মুহাররম ১৪৩৮   ||   অক্টোবর ২০১৬

স্মৃতিতে অম্লান হযরত মাওলানা আহমদ করীম ছাহেব রাহ.

ইসহাক ওবায়দী

বৃহত্তর নোয়াখালীর ছোট ফেনী নদীটি তখন খুব উত্তপ্ত ছিল। এপাড় ভাঙ্গে তো ওপাড় গড়ে এই ছিলো তার নিত্য দিনের অবস্থা। পশ্চিম তীরে ছিলো আদি নোয়াখালীর আদিবাস বাম্নি এলাকা, যেখানে এক সময় বড় একটি নদীবন্দর ছিলো বলে ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়। আর পূর্ব তীরে ছিলো চর দরবেশ নামে সুজলা সুফলা সুন্দর একটি গ্রাম। এই গ্রামের খেত-খামার ও ঘর-বাড়ি তার ভাঙ্গনের কবলে পড়ে অনেকবার। মুখলেছুর রহমান ও আয়েশা খাতুনের সংসারটি চার ছেলেকে নিয়ে ভালো ভালোই চলছিলো। এরই মধ্যে একাধিকবার তাদের বাড়িটি ভাঙ্গনের কবলে পড়ে তছনছ হয়ে যায়। ভাঙ্গনের পর বুকে অনেক আশা নিয়ে আরেক জায়গায় বাড়ি বানিয়ে বসবাস আরম্ভ করার পর আবারো ভাঙ্গনের শিকার হয়।

মুখলেছ সাহেবের সর্বকনিষ্ঠ ছেলে আহমদ করীম তখন বালক এবং প্রাইমারী হয়ে সোনাগাজী ফাযিল মাদরাসার ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। সব হারিয়ে এই পরিবারটি যখন দিশেহারা অবস্থায় কালাতিপাত করছিলো ঠিক তখনই গ্রাম্য এক আনপড় চাষা এসে আহমদ করীমকে বলল, এ সব ভাঙ্গা-গড়া নিয়ে তোমার কোনো চিন্তা করার দরকার নেই। কোথায় যাবে, কোথায় বাড়ি করবে এসব তোমার মুরুব্বীরাই চিন্তা করবেন, তুমি তোমার ভবিষ্যত গড়ার উদ্দেশ্যে দেওবন্দ চলে যাও। তুমি মানুষ হয়ে আসলে বাড়ি থাকলে পাবে, নতুবা  নতুন করে বাড়ি বানাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই গ্রাম্য লোকটির প্রতিটি কথা আহমদ করীমের অন্তরে পাহাড়সম সাহসের সৃষ্টি করে এবং সে দেওবন্দ অধ্যয়নরত মাওলানা জিয়াউল হকের সাথে দেওবন্দ মাদরাসায় চলে যায়। সেই যে দেওবন্দ গেলো আর কোনোদিন গ্রামের দিকে ফিরে তাকাবার সময় পর্যন্ত পায়নি সে। এক নাগাড়ে ছয় বছরে শরহে জামী কিতাব থেকে নিয়ে দাওরায়ে হাদীস ১৯৫৫ ঈ. সনে এবং দাওরাতুত তাফসীর ১৯৫৬ ঈ. সনে শেষ করে তারপর দেশে ফিরে আসা। এরইমধ্যে কতো আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুর খবর সম্বলিত পত্র পেয়েছে; কিন্তু সে তা খুলেও দেখেনি। দেওবন্দ থাকার সময়েই ১৯৫২ সালে বাবা মুখলেছুর রহমান সাহেবও ইন্তেকাল করেন। ১৯৫৬ সালের কিছু অংশ তাফসীর পড়ার পর দেশে ফিরে বছরের বাকি অংশে ওলামাবাজার দারুল উলূম হুসাইনিয়া মাদরাসায় উস্তায হিসেবে কর্মজীবন আরম্ভ করেন।

প্রিয় পাঠক! এই আহমদ করীমই আজকের নিবন্ধের মূখ্য ব্যক্তিত্ব, যাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের সামান্য কিছু আলোচনার প্রয়াস পাবো আমরা এখানে। ১৯৫৬ সাল থেকে এক নাগাড়ে ২০১৬ সালের ২৫ শে আগস্ট পর্যন্ত তিনি একই মাদরাসার (ওলামাবাজার মাদরাসার) স্বনামধন্য উস্তায হিসেবে বরিত হন। তিনি বৃহত্তর নোয়াখালীতে ওলামাবাজারের মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর হিসাবেই খ্যাত ছিলেন। তাঁর এই সুদীর্ঘ কর্মজীবনে- ৬০/৬১ বছরের শিক্ষকতা জীবনে কত হাজার ছাত্র যে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ধন্য হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এই অধম লেখকও তাঁর একজন নগন্য ভক্ত-ছাত্র। ১৯৬০ সালে ওলামাবাজার মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীসের দরস শুরু হলে তিনি বুখারী শরীফ ও তিরমিযী শরীফ পড়াতে আরম্ভ করেন। এক নাগাড়ে ৫৬ বছর পর্যন্ত তিনি সহীহ বুখারীর দরস আঞ্জাম দেন।

হযরত মাওলানা আহমদ করীম ছাহেব দেওবন্দে শরহে জামী কিতাবটি পড়েছিলেন হযরত মাওলানা নাসীরুদ্দীন ছাহেবের কাছে, আর সহীহ বুখারী ও তিরমিযী পড়েছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় উস্তায ও ব্যক্তিত্ব শায়খুল আরব ওয়াল আজম, স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সিপাহসালার, আওলাদে রাসূল, হযরত মাওলানা সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর কাছে। আর এই অধম শরহে জামী ও সহীহ বুখারী-তিরমিযী পড়েছি হযরতের কাছে। হযরত মাদানীর হাজার হাজার আশেকীনের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম আশেক ও ফেদায়ী। এই অধমের মধ্যে যদি হযরত মাদানীর কিঞ্চিত মহব্বতও থেকে থাকে, তা এই মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরের অবদানেই। দরসের সময় কথায় কথায় হযরত মাদানীর আলোচনা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই চলে আসতো হযরতের মুখে। হযরত মাদানীর চিন্তা-চেতনা ও আখলাকই ছিলো তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন। দেওবন্দে থাকাকালে প্রতিদিন আসর বাদ হযরত মাদানীর মজলিসে তিনি নিয়মিত বসতেন। তবে চা আপ্যায়নের পর। কেননা আগ থেকে বসা থাকলে চা পান করতে হবে তাই চা পর্বের পরেই বসতেন। হযরত মাদানী তাঁর এই আশেক সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলেই হয়তো আহমদ করীম রাহ.-এর রুমের পাশ দিয়ে নামাযে যাওয়ার সময় বলতেন, আহমদ করীম! নামাযের সময় হয়ে গেছে।

হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরের দরস ছিলো জীবন্ত, মতন পড়া হচ্ছে এরই মধ্যে যেখানে প্রয়োজন মনে করতেন ঐ বিধানের উপর এক ঝলক বয়ান করে দিতেন। আর প্রয়োজন মনে না করলে মতন (হাদীসের আরবী পাঠ) চলতে থাকতো। শুধু মতন পড়ে ছবক শেষ হয়ে যেতো। আমরা যারা হুযুরের কাছে শরহে জামী পড়েছি তাদের মধ্যে ৮/১০ জন ছাত্র একটু বেশি মেধাবী ছিলো। তারা বা-দস্তুর অগ্রিম ছবক মুতালাআ করে আসতো। আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে, আমি সকালে পাক্কা দুই ঘণ্টা শুধু শরহে জামীর ছবকই মুতালাআ করতাম। কাফিয়ার বিভিন্ন শরাহ ও শরহে জামীর হাশিয়া সামনে রেখে এই মুতালাআ হতো। কিতাবের ১৬ আনার মধ্যে ১৫ আনাই আমরা অগ্রিম মুতালাআর দ্বারা হল করে আসতাম। (পরে জানতে পারলাম যে, অগ্রিম মুতালাআয় এতো গভীর মুতালাআ নাকি মতলুব নয়)। মতন কিন্তু হযরত নিজেই পড়তেন। হযরতের পড়ার সময় আমাদের মাথা নাড়ার অবস্থা ও ছবক বোঝার কাইফিয়্যাত হুযুর পুরোপুরিভাবেই বুঝে ফেলতেন। ফলে তাকরীরের প্রয়োজন খুব কমই অনুভব করতেন। যেখানে একতটু কঠিন মনে করতেন সেখানে অথবা আমরা কোনো এশকাল করলে তখন হযরতের তাকরীর শুরু হতো। যতক্ষণ তা বুঝে না আসতো ততোক্ষণ পর্যন্ত হুযুর বিভিন্নভাবে সহজ করে বিষয়টাকে বুঝিয়ে দিতেন। দাওরায়ে হাদীসের দরসও এভাবেই চলতো। তবে সেখানে তিরমিযীর তাকরীর হুযুর লেখাতেন। হুযুরের দরসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিলো যে, মাঝে-মধ্যেই আকাবির-আসলাফদের বর্ণাঢ্য জীবনের কোনো অংশ সম্পর্কে আলোচনায় নিয়ে আসতেন এতে আমাদের মধ্যে আসলাফের আযমত-ভক্তি সৃষ্টি হতো।

হেদায়েতুন্নাহু থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত আমার ওলামাবাজার মাদরাসায় অধ্যয়ন করার সৌভাগ্য হয়। তার পূর্বে চট্টগ্রাম মাজাহেরে উলূম মাদরাসা ও পটিয়া মাদরাসায় পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো। ওলামাবাজারের আমলী ফেযা আমাকে খুব আকর্ষণ করেছিলো। বিশেষ করে চার মুরব্বী অর্থাৎ বড় হুযুর আমার পরম উস্তায ও প্রথম শায়েখ হযরত মাওলানা আবদুল হালীম ছাহেব হুযুর রাহ. ও বর্তমান হুযুর সাইয়েদ আহমদ ছাহেব হুযুর দা. বা. এবং মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর ও আদীব ছাহেব হুযুরের আমলী নমুনা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আমার এখন মনে হয়, আমার জীবনের সবচেয়ে উত্তম সময়গুলো ছিলো ওলামাবাজারের অধ্যয়ন-কাল। এর আগে ও পরে এত উত্তম ভাব ও আমল আমার মধ্যে আর কখনো দেখতে পাইনি এবং এখনো দেখছি না।

মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর সবসময় বাড়ি থেকে এসে পড়াতেন। মাদরাসায় রাত যাপন করতেন না। হুযুরের নিয়ম ছিলো ফজরের পর এক-দেড় মাইল পথ পায়ে হেঁটে সহীহ বুখারী পড়ানোর জন্য মাদরাসায় চলে আসতেন। দুই ঘণ্টার মতো পড়িয়ে আবার বাড়ি চলে যেতেন। কিছু মুতালাআ করতেন তারপর গোসল করে খাবার খেয়ে দশটার আগেই আবার মাদরাসায় যেতেন। সকালে নাস্তা করতেন বলে মনে হয় না। বিকালেও না, শুধু দুই বেলা খাওয়ার ওপরই কেফায়েত করতেন বলে মনে হয়। এই নিয়ম তো হলো ঘরে খাবার কিছু মওজুদ থাকলে। নতুবা আমি পরে শুনেছি, হুযুর মাদরাসায় দরসে মশগুল হয়ে যেতেন। কিন্তু এতো হাস্যোজ্জ্বলভাবে পড়াতেন যে, দরসের কাউকে তা বুঝতে দিতেন না। হুযুর প্রথম দিকে পান খেতেন না, একদিন দেখলাম, একটু করে কাগজে পেঁচিয়ে বাড়ি থেকে খিলি বানিয়ে পান নিয়ে এসেছেন, আমরা দেখে হাসলাম। তো হুযুরও মুচকি হাসলেন মুখে কিছু বললেন না। আমি পান রাখার জন্য একটা কৌটার ব্যবস্থা করেছিলাম। পরে শুনেছি, কোনো ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময় হুযুর বাড়ি থেকে উপোষ চলে আসতেন। কিন্তু দরসে বসে এমনভাবে পান চিবাতেন, কারো বোঝার ক্ষমতা হতো না- হুযুর উপোষ। হুযুরের এ নিয়মের মধ্যে ৪০ বছর পর্যন্ত কোনো রকমের পরিবর্তন আসেনি। পরে বার্ধক্যের কারণে ফজরের পর আর আসতেন না। একসাথে খেয়ে নেয়ে সকাল ৯টার মধ্যে মাদরাসায় চলে আসতেন এবং দুপুরে মাদরাসায় খেতেন। আর মাগরিবের পর বাড়ি চলে যেতেন। আরো পরে কিছুটা দুর্বল হওয়ার পর রিক্সায় করে আসতেন আর মাগরিবের আগে আগে চলে যেতেন। হুযুর দীর্ঘদিন যাবৎ মাদরাসার নাযেমে তালীমাত বা শিক্ষাসচীব ছিলেন। মাঝখানে ১/২ বছর অসুস্থতার কারণে মনে হয় হুযুর একটু অন্যরকম হয়ে যান। মাদরাসায় আসতে চাইতেন না। জিজ্ঞাসা করলে দুর্বলতার কথা বলতেন। পরে আল্লাহর শোকর এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন।

হুযুরের শত শত গুণের মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক গুণ ছিল নিয়মানুবর্তিতা ও কানুনের ইহতেমাম। আইনের খেলাফ হুযুরকে এক চুলও নড়ানো যেতো না। আমার মনে আছে একবার আমার এক ভাগিনাকে ভর্তি করাতে ওলামাবাজার নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু আগের মাদরাসার ছাড়পত্র না থাকায় হুযুর তাকে ভর্তি করলেন না। আমি বর্তমান মুহতামিম ছাহেব হুযুরের সরণাপন্ন হলাম। হুযুর সুপারিশ করলেন, তবুও তিনি ভর্তি করলেন না। কেননা ছাড়পত্র ছাড়া ভর্তি করা ওলামাবাজার মাদরাসার আইনের খেলাফ।

হুযুর কখনো ছবক নাগাহ বা নষ্ট করতেন না। এমনকি যৌবনকালে বিয়ের দিনেও হুযুর ছবক পড়িয়ে সোনাগাজি গেছেন এবং বিয়ের কাজ সামাধা করে আবার মাদরাসায় এসে ছবক পড়িয়েছেন। হুযুর আমাদের মাদরাসার মজলিসে শুরার অন্যতম সদস্য ছিলেন। একবার মজলিসে শুরার তারিখ ঠিক করা হয়েছিলো শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের অন্য কোনো দিনে। হুযুরকে দাওয়াত দিতে গেলে হুযুর খুব রাগ করলেন এবং বললেন, মাদরাসার ছবক বাদ দিয়ে আমি কোথাও যাবো না। আপনারা শুক্রবার অথবা বৃহস্পতিবার বিকেলে করলেন না কেন? আমি বললাম, অন্যান্য হুযুরদের অপারগতার কারণে এই তারিখ করা হয়েছে। হুযুর কিছুই শুনলেন না। মাদরাসার কিছু সমস্যার কারণে ঐ বৈঠকে হুযুরের উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি ছিলো বিধায় আমি মুহতামিম ছাহেবকে বিষয়টি জানালাম। হুযুর বললেন, আমি তাঁর ছুটি মঞ্জুর করছি, তাঁকে যেতে বলেন। আমি হুযুরের ছুটি দেওয়ার কথা বলাতে আরো রেগে উঠলেন এবং বললেন, আমি কি কারো কাছে ছুটি চাচ্ছি? ছবক নাগাহ হওয়ার ভয়ে হুযুর কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন, আমি মাদরাসার চাকরি করি, শুরার চাকরি করি না। হুযুর শুক্রবারও মাদরাসায় চলে আসতেন এবং মাদরাসার মসজিদেই জুমার নামায পড়তেন। নিয়মানুবর্তিতা, সময়ের পাবন্দি ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরের মতো আর কাউকে দেখিনি।

হুযুর ছিলেন পুরা সুন্নাতের অনুসারী। প্রতিটি কাজে সুন্নতকে প্রাধান্য দিতেন। তাহাজ্জুদ, আউয়াবীন ও ইশরাক সব সময় পড়তেন। শেগাববন্ধ  লম্বা জামা ও লুঙ্গি পরিধান করতেন। নামাযের সময় পাগড়ি ব্যবহার করতেন। এমন সাদাসিধেভাবে চলতেন যে, বাইরের কেউ অথবা সাধারণ মানুষ হুযুরকে আল্লাহর ওলি মনে করার মতো কিছুই পেতো না। যতদূর আমল করতেন তা সবসময় করতেন। হুযুর অনেক সময় বলতেন-

الاستقامة فوق الكرامة

দেওবন্দে হুযুরের কয়েকজন বিশেষ বিশেষ উস্তায ছিলেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, শাইখুল আরব ওয়াল আজম, আওলাদে রাসূল হযরত মাওলানা সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ., শাইখুল আদব হযরত মাওলানা এজায আলী রাহ., শাইখুল মাকুলাত হযরত মাওলানা ইবরাহীম বলিয়াবী রাহ. ও হযরত মাওলানা নাসীরুদ্দিন রাহ.। মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরের দেওবন্দ থেকে আসার পরের বছরেই অর্থাৎ ১৯৫৭ ঈ. সনে হযরত মাদানী রাহ. ইন্তেকাল করেন। আমি সে বছর মাত্র মাজাহেরে উলূম দরাসায় ভর্তি হয়েছি, বয়স ছিলো আমার মাত্র ৯বছর।

আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর অনেক প্রাগ্রসর ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি বড় হুযুর হযরত মাওলানা আব্দুল হালীম ছাহেবের হাতে বাইআত ছিলেন। হযরত মাদানীর আশেক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কাছে মুরিদ না হয়ে হযরত মাওলানা আব্দুল হালীম সাহেব হুযুরের কাছে কেন মুরিদ হলেন?- এ ধরনের এক প্রশ্নের জবাবে মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর বলেন, দেওবন্দ যাওয়ার আগেই আমি হযরতের কাছে মুরিদ হই। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, হুযুর কাফিয়ার বছরই মুরিদ হন। দেওবন্দ থেকে আসার পর শিক্ষকতার জীবনে হযরতের সোহবত-সান্নিধ্যে থেকেই তিনি সুলুকের লাইনে উন্নতি লাভ করেন। ১৯৭১ সালে বড় হুযুর যখন পাকিস্তানে ১৪ মাস তাবলীগের সফরে ছিলেন তখন মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরকে খেলাফত দান করেন। তখন একবার ঢাকা থেকে বাড়ি এলে আমি ওলামাবাজার গিয়েছিলাম। দেখলাম, মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর বড় হুযুরের হুকুমে একটি যিকিরের মজলিস করতেন। তখন জানতে পারলাম যে, হযরতকে এজাযত দেয়া হয়েছে। এর পূর্বে অবশ্য বিশেষ এক কারণে মাওলানা আলী আসগর ছাহেবকে খেলাফত দিয়েছিলেন। সে হিসাবে বড় হুযুরের স্বতঃস্ফূর্ত প্রথম খলিফা আমাদের এই মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরই। মুহাদ্দেস ছাহেব হুযুর কিছু বাইআত করেছেন বলে জানা গেছে। তবে কাউকে খেলাফত দেননি।

বহু বছর পর্যন্ত মাদরাসার ফতোয়া বিভাগ আলাদাভাবে ছিলো না। বড় হুযুরের উস্তায আমাদেরও উস্তায হযরত মুফতী মুহাম্মাদ হাসান ছাহেব মুফতি ছাহেব হুযুর হিসাবে পরিচিত থাকলেও মাদরাসায় আগত সব ফতোয়া ফারায়েযের তাহকীক-তাদবীনের কাজ মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরই আঞ্জাম দিতেন। পরে মুফতী ছাহেব হুযুরসহ অন্যান্যদের কাছ থেকে দস্তখত নিয়ে নিতেন। বাংলা ভাষায় মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরের লেখা কয়েকখানা পুস্তকও ছাপা হয়েছিলো : ১. হযরত মাওলানা আব্দুল হালীম ছাহেবের সংক্ষিপ্ত জীবনী ২. তাকলীদ কী ও কেন ৩. তোহফায়ে রমাযান ৪. মোআমালাত ৫. কুরবানীর মাসায়েল ৬. আহকামে মাইয়েত ৭. নামায কীভাবে পড়বো (অনুবাদ) আর রহমতে আলম সা. নামে একটি সীরাতের বই ও হযরতের আত্মজীবনী প্রায় কম্পোজ অবস্থায় আছে।

বলা হয়, হযরতের সম্ভাব্য জন্ম তারিখ ১৯২৮/১৯২৯ সালের কোনো এক তারিখে । হযরতের আব্বাজানের নাম জনাব মুহাম্মাদ মুখলেছুর রহমানএবং আম্মাজানের নাম মোসাম্মাত আয়েশা খাতুন। তাঁরা খুব ধার্মিক ছিলেন। হযরত দেওবন্দ থাকার সময় ১৯৫২ সালে হযরতের আব্বাজান ইন্তেকাল করেন। আর দেওবন্দ থেকে আসার পর ১৯৫৯ সালে হযরতের আম্মাজান ইন্তেকাল করেন। হযরতসহ হযরতের ভাইয়েরা চারজন ছিলেন। তাঁর কোনো বোন ছিলো না। হযরত সকলের মধ্যে ছোট ছিলেন।

প্রথমে হযরতের বিবাহ হয় সোনাগাজি ফাযিল মাদরাসার প্রবীণ শিক্ষক হযরত মাওলানা তাজুল ইসলাম ছাহেবের বোনের সাথে। সে ঘরে আবু তায়্যেব, আবু তাহের ও আব্দুল্লাহ নামের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের জন্মের পর ঐ বিবি ছাহেবা ইন্তেকাল করেন। এরপর ওলামাবাজার মাদরাসার একেবারে পাশের বাড়ির ঢাকা মালিবাগ জামেয়ার স্বনামধন্য মুহাদ্দিস জনাব মাওলানা আবু সাবের মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ছাহেবের বোনকে বিয়ে করেন। সে ঘরে হযরতের চার ছেলে চার মেয়ে আছে। হযরতের ৭ ছেলের সকলেই আলেম এবং দ্বীনী খেদমতে নিয়োজিত আছেন। আর ৬ জামাতাও আলেম। হযরতের সম্ভাব্য জন্ম সাল অনুযায়ী হযরতের মৃত্যুর দিন ২৫ আগস্ট ২০১৬ ঈ. পর্যন্ত বয়স দাঁড়ায় প্রায় ৮৭/৮৮ বছর। মৃত্যুর দিন বৃহস্পতিবার হযরত নিয়মিত ছবক পড়িয়েছেন এবং আসরের পর একটি মজলিসে মাদরাসার কয়েকজন উস্তাযের সাথে কিছুক্ষণ কথাও বলেছেন। তারপর মাগরিবের পূর্বেই বাড়ি চলে যান। মাগরিবের পর প্রতিদিনের মামূল হিসাবে কুরআনে কারীম তিলাওয়াত করেন। এরপর এশার নামাযও পড়েন। এশার পর খাওয়ার মামূল হিসাবে পাওরুটি হরলিক্স আসতে একটু বিলম্ব হচ্ছিলো, এমতাবস্থায় কাশি আরম্ভ হয়। সাথে বমি এবং রক্ত দেখা যায়। এরই মধ্যে হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর কাউকে কিছু না বলেই মাহবুবে আলার ডাকে সাড়া দিয়ে চিরস্থায়ী আবাসের দিকে পাড়ি দেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। পরদিন ২৬ আগস্ট ২০১৬ ঈ. শুক্রবার সকাল ৯টায় ওলামাবাজার মাদরাসার প্রাঙ্গণে হাজার হাজার আলেম-ওলামার উপস্থিতিতে হযরতের নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। নামায পড়ান হযরতের দীর্ঘদিনের সহকর্মী আমার প্রিয় উস্তায শাইখুল হাদীস ওয়াল আদব হযরত মাওলানা নূরুল ইসলাম ছাহেব দা. বা.। উলামাবাজার মাদরাসা মসজিদের সম্মুখে অবস্থিত মাকবারায়ে হালীমিতে তাঁকে দাফন করা হয়। আল্লাহ পাক তাঁকে গরীকে রহমত করুন। আমীন 

 

 

advertisement