শাওয়াল ১৪৩৭   ||   জুলাই ২০১৬

নিরাপত্তা : শব্দের ভালোমন্দ

আবু তাশরীফ

একটি সতর্কতার খবর। প্রেক্ষাপট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দৃষ্টিভঙ্গি ও বিবেচনাও তাদের। কিন্তু মনে হয়েছে, এ খবরে আমাদের জন্যও শেখার কিছু বিষয় থাকতে পারে। ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকার ৭-এর পাতায় ছাপা হয়েছে ১৯ জুন। শিরোনাম : চরমপন্থী ভাবাদর্শ থেকে বাঁচতে মার্কিন কর্মসূচি। ওই খবরে দেখা গেছে, চরমপন্থী (তাদের ভাষায়) ভাবাদর্শের উত্থান ঠেকানোর জন্য কিছু মনোজাগতিক কর্মসূচি তারা হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ধর্মীয় শব্দ ব্যবহার না করার নির্দেশনা দেওয়া। এ নিয়ে একটি প্রতিবেদনও তৈরি করা হয়েছে।

ধর্মীয় শব্দ ব্যবহার না করার বিষয়ের ধরনটা কী? খবরে বলা হয়েছে, বারাক ওবামা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেশটির হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছে যে তারা যেন জিহাদ’, ‘শরীয়া’, ‘উম্মাহএবং এ জাতীয় শব্দ নেতিবাচক বিবরণে ব্যবহার না করে। তারা যেন আলোচনার সময় ইসলাম ধর্মকে প্রতিপক্ষ করে কথা না বলে। এমনকি চরমপন্থারঝুঁকি নিয়ে আলোচনার সময় সংশ্লিষ্টরা যেন তারাবনাম আমরাবলে বিভাজনের প্রাচীর দাঁড় না করায়। বরং সাধারণ আমেরিকান ইংরেজিতে তাদের সচেনতামূলক আলোচনা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিভেদমূলক অবস্থান কমিয়ে আনতে ওই প্রতিবেদনটিতে মার্কিন মুসলমানদের মুসলিম আমেরিকানবলার পরিবর্তে আমেরিকান মুসলিমকথাটি ব্যবহারেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

টুকটাক আরো কিছু প্রাসঙ্গিকতাসহ খবর তো ছিল এতটুকুই। এখানে লক্ষ করার মতো বিষয়গুলো কী? কথিত চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদ দমনে এরকম বিনয়ীকর্মসূচি নেওয়ার পেছনে কি কোনো উদার মানসিক অবস্থান কাজ করেছে? না কি এটাই এখন জানরক্ষার উপযোগী কৌশল? একটু ভেবে দেখলেই কয়েকটি জিনিস সামনে আসে। এক. সেই ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর থেকে মার্কিনীরা নিজেরা মুসলিম সমাজে বহু বহু রক্তপাত ঘটানোর পর কিছুদিন যাবত নিজেদের সমাজের মধ্যেই পাল্টা হামলার মুখে পড়ছে। গলাটিপে কোনো কষ্টের আগুন ও দ্রোহের শিখা তারা নেভাতে পারছে না। অস্ত্র ও হত্যা মার্কিনীদের নিরাপত্তার সমাধান দিচ্ছে না। একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে মেরে-শত্রু বানিয়ে, গাল দিয়ে দিয়ে নি-িদ্র নিরাপত্তার মধ্যে থাকা যায় না। এটা এখন তারা বুঝতে পারছে। এক ধরনের ডোনাল্ড ট্রাম্প-মার্কা খোলা উন্মাদতাদের সমাজে বাস করলেও তাদের বেশির ভাগ এখন জান বাঁচানোর কৌশলেরপক্ষে। তাই শব্দে শব্দে গাল এবং ইসলাম ধর্ম ও ধর্মের অনুসারীদের প্রতি বিষোদগার বন্ধ করার মরিয়া উপায় খুঁজছে তারা। অথচ আমাদের সমাজের কর্তাদের দেখা যাচ্ছে উল্টো অবস্থানে। নিজেদের পরিসরেই ধর্ম ও ধর্মানুসারী মানুষদের গায়ে পড়ে শত্রু বানানোর মহড়া দিয়ে বিজয়ীর ভাব ধরছেন তারা। এ সমস্যা দিন দিন যেন আরো প্রকট হচ্ছে। 

দ্বিতীয়ত মার্কিনীদের এই নির্দেশনা থেকে এ-ও বোঝা যায়, ক্ষমতাসীনদের উসকানি কোনো কার্যকরী ঔষধ নয়। কোনো প্রতিবাদ, কোনো উত্তেজনা কিংবা ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে শাব্দিক উসকানিও মারাত্মক অবমাননাকররূপে এবং বাড়তি উত্তেজনা সৃষ্টিকারী হিসেবে কাজ করে। ক্ষমতা ও শক্তির চেয়ার থেকে উসকানিমূলক শব্দের ঢালাও ব্যবহার যে-কোনো সম্প্রদায়ের সবাইকে কমবেশি আহত করে। এটা বন্ধ না করলে শত্রু-নয় লোকও শত্রুতে পরিণত হয়। এতে নিরাপত্তার ঝুঁকি আরো বাড়ে। ধমক ও গালাগাল দিয়ে সবকিছু বন্ধ করা যায় না। এটা এখন তারা বুঝতে শুরু করেছেন। তৃতীয় বিষয়টি অবশ্য মুসলিম সর্ব সাধারণের সতর্কতার জন্য সহায়ক। এ নির্দেশনা দেখলে এটা বেশ স্পষ্টতই বোঝা যায়, আমেরিকান কর্তাদের চোখে ইসলাম ও মুসলমানদের অবস্থানটা কী? তারা শব্দের মারপ্যাঁচপ্রকাশ্যে কিছুটা কমাতে চাইলেও ভেতরে ভেতরে কতটা বিভেদপোষণ করেন। মনেপ্রাণে বিদ্বেষ ও বিভেদ জমিয়ে রেখেও শত্রুতা ভোঁতা করার জন্য কিছু শাব্দিকপদক্ষেপ তারা এভাবে নিলেন। এতে তাদের চেহারা আরো স্পষ্ট হলো। মুসলমানদের চিন্তা ও বোধেও মার্কিনী ও পশ্চিমা প্রশাসনের প্রতি মূল্যায়নে কিছু সতর্কতার উপলক্ষ সামনে এল। এ থেকে ধোঁকা না খাওয়ার পাঠগ্রহণই বড় বিষয় হতে পারে।

চরমপন্থী ভাবাদর্শহচ্ছে তাদের শব্দ। এ থেকে বাঁচার কর্মসূচিটিও তাদের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রজন্মের মুসলমানদের মাঝে প্রয়োগের জন্য এ কর্মসূচি। চরমপন্থী’ ‘উগ্র- এসব শব্দ দিয়ে তারা কী বোঝাতে চান এবং কাকে ঘায়েল করতে চান- এটা এখন প্রায় সব শ্রেণির মুসলমানই বুঝেন। তাদের বক্তব্য ও শব্দের স্বরূপ নিয়ে এখানে লেখার ইচ্ছে নেই। এখানে প্রধানত আমরা বুঝতে চেয়েছি, এতদিন পর তারা শব্দ প্রয়োগে কিছুটা সাবধানীহতে চাইছেন কেন? আর তারা যদি বুঝেশুনে এমন সাবধানীপথ ধরেই থাকেন তাহলে আমাদের সমাজের কর্তা-সুশীলেরা উল্টোপথে কেন হাঁটছেন? আমাদের কর্তাবাবুরা কি একটু বেশি বুঝছেন? আমাদের কর্তাদের শব্দজ্ঞান কি একটু বেশি টনটনে? জঙ্গিবাদ খুঁজতে গিয়ে মসজিদ মাদরাসা, দাড়ি, টুপি, হিজাব, পাঠ্যবই সিলেবাস-সবকিছুর মধ্যে তারা ঢুকে পড়তে চাচ্ছেন কেন? ‘পনের জনেরসমস্যায় আমাদের বাবুরা কি ১৫ কোটি মুসলমানের বিশ্বাস ও চেতনা গলাটিপে মেরে ফেলতে চান? সময় বলে দেবে- এখানেও কত শব্দের ব্যবহারে রদবদল ঘটাতে হবে! সময় বলে দেবে- এখানেও কত বিভেদের প্রাচীর ভাঙতে হবে!!

সে সময়ের আগ পর্যন্ত তো কেবলই উত্তম দর্শক!

 

 

 

advertisement