জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩১   ||   জুন ২০১০

বাইতুল্লাহর ছায়ায় ৫

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) মানুষের জীবনে আল্লাহর দেয়া নেয়ামতের তো সীমা-পরিসীমা নেই। কিছু নেয়ামত সবার জন্য সমান। যেমন বেঁচে থাকার জন্য বাতাস ও শ্বাস-প্রশ্বাস। কিছু নেয়ামত বিশেষ কোন বান্দাকে বিশেষভাবে দান করা হয়। যেমন অর্থসম্পদ, জ্ঞানসম্পদ এবং অন্যান্য সম্পদ। আবার কিছু নেয়ামত আছে যা অর্জনের পিছনে মানুষের নিজের কোন ভূমিকা নেই। জন্মসূত্রেই মানুষ তা প্রাপ্ত হয়। যেমন রূপ ও সৌন্দর্য এবং মেধা ও বুদ্ধি। তো যেসব নেয়ামত সবার জন্য সমান তা আলোচনা করায় সমস্যা নেই। তাতে মানুষের মনে অহঙ্কার আসে না। মানুষ তা আলোচনা করে শুধু শোকর করার জন্য। বাতাস আল্লাহর কত বড় নেয়ামত! আগুন, পানি কত বড় নেয়ামত! গাছের ফল, মাঠের ফসল কত বড় নেয়ামত! মেঘ-বৃষ্টি-বাদল, নদী-ঝর্ণা ও সাগর কত বড় নেয়ামত! সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি মানুষের জন্য আল্লাহ তা‘আলার কত বড় নেয়ামত! এগুলো তুমি যত আলোচনা করবে, তোমার বুক থেকে, মুখ থেকে ততই শোকরের সুবাস ছড়াবে। শোকর ও কৃতজ্ঞতা ছাড়া তাতে আর কিছু থাকে না। সমস্যা হয় ঐ সব নেয়ামতের আলোচনায় যা আল্লাহর পক্ষ হতে বিশেষভাবে কাউকে দান করা হয়েছে। মেধা ও সৌন্দর্য আল্লাহর দেয়া বড় নেয়ামত। তো মানুষ যখন তার মেধা ও সৌন্দর্য আলোচনা করে তখন তার পিছনে কখনো থাকে শোকরের প্রেরণা, কখনো থাকে অহঙ্কারের প্ররোচনা। কখনো তার মুখের কথায় থাকে শোকরের ঘ্রাণ, কখনো থাকে অহঙ্কারের দুর্গন্ধ। মেধা ও সৌন্দর্যের কারণে তো গর্ব-অহঙ্কার আসার কথা নয়, কারণ তা অর্জনে বান্দার কোন ভূমিকা নেই। তারপরো মানুষ গর্ব করে। আল্লাহর দেয়া এবং জন্মসূত্রে পাওয়া নেয়ামত নিয়েও সে অহঙ্কার করে। এভাবে মেধাবী মানুষও নির্বোধ এবং সুন্দর মানুষও কুৎসিত হয়ে যায়। যে সমস্ত নেয়ামত আল্লাহ কখনো বিশেষ কাউকে দান করেন, তবে তার পিছনে থাকে বান্দার চেষ্টা-মেহনতের পর্দা। অর্থাৎ দান করেন আল্লাহ, কিন্তু সবব ও অছীলার পর্দায় নিজেকে তিনি আড়াল করে রাখেন। ফলে অছীলা ও উপলক্ষই থাকে বান্দার নজরে, লক্ষ্য থেকে যায় তার চিন্তার অগোচরে। তো মানুষ যখন এসব নেয়ামত আলোচনা করে তখন বড় ফেতনার আশঙ্কা থাকে। নিজের অজান্তেই তার অন্তরে গর্ব ও অহঙ্কারের কালো ছায়া পড়ে। এমনকি শোকর ও কৃতজ্ঞতার আবরণেও মানুষ গর্ব ও অহঙ্কার করে। আল্লাহ যাকে হেফাযত করেন সেই শুধু নিরাপদ থাকে। বান্দাকে অবশ্য আদেশ করা হয়েছে, ‘তুমি তোমার রাবের নেয়ামত আলোচনা করো।’ বান্দা যখন শুধু শোকরের জাযবা ও কৃতজ্ঞতার আবেগে আল্লাহর নেয়ামত আলোচনা করে, আল্লাহ তাতে খুশী হন এবং নেয়ামত বাড়িয়ে দেন। বান্দার দিলে কী আছে তা মানুষের কাছে গোপন থাকতে পারে, কিন্তু আল্লাহর কাছে কোন কিছুই গোপন থাকে না। এ জন্য আল্লাহর কিছু বান্দা, ‘অহঙ্কার এসে যায়’ এ আশঙ্কায় নেয়ামতের কথা গোপন রাখেন, মানুষের সামনে তা আলোচনা করেন না। আবার কোন কোন বান্দা, শোকর ও ‘তাহদীছ’-এর জাযবায় নেয়ামতের আলোচনা করেন। দু’টোই ঠিক। আল্লাহর দরবারে তো ফায়ছালা হবে নিয়তের উপর। এ দীর্ঘ ভূমিকার উদ্দেশ্য ছিলো আল্লাহ তা‘আলার একটি বড় নেয়ামতের কথা আলোচনা করা, যা এই সফরে তিনি তাঁর গোনাহগার বান্দাকে দান করেছিলেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কলমের সংযমই এখানে নিরাপদ। শুধু প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন তাওফীক দান করেন শোকর আদায় করার। নেয়ামত যেন আমাদের মধ্যে শোকর ও কৃতজ্ঞতার অনুভূতি সৃষ্টি করে, গর্ব ও অহঙ্কার নয়। আল্লাহুম্মা আমীন। এই সফরে আমার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনেক বড় ইহসান ছিলো হযরত পাহাড়পুরী হুযূরের ছোহবত। এটা চেষ্টার অর্জন ছিলো না, ছিলো আল্লাহর অনুগ্রহ। সেই সফরে হারাম শরীফে উম্মেহানিতে তাঁর নূরানী ছোহবত সত্যি আমার জন্য ছিলো ...! জীবনের প্রথম সফরের সেই নূরানী ছোহবত যেন আবার জীবন্ত হয়ে ফিরে এসেছিলো! হুযূর তো ছিলেন তাঁর শায়খের দিল ও হায়াত। ‘হায়াত’ থেকে মনে পড়লো নূরানিয়াতপূর্ণ সেই ঘটনাটি এবং তা বলার জন্য এখন আমি স্বেচ্ছায় প্রসঙ্গ থেকে দূরে যাচ্ছি। কারণ এ যুগের তালিবানে ইলমের তা জানা দরকার। মাদরাসায় থাকে অনেকে, পড়ে থাকে ক’জন! আমার হুযূর সেই পড়ে থাকাদের একজন। মাদরাসার নূরানী পরিবেশে তালিবানে ইলমের নূরানী জামা‘আতের পরিমণ্ডলেই তাঁর দিন-রাতের জীবন যাপন। কিন্তু শায়খের পক্ষ হতে যখন ইশারা হলো, দ্বিধামাত্র না করে তিনি মাদরাসার ‘শীতল গাছের ছায়া’ ত্যাগ করে চলে গেলেন বহু দূরের আজনবী একদেশে। সেটা ঊনিশশ’ পঁচাশি সনের ঘটনা। হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রাহ.) একটি আন্তর্জাতিক সংসস্থার আয়োজিত হজ্বসম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে লন্ডন যাচ্ছেন। সেখান থেকে যাবেন হজ্বের সফরে আল্লাহর ঘরে। পাহাড়পুরী হুযুরকে তিনি সফরসঙ্গী করে নিলেন। হুযূর খুশী যে, হযরতের ছোহবতে আবার হজ্ব নছীব! হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রাহ.) লন্ডন থেকে যখন আল্লাহর ঘরে রওয়ানা হবেন তখন ঘটলো সেই ঘটনা, যা আমার হুযুরের কল্পনায়ও ছিলো না। হযরত তাঁকে একান্তে ডেকে বললেন, ‘মওলবী আব্দুল হাই! আপনার প্রতি আমার ই‘তিমাদ আছে, আপনি এখানে থাকেন, মাদরাসার কাজ করেন। আমি দু‘আ করি, আল্লাহ তা‘আলা সব ইনতিযাম করে দেন।’ আকস্মিকতার ঘোর ছিলো মুহূর্তের জন্য এবং তা ছিলো মানবীয় দুর্বলতার...। তবে এরই মধ্যে তিনি দেখে নিলেন আসমানি ইশারার ঝিলিক। পূর্ণ ইতমিনানের সঙ্গে তিনি বললেন, ‘জ্বি আচ্ছা!’ কোথায় কীভাবে থাকা হবে? থাকার ইনতিযাম কী হবে, কিছুই জানলেন না এবং জানতে চাইলেন না। হযরত যথাসময়ে হিজাযের উদ্দেশ্যে হিথরো বিমানবন্দর ত্যাগ করলেন, আর পাহাড়পুরী হুযূর এত বড় এক দুনিয়াদার শহরে একা হয়ে গেলেন। একা মানে সম্পূর্ণ একা! তবে তাঁর বিশ্বাস ছিলো, তিনি একা নন এবং নিঃসঙ্গ নন। গায়বের মদদ অবশ্যই আসবে। এবং এলো। অপ্রত্যাশিতভাবেই গায়বী মদদ এলো। গাড়ীর কোলাহলপূর্ণ পথে তিনি হাঁটছেন, একা। হঠাৎ কেউ বলে উঠলো, হুযূর আপনে! ফিরে দেখেন, নূরিয়ার প্রতিবেশী একজন! ভদ্রলোক অবাক হবেন, তাতে আশ্চর্যের কী! কোহকাফে ‘আদমযাদ’, অবাক হওয়ারই তো কথা! ঘটনা শুনে তিনি বললেন, চিন্তা নেই, চলেন আপনে আমার মেহমান। ধীরে ধীরে তিনি পরিচিত হলেন এবং সবার প্রিয় হলেন। সবকিছু তাঁর অনুকূল হলো। কেন নয়! সবসময় তাঁর মুখে যে থাকতো স্নিগ্ধ হাসির উদ্ভাস। এটা আল্লাহর দান। হাসি অনেকের মুখে থাকে, হাসির স্নিগ্ধতা এবং হাসির উদ্ভাস সবার মুখে থাকে না। ‘ফুলের হাসি’ বলতে যা বোঝায়, আমার হুযূরের মুখের হাসি ছিলো তেমন! ‘ছিলো’ বলছি; কারণ সেখানে এখন ছায়া পড়েছে জীবনের বিভিন্ন দুর্যোগের। এমন নাযুক ও সংবেদনশীল মানুষ এখনো জীবিত আছেন শুধু আল্লাহর ফযল ও করমে। কামনা করি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আল্লাহ তাঁকে জীবন্ত রাখুন। ‘সজীব হৃদয়ে’ আবার তিনি আল্লাহর ঘর দেখে আসুন, আমীন। তো, আমার হুযূরের মুখের স্নিগ্ধ হাসিটুকুই যথেষ্ট ছিলো মানুষের দিলের জাহান আবাদ করার জন্য; তদুপরি যেমন বিনয় তেমন আন্তরিকতা! যেমন নির্লোভ তেমন দরদী মন! লন্ডনের বিষয়মুখী ও দৌড়ঝাঁপের জীবনে কোথায় এসব গুণ! সকলে তাই সামান্য সান্নিধ্যেই অনুভব করলো যে, তাদের দ্বীনী হালাতের উপর আল্লাহ রহম করেছেন এবং তাদের সন্তানদের দ্বীনী তা‘লীম ও তারবিয়াতের জন্য একজন মুখলিছ ও দরদী মানুষ পাঠিয়েছেন। সবাই তাঁকে এত ভালোবাসলো এবং তিনি সবার এমন প্রিয়পাত্র হলেন যে, নিজেদের দ্বীনী ফায়দা চিন্তা করে তারা তাঁর স্থায়ী থাকার ইনতেযাম করলো। আর তখন হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রাহ.)-এর পত্র উপস্থিত হলো। পত্রটি যখন লেখা হয়, আমি সেখানে ছিলাম। এখনো চোখে ভাসে সেই ছোট্ট বাক্যটি, ‘খাত মিলতে হী ফাওরান চলে আইয়ে’। তিনি চলে এলেন এবং ‘ফাওরান’। হযরত তাঁর ইসতিকবালে বিমানবন্দর গেলেন। বড় অভূতপূর্ব ছিলো সেই মু‘আনাকা ও আলিঙ্গনের দৃশ্য! আমার চোখ এখন বড় তৃষ্ণার্ত তেমন একটি দৃশ্য আবার দেখার জন্য। কিন্তু অতীত যখন অতীত হয়, সবকিছু সঙ্গে নিয়েই অতীত হয়! কিছুই সে রেখে যায় না ভবিষ্যতের জন্য, সামান্য স্মৃতি ছাড়া। আর স্মৃতি, দুঃখের হোক বা সুখের, শুধু বেদনাই সৃষ্টি করে হৃদয়ের গভীরে, যদিও দুই বেদনার স্বাদ ভিন্ন। এত কিছু বলা হলো যে জন্য সে কথাটি এবার বলি। আমার হুযূরকে পেয়ে হযরতের চেহারা সেদিন যেমন ঝলমলে দেখেছিলাম তেমন আর কখনো দেখিনি, না আগে, না পরে। সেদিন তিনি বলেছিলেন একটি বাক্য, যা কারো ভাগ্য খুলে দেয়ার জন্য ছিলো যথেষ্ট। আর সেদিন আমার মন বলছিলো, ঐ সৌভাগ্যে আমারও কিছু না কিছু প্রাপ্তি ছিলো। উসতাযের খোশকিসমতি শাগিরদেরও কিসমত খুলে দেয়, যদি কলবের সঙ্গে কলব লেগে থাকে। ঐ বাক্যটি সেদিন তাই আমাকেও করেছিলো আনন্দে উদ্বেলিত। হযরত বলেছিলেন, ‘আব্দুল হাই আ-গায়া তো মেরী হায়াত আ-গায়ী! (আব্দুল হাই এসে গেছে, তো আমার হায়াত এসে গেছে।) হায়, এমন কথা আবার কবে শোনবো কারো জন্য কারো মুখে! এজন্যই শুরুতে বলেছিলাম, সত্যি আমার হুযূর ছিলেন তাঁর শায়খের দিল ও হায়াত। আর তাই আল্লাহর ঘরে আমার হুযূরের ছোহবতে সেদিন মনে হয়েছিলো, জীবনের প্রথম সফরের সজীবতা যেন ফিরে এসেছে! সব স্মৃতি যেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে! এই ছোহবত যেন সেই ছোহবতের সুকূন ও সাকীনা এবং নূর ও নূরানিয়াত ফিরিয়ে এনেছে! আমার হুযূরকে আল্লাহ হায়াতে তাইয়েবা দান করুন! সত্যি, আল্লাহর ঘরে আল্লাহর দানরূপে তাঁকে আমি পেয়েছিলাম। রামাযানের বড় মধুময় দিনগুলো ছিলো! প্রতিদিনের টুকরো টুকরো কত ঘটনা! কত উপদেশ ও সতর্কবাণী! স্নেহ ও মমতার কত মধুর স্মৃতি এবং শুভকামনা ও নেক দু‘আর কী বিপুল পাথেয়! একদিন হুযূর বললেন, ‘আসেন, আপনাকে তাওয়াফ করাই’। প্রথমে চমকিত হলাম, তারপর পুলকে, আনন্দে, আবেগে, উচ্ছ্বাসে আশ্চর্যরকম আন্দোলিত হলাম! কেন? কারণ এখানে এই উম্মেহানিতে একই কথা ধ্বনিত হয়েছিলো আরেকবার, ‘চলো তোমাকে তাওয়াফ করাই’। ভিন্নতা শুধু ‘তুমি’ শব্দের নতুন সংস্করণে! ভাবে ও মর্মে এবং স্নেহের অভিব্যক্তিতে যেন অভিন্ন! কিন্তু আজকে আমার আনন্দের উচ্ছ্বাস ছিলো সেদিনের চেয়ে বেশী। কারণ কী, তা জানি না। শুধু মনে হলো, এই মানুষটিকে একদিন আমি বাইতুল্লাহর সফরের শুরুতে নিজে নৌকা বেয়ে নদী পার করেছিলাম। নদীতে ঢেউ ছিলো। সেই নদীর ঢেউগুলো যেন আল্লাহ আজ ফিরিয়ে দিলেন আমার হৃদয়-নদীতে। উম্মেহানির দিক থেকে মাতাফে নেমে হাতের ডানে কিছু দূর অগ্রসর হলে তারপর হাজরে আসওয়াদ। সেখান থেকে আমার হুযুরের ছোহবতে শুরু হলো জীবনের স্মরণীয় তাওয়াফ। এ যেন ঘরের তাওয়াফ নয়, ঘুরে ঘুরে ঘরওয়ালার সান্নিধ্য লাভের আকুতি! সাত চক্কর শেষে ঘরের দুয়ারের সামনে দাঁড়ালাম। আমার চোখে পানি ছিলো না, অন্তরে কোন উচ্ছ্বাস ছিলো না, দুয়ারের দিকে তাকিয়ে শুধু একটি নিবেদন ছিলো, ‘আর কত! আর তো পারি না প্রভো! এবার দুয়ার খোলো!’ এর আগে অনেক তাওয়াফে অনেক রকম অনুভূতি ছিলো, কিন্তু হুযূরের ছোহবতে সেদিনের সেই তাওয়াফে সেই অনুভূতিটি ছিলো একেবারে নতুন! মনে হলো, ঘরের দুয়ার যেন খুলে গেলো এবং .. এবং এখনই প্রয়োজন কলমের সংযম। হুযূরকে এখন আমার যে ভয়, তখন তা ছিলো না; তখন সাহস ছিলো। যা বলা যায় না তাও বলে ফেলতাম এবং স্পষ্ট করে। সেদিন তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহীমে সিজদা দেয়ার পর যখন যামযামে হাযির হলাম এবং তাঁর হাতে যামযামের পেয়ালা তুলে দিলাম তখন বললাম, হয়ত নির্বোধের মত- হযূর! আমার দিল আপনাকে দিলাম, আপনার দিল আমাকে দিন! হুযূরের মুখে সেই স্নিগ্ধ মধুর হাসির উদ্ভাস। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, তারপর মাথায় স্নেহের হাত রাখলেন। এই ‘হস্তস্পর্শ-এর কিছু অর্থ ছিলো নিশ্চয়! আমি বুঝিনি, তবু ছিলো। কারণ তখন থেকেই শুরু আমার জীবনের নতুন অধ্যায়ের। তখন থেকে ধীরে ধীরে হুযূরকে ভয় করতে শুরু করলাম। এখন তো অবস্থা এই যে, আমার প্রিয় মাওলানা আব্দুল মালিককে সঙ্গে না নিয়ে হুযূরের সঙ্গে দেখা করার সাহস হয় না। একদিন তারাবীর নামাযে ইমামুল হারাম তিলাওয়াত করলেন- বলুন আপনি, হে আমার বান্দাগণ, যারা অবিচার করেছো নিজেদের উপর, নিরাশ হয়ো না তোমরা আল্লাহ রহমত থেকে। অবশ্যই আল্লাহ মাফ করে দেবেন গোনাহ, সমস্ত। তিনিই তো ক্ষমাশীল, দয়াময়। এখানে এসে ইমামুল হারাম কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তিনি কাঁদছেন, আর পড়ছেন, পড়ছেন, আর কাঁদছেন! সেই কান্নার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে আমার হুযূরেরও বুকের ভিতরে। আমি ইমামুল হারামের কান্না শুনছি এবং সে কান্নার ঢেউ অনুভব করছি, আর আফসোস করছি, আমার দিল কেন এত মুরদা! আমার দিলে কেন আঘাত করে না কান্নার ঢেউ! তারাবীহর পর হুযূর বললেন, ‘আল্লাহ তা‘আলার কত বড় সান্ত্বনা তাঁর গোনাহগার বান্দার জন্য! সব গোনাহ মাফ করে দেবেন! শুধু একটু অনুতাপ, একটু তাওবার এত বড় পুরস্কার! সুবহানাল্লা!! তাওবা যদি বারবার ভেঙ্গে যায়?! তবু চিন্তা নাই। আবার তাওবা করেন, যতবার ভাঙ্গে ততবার করেন, শুধু অন্তরে যেন লজ্জা আসে, অনুতাপ আসে।’ মনে পড়ে, আল্লাহর ঘরকে সামনে রেখে সেদিন তাওবা করেছিলাম যিন্দেগির সব গোনাহ ও গান্দেগি থেকে। কত বড় মেহেরবান তুমি হে আল্লাহ! সেদিন মনে হয়েছিলো, আমি যেন সেই মানুষটির প্রতিচ্ছবি, যার সম্পর্কে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব বলেছেন, গোনাহ থেকে যে তাওবা করে তার কোন গোনাহ থাকে না। নিজেকে সেদিন বড় শুভ্র-পবিত্র ও নিষ্পাপ মনে হয়েছিলো। আল্লাহর নেক বান্দাদের ছোহবত ছাড়া তাওবার এমন চেতনা কি অন্তরে জাগ্রত হয়? একা একা তাওবা এবং কারো পবিত্র সান্নিধ্যের তাওবা, দু’টোই ভালো, তবে পার্থক্য হলো তারার আলো এবং চাঁদের আলো। আল্লাহর ঘরে হুযূরের ছোহবতে যাপন করা সেই মধুর দিনগুলো জানি আর কখনো ফিরে আসবে না, তবু তার স্মৃতিচারণেও কত আনন্দ! সেবার আল্লাহ আমাকে হারামের ইতিকাফ দান করেছিলেন। আব্বা সারা জীবন ই‘তিকাফ করেছেন। রোযার মাস ছিলো তাঁর রিযিকের ব্যস্ততার মাস। কিন্তু শেষ দশদিন সবকিছু থেকে বে-পরোয়া হয়ে তিনি পড়ে থাকতেন মসজিদে। আব্বার সঙ্গে আমি ইফতারে ছিলাম, ই‘তিকাফে ছিলাম না। কারণ আমার তখন অনেক দ্বীনী কাজ! নফসের ধোকা আসলেই বড় বিচিত্র! সেই ধোকায় পড়ে ছিলাম জীবনের চল্লিশটি বছরেরও বেশী সময়। আশ্চর্য! হযরত হাফেজ্জী হুযূর ই‘তিকাফ করতেন, আমি দেখা করতাম, দু‘আ নিতাম, কিন্তু কখনো আমাকে তিনি ই‘তিকাফের কথা বলেননি। পাহাড়পুরী হুযূর ই‘তিকাফ করেছেন, তিনিও বলেননি, আব্বাও না। কেন বলেননি, আল্লাহ জানেন। আফসোস, জীবনের সেই সোনালী সময়গুলোর জন্য! তবে আলহামদু লিল্লাহ, সফরের আগের বছর হঠাৎ করেই যেন গাফলাতের ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো! ভিতর থেকে যেন একটি সতর্কবাণী এলো, অতীত আর ফিরে আসবে না, তবে বর্তমান থেকে মাহরূম হয়ো না। যাই হোক, আল্লাহর রহমতে আল্লাহর দাওয়াতে আল্লাহর ঘরে মেহমান হলাম। আব্বার সঙ্গে জীবনের প্রথম ই‘তিকাফ হলো। তখন আল্লাহ যদ্দুর তাওফীক দিলেন, বুঝলাম, ই‘তিকাফের স্বাদ কাকে বলে এবং আল্লাহর নেক বান্দারা কেন ই‘তিকাফ করেন! জীবনের দ্বিতীয় ই‘তিকাফ হলো মসজিদুল হারামে। মাওলার কোন্‌ কোন্‌ নেয়ামতের কী শোকর আদায় করবে বান্দা! সেই ই‘তিকাফে আল্লাহ আমাকে আমার তিনজন উস্তাযের ছোহবত দান করলেন; হযরত পাহাড়পুরী হুযূর, সুলতান যাওক ছাহেব হুযূর এবং হযরত বু-আলী ছাহেব হুযূর। যাওক ছাহেবের ছোহবতে ছিলো ইলমী ও আদাবী ফায়দা, তবে তাতেও ছিলো হারামের সুবাস, মারহূম আলী তানতাবী যাকে বলেছেন ‘নাফাহাতুল হারাম’। বু-আলী ছাহেব যেন আর কিছু জানতেন না তাওবা-ইস্‌তিগফার ছাড়া। তিনি বলতেন তাঁর দেশের ভাষায়, ‘ওবা! এই ফুরসত আর নো আইবো ...’ অর্থাৎ দেখো বাবা! এ সুযোগ আর আসবে না, তাওবার কাবূলিয়াতের জন্য এটাই সর্বোত্তম সময় এবং সর্বোত্তম সন্তান। তোমরা জোয়ান, ই‘তিকাফের হালাতে যত পারো তাওয়াফ করো, আর তাওবা- ইস্‌তিগফার করো। এই ছিলো এক জ্বালা! বুড়োরা সবাই বলতেন, আমরা জোয়ান। অথচ আমাদের জোয়ানি ছিলো তাঁদের কাছে, আর তাঁদের বার্ধক্য আমাদের কাছে! এখন অবশ্য কেউ আর জোয়ান বলে না, তবে শুনতে ইচ্ছে করে! কত বিচিত্র মানুষের মনের গতি-প্রকৃতি! তিনি আরো বলতেন, তাঁর দেশের ভাষায় কথাগুলো শুনতে বড় ভালো লাগতো। ‘মাওলা ডেকে এনেছেন মাফ করার জন্যই, মাফ না করার জন্য নয়।’ অনিবার্য কারণে পাহাড়পুরী হুযূরের পক্ষে ই‘তিকাফ করা সম্ভব ছিলো না; তবে ‘যার্‌রা নাওয়াযি’-এর চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়ে তিনি বলতেন, ‘আপনার ই‘তিকাফ আমি মনে করি, আমারই ই‘তিকাফ।’ ই‘তিকাফ শুরু হবে মাগরিবের সময়, আর দুর্ঘটনা ঘটলো আছরের কিছু আগে। দুর্ঘটনা মানে, হাত ব্যাগটা হারিয়ে গেলো। তাতে ছিলো সফরের পাথেয়, আর ছিলো সফরের বৈধতার প্রমাণ, পাসপোর্ট। ব্যাগের কথা মনে পড়লো আছরের পর। মনের অবস্থা তখন কী হতে পারে! তবে আল্লাহর শোকর, যা হতে পারে তা হয়নি, যা হওয়া উচিত তাই হলো। প্রশান-চিত্তে অনুভব করলাম, আল্লাহর দয়া ও মায়ার এ যেন অন্য একরূপ! বান্দাকে আল্লাহ যেন সকল সম্পর্ক থেকে মুক্ত অবস্থায় তাঁর ঘরে ই‘তিকাফ করাবেন! আমি তখন আকাশের দিকে তাকাই, আর বলি, হে আল্লাহ, আমাদের দেশে, মেহমানকে যেতে দিতে যদি ইচ্ছে না হয়, তার সামান লুকিয়ে রাখা হয়। তুমি আমাকে এত মায়া করো যে, যেতে দিবে না বলে পাসপোর্ট লুকিয়েছো! তোমার দয়ায়, তোমার মায়ায় আমি খুশী হে আল্লাহ, আমি খুশী। মাগরিব পর্যন্ত সম্ভাব্য সকল সন্তানে তালাশ করা হলো, পাওয়া গেলো না। সবার পরামর্শ, ই‘তিকাফ রেখে এখন পাসপোর্টের চিন্তা করা দরকার। সেজন্য জেদ্দায় যেতে হবে, দূতাবাসে রিপোর্ট করতে হবে, অগায়রা। আমি ভাবলাম, আল্লাহর উপর ভরসা করে ই‘তিকাফ তো করি। তারপর আল্লাহ যা করেন। তারাবীহর পর ঘটনা শুনে পাহাড়পুরী হুযূর পেরেশান হলেন, তবে ই‘তিকাফ করছি শুনে খুশী হলেন এবং বললেন, ইনশাআল্লাহ নিজের চোখে দেখবেন, গায়ব থেকে আল্লাহ কীভাবে সাহায্য করেন! কীভাবে সাহায্য করেন দেখলাম এবং দেখে কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হলাম। ছাফা-এর দিকে হারানোপ্রাপ্তির কেন্দ্র ছিলো। তিনদিন পর সেখানে পাসপোর্ট পাওয়া গেলো। আল্লাহর কোন বান্দা দয়া করে জমা দিয়ে গেছেন। জাযাহুল্লাহু খায়রান। ঘটনার অন্য অংশটুকু এখানে বলার ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু পাহাড়পুরী হুযূরের একটি সুন্দর মন্তব্য উল্লেখ করার জন্য বলতে হচ্ছে। ব্যাগে পাসপোর্টের সঙ্গে তিনশ রিয়াল ছিলো, যা পাওয়া যায়নি। হুযূর বললেন, আল্লাহর ঐ বান্দার দেখা পেলে আপনি তো অবশ্যই তাকে পুরস্কৃত করতেন। আল্লাহ হয়ত তার দিলে সেটা ইলকা করে দিয়েছেন, তাই সে আপনার পুরস্কার হিসাবে তা নিয়ে নিয়েছে। সবকিছু আমার হুযূর এমন সুন্দর দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেন। এটা তাঁর স্বভাবসত্তার অংশ। (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement