জুমাদাল উলা ১৪৩৮   ||   ফেব্রুয়ারি ২০১৭

অ-তে অজ

শাহ মুহাম্মাদ খালিদ

তাহারা স্বঘোষিত সুশীল, প্রগতিশীল। নিজেদের উদারমনা ঘোষণা করিয়া সবিশেষ প্রশান্তি লাভ করেন, যেমনটা বিনোদিত হন ধার্মিক মানুষকে মৌলবাদী আখ্যা দিয়া। উদারতার সাইনবোর্ড বহনকারী এইসব পক্ককেশীর উদারতার মাত্রা ঠিক কতখানি  তাহা নূতন করিয়া আবার প্রকাশ পাইল।

এইবার তাহারা বেজায় চটিয়াছেন। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটির এত বড় আস্পর্ধা! দেশে এখন তাহাদের একচেটিয়া কায়কারবার। শাসকদলের পিঠে সওয়ার হইয়া শিল্প ও সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, আইন ও সংবিধান সর্বত্র ধর্ম-নিরপেক্ষতা, অর্থাৎ ধর্মবিদ্বেষ, অর্থাৎ ইসলামবিদ্বেষ বসাইয়া দিয়াছেন। এরই মধ্যে এমন অঘটন?!

চেতনায় আঘাত পাইয়া তাহারা ক্ষুব্ধ হইলেন। গোঁফঅলা একজন তো বলিয়াই বসিলেন, হেফাজতের দাবির মুখে পাঠ্যপুস্তকে যেই পরিবর্তন আনা হইয়াছে তাহাতে আমি অত্যন্ত মর্মাহত।...’’

আরেকজন কহিলেন, আমরা তো বাল্যকালে পড়িয়াছি ও-তে ওলকপি। এখন বৃদ্ধবয়সে আসিয়া ওড়না দেখিতেছি কেন? শিশু যদি জিজ্ঞেস করিয়া বসে ওড়না দিয়ে কী করিব তখন শিক্ষক কী উত্তর দিবেন?

তাই তো! পাঠ্যপুস্তক যাহারা প্রণয়ন করেন তাহারা কেবল শিশুর কথাই ভাবিলেন, বেচারা শিক্ষকের কথা একবারও ভাবিলেন না! ইহা কি উচিত হইয়াছে? যেই বাঙ্গালী মায়ের কোলে শিশু হাসিয়া খেলিয়া বড় হয় সেই মায়ের মাথায় যে কাপড়খানা থাকে, দাদু-নানু, খালা-ফুফু ও আশেপাশে আরো অনেকে যে কাপড়খানা গলায় মাথায় ফেলিয়া রাখেন ইহাকেই যে ওড়না কহে তাহা একটা শিশু কি রূপে বুঝিবে?! আর শিক্ষক মহোদয়ই বা শতাব্দীর এই জটিলতম বিষয়খানা কীভাবে বুঝাইবেন?! হায়! হায়! এই সকল মহাজ্ঞানী বুদ্ধিজীবী না থাকিলে আমরা যে দিকভ্রষ্ট লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া কোন্ রসাতলে চলিয়া যাইতাম তাহা ভাবিলেও দেহমনে শিহরণ জাগিয়া ওঠে!

আচ্ছা, ইহা না হয় বুঝিলাম। কিন্তু বর্ণমালার একবারে শুরুতে যে বলা হইয়াছে অ-তে অজ ইহার অর্থ স্বয়ং শিক্ষক বেচারা কাহাকে জিজ্ঞাসা করিবেন?১. ইহার অর্থ বুঝিবার জন্য তো আপনাদের মুখপানে চাহিয়া থাকা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় এই অধমের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে উদিত হইতেছে না!

এই দেখুন, আরেক মহাশয়া, থুক্কু মহাশয় কী কহিয়া উঠিলেন। সাবধান! ইনি নাকি জেন্ডার বিশেষজ্ঞ। হাঁ তিনি বলিতেছেন-

যে বই ছেলে ও মেয়ে উভয়ে পাঠ করিবে তাহাতে কেবল নারীপোশাকের কথা থাকিবে কেন? ইহার মাধ্যমে শিশুবয়সেই নারী-পুরুষে বিভেদ তৈরি করা হইতেছে।

ওহ হো! জেন্ডার তো দেখিতেছি, ভারি ফ্যাকরার জিনিস। ইহাতে নারীর কথা কহিলে বিভেদ আসিয়া পড়ে, পুরুষের কথা কহিলে বৈষম্য উঠিয়া দাঁড়ায়! বেয়াদবি মাফ করিবেন, নারী আর পুরুষে যখন সৃষ্টিগতভাবেই পার্থক্য বিদ্যমান তখন সেই পার্থক্যের অনুভূতি মনে জাগিলে পাপ হইবে কেন? ইহাছাড়া এই পার্থক্যের অনুভূতি জাগাইবার মত কতকিছুই তো চতুর্দিকে রহিয়াছে! এই যেমন ধরুন নারীপুরুষের পোশাক-পরিচ্ছদ হইতে শুরু করিয়া আরো কত কি! এতকাল চতুর্দিকের এতকিছু দেখিয়াও তো বিভেদ-বৈষম্যের কথা মনে কখনো জাগে নাই। আজ যখন জাগিল তখন একটা সমাধানও মনে মনে ভাবিয়াছি। এই বঙ্গদেশের নারী ও পুরুষকে লিঙ্গবৈষম্যের ঊর্ধ্বে তুলিবার মহান লক্ষ্যে এই সমাধানটা প্রয়োগ করা যায় কি না বিজ্ঞ সুশীলদল চিন্তা করিবেন। তাহা হইতেছে, এই দেশের নারী-পুরুষ সকলে কোনো প্রকার ভেদাভেদ না রাখিয়া বছরের ছয়মাস ধুতি ও পাঞ্জাবি পরিবেন, আর পরের ছয়মাস পরিবেন শাড়ী ও পেটিকোট। তামা-তুলসি নিয়া কিরা কাটিয়া বলিতে পারি, এই সমতার ব্যবস্থা হইলে পৃথিবীর কেবল পশ্চিমের নহে, পূবেরও গোটা মানবকূল একেবারে অভিভূত হইয়া যাইবে! আর তখন আমরা নিশ্চিন্তমনে প-তে পাঞ্জাবি যেমন লিখিতে পারিব তেমনি প-তে পেটিকোট লিখিতেও দোষ থাকিবে না।

আরে! ও-তে ওড়না লিখিলেও তো লিঙ্গবৈষম্যের কোনো কারণ নাই। ইহার কৃতিত্ব আমাদের সংস্কৃতিবান কীর্তিমান পুরুষদিগকেই দিতে হয়। কারণ ইহারাও তো শাল, থুক্কু ওড়না পরিয়া থাকেন। তবে কিনা খানিকটা বৈষম্য বজায় রাখিয়া ওড়নাটা ঘাড়ের ওপর স্থাপন করেন আর দুই প্রান্ত বুকের ওপর ঝুলাইয়া দেন। এইরূপ না করিয়া উহারা যদি শালখানি, থুক্কু ওড়নাখানি গলায়  স্থাপন করিয়া দুই প্রান্ত পৃষ্ঠদেশে ছড়াইয়া দেন তাহা হইলে নারী-পুরুষের লিঙ্গবৈষম্য একেবারে ঘুচিয়া যায়। একই সাথে পাঠ্যপুস্তকে লিখিত ওড়নাটাও একেবারে ফ্রেশ ক্লীব হইয়া পড়ে। আমরা প্রত্যাশা করিব, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তাঁহারা এই ত্যাগটুকু স্বীকার করিবেন!

প্রিয় পাঠক! এইবার একটু বিরতি লইতেছি। কারণ এইমাত্র রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করিলেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। তাহাদের বক্তব্য একটু শুনিতে হয়। অবশ্য ইহাদের নামখানিতেই কীসের যেন কটুগন্ধ রহিয়াছে। তিন জাতি ঐক্যে কোন্ জাতি বাদ পড়িয়াছে তাহা পাঠকবর্গের জন্য কুইজ হিসেবে ছাড়িয়া গেলাম।

 যাহা হউক ইঁহারা বলিতেছেন, ‘‘পাঠ্যপুস্তকে হিন্দু ধর্মীয় লেখকদিগকে বাদ দিয়া এবং ওড়না ইত্যাদির মত জিনিসকে অন্তর্ভুক্ত করিয়া ভবিষ্যত প্রজন্মকে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতায় প্ররোচিত করা হইয়াছে।’’

না! না! না! ইহা কিছুতেই হইতে পারে না। এই বঙ্গদেশকে কোনো অবস্থাতেই জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলিয়া দেওয়া যাইবে না। তবে কথা হইল গিয়া, এই ব্যাপারটা কখনো  ঘটিতে পারিবে বলিয়া বোধ হইতেছে না। কারণ ও-তে ওড়নার মত জঙ্গিবাদী মন্ত্র যেই পাঠ্যপুস্তকে আছে, তাহাতে র-তে রথ টানি আর ঋ-তে ঋষির মত অব্যর্থ দাওয়াইও তো রহিয়াছে! রথ-ঋষির মত অসাম্প্রদায়িক শব্দ থাকিতে কীভাবে এই দেশ জঙ্গিবাদে তলাইয়া যাইতে পারে!

ওড়না যদি পস্নাস হয় রথ তো মাইনাস। আর পস্নাসে-মাইনাসে যে মাইনাসই হয় তাহা তো দাদাবাবুরাও জানিয়া থাকিবেন। কাজেই যে পর্যন্ত রথ-ঋষি রহিয়াছে সে পর্যন্ত অজু-ওড়নার মত শব্দ কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াইবে?

প্রশ্ন হইল, একজন যদি রথ টানি, তবলা বাজাই, পর্যন্ত কহিতে পারে, অন্যজন কি ও-তে ওড়নাটুকুও কহিতে পারিবে না?! ভারি শংকা জাগে, অসাম্প্রদায়িক হইতে হইতে এই বঙ্গদেশ না আবার আসাম-গুজরাট হইয়া যায়!

 প্রিয় দেশবাসী! শিক্ষা সিলেবাসের সামান্য ওড়না লইয়া যাহাদের এত মায়াকান্না, সমস্ত শিক্ষা-ব্যবস্থাই যে ধ্বংসের মুখে তাহাতে তাহাদের কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ

পড়িতেও দেখা যায় না। দশ বছরের বাচ্চা যখন ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে জিপিএ ফাইভের সার্টিফিকেট গলায় ঝুলাইয়া বগল বাজাইতে থাকে এবং শিশুকাল হইতেই অসৎ পথে কার্যহাসিলের সবক রপ্ত করে তখন বুদ্ধিজীবীদের বিবেক এসির ঠা-ায় জমাট হইয়া থাকে। শিক্ষাঙ্গনকে ক্যান্টনম্যান্ট বানাইয়া সোনার ছেলেরা যখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগাম মহড়া দিয়া বেড়ায় তখনও তাহাদের ওপর বোবাজ্বীন সওয়ার হইয়া থাকে। শুধুমাত্র কোথাও যখন মুসলমানিত্বের কিছু পাওয়া যায় তখনই তাহারা বর্ষার নতুন পানি পাওয়া ব্যাঙের মত  কোরাস গাহিতে শুরু করেন।

একটা জিনিস ঠান্ডা মাথায় অনুধাবন করিতে হইবে- এই দেশে নবক্ষই ভাগ মানুষ মুসলমান। অতএব এইদেশের মানুষের শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতিসহ জীবনের সকল অঙ্গনে ধর্মীয় ভাবধারার ছাপ থাকা অতি স্বাভাবিক। একইসাথে এইদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধসহ সকল ধর্মের লোকেরা বিশ্ববাসীর সামনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চমৎকার এক উদাহরণ হইয়া রহিয়াছে। শালীন ও মার্জিত জীবন যাপন করা এইদেশের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের গৌরবের বিষয়। ওড়না সেই শালীনতারই অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। অবএব বিকৃত মানসিকতার যেই সব লোক ওড়নার মত অতি স্বাভাবিক জিনিসকেও হজম করিতে পারিতেছেন না, তাহারা যদি সময় নষ্ট না করিয়া ওড়নাবিহীন কোনো দেশের টিকিট কাটিয়া ফেলেন তাহা হইলে আমরা একটুও বেজার হইব না।

১৪/০১/২০১৭ ঈ.

 

 

 

advertisement