রজব ১৪৩৭   ||   এপ্রিল ২০১৬

লক্ষ্য যার আখেরাত

আবু সালেহ মোহাম্মাদুল্লাহ

ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়ায় সকলেই যার যার কাজে ব্যস্ত। নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে সবাই। প্রত্যেকের চলার গতি ভিন্ন। বৈচিত্রময় গতিতে নিজ গন্তব্য পানে ছুটে চলেছে প্রত্যেকেই। যার লক্ষ্য যত গুরুত্বপূর্ণ, সে তত গুরুত্ব দিয়ে লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাচ্ছে।

একজন ছাত্র নামায শেষ করে দ্রুত মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেল। কারণ সামনে তার পরীক্ষা। তার চলার ধরন দেখলেই অনুমান করা যায়, গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা তার সামনে। বাড়িতে মেহমান আসে। সকলে মিলে গল্প করে। আনন্দ-ফূর্তি করে। কিন্তু সে ছাত্র উপস্থিত থাকে না। মেহমান জানতে চায়Ñ সে কোথায়? সকলে বলে, সামনে তার গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা, সে তার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অথচ তারও সবার সাথে সময় কাটাতে মনে চায়। কিন্তু সে ভাবে, মেহমানের সাথে গল্প-গুজব আমার পরীক্ষার কোনো কাজে আসবে না। পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভর করবে আমার ভবিষ্যত। তাই যত ত্যাগ-ই স্বীকার করতে হয় আমি প্রস্তুত। আমি আমার ভবিষ্যতকে নষ্ট করব না।

অনুরূপভাবে আরেকজন ব্যাগ হাতে দৌড়ে ছুটে যাচ্ছে। একটু হাঁটে, আবার দৌড় দেয়। তার চলার গতি সবার থেকে ভিন্ন। তার পথচলা দেখলেই বোঝা যায়, কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে সে ব্যস্ত। অন্যরা গল্প করতে করতে পথ চলছে। কিন্তু সে চলছে ভিন্ন গতিতে। কারণ তার ট্রেন ছাড়তে মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। অসতর্কতা বশত দেরি হয়ে গেলে ট্রেন চলে যাবে। তার টিকিটের টাকা নষ্ট হবে। জরুরি মিটিং ছুটে যাবে। তার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।

ঠিক তেমনি অল্প দিনের এই দুনিয়ায় কারো কারো জীবন-পথের চলার গতি থাকে একটু ভিন্ন। জীবনের রং হয় একটু ভিন্ন প্রকৃতির। তার প্রতিটি কাজ-কর্মে বুঝে আসে, সে খুবই গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনে ছুটে চলেছে। তার জীবনের লক্ষ্য আখেরাত। সে গল্প-গুজবে, অনর্থক কাজে মূল্যবান সময় নষ্ট করে না।  খেল-তামাশা, ফূর্তি-ফার্তা, অন্যায়-অশ্লীলতা আর সমাজের ¯্রােতে গা ভাসিয়ে দেয় না। কারণ সে জানে, আজকের এই উৎসব আমার পরকালে কোনো কাজে দেবে না। পথ চলার সময় রাস্তার মাঝে বড় পর্দায় কোথাও কোনো মন মাতানো দৃশ্য দেখানো হচ্ছে, নাচ-গান চলছে, কিন্তু সে তার ধারে কাছেও ঘেঁষে না। অন্য পথ দিয়ে চলে যায়। কারণ সে জানে এতে আমার আখেরাত বরবাদ হবে। সুতরাং লক্ষ্য যার আখেরাত, সে আপন গন্তব্য ও লক্ষ্যপানে ছুটে চলে দুর্বার; সকল প্রতিকুলতা ও লোভ লালসাকে পিছে ঠেলে।

সে ভাবে, একজন ছাত্রের সামনে পরীক্ষা যত গুরুত্বপূর্ণ, একজন পথিকের কাছে টিকিট ও মিটিং যত মূল্যবান, এর চেয়ে আমার গন্তব্য অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পরীক্ষার্থীর জন্য আবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর পথিকের টিকিটের দামই বা কত! মিটিং ছুটে গেলে মিটিংয়ের তারিখ পাল্টানো যায় বা আবার মিটিং করা যায়। অথচ আমার গন্তব্যের সাথে সম্পর্ক অনন্তকালের। এর ফলাফলের সাথে সম্পর্ক জান্নাতের। তাছাড়া এক্ষেত্রে সুযোগ মাত্র একবার; যতদিন আমি দুনিয়াতে বেঁচে আছি ততদিন। হায়াত ফুরিয়ে গেলে আর দ্বিতীয়বার সুযোগ দেওয়া হবে না। কাজেই আমাকে লক্ষ অর্জনে আরো বেশি পরিশ্রমী হতে হবে, আরো বেশি সতর্ক হতে হবে।

যে শুধু দুনিয়ার পিছে ছোটে তার লক্ষ্য একদিকে যেমন ক্ষণস্থায়ী কিছু অর্জন করা, তেমনি লক্ষ অর্জনে সে কতটুকু সফল হবে তাও অনিশ্চিত। হতে পারে লক্ষ্য অর্জনের আগেই তার ইন্তেকাল হয়ে গেল। বা সে তার লক্ষ্য অর্জন করলেও নিজে ভোগ করতে পারবে কি না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর আখেরাতের পাকড়াও তো আছেই। পক্ষান্তরে যে আখেরাত চায় তার লক্ষ্য যেমনিভাবে চিরস্থায়ী, তেমনি ইখলাসের সাথে মেহনত করলে তার সফলতাও সুনিশ্চিত। সে যে বয়সেই ইন্তেকাল করুক সে সফল। আর সে এর ফল ভোগ করবে অনন্তকাল; যার শুরু আছে শেষ নেই।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

وَمَنْ أَرادَ الْآخِرَةَ وَسَعى لَها سَعْيَها وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولئِكَ كانَ سَعْيُهُمْ مَشْكُوراً.

অর্থ : আর যারা মুমিন হয়ে আখেরাত চায় এবং এর জন্য যথাযথভাবে চেষ্টা করে, তাদের চেষ্টা পুরস্কারযোগ্য। Ñসূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ১৯

সমাজ চলছে এভাবে, সমাজের লোকজন ছুটছে ওদিকে, আমি কি আর ভিন্ন হয়ে থাকতে পারি! অনেকে আবার সমাজের দোহাই দিয়ে বলেন, সমাজটা চলছে এভাবে। আমি কী করব? আমার কী দোষ!

হাঁ, আমি যদি কখনো লঞ্চে কোথাও যাই। আর লঞ্চ ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয় এবং আমার কোনোভাবে বেঁচে যাওয়ার সুযোগ থাকে। তাহলেও কি আমি বলব, না, সকলেই যেহেতু ডুবে যাচ্ছে, আমার আর বেঁচে থেকে লাভ কী! আমিও সকলের সঙ্গ দেই। আমিও সবার সাথে ডুবে মরি।

না, একথা কখনোই আমি বলব না। আমি ভাবব, সকলে ডুবে গেলেও আমাকে তো প্রাণে বাঁচতে হবে। যে কোনো উপায়েই হোক আমার প্রাণ নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। কারণ আমার কাছে আমার প্রাণের মূল্য অনেক।

অনুরূপ আমার কাছে যদি আমার ঈমানের মূল্য থাকে তাহলেও আমি বলব, যে যা ইচ্ছা করুক, সমাজ যেদিকেই যাক, আমাকে তো আমার ঈমান রক্ষা করতে হবে। যে কোনো উপায়েই হোক আমার আখেরাতনষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।

প্রাণ তো একদিন না একদিন যাবেই। তা রক্ষা করার জন্য যদি এত প্রচেষ্টা, এত দৌড়ঝাঁপ তাহলে ঈমান রক্ষার জন্য কি আরো বেশী যতœবান হওয়া উচিত নয়! আখেরাত সুন্দর করার জন্য কি আরো বেশী সচেষ্ট হওয়া জরুরি নয়!

যার জীবনের লক্ষ্য আখেরাতের সফলতা তার জীবন কত সুন্দর! কত ঈর্ষণীয়! কত সাফল্যমণ্ডিত!

আমরা কি এমন সুন্দর একটা জীবন কামনা করতে পারি না। আমরা কি পরকালের সফলতাকে আমাদের জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে পারি না। আসলে সমাজ যেদিকেই যাক, যে যাই বলুক, আমার চেষ্টা থাকবেÑ আমার আখেরাত যেন সুন্দর হয়। আমার আল্লাহ যেন আমার উপর নারায না হন, তিনি যেন আমার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। তবেই আমাদের জীবন সুন্দর হবে, আমি সফল হব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে এমন সুন্দর একটি জীবন অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমীন। 

 

 

advertisement