রবিউল আউয়াল ১৪৩৮   ||   ডিসেম্বর ২০১৬

আমাদের রাজ্য শাসন-১৪

মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়ায়ী

[এ লেখার ১৩টি কিস্তি শিশু-কিশোর বিভাগে ধারাবাহিকভাবে এসেছে। সর্বশেষ সফর ১৪৩৫=ডিসেম্বর ২০১৩-এ প্রকাশিত হয়েছে। দীর্ঘ বিরতির পর তা আবার ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।]

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

খেলাফত-ব্যবস্থা

আবু বকর রা. তাঁর শাসনামলে নবীযুগের শাসনব্যবস্থাকেই হুবহু বহাল রেখেছিলেন। কোনো ধরনের পরিবর্তন তিনি তাতে আনেননি। তবে ওমর রা.-এর শাসনামলে অনেক নতুন রাষ্ট্র ইসলামী শাসনব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এবং অনেক সৈন্য ইসলামে দীক্ষিত হওয়ায় শাসন ব্যবস্থায় বেশ পরিবর্ধন ও বিস্তৃতি ঘটাতে হয়েছে। আর এই পরিবর্ধন ও বিস্তৃতিই ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থার রূপ পরিগ্রহ করে। এই শাসনব্যবস্থার তালিকাও বেশ দীর্ঘ। সে যুগের সভ্য ও আধুনিক রাষ্ট্রের কোনো বিভাগ এমন পাওয়া যাবে না, যা তিনি প্রতিষ্ঠা করেননি। তবে সবকিছুই তিনি করেছেন সাহাবায়ে কেরামের ঐকমত্য ও ইসলামী শিক্ষার আলোকে।

তিনি একটি মজলিসে শূরা গঠন করেছেন। বড় বড় সাহাবীগণ ছিলেন এই মজলিসের সদস্য। গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয় তাদের পরামর্শক্রমেই চূড়ান্ত করা হত। আর সাধারণ মুসলমানদেরকেও দিয়েছিলেন তাদের স্বাধীন মত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার। বিজিত অঞ্চলগুলোকে বিভিন্ন প্রদেশ ও জেলায় বিভক্ত করে জনসংখ্যা জরিপ করাতেন। চাষ উপযোগী জমিতে চাষাবাদের বন্দোবস্ত করে এর উৎপাদিত শস্যে খারাজ ও উশর ধার্য করে দেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে নজরদারির ব্যবস্থা করেন। প্রদেশগুলোতে গভর্ণর, কালেক্টর, মীর-মুন্সি ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দেন। বিচার ব্যবস্থা ও প্রশাসনের পৃথক বিভাগ স্থাপন করেন। প্রতিটি জেলায় মামলা-মোকদ্দমা নিষ্পত্তির জন্য বিচারক নিযুক্ত করেন। আইন-কানুনের ব্যাপক প্রচারণা ও সচেতনতার জন্য দারুল ইফতা প্রতিষ্ঠা করেন। সার্বিক দেখাশোনা ও নজরদারির জন্য ইহতিসাব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। বাইতুল মালের (অর্থ মন্ত্রণালয়) জন্য এক বৃহৎ ভবন নির্মাণ করেন এবং গোটা রাষ্ট্রের সমুদয় অর্থের আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশের পূর্ণ ব্যবস্থা করেন। সাধারণ জেলা ও প্রদেশগুলোতে সরকারী ভবন নির্মাণ করেন। জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের অধীনে রাস্তা-ঘাট, সেতু, মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তী প্রত্যেক মনযিলে নিরাপত্তা চৌকি, সরাইখানা ও পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন।

জমি চাষাবাদের সুবিধার্থে বহু খাল খনন করেন। ইরাক, কূফা, বসরা, মুসেল এবং মিসরের ফুসতাত-এর মতো বড় বড় শহর  গড়ে তোলেন। কয়েক হাজার মসজিদ নির্মাণ করেন। দেশের সকল অন্ধ, পঙ্গু ও প্রতিবন্ধীর জন্য ভাতা চালু করেন।

ওমর রা. মজবুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। যার সুবাদে কয়েক বছরেই লক্ষাধিক সশস্ত্র সৈন্য প্রস্তুত হয়। প্রধান প্রধান স্থান ও সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা ছাউনি স্থাপন করেন এবং বিভিন্ন স্থানে মজবুত দুর্গ নির্মাণ করেন। সেনা বাহিনী ছাড়াও রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য পৃথক পুলিশ ফাঁড়ি প্রতিষ্ঠা করেন।

ওমর রা. তাঁর রাষ্ট্রের পদাধিকারীদেরও কঠোরভাবে দেখভাল করতেন। সর্বোচ্চ পদে আসীন কোনো ব্যক্তিরও সাধারণ মানুষের উপর বাড়াবাড়ি করার দুঃসাহস হত না। সাধারণ ঘোষণা ছিল, কোনো শাসক বা পদাধিকারী কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কারো কোনো অভিযোগ থাকলে হজ্বের সময় যেন তা উত্থাপন করা হয়। কেননা হজ্বের সময় সব অঞ্চলের শাসক মক্কায় সমবেত হত। এর ফলে সকল অভিযোগ খুব সহজেই নিষ্পত্তি হয়ে যেত। বাড়াবাড়ি করলে কোনো কর্মকর্তাকেই ক্ষমা করা হত না; বরং সবার সামনেই তাকে শাস্তি দেওয়া হত।

ওমর রা. বাইতুল মালের (রাষ্ট্রীয় কোষাগার) নিরাপত্তার ব্যাপারে খুবই গুরুত্ব দিতেন। ফলে একটি কড়িও অনর্থক ব্যয় হত না। একবার ঔষধ তৈরির জন্য তাঁর কিছু মধু প্রয়োজন হয়। কিন্তু মুসলমানদের অনুমতি না নেওয়া পর্যন্ত তিনি তা গ্রহণ করলেন না। অথচ মধু ছিল খুবই সামান্য একটি বস্তু।

প্রজাদের সুখ-দুঃখে ওমর রা. ছিলেন খুবই আন্তরিক। রাতের আঁধারে তাদের খোঁজ-খবর নিতেন। রাষ্ট্রের দূরবর্তী অঞ্চলগুলোর সংবাদ গ্রহণের জন্য দূত নিয়োগ করেছিলেন, যারা সামান্য বিষয়ও তাঁকে অবহিত করতেন। সব প্রজাই ছিল তাঁর কাছে সমান। ধনী-গরিবের মাঝে কোনো তফাত ছিল না। সবার সাথে একই আচরণ করতেন। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষপাতিত্ব করতেন না। এমনকি নিজের সন্তানের জন্যও কোনো ছাড় ছিল না।

ওমর রা. ইসলামের অনেক খেদমত করে গেছেন। তাঁর শাসনামলে হাজার হাজার মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হন। তিনি হাজার হাজার মসজিদ নির্মাণ করেন। হারাম শরীফ ও মসজিদে নববীর সম্প্রসারণ করেন। মুজাহিদদের সন্তান-পরিজনের জন্য ভাতা চালু করেন। আল্লাহ তাআলার কিতাব ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিধানকে গোটা রাজ্যে প্রচার-প্রসার করেন। প্রতিটি শহরে কুরআনের তালীমের জন্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে কুরআন-সুন্নাহর পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষাও প্রদান করা হত। এর ফলে গোটা আরব ভূখণ্ডে অতি অল্প সময়ে শিক্ষার প্রসার ঘটে।

ওমর রা. ছিলেন একজন অতি মর্যাদাবান সাহাবী। কয়েকটি শাস্ত্রের তিনি প্রবর্তক। তিনি অনেক বড় আবেদ, মুত্তাকী ও দুনিয়াবিমুখ ছিলেন। আল্লাহর ভয়ে সর্বদা কম্পমান ছিলেন। তিনি খুবই সাধারণ খাবার খেতেন। পুরোনো কাপড় পরতেন। তাঁর জীবনাচার এত সাদাসিধে ছিল যে, নিজ গোলামের সাথেও তাঁর কোনো পার্থক্য চোখে পড়ত না। তাঁর দৈনিক মোট খরচ ছিল মাত্র দশ আনা।

লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, আরব, ইরাক, ইরান শাম ও মিসরের মতো দেশ যে খলীফার অধীনে, কায়সার ও কিসরার ধনভাণ্ডার যার করতলে তাঁর জীবন যাপন ছিল কতই না সাধারণ, সাদাসিধা!! 

 

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

অনুবাদ : আবদুল্লাহ ফাহাদ

 

 

advertisement