصلي من الليل ثلاث عشرة ركعة مع الوتر فنسبت صلاة الليل إلى الوتر (তিরমিযী ১/৬০) সুনানে নাসায়ীতে মিকসাম রাহ.-এর বর্ণনায় উম্মে সালামা রা.-এর বিবরণ এভাবে উল্লেখিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঁচ রাকাত ও সাত রাকাত বিতর পড়তেন মাঝে সালাম-কালাম দ্বারা আলাদা করতেন না। كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بخمس وسبع لا يفصل بينهما بسلام ولا كلام. (নাসায়ী ১/২৪৯) প্রথম কথা এই যে, রেওয়ায়েতটি মুযতারিব। (উসূলে হাদীসের পরিভাষা অনুযায়ী মুযতারিব জয়ীফ রেওয়ায়েতের একটি বিশেষ প্রকার। যে রেওয়ায়েতের সনদ বা মতনে এমন বিরোধ ও বর্ণনাগত পার্থক্য বিদ্যমান, যা সমন্বয় করা যায় না এবং যা বর্ণনাকারীর বর্ণনাগত দুর্বলতা নির্দেশ করে।) ইমাম নাসায়ী রাহ. তা দেখিয়েছেন। মিকসাম কখনো তা উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণনা করেন, কখনো মাঝে ইবনে আব্বাস রা.-এর সূত্র উল্লেখ করেন। আবার কখনো আয়েশা রা. এবং মায়মূনা রা.-এর দিকে এই বক্তব্যকে নিসবত করেন যে, বিতর সাত রাকাত হওয়া চাই। অন্তত পাঁচ রাকাতের কম নয়।’ এ ধরনের মুযতারিব রেওয়ায়েত মুতাওয়াতির রেওয়ায়েতের মোকাবেলায় গ্রহণযোগ্য নয়। এরপরও যদি সহীহ বলতে হয় তাহলে এই ব্যাখ্যা করতে হবে যে, ঐ পাঁচ বা সাত রাকাতে সালাম উচ্চস্বরে বলতেন না এবং কারো সঙ্গে কথাও বলতেন না। সর্বশেষ রাকাতে এত জোরে সালাম বলতেন যে, ঘরের লোকেরা সজাগ হয়ে যেত। সর্বশেষ রাকাতে উচ্চস্বরে সালাম ফেরানোর কথা হযরত আয়েশা রা.-এর বর্ণনায় আছে। তাই উপরোক্ত রেওয়ায়েত থেকেও এই অর্থই গ্রহণ করতে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর হাদীস হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাতের নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, রাতের নামায দুই রাকাত, দুই রাকাত। (এভাবে আদায় করতে থাকবে) যখন সুবহে সাদিকের আশঙ্কা হবে তখন এক রাকাত পড়বে, যা তার আদায়কৃত নামাযকে বিতর করবে। إن رجلا سأل النبي صلى الله عليه وسلم عن صلاة الليل، فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم : صلاة الليل مثنى مثنى، فإذا خشي أحدكم الصبح صلى ركعة واحدة توتر له ما قد صلى. (সহীহ বুখারী ১/১৩৬; সহীহ মুসলিম ১/২৫৭) সহীহ মুসলিমে (১/২৫৭) আবু মিজলায রাহ. ইবনে আব্বাস রা. ও ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, বিতর এক রাকাত, রাতের শেষাংশে। الوتر ركعة من آخر الليل এটি আলাদা হাদীস নয়; বরং পূর্বোক্ত হাদীসেরই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। কারণ সুনানে ইবনে মাজায় (পৃ. ৮৩) তা এভাবে আছে, রাতের নামায দুই রাকাত, দুই রাকাত। আর বিতর এক রাকাত সুবহে সাদিকের পূর্বে। কেউ কেউ মনে করেছেন, এই হাদীস এক রাকাত বিতর সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন। কিন্তু তা সঠিক নয়। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. লেখেন, এক রাকাত আলাদাভাবে আদায় করার বিষয়ে এই হাদীস দ্ব্যর্থহীন নয়। কারণ দুই রাকাতের সাথে এক রাকাত যুক্ত করে তিন রাকাত বিতরও উদ্দেশ্য হতে পারে। وتعقب بأنه ليس صريحا في الفصل، فيحتمل أن يريد بقوله صلى ركعة واحدة أن مضافة إلى ركعتين مما مضى (ফাতহুল বারী ২/৩৮৫) অর্থাৎ নামায বিতর (বেজোড়) হওয়া এক রাকাতের উপরই নির্ভর করে। এর দ্বারাই নামাযী তার নামাযকে বিতর (বেজোড়) করবে। এই এক রাকাত যোগ করা ছাড়া সারা রাত নামায পড়লেও নামায বিতর হবে না। কারণ রাতের নামায তো দুই রাকাত দুই রাকাত। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলা হয়েছে যে, বিতর হল এক রাকাত, রাতের শেষে। একথাটা ঠিক তেমনি যেমন হজ্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, হজ্ব হচ্ছে আরাফা। الحج عرفة (সুনানে আরবাআ, মুসনাদে আহমদ প্রভৃতি-জামে সগীর ১/১৫১) অর্থাৎ উকূফে আরাফা ছাড়া হজ্ব হয় না। কিন্তু উকূফে আরাফাই সম্পূর্ণ হজ্ব তা বলা উদ্দেশ্য নয়। কারণ হজ্বে আরও অনেক রোকন ও আমল আছে, ইহরাম আছে, তাওয়াফ আছে, সায়ী আছে ইত্যাদি। তদ্রূপ বিতর এক রাকাত, রাতের শেষে-একথার অর্থও এই নয় যে, এক রাকাতই সম্পূর্ণ বিতর; বরং তা বিতরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা ছাড়া বিতরের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। একথাটাই এভাবে বলা হয়েছে যে, রাতের নামায দুই রাকাত করে। অতঃপর যখন সুবহে সাদিকে আশঙ্কা হয় তখন এক রাকাত পড়বে, যা তার আদায়কৃত নামাযকে বিতর করে দিবে। এই হাদীসের সরল অর্থ এছাড়া আর কী হতে পারে যে, দুই রাকাত করে পড়তে থাকবে। যখন সুবহে সাদিক নিকটবর্তী হবে তখন দুই রাকাতের সাথে আরো এক রাকাত যোগ করে তিন রাকাত আদায় করবে। এতে তার নামায বিতর (বেজোড়) হয়ে যাবে। এখানে আরো মনে রাখা উচিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হাদীস মিম্বরে দাড়িয়ে জুমার খুতবায় ইরশাদ করেছেন। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/৬৮, বাবুল হিলাকি ওয়াল জুলূসি ফিল মাসজিদ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীর অর্থ যদি এই হত যে, বিতর শুধু এক রাকাত তাহলে সাহাবায়ে কেরামের তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অথচ সাহাবায়ে কেরাম দু’ চারজন ছাড়া কেউ তিন রাকাতের কম বিতরের প্রবক্তা ছিলেন না। দু’চার জনের ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে, কিন' সকল সাহাবী হাদীসের অর্থ ভুল বুঝেছেন কিংবা হাদীসটি তাদের নিকটে পৌঁছায়নি-এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। অতএব শীর্ষস্থানীয় অসংখ্য সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীর যে অর্থ বুঝেছেন তা অবশ্যই হাদীসের সঠিক মর্ম। সবশেষে মনে রাখা উচিত যে, স্বয়ং হাদীসের রাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর সূত্রেও বিতর নামায তিন রাকাত হওয়ার হাদীস বর্ণিত হয়েছে। (দেখুন : হাদীস নং ১২)। হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা.-এর হাদীস সুনানে নাসায়ী (পৃ. ২৪৯), সুনানে আবু দাউদ (১/২০১), সুনানে ইবনে মাজাহ (পৃ. ৮৪) প্রভৃতি হাদীসের কিতাবে হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা. থেকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, প্রত্যেক মুসলিমের উপর বিতর ওয়াজিব। অতএব যে পাঁচ রাকাত বিতর পড়তে চায় পড়বে, যে তিন রাকাত পড়তে চায় পড়বে, এবং যে এক রাকাত পড়তে চায় পড়বে। قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : الوتر حق على كل مسلم، فمن أحب أن يوتر بخمس فليوتر، ومن أحب أن يوتر بثلاث فليفعل، ومن أحب أن يوتر بواحدة فليفعل. যারা এক রাকাত বিতরের মত পোষণ করেন, বাহ্যিকভাবে এই রেওয়ায়েত তাদের স্পষ্ট দলীল মনে হতে পারে কিন্তু বর্ণনাটি একাধিক কারণে ত্রুটিপূর্ণ। এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী কি না-এ সম্পর্কেই কথা আছে। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. আততালখীসুল হাবীর গ্রন্থে (২/১৩) লেখেন, আবু হাতিম, যুহলী, দারাকুতনী-ইলাল গ্রন্থে, বাইহাকী ও আরো অনেক মনীষী বলেছেন যে, প্রকৃত রেওয়ায়েতটি মাওকূফ। তাঁদের এই সিদ্ধান্তই সঠিক। صحح أبو حاتم والذهلي والدار قطني في العلل والبيهقي وغير واحد وقفه وهو الصواب. অর্থাৎ এটি হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা-এর বাণী, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস নয়। দ্বিতীয় কথা এই যে, ইমাম দারাকুতনী রেওয়ায়েতটি এভাবে বর্ণনা করেছেন, বিতর হচ্ছে ওয়াজিব, হক্ব। অতএব যার ইচ্ছা সে যেন তিন রাকাত বিতর আদায় করে। الوتر حق واجب، فمن شاء فليوتر بثلاث. হাফেয ইবনে হাজার রাহ. এই রেওয়ায়েত উল্লেখ করে মন্তব্য করেন, এই রেওয়ায়েতের রাবীগণ ছিকা-নির্ভরযোগ্য। ورجاله ثقات (আততালখীসুল হাবীর ২/১৩) অতএব আবু আইয়ুব আনসারী রা.ও এক রাকাতের কথা বলেছেন কি না তা সন্দেহযুক্ত। তৃতীয় কথা এই যে, সুনানে নাসায়ীর (১/২৪৯) এক রেওয়ায়েতে সাত রাকাত ও পাঁচ রাকাতের পর বলা হয়েছে, যার ইচ্ছা এক রাকাত পড়বে এবং যার ইচ্ছা ইশারা করবে। ومن شاء أوتر بواحدة ومن شاء أومأ إيماء এই রেওয়ায়েতের সাধারণ অর্থ নেওয়া হলে এক রাকাত বিতরও অবশিষ্ট থাকে না, শুধু ইশারা করাই যথেষ্ট হয়ে যায়। তবে অর্থ যদি এই হয় যে, মাযূর ও অপারগ ব্যক্তির জন্য ইশারার অবকাশ দেওয়া হয়েছে তাহলে এমন কথা এক রাকাত সম্পর্কেও বলা যায় যে, যিনি তিন রাকাত বিতর পড়তে অক্ষম তিনি এক রাকাত পড়বেন। সারকথা, বর্ণনাগত বিচারে রেওয়ায়েতটি যেমন মারফূ হাদীস বা রাসূলের বাণী হওয়া প্রমাণিত নয়, তেমনি আবু আইয়ুব আনসারী রা.-এর প্রকৃত বক্তব্যও কতটুকু এ বিষয়েও ইযতিরাব বা বর্ণনাগত বিরোধ রয়েছে। কোথাও পাঁচ, তিন ও এক রাকাতের কথা আছে, কোথাও শুধু তিন আর কোথাও শুধু ইশারার দ্বারাও বিতর আদায় হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ অবস্থায় নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল যে, বাস্তবিকই হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা. এক রাকাতের ফতোয়া দিতেন কি না। শেষকথা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আলোচনা দীর্ঘ হয়ে গেল। পরিশেষে একটি তথ্য নিবেদন করে প্রসঙ্গটি সমাপ্ত করছি। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. হাফেয ইবনুস সালাহ রাহ.-এর মন্তব্য উল্লেখ করেছেন যে, বিতর সম্পর্কে বিপুল সংখ্যক হাদীস বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আমরা কোথাও পাইনি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো শুধু এক রাকাত বিতর পড়েছেন। لا نعلم في روايات الوتر مع كثرتها أنه عليه الصلاة والسلام أوتر بواحدة فحسب. (আততালখীসুল হাবীর ২/১৫) হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ইবনুস সালাহ রাহ.-এর উপরোক্ত বক্তব্য খণ্ডন করার জন্য ইবনে হিব্বান রাহ.-এর হাওয়ালায় কুরাইব আন ইবনে আব্বাস’ এর সূত্রে বর্ণিত একটিমাত্র রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন, যার তরজমা এই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক রাকাত দ্বারা বিতর করেছেন। إن النبي صلى الله عليه وسلم أوتر بركعة ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, কুরাইব রাহ. ইবনে আব্বাস রা.-এর নবী-গৃহে নামায দেখার জন্য রাত্রীযাপনের ঘটনাই বর্ণনা করেন। তাঁর সকল বর্ণনা প্রকৃতপক্ষে ঐ ঘটনারই বিবরণ। আর ইবনে আব্বাস থেকে একাধিক রাবীর সহীহ রেওয়ায়েতে এবং স্বয়ং কুরাইবেরও বিশুদ্ধ বর্ণনায় পরিষ্কার আছে যে, সে রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাকাত বিতর আদায় করেছিলেন। অতএব ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর এই একমাত্র বর্ণনার অর্থ এই হবে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই রাকাতের সাথে এক রাকাতকে মিলিয়ে বিতর করেছেন। মোটকথা, একটি হাদীসেও সস্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু এক রাকাত বিতর পড়েছেন। কোনো বর্ণনার ভাষা থেকে এমন কোনো সম্ভাবনার উদ্রেক হলে অন্যান্য মুতাওয়াতির রেওয়ায়াত দ্বারা সে ধারণা দূর হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ, কোনো কোনো সাহাবী ও তাবেয়ী এক রাকাত বিতরের কথা বলেছেন যেমন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা., সা’দ ইবনে আবী ওয়াককাস রা.সহ দুই একজন সাহাবী। এখানে একটি বিষয় ভেবে দেখা উচিত যে, রমযান ছাড়া বছরের অন্য সময় বিতর সাধারণত তাহাজ্জুদের সাথে পড়া হত। এটাই ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাধারণ নিয়ম এবং সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সাহাবায়ে কেরামও সাধারণত এই নিয়ম অনুসরণ করতেন। ফলে ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ গৃহে আদায়ের ফলে বিতরের রাকাত-সংখ্যা ও বিতর আদায়ের নিয়ম পরর্বর্তীদের জন্য অস্পষ্ট হতে পারত। কিন্তু রমযান মাসে যখন থেকে তারাবীর নামায জামাতের সাথে হতে লাগল তখন বিতরও প্রকাশ্যে জামাতের সাথে পড়া হয়েছে। তখন বড় বড় মুহাজির ও আনসারী সাহাবী বিদ্যমান ছিলেন। দেখার বিষয় হল, সে সময় বিতর কয় রাকাত পড়া হয়েছে। ১৪ হিজরী থেকেই হযরত উবাই ইবনে কাব রা.-এর ইমামতিতে মুহাজির ও আনসারী সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে নববীতে তারাবী ও বিতর আদায় করেছেন। হাদীসের কিতাবে সুস্পষ্ট বিবরণ আছে যে, তাঁরা সে সময় তিন রাকাত বিতর পড়েছেন। কোনো সাহাবী এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র আপত্তি করেননি এবং এই তিন রাকাত নামাযও নতুন কোনো নিয়মে আদায় করা হয়েছে এমন কোনো রেওয়ায়েত নেই। এমনকি আট রাকাত তারাবীর প্রবক্তাগণ দলীল হিসাবে যে হাদীসটি পেশ করে থাকেন তাতেও তিন রাকাত বিতরের কথা রয়েছে। পক্ষান্তরে এমন একটি রেওয়ায়েতও পাওয়া যায় না, যাতে বলা হয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরামত জামাতের সাথে এক রাকাত বিতর পড়েছেন! মোটকথা একথা প্রমাণিত যে, তিন রাকাত বিতরই ছিল সাহাবায়ে কেরামের সাধারণ আমল। এ থেকে বোঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরামের সাধারণ নিয়ম আসলে কী ছিল। তাবেয়ী ইয়াযীদ ইবনে রূমান বলেন, উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর যুগে মানুষ (সাহাবা ও তাবেয়ীন) রমযান মাসে ২৩ রকাআত পড়তেন। كان الناس يقومون في زمان عمر بن الخطاب رضي الله عنه في رمضان بثلاثوعشرين ركعة (মুয়াত্তা ইমাম মালেক পৃ. ৪০; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী ২/৪৯৬) তাবেয়ী আবদুল আযীয ইবনে রুফাই বলেন, উবাই ইবনে কাব রা. রমযান মাসে মদীনায় লোকদের নিয়ে বিশ রাকাআত তারাবীহ এবং তিন রাকাআত বিতর পড়তেন। كان أبي بن كعب يصلي بالناس في رمضان بالمدينة عشرين ركعة، ويوتر بثلاث. (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ২/২৮৫) বিখ্যাত তাবেয়ী আতা ইবনে আবী রাবাহ মক্কী রাহ. বলেন, আমি লোকদেরকে (সাহাবা-প্রথম সারির তাবেয়ীনকে) দেখেছি, তাঁরা বিতরসহ তেইশ রাকাআত পড়তেন। أدركت الناس وهم يصلون ثلاثا وعشرين ركعة بالوتر (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ২/২৮৫) অন্যান্য তাবেয়ী থেকেও এরূপ বিবরণ আছে। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, এটা প্রমাণিত যে, উবাই ইবনে কাব রা. রমযানের তারাবীতে লোকদের নিয়ে বিশ রাকাআত পড়তেন এবং তিন রাকাআত বিরত পড়তেন। তাই অনেক সময় এই সিদ্ধানে- পৌঁছেছেন যে, এটিই সুন্নত। কেননা উবাই ইবনে কাব রা. মুহাজির ও আনসারী সাহাবীগণের উপসি'তিতেই বিশ রাকাআত পড়িয়েছেন এবং কোনো একজনও তাতে আপত্তি করেননি। إنه قد ثبت أن أبي بن كعب كان يقوم بالناس عشرين ركعة في قيام رمضان ويوتر بثلاث، فرأى كثير من العلماء أن ذلك هو السنة، لأنه أقامه بين المهاجرين والأنصار ولم ينكره منكر. (মাজমূউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া ২৩/১১২-১১৩) (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement