জুমাদাল উলা ১৪৩১   ||   মে ২০১০

সাহিত্য ও সাহিত্যের উৎস

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

যার রাজ্য নেই তার আবার রাজত্ব কীসের? [২২ রবীউস সানী বৃহস্পতিবার হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ ছাহেবের এই মজলিসটি ধারণ করা হয়। তাঁর সামনে যখন মুছাজজিলটি চালু করে রাখা হল তিনি নিষেধ করলেন। কিন্তু তা বন্ধ করতে ইচ্ছা হল না। মুছাজজিলটি চলতে থাকল। তিনি মুচকি হেসে বললেন, হাঁ, ভাই ‌‌'যার রাজ্য নেই তার আবার রাজত্ব কীসের? নীচের সম্পূর্ণ আলোচনা এসেছে এই বাক্যটির সূত্র ধরে।] আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি যে, কোনো রকম চিন্তাভাবনা ছাড়া এই জুমলাটি কীভাবে এল? এমন জুমলা তো চিন্তা ছাড়া আসে না, আবার চিন্তা করেও তো এমন জুমলা পাওয়া যায় না। দেখেন, চিন্তা ছাড়া আসে না-এটা হচ্ছে যুক্তির কথা, আর চিন্তা করেও পাওয়া যায় না-এ হচ্ছে কলবের কথা। আচ্ছা, এই যে কথাগুলি আসছে তা কি একজন গান্দা ইনসানের ভিতর থেকে আসতে পারে? বোঝা যাচ্ছে যে, সবই আসমানের দান। আপনি কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই অনুভব করতে পারেন যে, আল্লাহ আপনাকে সঙ্গ দিচ্ছেন। শুধু একটু পর্দা থাকবে। এই পর্দাটা যদি বোঝেন এবং পর্দাওয়ালাকে অনুভব করেন তাহলেই আপনি স্বাদের একটি যিন্দেগী যাপন করবেন। দুনিয়ার আসবাব হল পর্দা। এই পর্দার পিছনে তিনি আছেন। মেঘ হল পর্দা, মেঘের আড়ালে তিনি আছেন। বীজ হল পর্দা, বীজের আড়ালে তিনি আছেন। এই আড়ালটুকু যে বুঝতে পারবে তার জীবনে শুধু স্বাদ আর স্বাদ, শান্তি আর প্রশান্তি। তার কোনো কষ্ট নেই। কোরআন মজীদের একটি আয়াত যখন আমি তেলাওয়াত করি তখন এক অনাবিল প্রশান্তি অনুভব করি। এই আয়াতের স্বাদ যে বুঝবে তার যবান ও কলম থেকে শুধু ঝরতেই থাকবে। এটা কিন্তু সুন্নাতুল্লাহ যে, আসবাব যখন কম থাকে তখন মুসাব্বিব খুব যাহির থাকেন। এজন্য পশুপাখির জগতে কাফির নেই, মুশরিক নেই। আমাদের যামানায় ইলম শিখবার আসবাব এখনকার তুলনায় অনেক কম ছিল। তাই তখন ইলকা অনেক বেশি হত। আমাদের বলবার কেউ ছিল না যে, সাহিত্য এভাবে শেখ, এই উদ্দেশ্যে শেখ। এজন্য মুসাব্বিব নিজে আমাদেরকে শিখিয়েছেন। শুধু কিতাব থেকে কি সব কিছু শেখা যায়, যদি মুসাববিব শিক্ষা না দেন? এই কথাটাই যদি কিতাবে তালাশ করেন, পাওয়া কঠিন হবে। মানুষ যদি সব জিনিস কিতাব থেকে শিখতে চায় তাহলে তার শেখার পরিমাণ খুব কম হবে। আপনারা তিনজন আছে, আমার জন্য একটু দোয়া করেন, আল্লাহ যেন আমাকে মাফ করে দেন। আর ওয়াদা করেন যে, গায়েবানাও একটু দোয়া করবেন। আল্লাহ আপনাদেরকে অনুরূপ দান করুন। যে যত অসহায় আল্লাহর রহমত তার তত কাছে [অনেক দিন পর হুজুরের ভাগ্নী মামার কাছে বেড়াতে এসেছেন। মামার ইচ্ছা ছিল আজ আর অন্য কাউকে সময় দিবেন না, পূর্ণ সময়টা ভাগ্নীকেই দেবেন, কিন্তু কোনো কারণে তা সম্ভব হয়নি। এরই সূত্র ধরে নীচের সম্পূর্ণ আলোচনা।] ভেবেছিলাম আজকের দরসটা মুলতবি থাকুক। যারা সব সময় পায় তারা না হয় আজ না পাক, যে সব সময় পায় না আজকে তাকেই কিছু দেই। কিন্তু তা যখন আর হল না, তখন বললাম, তোমরা সব সময় অর্ধেকই পাবে। এতেই তোমাদেরকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। তবে তোমাদের মাসকানাতের উপর আল্লাহ রহম করবেন। যত কমযোর হবে তত আল্লাহর মদদ ও নুসরত পাবে। এজন্য আমার সব সময়ের বিশ্বাস; বরং এ তো হাদীস শরীফেরই মর্মবাণী যে, বাবার চেয়ে মায়ের কাছে সন্তানের ভবিষ্যত বেশি গচ্ছিত। আল্লাহ তাআলা মা’কে এই মর্যাদা দিয়েছেন তার অসহায় হওয়ার কারণে। কারণ এই সন্তান ছাড়া দুনিয়াতে মায়ের কোনো অবলম্বন নেই। সন্তান যাতে বাবার চেয়ে মায়ের প্রতি বেশি অনুগত থাকে। এ জন্যই ‘তাহতা আকদামিল উম্মাহাত’। এই বোধটা-আলহামদুলিল্লাহ-আল্লাহ তাআলা আমাকে দান করেছেন একদম শুরু থেকে। আমার মনে আছে, তখন আমার খুব অভাব, বিয়ের দ্বিতীয় দিন, স্ত্রীর কাছে যাব, কী নিয়ে যাব? দুই টাকার চকোলেট নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন এতটুকুই ছিল আমার সামর্থ্য। শহরে যেতে হবে, দুই পয়সার জন্য গুদারাঘাট পার হতে পারিনি।অপেক্ষা করেছি, গুদারা-ভাড়াটা আসুক। তবুও মায়ের কাছে চাইনি, তাঁর কষ্ট হবে। ইসলামিক ফাউণ্ডেশনে তো হেঁটে গেছি অনেক। এখন ওদের নতুন দফতর হয়েছে, আট নয় বছর তো হয়ে গেল, এখনও দেখার সুযোগ হয়নি, কিন্তু তখন যেতে হত, অনেক গিয়েছি। সে সময় ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের একটি কাজে পনেরো শ’ টাকা পেয়েছিলাম। টাকাটা পেয়ে নিজেকে বড় ঐশ্বর্যের মালিক মনে হয়েছিল। আমার স্ত্রী তখন নতুন। তবুও পুরো পনেরো শ টাকা আমি তুলে দিয়েছিলাম মায়ের হাতে। আমি ভেবেছি, আমার ও আমার স্ত্রী উভয়েরই এতে কল্যাণ হবে। আলহামদুলিল্লাহ, তা হয়েছে। অনেক বরকত আল্লাহ তাআলা দান করেছেন। বলছিলাম যে, সন্তানের ভবিষ্যত কিন্তু মায়ের কাছে গচ্ছিত। আর এটা তার কমযোরী ও অসহায়ত্বের কারণে। এজন্য মূল কথা ঐটাই যে, যে যত কমযোর হবে তার প্রতি আল্লাহর রহমত তত বেশি হবে, যে যত নিঃসম্বল হবে মুসাববিব তার তত কাছে থাকবেন। ব্যথা ছাড়া লেখা হয় না আমি আগেও বলেছি যে, ব্যথা ছাড়া লেখা হয় না। তবে তা সত্যি হওয়া জরুরি নয়। একজন আমাকে ব্যথা দেয়নি, কিন্তু আমি কল্পনা করে নিচ্ছি, সে আমাকে ব্যথা দিয়েছে। মনে মনে ব্যথিত হচ্ছি এবং ভাবছি যে, এমন একটি আচরণ সে আমার সঙ্গে করল? কিন্তু বাস্তবে যেহেতু সে ঐ আচরণ করেনি, তাই আমার কল্পনার কারণে তার কোনো ক্ষতি হবে না, তবে এই ব্যথা থেকে আমার লেখা তৈরি হয়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথের একটি ঘটনা পড়েছি। সে একজনের সম্পর্কে বলছে, দেখ মাসী, সে আমাকে কেমন কথা বলল? যার ব্যাপারে বলছে সে তো অবাক। : ওমা, একথা কখন বললুম! : বলতে কতক্ষণ! অর্থাৎ তুমি আমাকে এমন একটি ব্যথা দিয়েছ-এটা আমি কল্পনা করে নিচ্ছি, নয়তো কবিতা আসবে না। রবীন্দ্রনাথ তো অনেকেই পড়ে কিন্তু ... ওদের মহলে আরেকটি কথাও প্রচলিত আছে যে, নারীর প্রেরণা ছাড়া লেখা হয় না। আসলে মূল কথাটা হচ্ছে, লেখার জন্য প্রেরণা লাগবে। হয় জায়েয জায়গা থেকে কিংবা না-জায়েয জায়গা থেকে তবে প্রেরণা ছাড়া লেখা হবে না। কেউ কেউ তো গাঁজা থেকেও প্রেরণা পায়। এজন্য খুব মশহুর একটি কথা আছে যে, গাঁজার কল্কেতে কষে দম না দিলে কবিতা আসে না! কথা কিন্তু ঠিক, তবে সে কবিতাও হবে সেরকম কবিতা। পক্ষান্তরে যা আসমান থেকে আসবে তা-ই হবে কামিয়াব বিষয়। তদ্রূপ মাসকানাতের অনুভূতি থেকে লেখা তৈরি হবে। আপনি অনেক সম্পদশালী, অনেক আপনার লোক-লশকর, কিন্তু আপনি ভাবতে পারেন যে, আমি তো মিসকীন। কারণ এইসব ধন-সম্পদ কিছুই আমার নয়, এসব অন্যের জিনিস, আমার কাছে গচ্ছিত আছে মাত্র। সব কিছু ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে। আর আমার চার পাশে যারা আছে কেউ আমার নয়, সবাই নিজ নিজ ফায়েদার জন্য আছে। আমি এসেছিও একা, চলেও যাব একা, যদি আল্লাহর সঙ্গ নসীব হয় তাহলেই আমার কামিয়াবী-এভাবে মাসকানাতের অনুভূতি জাগ্রত করলেও ব্যথা ও হাহাকার তৈরি হবে। তখন লেখা আসবে। এই অনুভূতি যদি সত্যি সত্যি না থাকে তাহলে তৈরি করে নিতে হবে। নতুবা লেখা হবে না। এই জিনিসগুলি এখন নেই। কারো মধ্যে যদি সামান্য কিছু দেখি তখন ভারি লোভ হয় যে, এই মানুষটা একটু আগে বাড়ুক, তার এই জিনিসটা দ্বারা একটু ফায়েদা হাসিল করুক। কিন্তু আমাদের মাঝে যে মেহনতের বড় অভাব! সাহিত্যের জন্য গৃহকর্ম আমার একজন ছাত্র একদিন একটি ঘটনা শোনাল। তার নিজের জীবনের, বেশ শিক্ষণীয় ঘটনা। আমি বললাম, তুমি এটা লিখে ফেল। সঙ্গে সঙ্গে বলে কি-পুষ্পের জন্য? আমি বললাম, না, তোমার নিজের জন্য। তুমি পুষ্পের জন্য ভাবছ কেন? পুষ্পে যদি তা ছাপাও হয় তাতে তুমি নিজের লেখার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাবে না। তোমাকে বলে বিশ্বাস করাতে হবে যে, এটা তোমার লেখা। তুমি তো লিখবে তোমার জন্য। একদিন দেখবে, তোমার লেখা তৈরি হয়ে গেছে। আমি নিজের জন্য প্রচুর লিখেছি। পটিয়ায় থাকতে মিশকাতের বছর ‘বীছ বড়ে মুসলমান’ পুরোটা অনুবাদ করেছিলাম। ছাপার জন্য নয়, নিজের জন্য। এবং যথারীতি এখন তা আমার কাছে নেই। তখন কিন্তু আমার লেখা ছাপা হয়েছে। আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়েছে শরহে বেকায়ায়, আততাওহীদে। তবে অনুশীলন চলেছে মীযান থেকে, আর অনুশীলন ছাড়া এমনি লেখা চলেছে হেফয খানা থেকে। প্রথম লেখা ছিল, ‘চোর আসিল ...’। স্বপ্ন দেখেছিলাম, স্বপ্নটা লিখেছিলাম। ‘বীছ বড়ে মুসলমান’ ছাড়াও ‘মাজমাউল আমছাল’ কিতাবটি পেয়েছিলাম পটিয়ায়। ঐটাও হরফুল আইন পর্যন্ত তরজমা করেছিলাম। এরকম অনেক কাজ আমি করেছি নিজের জন্য। এজন্য আমার প্রায় বিশ বছর আগের লেখা এবং এখনকার লেখায় গুণগত পার্থক্য নেই। সময়ের ব্যবধানের যে পার্থক্য তা আছে। এটা থাকবেই, তবে গুণগত পার্থক্য নেই। অনেক লেখক, এমনকি খোদ রবীন্দ্রনাথও তার বালক বয়সের লেখা সম্পর্কে বলেছে যে, তার খুব ইচ্ছা, লেখাগুলো মুছে ফেলা হোক। কিন্তু তার সঙ্গীরা রাজী না। তাদের যুক্তি, এগুলি হচ্ছে ইতিহাস, আর ইতিহাস মুছে ফেলা ঠিক নয়। রবীন্দ্রনাথ এটা নিয়ে খুব কটাক্ষ করেছে যে, ইতিহাস দিয়ে কী করবে, আগে আমার লজ্জা ঢাক। আমার ইতিহাস রক্ষা করতে গিয়ে আমাকেই তোমরা নগ্ন করে দিচ্ছ! আল্লাহ তাআলার শোকর, আমার লেখা যখন থেকে প্রকাশিত হচ্ছে তখন থেকে এখন পর্যন্ত, গুণগত পার্থক্য-ইনশাআল্লাহ-পাওয়া যাবে না। এসবই আল্লাহর দান, তবে বান্দাকে তার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা তো করতে হবে। সৃজনের ধারা কখনো বন্ধ হবে না [সম্প্রতি তাঁর গ্রন্থ-‘এসো কলম মেরামত করি’ এসেছে নতুন আঙ্গিকে, অনেক সম্পাদনা ও সংযোজনসহ। আল্লাহ তাআলার মেহেরবানী যে, গ্রন্থকার স্বয়ং তাঁর অমূল্য গ্রন্থটির কয়েকটি জায়গা থেকে পাঠ করে শুনিয়েছেন এবং আলোচনা করেছেন। দু’টো আলোচনা এখানে পত্রস্থ হল।] ‘এসো কলম মেরামত করি’র ভূমিকা থেকে কয়েকটি বাক্য পড়ছি : ‘‘কয়েকটি নাম বুকে আছে বুকেই থাকুক। শুধু বলি, সময় দিয়ে, উপদেশ দিয়ে, প্রেম ও প্রার্থনা দিয়ে এবং প্রাপ্য ত্যাগ করে যারা আমার সাহিত্য-সাধনার পথ মসৃণ করেছেন, আল্লাহ তাদের শায়ানে শান জাযা দান করুন, আমীন।’’ ‘কয়েকটি নাম বুকে আছে বুকেই থাকুক’ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এই ভঙ্গিটায় নতুনত্ব আছে। সময় দিয়ে, উপদেশ দিয়ে, প্রার্থনা দিয়ে-এই তিনটি কথা এক আন্দাযের, ‘প্রাপ্য ত্যাগ করে’-এটা ভিন্ন আন্দাযের, তাই ‘ও’ না বলে ‘এবং’। আগে ছিল, সময় দিয়ে, উপদেশ দিয়ে, প্রার্থনা দিয়ে এবং প্রাপ্য ত্যাগ করে, হঠাৎ মনে হলো ‘ভালোবাসা দিয়ে’ এ কথাটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেন আমার কলম থেকে ঝরলো না? অথচ ‘নিকট ও দূর’ থেকে যত দান আমি পেয়েছি তার মধ্যে ভালোবাসার দানই তো সবার বড় দান! তাহলে কি স্বভাবের দিক থেকে আসলে আমি অকৃতজ্ঞ! আল্লাহ মাফ করুন। তবু আল্লাহর শোকর, স্বতঃস্ফূর্তভাবে না হোক, চিন্তার মাধ্যমেই হোক, শেষ পর্যন- কথাটা এসেছে। তারপর মনে হলো, এখানে ‘প্রার্থনা’-এর সঙ্গে ‘ভালোবাসা’-এর পরিবর্তে ‘প্রেম’ হলে ভালো হয়। তুমি কানে বাজিয়ে দেখো, ‘ভালোবাসা ও প্রার্থনা দিয়ে/প্রেম ও প্রার্থনা দিয়ে’।’’ এই যে আত্মসমালোচনা, আমাদের মাঝে এর বড় অভাব। না নিজের সমালোচনা নিজে করি, না অন্যের কাছ থেকে শুনতে চাই। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তাআলা আমাকে তাওফীক দিয়েছেন নিজের লেখার দোষত্রুটি খুঁজে বের করার। এখানেই দেখেন-‘ভালোবাসা দিয়ে’ কথাটা কিন্তু লেখায় এসেছে, তবু খুশি হচ্ছি না; বরং নিজেকে তিরস্কার করছি যে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেন এল না? ‘প্রাপ্য ত্যাগ করে’। এটা একটা ব্যাপক শব্দ। আমার স্ত্রী তার অনেক প্রাপ্য ত্যাগ করেছে, আমার মেয়েরা তাদের প্রাপ্য ত্যাগ করেছে, আমার ছাত্ররা প্রাপ্য ত্যাগ করেছে, শুধু আমার সাহিত্য-সাধনার জন্য। ছাত্রদের কারণেই কথাটা এখানে এসেছে। বিরতির পর প্রায় ১০/১১ দিন ওদেরকে পড়াইনি। আমি পঞ্চম বর্ষে হিসাব দিলাম যে, তোমরা ৪৩ জন। এগারো দিন তোমাদেরকে পড়াইনি। তাহলে প্রত্যেকের ১১ ঘণ্টা করে নিয়েছি। প্রায় হাজার ঘণ্টা সময় আমার নিকট তোমাদের প্রাপ্য ছিল। তোমরা যদি খুশিমনে এই প্রাপ্যটা ত্যাগ করে থাক তাহলে তোমরা অত্যন্ত খোশনসীব। আপনি গোটা বাংলা-সাহিত্য চষে বেড়ান, সব ভূমিকা পড়ুন, অনেক ভালো ভালো কথা পাবেন, কিন্তু প্রাপ্য ত্যাগ করে সাহায্য করেছে-এই কথাটা এভাবে হয়তো পাওয়া যাবে না। এ হচ্ছে সৃজন। তবে সৃজনের ধারা কখনো বন্ধ হবে না। কেউ যদি আসমানের কাছে হাত পেতে চায় তাহলে আরো নতুন নতুন প্রকাশ সেখান থেকে আসবে। এবং কোনো কোনোটা আগেরটার চেয়েও সুন্দর হবে। সম্পাদনার একটি নতুন ধারা ‘এসো কলম মেরামত করি’র ৩৬ পৃষ্ঠায় একটি লেখা আছে-‘বাংলা ভাষার ফরিয়াদ’। এটা পুষ্পেও আছে। খুব সুবিধা হবে পুষ্পের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে পড়লে। এই লেখাটার উপর ৩৭ পৃষ্ঠায় একটি টীকা আছে। সেটি পড়ছি : ‘‘আগে ছিল এ রকম-‘আমি বাংলা ভাষা, আমার বুকে লুকিয়ে আছে অনেক ব্যথা, অনেক যন্ত্রণা। আর কত দিন লুকিয়ে রাখবো! একজন দরদী বন্ধুও কি খুঁজে পাবো না, যে শোনবে আমার বুকের ব্যথা ও যন্ত্রণার কথা এবং আমাকে দেবে সামান্য কিছু সান্ত্বনা!’ ‘আর কত দিন লুকিয়ে রাখবো’ কথাটা অসম্পূর্ণ মনে হলো। তাই চিন্তা করে লিখলাম, ‘কিন্তু আর কত দিন লুকিয়ে রাখবো বুকের ভিতরে বুকের ব্যথা-বেদনা!’ তারপর ভাবলাম, তাকরার হলে বক্তব্যটি আরো জোরালো ও আবেদনপূর্ণ হবে, তাই লিখলাম, ‘আর কতকাল নীরবে সইবো এ জ্বালা যন্ত্রণা! এখন বাহ্যত আর ভাষাগত কোন সমস্যা নেই। কিন্তু চিন্তা করলাম, সান্ত্বনা শব্দটিকে নীচে আনতে পারলে একটি প্যারা সৃষ্টি হতো, তাতে সজ্জাটি সুন্দর হতো। কিন্তু কীভাবে? দৃষ্টিটা তীক্ষ্ণ হলো, খুঁজে খুঁজে দেখলাম, কোথায় একটা দু’টো শব্দ বাড়ানো যায়! অনেক চিন্তার পর লিখলাম, ‘আমাকে দেবে একটু সামান্য শান্তি ও সান্ত্বনা! আরো সুন্দর হলো, কিন্তু শব্দটি নামল না। অনেক চিন্তার পরও কোন পথ হলো না। তখন ভাবলাম, আচ্ছা! একেবারে শুরু থেকে চেষ্টা করে দেখি, তখন হঠাৎ করেই, একেবারে হঠাৎ করেই কলম থেকে যেন ঝরে পড়লো, ‘আমি এক মযলূম ভাষা, আমি বাংলা ভাষা।’ এতে কাজ হলো, প্যারা সৃষ্টি হলো, কিন্তু নীচের লাইনটি অর্ধেক ভরে গেলো। তখন অনেক চিন্তা-ভাবনা করে কিছু শব্দ কমিয়ে বর্তমান রূপটি পেলাম। এখন চিন্তা করে দেখো, শুধু একটি প্যারা তৈরির চিন্তা ও চেষ্টা থেকে কত সুন্দর সম্পাদনা হলো। প্যারা সৃষ্টির তাগাদা না হলে এ সম্পাদনাটুকু হতো না। কারণ বাহ্যত ভাষাগত কোন সমস্যা ছিল না। আমার মনে হয়, লেখা সম্পাদনার এটি একেবারে নতুন একটি ধারা! আল্লাহ যেন কবুল করেন।’’ এগুলি চিন্তা করতে পারবে কখন? যদি লেখক নিজে কম্পোজ করে। আমি জানি, এই অঙ্গসজ্জাটা থাকবে না, বই আকারে করতে গেলেই পরিবর্তন হয়ে যাবে। তা যাক, কিন্তু এখন যদি এই সজ্জাটাকে কেন্দ্র করে একটু চিন্তা করি, এতে যদি ভাষা ও সাহিত্যের খানিকটা উন্নতি হয় তাহলে ক্ষতি কি? সজ্জা সুন্দর করতে গিয়ে যদি একটি সুন্দর সম্পাদনা হয় তাহলে অতিরিক্ত প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তিটা আমার প্রচুর ঘটে আল্লাহর রহমতে। ধারণ ও উপস্থাপন : মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ

 

advertisement