রজব ১৪৩১   ||   জুলাই ২০১০

হাদীস ও আছারের আলোকে বিতর নামায – ২য় পর্ব

মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ লুধিয়ানভী রাহ.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিতর আদায়ের যে পদ্ধতি হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে এবং সাহাবা ও তাবেয়ীন ব্যাপকভাবে যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন তা ইতিপূর্বে নির্ভরযোগ্য বর্ণনার আলোকে তুলে ধরা হয়েছে। এখন ঐসব রেওয়ায়েত সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই, যেগুলোতে পাঁচ, সাত বা এক রাকাত বিতরের কথা উল্লেখিত হয়েছে। এই ধরনের রেওয়ায়েত আয়েশা রা., উম্মে সালামা রা., আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও আবু আইয়ুব আনসারী রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। ১. উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন- أعلم أهل الأرض بوتر رسول الله صلى الله عليه وسلم অর্থাৎ তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিতর সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত। (সহীহ মুসলিম ১/২৫৬) বিতর সম্পর্কে উম্মুল মু’মিনীনের বিবরণ অনেক রাবীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ ভাষায় তা বর্ণনা করেছেন। অনেকগুলো নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় তিন রাকাত বিতরের কথা পরিষ্কার ভাবে বলা হয়েছে। ইতিপূর্বে উদ্ধৃতিসহ আমরা তা উল্লেখ করেছি। কোনো কোনো বর্ণনায় কিছু ভাষাগত পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে বর্ণনার ভাষাগত বিভিন্নতাকে কেউ কেউ বিতরের পদ্ধতিগত বিভিন্নতা ধরে নিয়েছেন। অথচ সকল বর্ণনা একত্র করলে দেখা যায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূল বিতর তিন রাকাতই পড়তেন। দ্বিতীয় রাকাতে বৈঠক করতেন এবং তৃতীয় রাকাতে বৈঠকের পর সালাম ফেরাতেন। এখানে ঐ বর্ণনাগুলি উল্লেখ করা হল। ক. সা’দ ইবনে হিশামের বর্ণনা বর্ণনাটি সহীহ মুসলিমে (১/২৫৬) রয়েছে। সা’দ ইবনে হিশাম বলেন, ‘‘আমি উম্মুল মু’মিনীনের নিকট আরজ করলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিতর সম্পর্কে আমাকে বলুন। তিনি উত্তরে বললেন, ‘আমরা তাঁর জন্য মিসওয়াক ও (অযুর) পানি প্রস্তুত রাখতাম। রাতে আল্লাহ যখন তাঁকে জাগ্রত করতেন, তিনি ওঠতেন এবং মিসওয়াক করতেন ও অযু করতেন। অতঃপর নয় রাকাত নামায পড়তেন। শুধু অষ্টম রাকাতে বসতেন এবং আল্লাহ তাআলার যিকর ও হামদ-ছানা করতেন এবং দুআ করতেন। অতঃপর সালাম না ফিরিয়ে উঠে যেতেন। নবম রাকাতে বসতেন এবং দুআ করতেন। এরপর এমনভাবে সালামের বাক্য পাঠ করতেন যে, তা আমাদের শ্রুতিগোচর হত। এরপর বসে বসে দুই রাকাত নামায পড়তেন। তো সর্বমোট এগারো রাকাত হল হে বৎস! এরপর যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বয়স বৃদ্ধি পেল এবং শরীর ভারী হয়ে গেল তখন তিনি সাত রাকাত দ্বারা বিতর পড়তেন এবং (শেষের) দুই রাকাত পূর্বের মতোই আদায় করতেন। তো সর্বমোট নয় রাকাত হল হে বৎস!’’ أنبئني عن وتر رسول الله صلى الله عليه وسلم فقالت كنا نعد له سواكه وطهوره فيبعثه الله ما شاء أن يبعثه من الليل فيتسوك ويتوضأ ويصلي تسع ركعات لا يجلس فيها إلا في الثامنة فيذكر الله ويحمده ويدعوه ثم ينهض ولا يسلم ثم يقوم فيصلي التاسعة ثم يقعد فيذكر الله ويحمده ويدعوه ثم يسلم تسليما يسمعنا ثم يصلي ركعتين بعدما يسلم وهو قاعد فتلك إحدى عشرة ركعة يا بني فلما أسن نبي الله صلى الله عليه وسلم وأخذه اللحم أوتر بسبع وصنع في الركعتين مثل صنيعه في الأول فتلك تسع يا بني. এই বর্ণনা থেকে কারো কারো ধারণা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমদিকে নয় রাকাত বিতর পড়তেন এবং শুধু অষ্টম রাকাতে বৈঠক করতেন ও নবম রাকাতে সালাম ফেরাতেন। বয়স বেড়ে যাওয়ার পর সাত রাকাত পড়তেন এবং শুধু ষষ্ঠ রাকাতে বৈঠক করতেন ও সপ্তম রাকাতে সালাম ফেরাতেন। অথচ এই হাদীস এই সনদে (সা’দ ইবনে হিশাম ‘আন আয়েশা) হাদীসের বহু কিতাবে এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না।’ كان النبي صلى الله عليه وسلم لا يسلم في ركعتي الوتر (নাসায়ী ১/২৪৮; মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৫১; তহাবী ১/১৩৭; মুহাল্লা ইবনে হাযম ২/৪৮; ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৫; মুসতাদরাকে হাকিম ১/৩০৪; দারাকুতনী পৃ. ১৭৫; বাইহাকী ৩/৩১) মুসতাদরাকে হাকিম কিতাবে (১/৩০৪) হাদীসটি (সা’দ ইবনে হিশাম ‘আন আয়েশা) এভাবে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাকাত বিতর পড়তেন এবং শুধু শেষ রাকাতে সালাম ফেরাতেন।’ كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث لا يسلم إلا في آخرهن মুসনাদে আহমদে (৬/১৫৬) সা’দ ইবনে হিশামের বর্ণনা এভাবে আছে, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশার নামায আদায় করার পর গৃহে প্রবেশ করতেন এবং দুই রাকাত নামায পড়তেন। এরপর আরো দুই রাকাত পড়তেন, যা পূর্বের নামাযের চেয়ে দীর্ঘ হত। এরপর তিন রাকাত পড়তেন, যা মাঝে আলাদা করতেন না। এরপর বসে বসে দুই রাকাত নামায পড়তেন। إن رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا صلى العشاء دخل المنزل ثم صلى ركعتين ثم صلى بعدهما ركعتين أطول منهما ثم أوتر بثلاث لا يفصل بينهن ثم صلى ركعتين وهو جالس প্রকৃতপক্ষে এগুলো সা’দ ইবনে হিশাম ‘আন আয়েশা-সূত্রে বর্ণিত একই হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা। সকল বর্ণনা একত্র করলে যে বিষয়গুলো প্রতীয়মান হয় তা এই : ক. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বমোট এগারো রাকাত নামায পড়তেন। বিতর ও বিতর-পরবর্তী দুই রাকাত নফল নামাযও এর মধ্যে শামিল। খ. প্রতি দুই রাকাতে বৈঠক করতেন। গ. বিতর তিন রাকাত হত। ঘ. বিতরের দুই রাকাতের পর বৈঠক করতেন তবে সালাম ফেরাতেন না। ঙ. বিতরের পর বসে বসে দুই রাকাত নফল পড়তেন। এই বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে, সহীহ মুসলিমে সা’দ ইবনে হিশামের বর্ণনায় যেখানে নয় রাকাতের কথা আছে তাতে ছয় রাকাত তাহাজ্জুদ এবং তিন রাকাত বিতর। তবে সবগুলোকে একত্রে ‘বিতর’ বলা হয়েছে। সম্ভবত এটিই পরবর্তীদের জন্য হাদীসের মূল বক্তব্য অনুধাবনে জটিলতা সৃষ্টি করেছে। সা’দ ইবনে হিশাম যেহেতু তাহাজ্জুদ সম্পর্কে প্রশ্ন করেননি, করেছেন বিতর সম্পর্কে তাই উম্মুল মু’মিনীন তাহাজ্জুদের বিষয়টি প্রাসঙ্গিকভাবে উত্থাপন করে মূল প্রসঙ্গে চলে গিয়েছেন এবং বলেছেন যে, সালাতুল লায়লের অষ্টম রাকাতে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৈঠক করতেন, যা মূল বিতরের দ্বিতীয় রাকাত। তবে এ বৈঠকে সালাম ফেরাতেন না; বরং নবম রাকাতে সালাম ফেরাতেন, যা বিতরের তৃতীয় রাকাত। এ কথাটিই সা’দ ইবনে হিশামের অন্যান্য বর্ণনায় সহজভাবে বলা হয়েছে। অতএব সহীহ মুসলিমের উপরোক্ত বর্ণনার অর্থ এই নয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের পূর্ববর্তী রাকাতগুলোতে কোনো বৈঠক করতেন না। কারণ এটা স্বয়ং উম্মুল মু’মিনীনের অন্যান্য বর্ণনার বিপরীত। বরং অর্থ হচ্ছে অষ্টম রাকাতে যে বৈঠক করতেন তা পূর্বের রাকাতগুলোতে হত না। পূর্বের দু’ রাকাত পর পর যে বৈঠক হত তাতে সালাম ফেরাতেন। পক্ষান্তরে সপ্তম, অষ্টম ও নবম রাকাত যেহেতু বিতরের তিন রাকাত তাই অষ্টম রাকাতের বৈঠকে সালাম ফেরানো হত না। বরং বৈঠকের পর সালাম না ফিরিয়ে পরবর্তী রাকাতের জন্য দাড়িয়ে যেতেন এবং সেই রাকাত সমাপ্ত করে সালাম ফেরাতেন। এই ব্যাখ্যা অনুসারে সা’দ ইবনে হিশামের সকল বর্ণনা সুসমন্বিত হয়ে যায়। সারকথা এই যে, একজন রাবীর একটি রেওয়ায়েত বিভিন্ন ভাষায় বর্ণিত হলে প্রত্যেক বর্ণনাকে আলাদা আলাদা হাদীস গণ্য করা এবং তা থেকে একাধিক পদ্ধতি আহরণ করে একথা মনে করা যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো এই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন, কখনো ঐ পদ্ধতি, সঠিক চিন্তা নয়। কারণ একটি ঘটনা শুধু বর্ণনাকারীর ভাষা ও উপস্থাপনার বিভিন্নতার কারণে বিভিন্ন ঘটনায় পরিণত হয় না। খ. উম্মুল মু’মিনীন থেকে উরওয়া ইবনুয যুবাইর এর বর্ণনা উরওয়া ইবনুয যুবাইর রাহ.ও উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. থেকে রেওয়ায়েত করেছেন। তার রেওয়ায়েতও বিভিন্ন ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। এক বর্ণনায় আছে, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে এগারো রাকাত নামায পড়তেন তন্মধ্যে এক রাকাত দ্বারা বিতর করতেন। এরপর ডান কাতে শুয়ে পড়তেন। এরপর যখন মুয়াযযিন তাঁর নিকটে আসত তখন দুই রাকাত নামায হালকাভাবে পড়তেন।’ يصلي بالليل إحدى عشرة ركعة يوتر منها بواحدة فإذا فرغ منها اضطجع على شقه الأيمن حتى يأتيه المؤذن فيصلي ركعتين خفيفتين. (সহীহ মুসলিম ১/২৫৩) অন্য বর্ণনায় আছে, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশার নামায থেকে ফারিগ হওয়ার পর সোবহে সাদিক পর্যন্ত এগারো রাকাত নামায পড়তেন। প্রতি দু’ রাকাতে সালাম ফেরাতেন এবং এক রাকাত দ্বারা বিতর করতেন। ফজরের আযান শেষে মুয়াযযিন যখন তাঁর নিকটে আসত এবং সোবহে সাদিক প্রকাশিত হতে দেখতেন তখন দুই রাকাত হালকাভাবে আদায় করতেন। এরপর ডান কাতে শুয়ে পড়তেন, একামতের জন্য মুয়াযযিন তাঁর নিকটে আসা পর্যন্ত। يصلي فيما أن يفرغ من صلاة العشاء إلى الفجر إحدى عشرة ركعة يسلم بين كل ركعتين ويوتر بواحدة فإذا سكت المؤذن من صلاة الفجر وجاءه وتبين له الفجر قام فركع ركعتين خفيفتين ثم اضطجع على شقه الأيمن حتى يأتيه المؤذن للإقامة. (সহীহ মুসলিম ১/২৫৪) তৃতীয় বর্ণনায় আছে, ‘তিনি রাতে তেরো রাকাত নামায পড়তেন। অতঃপর ফজরের আযান শোনার পর দুই রাকাত হালকাভাবে আদায় করতেন।’ كان يصلي بالليل ثلاث عشرة ركعة ثم يصلي إذا سمع النداء ركعتين خفيفتين (তহাবী ১/১৩৮) চতুর্থ বর্ণনায় আছে, ‘(তিনি) রাতে তেরো রাকাত নামায পড়তেন, তন্মধ্যে পাঁচ রাকাত বিতর পড়তেন। এই রাকাতগুলির মাঝে বসতেন না, শুধু শেষে (বসতেন)।’ يصلي من الليل ثلاث عشرة ركعة يوتر من ذلك بخمس ولا يجلس في شيء إلا في آخرها (সহীহ মুসলিম ১/২৫৪) পঞ্চম বর্ণনায় আছে, ‘(তিনি) ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত)সহ তেরো রাকাত নামায পড়তেন।’ كان يصلي ثلاث عشرة ركعة بركعتي الفجر (সহীহ মুসলিম ১/২৫৪) উরওয়া ইবনুয যুবাইর রাহ.-এর এইসব বর্ণনা বাহ্যত পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে। তদ্রূপ উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা রা. থেকে আরো যারা বিতরের হাদীস বর্ণনা করেছেন তাদের বিবরণের সাথেও সাংঘর্ষিক মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের মতে, এইসব বর্ণনার মাঝে কোনো বিরোধ নেই এবং তা বিতরের বিভিন্ন পদ্ধতিও নির্দেশ করে না। এগুলি নিছক বর্ণনার পার্থক্য। যে বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, এগারো রাকাত নামায পড়তেন এবং প্রতি দু’ রাকাতের মাঝে সালাম ফেরাতেন, অতঃপর এক রাকাত দ্বারা বিতর করতেন, তাতে দুটি কথা বলা হয়েছে : এক. প্রতি দুই রাকাতের পর বসা। দুই. দুই রাকাতের সাথে অতিরিক্ত এক রাকাত মিলিয়ে নামাযকে বিতর (বেজোড়) বানানো। প্রথম কথাটি বলা হয়েছে বিতরের আগের আট রাকাত সম্পর্কে। আর দ্বিতীয় কথাটি বলা হয়েছে বিতর সম্পর্কে। অতএব বিতর শুধু এক রাকাত পড়তেন তা উদ্দেশ্য নয়; বরং উদ্দেশ্য হল, নবম ও দশম রাকাতের সাথে আরো এক রাকাত মিলিয়ে বিতর (বেজোড়) করতেন। বিতর-নামায এক রাকাত হওয়ার ধারণা কারো চিন্তায় পূর্ব থেকে বদ্ধমূল না থাকলে বর্ণনার পূর্বাপর থেকে এই ব্যাখ্যা খুব সহজেই বুঝে আসার কথা। এ ব্যাখ্যার সপক্ষে দুটি শক্তিশালী আলামত রয়েছে : ১. হযরত আয়েশা রা. থেকে মুতাওয়াতির রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাকাত বিতর পড়তেন। এবং স্বয়ং আয়েশা রা.-এর ফতোয়াও ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, বিতর শুধু তিন রাকাত পড়া উচিত নয়; এর পূর্বে দুই রাকাত বা চার রাকাত (নামায) অবশ্যই পড়া উচিত। মোটকথা, যখন উম্মুল মু’মিনীন থেকে অন্যান্য রাবীর সহীহ রেওয়ায়েতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিন রাকাত বিতর পড়ার কথা আছে তখন উরওয়া রাহ.-এর রেওয়ায়েত থেকে শুধু শব্দগত পার্থক্যের কারণে বিপরীত অর্থ গ্রহণ করা উচিত নয়। দ্বিতীয় আলামত এই যে, বিতর সম্পর্কে স্বয়ং উরওয়া রাহ.-এর ফতোয়া হল, ‘বিতর তিন রাকাত এবং তা মাঝে সালাম ফিরিয়ে আলাদা করা হবে না।’ الوتر ثلاث لا يفصل بينهن بسلام অতএব তাঁর বর্ণনায়-‘এক রাকাত দ্বারা বিতর করতেন’-এর অর্থ যদি এই হত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরে এক রাকাত পড়তেন তাহলে উরওয়া কখনো তিন রাকাত বিতরের ফতোয়া দিতেন না। অতএব উরওয়া রাহ.-এর বর্ণনার সঠিক ব্যাখ্যা তা-ই যা উম্মুল মু’মিনীন থেকে অন্যান্য রাবীর রেওয়ায়েত এবং স্বয়ং উরওয়া রাহ.-এর ফতোয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ২. যে বর্ণনায় আছে, ‘পাঁচ রাকাত দ্বারা বিতর করতেন এবং শুধু শেষে বসতেন।’-এর অর্থ এই নয় যে, এই পাঁচ রাকাতের মাঝে কোনো ধরনের বৈঠকই করতেন না এবং সালামও ফেরাতেন না। কারণ স্বয়ং উরওয়া রাহ.-এর পূর্ববর্তী বর্ণনায় বলা হয়েছে, প্রতি দু’ রাকাতের মাঝে সালাম ফেরাতেন। একই বর্ণনাকারীর একই সনদে বর্ণিত হাদীসকে ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ বলে দাবি করা যুক্তিযুক্ত নয়। এই বর্ণনার সঠিক অর্থ, যা উম্মুল মু’মিনীন রা.-এর বিবরণ এবং স্বয়ং উরওয়া রাহ.-এর ফতোয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, এই যে, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাতের নামায সর্বমোট তেরো রাকাত হত। এর মধ্যে ছয় রাকাতে তো কিছু সময় বিরতি দিতেন কিন্তু শেষ পাঁচ রাকাত বিরতি ছাড়া আদায় করতেন। প্রথমে দুই রাকাত নফল এরপর তিন রাকাত বিতর। এই পাঁচ রাকাতের মাঝে বিরতি হত না; বরং পাঁচ রাকাত শেষ হওয়ার পর বিরতি দিতেন। সারকথা এই যে, এই রেওয়ায়েতে বিতর-পূর্ব দুই রাকাতে সালাম না ফেরানো এবং বিতরের দ্বিতীয় রাকাতে না বসার কথা বলা হয়নি। বরং দু রাকাত নফল ও তিন রাকাত বিতরের মাঝে বিরতি না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কথাটা এভাবেও বলা যায় যে, এই বর্ণনায় নামাযের বৈঠক সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি, বলা হয়েছে সালামের পর বিরতি সম্পর্কে। অন্য একটি হাদীস থেকে এ ধরনের একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যোহর-আছর এবং মাগরিব-ইশা একত্রে পড়ার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আট রাকাত একসাথে এবং সাত রাকাত একসাথে আদায় করেছি।’ صليت مع النبي صلى الله عليه وسلم ثمانيا جميعا وسبعا جميعا (সহীহ মুসলিম ১/২৪৬) বলাবাহুল্য, এর অর্থ কখনো এই নয় যে, যোহর-আসরের আট রাকাত এবং মাগরিব-ইশার সাত রাকাত এক সালাম ও এক বৈঠকে আদায় করেছেন। বরং উদ্দেশ্য হল, সাধারণ অবস্থায় যোহর ও আসরের মাঝে এবং মাগরিব ও ইশার মাঝে যে বিরতি হয়ে থাকে তা দেননি। যোহর শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আসর এবং মাগরিব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইশার নামায আদায় করেছেন। একই কথা বিতরের উপরোক্ত বর্ণনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পাঁচ রাকাতের শুধু শেষ রাকাতে বসতেন বলে নামায শেষের বিরতি বোঝানো হয়েছে, সালাম বা নামাযের বেঠক বোঝানো হয়নি। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. থেকে আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান, ‘আমরা বিনতে আবদুর রহমান, আবদুল্লাহ ইবনে আবী কায়স এবং আবদুল আযীয ইবনে জুরাইজও বিতরের হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনায় তিন রাকাত বিতরের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। তদ্রূপ আসওয়াদ ইবনে কায়স, মাসরূক ইবনুল আজদা’ ও ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার রাহ.ও বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনায় তিন রাকাতের কথা স্পষ্টভাবে না থাকলেও অন্য বর্ণনার সাথে মিলিয়ে পাঠ করলে তিন রাকাতই প্রতীয়মান হয়। মোটকথা, উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা., যিনি সকল আহলে ইলমের মতে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিতর সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত, তাঁর বিবরণ সকল রাবীর বর্ণনা থেকে একত্র করলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, বিতর তিন রাকাত। সা’দ ইবনে হিশাম ও উরওয়া ইবনুয যুবাইর রাহ.-এর দু’ একটি বর্ণনায় যে ভিন্নতা, তা-ও উপরোক্ত ব্যাখ্যার পর অবশিষ্ট থাকে না। উপরোক্ত বর্ণনাগুলিতে আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। তা এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম-এর তাহাজ্জুদের রাকাত কমবেশি হত, কিন্তু বিতরের রাকাত কমবেশি হত না। সা’দ ইবনে হিশাম, মাসরূক ইবনুল আজদা’ ও ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার-এর বর্ণনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরের নামায ও আগের নামাযের পার্থক্য বর্ণনা করা হয়েছে। তাতে তাহাজ্জুদের রাকাত-সংখ্যায় পরিবর্তন হলেও বিতর সর্বাবস্থায় তিন রাকাত। আবদুল্লাহ ইবনে আবী কায়স রাহ.-এর বর্ণনায় আছে, আমি আয়েশা রা.কে জিজ্ঞাসা করেছি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত রাকাত বিতর পড়তেন। سألت عائشة رضي الله عنها بكم كن رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر উম্মুল মুমিনীন এর উত্তরে বলেছেন, ‘চার ও তিন, ছয় ও তিন এবং আট ও তিন’। بأربع وثلاث وست ثلاث وثمان وثلاث (আবু দাউদ ১/১৯৩; তহাবী ১/১৩৯) অর্থাৎ তাহাজ্জুদের রাকাত-সংখ্যা কখনো চার, কখনো ছয় এবং কখনো আট হত, কিন্তু বিতর সর্বাবস্থায় তিন রাকাতই পড়তেন। যদি তাহাজ্জুদের মতো বিতরের রাকাত-সংখ্যা পরিবর্তন হত তাহলে উম্মুল মু’মিনীন রা. অবশ্যই তা বর্ণনা করতেন। কারণ আবদুল্লাহ ইবনে আবু কায়স বিতর সম্পর্কেই প্রশ্ন করেছিলেন। সারকথা এই যে, তাহাজ্জুদের রাকাত-সংখ্যায় হ্রাস-বৃদ্ধি উল্লেখ করা সত্ত্বেও বিতরের রাকাত-সংখ্যা সর্বাবস্থায় তিন বলা প্রমাণ বহন করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা বিতর তিন রাকাত পড়তেন। এতে কোনো পরিবর্তন হত না। ইবনে আব্বাস রা.-এর বিবরণ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এক রাতে তার খালা উম্মুল মু’মিনীন মায়মূনা রা.-এর নিকট শুধু এই উদ্দেশ্যে রাত্রীযাপন করেছিলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কিয়ামুল লাইল (রাতের নামায) প্রত্যক্ষ করবেন। তাঁর ঐ বিবরণও বিভিন্ন রাবীর মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর রাত্রিযাপনের ঘটনা সম্পর্কে হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, ‘আমার ধারণা, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাতের নামায দেখার জন্য) একবারই নবী-গৃহে রাত্রিযাপন করেছেন। তাই এ বিষয়ে যেসব বর্ণনা পাওয়া যায় সেগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা উচিত। আর একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিবরণের যে অংশটুকুর উপর অধিক সংখ্যক রাবী ও অধিক নির্ভরযোগ্য রাবীগণ একমত তা গ্রহণ করাই উত্তম, বিশেষত বর্ণনার বিভিন্নতা যদি হয় হ্রাস-বৃদ্ধিমূলক। والحاصل أن قصة مبيت ابن عباس رضي الله عنهما يغلب على الظن عدم تعددها فلهذا ينبغي الاعتناء بالجمع بين مختلف الروايات منها ولا شك أن الأخذ بما اتفق عليه الأكثر ولأحفظ أولى مما خالفهم فيه من هو دونهم ولا سيما إن زاد أو نقص. (ফাতহুল বারী ২/৩৮৮) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর উপরোক্ত ঘটনার বিবরণে তিন রাকাত বিতর একাধিক রাবীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। যথা ১. ইবনে আব্বাস রা.-এর পুত্র আলী ইবনে আবদুল্লাহ-এর বর্ণনায় আছে, ... ‘অতঃপর তিন রাকাত বিতর পড়লেন।’ ثم أوتر بثلاث (নাসায়ী ১/২৪৯; তহাবী ১/১৪০) মূল হাদীসটি সহীহ মুসলিমেও রয়েছে। তবে ইমাম মুসলিম হাদীসটির পূর্ণ পাঠ উল্লেখ করেননি। দেখুন : সহীহ মুসলিম ১/২৬১ ২. ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার-এর বর্ণনায় আছে, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে আট রাকাত (তাহাজ্জুদ) এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। এরপর ফজরের নামাযের পূর্বে (আরো) দুই রাকাত পড়তেন। كان يصلي من الليل ثمان ركعات ويوتر بثلاث ويصلي ركعتين قبل صلاة الفجر (নাসায়ী ১/১৯২; তহাবী পৃ. ১৪০) ৩. কুরাইব (মাওলা ইবনে আব্বাস রা.)-এর বর্ণনায় আছে, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশার পর দুই রাকাত নামায পড়লেন, এরপর আরো দুই রাকাত পড়লেন। এরপর আরো দুই রাকাত, এরপর আরো দুই রাকাত। এরপর তিন রাকাত বিতর পড়লেন। فصلى رسول الله صلى الله عليه وسلم ركعتين بعد العشاء ثم ركعتين ثم ركعتين ثم ركعتين ثم أوتر بثلاث (তহাবী ১/১৪১) সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে কুরাইব রাহ.-এর বর্ণনা অন্যভাবে আছে। তা এই, ‘এরপর দুই রাকাত পড়লেন। এরপর দুই রাকাত, এরপর দুই রাকাত, এরপর দুই রাকাত, এরপর দুই রাকাত, এরপর দুই রাকাত। এরপর বিতর করলেন। فصلى ركعتين ثم ركعتين ثم ركعتين ثم ركعتين ثم ركعتين ثم ركعتين ثم أوتر (বুখারী ১/১৩৫; মুসলিম ১/২৬০) যেহেতু আলী ইবনে আবদুল্লাহ, ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার এবং কুরাইব রাহ.-এরও এক বর্ণনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, সে রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাকাত বিতর পড়েছেন তাই সহীহাইনের রেওয়ায়েতে ছয় বার দুই রাকাত বলার পর ‘অতঃপর বিতর করলেন’ বলার অর্থ এই হবে যে, পূর্বের দু’ রাকাতের সাথে এক রাকাত যুক্ত করে নামাযকে বিতর করেছেন। ইতিপূর্বে উরওয়া রাহ.-এর সূত্রে বর্ণিত উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা.-এর বিবরণেও বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে। স্বয়ং হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.ও ‘‘ফাতহুল বারী’’ তে (২/৩৮৮) ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার রাহ.-এর বর্ণনাকে ‘নাতিক’ সাব্যস্থ করেছেন। এবং এর আলোকে সহীহাইনের বর্ণনা ব্যাখ্যা করেছেন। মোটকথা, যখন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে একাধিক রাবীর রেওয়ায়েতে আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে রাতে তিন রাকাত বিতর পড়েছিলেন, উপরন' কুরাইব রাহ.-এরও এক বর্ণনায় তা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। তাই কুরাইব রাহ. এর যে বর্ণনায় দুই অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে তা থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করার অবকাশ নেই; বরং অন্যান্য বর্ণনার আলোকে তার অর্থ এই হবে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্বের দুই রাকাতের সাথে আরো এক রাকাত যোগ করে বিতর করেছেন। অতএব এই বর্ণনা থেকে এক রাকাত বিতরের অর্থ গ্রহণ করা সঠিক নয়। কুরাইব রাহ.-এর রেওয়ায়েতের মতো আরেকটি রেওয়ায়েত সহীহ মুসলিম (১/২৬২) ও সুনানে আবু দাউদে (১/১৯৩) যায়েদ ইবনে খালিদ জুহানী রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাতেও ছয় বার দুই রাকাতের পর বলা হয়েছে-‘অতঃপর বিতর করলেন।’ উপরে কুরাইব রাহ.-এর রেওয়ায়েতের যে অর্থ বলা হয়েছে এই রেওয়ায়েতের অর্থও তাই। অর্থাৎ পূর্বের দুই রাকাতের সাথে তৃতীয় রাকাত যোগ করে বিতর করেছেন। এর একটি আলামত তহাবীর (১/১৪২-৩/২৬৩-২৬৪; নুখাবুল আফকার, ইউনুস আন ইবনে ওয়াহব আন মালিক সূত্রে) নিম্নোক্ত বর্ণনা, যাতে পাঁচ বার দুই রাকাতের পর বিতরের কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি এই দাঁড়াল যে, তহাবীর বর্ণনায় শেষ দুই রাকাতকে তৃতীয় রাকাতসহ বিতরের মধ্যে শামিল করা হয়েছে। পক্ষান্তরে মুসলিম ও আবু দাউদের রেওয়ায়েতে বিতরের তিন রাকাতের মধ্যে দুই রাকাত ও এক রাকাতকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি শুধু উপস্থাপনার পার্থক্য। মূল বিতর সর্বাবস্থায় তিন রাকাত। ৪. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ.-এর বর্ণনায় আছে, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাকাত বিতর পড়তেন।’ كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث পূর্ণ হাদীস ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, এই বিষয়টি মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং দশ জনেরও অধিক সাহাবীর সূত্রে বর্ণিত। সহীহ বুখারীতে (১/৯৭) সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ.-এর বর্ণনা এভাবে উল্লেখিত হয়েছে, ‘অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার রাকাত নামায পড়লেন এবং শয্যাগ্রহণ করলেন। এরপর (রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হওয়ার পর) শয্যাত্যাগ করলেন এবং নামাযে দণ্ডায়মান হলেন। আমি তাঁর বাম দিকে দাঁড়ালাম, তিনি আমাকে ডান দিকে দাঁড় করালেন। এরপর পাঁচ রাকাত নামায পড়লেন। এরপর দুই রাকাত (ফজরের সুন্নত) আদায় করলেন।’ فصلى أربع ركعات ثم نام ثم قام فجئت فقمت عن يساره فجعلني عن يمينه فصلى خمس ركعات ثم صلى ركعتين এখানে কেউ বলবে না যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার রাকাত এক বৈঠক ও এক সালামে আদায় করেছেন। তদ্রূপ শেষের পাঁচ রাকাত সম্পর্কেও বলা হবে না যে, তা এক বৈঠক ও এক সালামে আদায় করা হয়েছে। সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ.-এর পূর্বোক্ত বর্ণনার আলোকে এই রেওয়ায়েতের অর্থ এমনই করা হবে যে, দুই রাকাত নফল ও তিন রাকাত বিতর আলাদা আলাদা পড়েছেন। আর পাঁচ রাকাতকে একত্রে উল্লেখ করার পিছনে রাবীর উদ্দেশ্য এই নয় যে, উক্ত পাঁচ রাকাতের মাঝে বৈঠক বা সালাম হয়নি; বরং উদ্দেশ্য হল দুই রাকাতের সালাম ফেরানোর পর বিরতি না দিয়ে তিন রাকাত বিতর আদায় করেছেন। অর্থাৎ যেভাবে প্রথম চার রাকাতে সালামের পর বিরতি দেননি তেমনি এই পাঁচ রাকাতেও। তিনি বিরতি দিয়েছেন চার রাকাত ও পাঁচ রাকাতের মাঝে। সুনানে আবু দাউদের (১/১৯২) বর্ণনায় এই কথাটি এভাবে বলা হয়েছে যে, ‘‘এরপর তিনি পাঁচ রাকাত বিতর পড়লেন, মাঝে বসলেন না।’’ ثم أوتر بخمس لم يجلس بينهن বিরতি ছাড়া আদায় করার কারণে এই পাঁচ রাকাতের সমষ্টিকে বিতর বলা হয়েছে। হাদীস শরীফের মনোযোগী পাঠকদের অজানা নয় যে, বহু রেওয়ায়েতে বিতর-পূর্ব নফলকেও বিতর বলা হয়েছে। সারকথা এই যে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনাকারী সকল রাবীর রেওয়ায়েত একত্র করা হলেও দেখা যায় যে, কয়েকটি রেওয়ায়েতে তিন রাকাতের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আর অন্যান্য বর্ণনাতেও তার অবকাশ রয়েছে। এজন্য ঐসব রেওয়ায়েত থেকেও তিন রাকাতের অর্থই গ্রহণ করা হবে। এগুলোকে আলাদা আলাদা ঘটনা মনে করে বিতরের বিভিন্ন পদ্ধতি দ্বারা ব্যাখ্যা করা ঠিক নয়। কারণ এগুলো একটি ঘটনার বিভিন্ন উপস্থাপনামাত্র। বলাবাহুল্য যে, বর্ণনাগত পার্থক্যের কারণে একটি ঘটনা একাধিক ঘটনায় পরিণত হয় না। এ প্রসঙ্গে হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর মন্তব্য ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব এইসব রেওয়ায়েত দ্বারা বিতরের পদ্ধতিগত বিভিন্নতা প্রমাণ করা সমীচীন নয়। উপরন্তু হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর ফতোয়াও ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিতর শুধু তিন রাকাত পড়া উচিত নয়; সাথে দু’ চার রাকাত নফল নামাযও পড়া উচিত।’ এ থেকে প্রমাণ হয় যে, তাঁর নিকটেও মূল বিতর তিন রাকাত এবং এভাবে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পড়তে দেখেছেন। (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement