রবিউল আখির ১৪৩১   ||   এপ্রিল ২০১০

নারীঃ ইডেনের সাপ চিনতে হবে

আবু তাশরীফ

ইডেন কলেজ ঢাকার একটি নামকরা মহিলা কলেজ। এ কলেজের ছাত্রী নিবাসে গত ১৩ মার্চ একটি ছাত্র সংগঠনের দু’ গ্রুপে তুমুল মারপিট হয়। বেশ ক’জন আহতও হয় তাতে। এরপর দু’গ্রুপের বিরুদ্ধে দু’গ্রুপ যে অভিযোগ উঠায় তার প্রথম দিকে ছিল ভর্তিবাণিজ্য ও সিটবাণিজ্যের কথা। এটি ছিল ঘটনার কেঁচো। এ ঘটনায় কেঁচোর পেছনে পেছনে বিষধর ফনা উঠানো সাপের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় পরের দিনের পত্রপত্রিকায়। অভিযোগের তালিকায় দেখা যায় ইডেনের ছাত্রী নেত্রীরা যেসব ছাত্রীদের ভর্তি করতে ও সিট পেতে প্রভাব খাটিয়ে ব্যবস্থা পাকাপাকি করেন, তাদের একটি বড় অংশকেই তারা সংগঠনের উঁচুপদের নেতা, মূলদলের তরুণ সংসদসদস্য ও প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য পাঠিয়ে থাকেন। এ অভিযোগ উভয় গ্রুপই উভয় গ্রুপের বিরুদ্ধে উঠিয়েছে এবং গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। এ সংগঠনটি আবার বর্তমান সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন হিসেবে পরিচিত। এরপরের ঘটনা প্রায় সবারই জানা। এ বিষয়টি নিযে বেশ কয়েকটি মানববন্ধন হয়েছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সংগঠন ছাত্রীদের এভাবে ব্যবহার করার জন্য তদন্তপূর্বক দায়ীদের শাস্তি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি সংগঠন প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। সর্বশেষ তথ্য হল, ইডেন কলেজ থেকে বহু ছাত্রীকে তাদের অভিভাবকরা কলেজ পরিবর্তন করে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ইডেনের ছাত্রীদের জীবন, যৌবন ও সম্ভ্রম নিয়ে কুৎসিত খেলায় লিপ্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। এদেশে নারী অধিকার, নারীর নিরাপত্তা, নারীর সম্ভ্রম ও মর্যাদা নিয়ে উঁচু গলায় কথা বলা লোকের সংখ্যা দেখছিলাম দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু ইডেন-ঘটনার পর সেসব উঁচুগলা-লোক ও সংগঠনের কাউকে সরব হতে দেখা যায়নি। মিডিয়াগুলোতে নারী ইস্যু নিয়ে ইদানীং অনেক বাড়তি সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছিল। অথচ ইডেনের তরুণী ছাত্রীদের দিয়ে সরকারি দলের নেতা-কর্মী, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মনোরঞ্জন করানোর অভিযোগ উঠার পর প্রভাবশালী মিডিয়াগুলো যেন চুপসে গেছে। সুশীল কলমজীবী ও বুদ্ধি বণিকরাও মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তারা এ বিষয়টা নিয়ে সময় ‘নষ্ট’ করতে চান না। ভাবখানা এমন যে, তারা এ বিষয়টি চেপে যেতেই যান এবং চাপা দিতে পারলে খুশি হন। বিষয়টি বড় বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। নারীর জীবন-বিনাশী এত বড় সর্বনাশা ধারাবাহিক ঘটনার বিচার ও শাস্তি হলে ছাত্রীদের মাঝে সংগঠনের নামে তাদের সম্ভ্রম লুটের দরজা বন্ধ হওয়ার উপায় বের হতো। এভাবে বিপুল সংখ্যক নারীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখা যেত। এটা কি পক্ককেশ সুশীল আর চেতনা সৃষ্টিকারী মিডিয়ার কর্ণধাররা বুঝেন না? তারপরও তাদের নিরবতা ও দায়সারা ভূমিকার তাৎপর্য কী? ইডেন যদি কোনো মহিলা মাদরাসা হতো, সেখানে যদি এ ধরনের অভিযোগের এক দশমাংশও উচ্চারিত হতো, তাহলে কী করতেন সুশীল পণ্ডিত আর মিডিয়ার কর্ণধাররা? চুপ থাকতেন? কিংবা ইডেনেই যদি কোনো শালীনতাবাদী ধর্মপ্রাণ শিক্ষিকা কোনো একজন-দু’জন তরুণীর উচ্ছৃংখ্যলতামুখি চালচলনে নিয়ন্ত্রণ আরোপের অভিভাবকসুলভ সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করতেন তাহলে কি প্রভাবশালী মিডিয়াগুলোর ‘নারীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ’ এবং ফতোয়া শুরু হয়েছে ইডেনে’ বলে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলতেন না? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। পাঠকমাত্রই জানেন, তখন কী হতো অবস্থা। প্রশাসন, মিডিয়া, সুশীল আর এনজিও ওয়ালারা একসঙ্গে নাচানাচি শুরু করতেন। নারীর মর্যাদা রক্ষার নামে এই বদ প্রবণতাকেই আমরা ঘৃণা করি। যেখানে নারীর জীবন প্রকৃত অর্থেই বিপন্ন সেখানে নীরব থেকে যেখানে নারীকে পুঁজি করলে ইসলামী অনুশাসনকে গালাগালি করা যায় সেখানে সক্রিয় হওয়ার মানেই এই সক্রিয়তা মতলবী। নারীর জন্য এতে কোনোই কল্যাণ নিহীত নেই। ইডেনের ঘটনা আসলে একটি বিষধর সাপকেই সামনে আনেনি। এতে পাশাপাশি থাকা দুটি বিষধর সাপের অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল। এর একটি হচ্ছে, সংগঠনের নামে ছাত্রীদেরকে এদেশে এখন নেতাদের কাছে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নারীর জীবন যতই বিপন্ন হোক, এদেশে নারীর অধিকার নিয়ে গলা ফাটানো পরজীবীরা ধর্মকে গালি দিতে না পারলে সক্রিয় হবে না। এদেশে নারী অধিকারবাদীদের বেশির ভাগই নারীর শত্রু। এসব শত্রুতার ক্ষেত্র ও শত্রুদের মুখ চিনে নারীসমাজ ও সচেতন দেশবাসীর পদক্ষেপ ঠিক করতে হবে। ইডেনে কেঁচোর সঙ্গে বেরিয়ে আসা সাপের বিষদাঁত তবেই উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে।

 

advertisement