রবিউল আখির ১৪৩১   ||   এপ্রিল ২০১০

মুফতী নূরুল্লাহ রাহ.: কিছু স্মৃতি

মাওলানা তাহমীদুল মাওলা

হযরত মাওলানা মুফতী নূরুল্লাহ রাহ. ১৯৩০ খৃষ্টাব্দে নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানাধীন মধ্যনগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুনশি আবদুল আজীজ ও দাদার নাম আবদুল মজিদ। ছোটবেলায় মা ও দাদীর কাছে কুরআন শিক্ষা করেন এবং নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর ব্রাক্ষণবাড়িয়ার জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়ায় এসে ভর্তি হন। জামিয়া ইউনুছিয়া বাংলাদেশের একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক মাদরাসা, যা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯১৪ সালের এক সংকটময় মুহূর্তে। এটি প্রায় ৯৬ বছর কালব্যাপী দেশের একটি বিখ্যাত দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। হযরত মুফতী সাহেব রাহ. অত্র জামিয়ায় শরহে বেকায়া জামাত পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে লেখাপড়া করেন। জামিয়ার মুহতামিম ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম সাহেব রাহ., মুফতী রিয়াযত উল্লাহ সাহেব প্রমুখ উস্তাদদের সাথে গড়ে উঠেছিল তাঁর সুগভীর সম্পর্ক। মেধা, একনিষ্ঠা ও সুন্দর আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। আপন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার গভীর ভালবাসা আর শ্রদ্ধা ছিল। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা আজও মনে পড়ে। মুফতী সাহেব হুজুর একদিন বলেছিলেন, একবার আমার এক সহপাঠী জামিয়া ইউনুছিয়া ছেড়ে হাটহাজারী মাদরাসায় চলে গেল। মনে মনে আমারও ইচ্ছা জাগছিল। ভাবছিলাম, আগামী বছর চেষ্টা করব। কিছুদিন পর সে আমাকে চিঠি লিখল-নূরুল্লাহ, তোমার যদি ইলম পাওয়ার ইচ্ছা থাকে তাহলে তাড়াতাড়ি এখানে চলে এস। আর যদি ইউনুছিয়ার পুকুর-ঘাটায় ঘষে ঘষে পা ক্ষয় করার ইচ্ছা থাকে তাহলে সেখানেই পড়ে থাক। পত্র পাওয়ার পর আমি হাটহাজারী যাওয়ার ইচ্ছা পুরোপুরি বাদ দিলাম এবং তাকে লিখলাম, আমার হাটহাজারী যাওয়ার কোনো শখ নেই। এখানকার ঘাটেই পা ঘষতে চাই। আমি এমন ঘষা দেব, যেন আমার অন্তর পর্যন্ত পরিষ্কার হয়ে যায়। জামিয়ার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেয়েছিল। কিছুদিন পর অসুস্থতার কারণে সে আর পড়তে পারেনি। কদিন পর আবার আমার মনে দেওবন্দ যাওয়ার ইচ্ছা জাগল। কিন্তু প্রাণপ্রিয় উস্তাদগণের নিকট থেকে কী বলে বিদায় নেব ভেবে পাচ্ছিলাম না। বিশেষ করে হযরত ফখরে বাঙ্গাল এর কাছে বিদায় চাওয়াটা আমার কাছে অত্যন্ত কঠিন মনে হচ্ছিল। পরে হযরত যখন জিজ্ঞাসা করলেন, দেওবন্দ যেতে চাচ্ছ কেন? আমি সবিনয় আরজ করলাম, হুজুর, আল্লাহ তাআলা আমার রিজিকে যে পরিমাণ ইলম রেখেছেন তাই তো পাব। তবে আমার মনে হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানী রাহ.কে দেখার সাধ ছিল। শুনেছি, তিনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তাঁকে দেখার ইচ্ছা। আর কিছু না। একথা শুনে হযরত ফখরে বাঙ্গাল হাসিমুখে আমাকে অনুমতি দিয়ে দিলেন। মুফতী সাহেব রাহ. শায়খ আবদুল হক গাজীনগরী, মাওলানা আবদুর রহমান শায়খে ধুলিয়া প্রমুখ সাথীদের এক কাফেলার সাথে দারুল উলূম দেওবন্দে গমন করেন। সেখানে সুনামের সাথে লেখাপড়া করেন এবং দাওরায়ে হাদীস ও ফুনূনাত সমাপ্ত করেন। শায়খুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী ও শায়খুল আদব ইযায আলী রাহ.-এর সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দেওবন্দে অবস্থানকালে মাদানী রাহ.-এর পারিবারিক মসজিদে ইমামতি করতেন। মুফতী সাহেবের পুরো জীবনের কথা-বার্তায়, আচরণ-উচ্চারণে সেই সোহবত-সাহচর্যের প্রভাব লক্ষ করা যেত। এছাড়া মাওলানা ইদ্রীস কান্দলভী রাহ., মাওলানা গোলাম রাসূল খান রাহ. প্রমুখ প্রতিভাধর আকাবিরে দেওবন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণে ধন্য হয়েছেন। দারুল উলূম দেওবন্দে অধ্যয়নরত অবস্থায় তাঁর উস্তাদ ও মুরব্বী জামিয়া ইউনুছিয়ার মুহতামিম ফখরে বাঙ্গাল রাহ. তাকে চিঠি লিখলেন যে, ‘দেশে ফিরে তোমার কর্মস্থলের ব্যাপারে আমার সাথে কথা বলা ব্যতীত কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিবে না। পরবর্তীতে মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা শামছুল হক ফরীদপুরী রাহ. তাঁকে লিখলেন, ‘ঢাকার লালবাগ মাদরাসায় উচ্চতর বিভাগে তোমাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ইচ্ছা করেছি। তুমি ফেরার পথে অন্তত আমার সাথে দেখা না করে যাবে না।’ কিন্তু ফখরে বাঙ্গাল রাহ.-এর সাথে দেওয়া পূর্ব-প্রতিশ্রুতির কারণে মুফতী সাহেব তাঁর দাবি পূরণ করতে পারেননি। দেশে ফেরার পর থেকেই জামিয়া ইউনুছিয়ায় শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে অনিবার্য কারণবশত কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদিয়ায় শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেশবরেণ্য আলেমে দ্বীন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ দা.বা. তাঁর ঐ সময়কার ছাত্র। সেখানে তাঁর একজন সঙ্গী ছিলেন শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ দা.বা.। হযরত মুফতী সাহেব রাহ. দেওবন্দে অবস্থানকালীন সময়ের শেষ দিকে কাজী মুতাসিম বিল্লাহ সাহেব দা.বা. দেওবন্দে আসেন এবং তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ও সখ্যতার সৃষ্টি হয়। হকের ঝাণ্ডাবাহী সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত শায়খুল ইসলামের এ দুই শাগরেদ ও সৈনিককে আমরা সবসময়ই দেখেছি পরম বন্ধুত্বের জালে জড়ানো। আল্লাহ পরকালেও তাঁদের এ বন্ধন অটুট রাখুন। জামিয়া ইমদাদিয়ার মুহতামিম মাওলানা আতহার আলী রাহ.-এর সাথেও তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল। হযরত মুফতী সাহেব রাহ. একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি লেখাপড়া কিছুই করিনি। সম্পূর্ণ অযোগ্য একটা লোক। তবে আমার দুইটা সনদ আছে : একটা হল ঐ কবরওয়ালা (ফখরে বাঙ্গাল) বলেছিলেন, ‘নূরুল্লাহর ইলমের উপর আমার আস্থা আছে।’ আর অপরটি হল, যখন আমি জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে চলে আসি তখন মাওলানা আতহার আলী রাহ. আমাকে লেখা একটি চিঠিতে বলেছিলেন, তোমার সাথে আমার অন্তরের মহব্বত রয়েছে!’ ব্যস্। এ দু’টিই আমার পুঁজি। অবশেষে তিনি ফখরে বাঙ্গাল রাহ.-এর ডাকে পুনরায় জামিয়া ইউনুছিয়ায় চলে আসেন এবং উচ্চস্তরের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পান। এখানে সুদক্ষ আসাতিযার নিবিড় তত্ত্বাবধানে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করে চলেন। এদিকে ব্রাক্ষণবাড়িয়া শহরের অতি প্রাচীন ও প্রধান জামে মসজিদের পূর্বের ইমাম মাওলানা হাবীবুর রহমান সাহেবের ইন্তিকালের পর মুফতী সাহেব হুজুর রাহ. ইমাম ও খতীব হিসাবে দায়িত্ব পান। মসজিদটি সেখানে ‘বড় মসজিদ’ ও পার্শ্ববর্তী সড়কটি ‘মসজিদ রোড’ নামে খ্যাত। মসজিদ সংলগ্ন একটি অতি সাধারণ টিনের ঘরে হুজুর সপরিবারে থাকতেন। ইন্তিকাল পর্যন্ত তাঁর অবস্থা এমনই ছিল। ১৯৭৪ ঈ. সনে মুফতী সাহেব রাহ. একটি আশ্চর্য স্বপ্ন দেখলেন। তিনি দেখেন, বি.বাড়িয়া জেলা ঈদগাহ মাঠে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম উপস্থিত। নবীজি মিম্বরে উপবিষ্ট এবং বলছেন, ‘মুফতী রিয়াযত উল্লাহর জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি আসার পর দুআ হবে।’ মুফতী রিয়াযত উল্লাহ রাহ. ছিলেন ইউনুছিয়ার প্রধান মুফতী। বড় হুজুর মাওলানা সিরাজুল ইসলাম সাহেব রাহ.কে স্বপ্নবৃত্তান্ত বলার পর তিনি বুঝতে পারলেন যে, মুফতী রিয়াযত উল্লাহ সাহেবের পর মুফতী নূরুল্লাহ সাহেব তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন। তাই হল। পরবর্তীতে ইউনুছিয়ার প্রধান মুফতী হিসাবে ফতোয়া প্রদানের গুরুদায়িত্ব তাঁরই কাধে অর্পিত হয়। বড় হুজুর মাওলানা সিরাজুল ইসলাম সাহেব বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় মাদরাসা পরিচালনার সকল দায়িত্ব অঘোষিতভাবেই হযরত মুফতী সাহেবের উপর এসে পড়ে। ২০০২ ঈ. সনে বার্ধক্য ও অসুস্থতাজনিত কারণে বড় হুজুরের প্রতিনিধি হিসেবে পূর্ণ বুখারী শরীফ পড়ানোরও দায়িত্ব পান। তারপর ১৬ ডিসেম্বর ২০০৬ ঈ. শনিবার বড় হুজুরের ইন্তিকালের পর জামিয়ার শায়খুল হাদীস ও মুহতামিমের দায়িত্ব তাঁকে গ্রহণ করতে হয়। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এ গুরুদায়িত্ব অত্যন্ত যত্নের সাথে পালন করেছেন। হযরতের বহুমুখী বিস্তৃত বর্ণাঢ্য জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা আমাদের ভবিষ্যতের চলার পথে পাথেয় জোগাবে। উপযুক্ত ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার জোর আবেদন রইল। তবে অতি সংক্ষেপে আমার সামান্য অভিজ্ঞতার আলোকে দু’একটি বিষয়ে কিছু বলার প্রয়াস পাচ্ছি। বিনয় ও নম্রতা তাওয়াজু ও বিনয় ছিল হযরতের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সর্বোত্তম দিক। যে একবার তাঁকে দেখেছে সে এটা স্বীকার করতে বাধ্য। প্রকৃত অর্থেই নিজেকে সবসময় তুচ্ছ-জ্ঞান করতেন। শত্রু-মিত্র, ভক্ত-হিংসুক যেই তার কাছে আসত তার স্নিগ্ধ আচরণে মুগ্ধ হয়ে যেত। নিজেকে প্রকাশ করার সামান্যতম প্রবণতাও তার মাঝে ছিল না। এমনকি নিজ মাদরাসার বিশেষ বড় কোনো অনুষ্ঠানে পর্যন্ত কথা বলতে চাইতেন না। উস্তাদ আর মুরব্বীদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ও বিনয়। একটি ঘটনা মনে পড়ে। ২০০২ ঈ. সনে মুফতী সাহেব হজ্বে যাবেন। বড় হুজুর মাওলানা সিরাজুল ইসলাম সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য দফতরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। বড় হুজুর চারজানু হয়ে বসা ছিলেন। মুফতী সাহেব হুজুর তাঁর কাছে এলেন এবং বড় হুজুর তাঁকে দুআ করে দিলেন। তবুও যখন মুফতী সাহেব তাঁর নিকট বসে রইলেন তখন বড় হুজুর তার সাথে এমন একটি স্নেহপূর্ণ আচরণ করলেন যে, উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেল। এরপর তিনি সেখান থেকে উঠে আসলেন। হুজুরকে আগে সালাম দেওয়া ছিল খুবই কঠিন ব্যাপার। ছোট বড় সবাইকে আগে সালাম দিতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন-যারা আমাকে কোনো দুঃখ দিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে বা ভবিষ্যতে দিবে তাদের সকলকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। আমিও ক্ষমা চাই। বলতে বলতে তাঁর গলার স্বর নরম হয়ে আসত। ইলম ও প্রজ্ঞা মুফতী সাহেব হুজুর ছিলেন গভীর ইলম ও প্রজ্ঞার অধিকারী। কিন্তু তাওয়াজু ও বিনয়ের চাদরে আবৃত তাঁর এ প্রতিভা ও গভীরতার সন্ধান পাওয়া আমাদের জন্য ছিল বড়ই দুষ্কর। একদিন হযরতকে জিজ্ঞাসা করলাম, হুজুর! এই অসুস্থতা নিয়েও বুখারী পড়াতে পারছেন? বললেন, আমি কি আর পড়াই? ছাত্ররা পড়ে, আমি কেবল শুনে যাই। মাঝে মাঝে সাহারানপুরী রাহ.-এর হাশিয়ার সহযোগিতা নেই। শুনেছি, হযরত যৌবনে সারাক্ষণ অধ্যয়নে মগ্ন থাকতেন। রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অতি সামান্য সময় বিশ্রাম নিতেন। তাও জামিয়ার পুরাতন বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায় মিনারের নিচে একটা ইটের উপর মাথা রেখে। হযরতের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় বিভিন্ন বিষয়ের উপর যে পরিমাণ কিতাব দেখেছি, জামিয়ার কুতুবখানায়ও সে পরিমাণ কিতাব দেখিনি। হুজুরের শেষ জীবনে ‘মাশায়েখে চিশত’ নামে বাঙলায় একটি বই লিখেছেন, যাতে চার সিলসিলার পীর-মাশায়েখদের পরিচিতি এবং তাসাওউফ-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা সন্নিবেশিত হয়েছে। তাঁর জীবদ্দশাতেই এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়েছে। তাছাড়া মিশকাত জামাতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ‘ইকলীলুস সু’আদা ফী যিকরি তাজিল ওলামা’ আরবীতে ফখরে বাঙ্গাল রাহ.-এর জীবনী লেখেন, যার অমুদ্রিত পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত রয়েছে। ‘মারকুমাতে হাফীজ’ নামক একটি ফারসী কিতাবের অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সুনানে আবু দাউদের একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার পর রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যায়। অনুরূপ কাফিয়ার একটি শরাহও অপ্রকাশিত রয়েছে। মাদানী পরিবার শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী রাহ. ও তাঁর পরিবারের ভালবাসা হযরতের রক্তে-মাংসে মিশে গিয়েছিল। মূলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সত্যিকারের ভালবাসা ছিল এর উৎস। শায়খুল ইসলামের পরিবারের কোনো সদস্যের আগমন বা সাক্ষাৎ নয়; বরং তাদের নাম উচ্চারিত হলেই হযরতের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে যেত। তিনি ছিলেন ফিদায়ে মিল্লাত হযরত আসআদ মাদানী রাহ.-এর শীর্ষস্থানীয় একজন খলীফা। তা’লীম-তরবিয়তের পাশাপাশি তাসাওউফের ময়দানেও অবদান তাঁর আছে। সারা দেশে তিনি রেখে গেছেন অসংখ্য ভক্ত-মুরীদ ও ছয়জন খলীফা। জামিয়া ইউনুছিয়ার প্রতি তাঁর অনুরাগ শুনেছি, হুজুর তাঁর পূর্ণ জীবন জামিয়ার জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশ কুরবানী করে দিয়ে মাদরাসার উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য সচেষ্ট থাকতেন। বৃদ্ধ ও অসুস্থ অবস্থায়ও যা দেখেছি, তাতে মনে হতো মাদরাসার জন্য পুরো দুনিয়া কুরবান করে দিতেও প্রস'ত। ২০০০ সালে জামিয়ার পুরাতন মসজিদ ও শিক্ষাভবন ভেঙে অকল্পনীয় বিশাল বাজেট সামনে রেখে তা পুননির্মাণের কাজে হাত দেন। কোটি কোটি টাকার এ বাজেটকে সামনে রেখে দিবা-নিশি অক্লান্ত পরিশ্রম করে কাজ সমাপ্তির দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে গেছেন। মাদরাসাই ছিল তার বিশ্রামের স্থান। মাদরাসাই ছিল কর্মক্ষেত্র। ইন্তেকালের পূর্বেও বলেছেন, আমাকে মাদরাসায় নিয়ে চলো। পারিবারিক জীবন পারিবারিক জীবনেও এক সফল মনীষীর রূপে জীবন কাটিয়ে গেছেন। নয় পুত্রের প্রায় সকলেই কুরআনের হাফেয এবং ইতিমধ্যে সাতজন শিক্ষা সমাপ্ত করার পর দেশ-বিদেশে সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন দ্বীনী খিদমত করে যাচ্ছেন। অবশিষ্ট দু’জন এখনও মাদরাসায় অধ্যয়নরত। তিন কন্যার সকলকেই পাত্রস্থ করে গেছেন। হযরতের আহলিয়াকে আল্লাহ সুস্থতার সাথে দীর্ঘায়ু করুন। তাঁর প্রাত্যহিক জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। তবে আতিথেয়তায় তার বিশেষ সুখ্যাতি ছিল। নিজের সন্তানদের গড়ে তুলেছেন। বহু মুসলমানের সন্তানকে মানুষ করেছেন। অর্থ-সম্পদ সঞ্চয় করার দুর্বলতা তার মধ্যে বিন্দুমাত্র ছিল না। তাই সদকায়ে জারিয়া ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছুই রেখে যাননি। ইন্তিকাল ও দাফন হযরত মুফতী সাহেব বয়সের তুলনায় অসুস্থতার চাপে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিলেন। তবে তার কর্মোদ্দতায় কখনো ভাটা পড়েনি। সুস্থতা-অসুস্থতা সর্বাবস্থায় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতেন। মানুষের কাছে ক্ষমা চাইতেন। বিগত শা’বান মাসে হুজুরে সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তাকে দেখে স্বাভাবিক ও সুস্থ মনে হল। অনেক কথা বলার পর বললেন-তোমার আব্বাকে সালাম বলবে এবং আমাকে মাফ করে দেবে। হয়তো আবার দেখা হবে না। সত্যিই আর দেখতে পাইনি হুজুরকে। এমনকি জানাযাও না। ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকেই হুজুর খুব অসুস্থ ছিলেন। মাঝে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর ৩ ফেব্রুয়ারি বুধবার থেকে আবার বেড়ে যায়। মারাত্মক জ্বরাক্রান্ত হয়ে পড়েন। ৭ ফেব্রুয়ারি বুধবার বিকাল থেকে খানিক স্বস্তি বোধ করছিলেন। রাতে জ্বর বেড়ে যায়। ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়ানো হলে ঠিক তাহাজ্জুদের সময় নিজে নিজেই জেগে উঠেন। ছেলেরা আপত্তি করলে বললেন-এটাতো আমার অভ্যাস। এরপর শের-আশআর, হাদীস-কুরআন পড়তে থাকেন। ফজরের নামায জামাতের সাথে আদায় করেন। বারবার তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল – اللهم الرفيق الاعلى আমি বন্ধু আল্লাহর সান্নিধ্যে যেতে চাই। ইতিমধ্যে তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। তাঁকে ঢাকার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের করা হচ্ছিল। তখন বলছিলেন – (কবিতা) আল্লাহর শোকর, যন্ত্রণা ভোগ করছি তবে গুনাহর জালে আটকা পড়িনি। আরও বলছিলেন, আমি মাদরাসায় চলে যাচ্ছি। আর আসব না। ওখানে অনেক উলামায়ে কেরাম আছেন। অতঃপর ৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার সকাল সাড়ে সাতটায় স্থানীয় হাসপাতালে দুনিয়াকে চিরবিদায় জানিয়ে পরপারে আল্লাহর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান। জীবনভর সুন্নতে রাসূলের অনুসরণে হুজুর ছিলেন সদা তৎপর। তাই হুজুরের ছেলে মাওলানা ছিবগাতুল্লাহ সাহেব বলছিলেন-মনে হচ্ছে, কুদরতীভাবে আব্বাজীর ইন্তিকালের কিছু বিষয় হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মিলে গেল। যেমন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসুস্থতা বেড়েছিল বুধবারে। ইন্তিকাল করেন সোমবারে। তিনিও ইন্তিকালের সময় বলেছিলেন, اللهم الرفيق الاعلى ৮ ফেব্রুয়ারি আসরের পর ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার ঐতিহাসিক ঈদগাহ মাঠে লাখো মানুষ সমবেত হয়েছিল। ঈদগাহের পূর্ব দিকে শেষ প্রান্তে দাড়িয়ে ছিলাম আমি। আমার সামনে পিছনে, ডানে-বায়ে দেখে মনে হচ্ছিল শোকার্ত জনতার এক অথৈ সাগর। আমার পেছনে আরো কতদূর গড়িয়েছে এ মিছিল কে জানে! মনে হচ্ছিল, জনতার এই বিশাল মিছিলের সকলেই মৌনতার সুরে গাইছে-ইসলাম সে তো পরশ মাণিক, কে পেয়েছে তারে খুঁজি, পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরই মোরা বুঝি। দেশের সর্বস্তরের উলামায়ে কেরাম একত্রিত হয়েছিলেন এ মহামনীষীর জানাযায়। জানাযা শেষ হল। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের ন্যায় চারদিকে ছুটে গেল মানুষ। একটি এম্বুলেন্সে করে বহু কষ্টে জামিয়া ইউনুছিয়ার উত্তর পার্শ্বের এক কোণে শুয়ে থাকা ফখরে বাঙ্গাল রাহ.-এর কোলে তাঁকে সপে দেওয়া হল। কবর ফখরে বাঙ্গাল রাহ. ছিলেন তাঁর উস্তাদ ও মুরব্বী। তার সাথে হযরত মুফতী সাহেব রাহ.-এর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। হযরত ফখরে বাঙ্গালকে দাফনের সময় হুজুর নিজে কবরে নেমে বলেছিলেন-যদি কবরে মৃত মানুষের সাথে কোনো জীবিত মানুষের থাকা জায়েয হতো তবে আমি এখানেই থেকে যেতাম। প্রায় প্রতিদিন উস্তাদের যিয়ারত করতেন। তার নাম না বলে বলতেন, কবরওয়ালা। এই কবর নিয়ে একবার এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল। প্রায় বার-তের বছর আগে। এক মহিলা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটি মেয়েকে দিয়ে ফখরে বাঙ্গালের কবরে একটি তাবীয পুঁতে রাখতে পাঠাল। মেয়েটি তাবীয পুঁতে রাখতে গেলে অকস্মাৎ তার হাত বাঁকা হয়ে গেল। মুহূর্তে আশপাশে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। প্রত্যক্ষদর্শী আমার সহপাঠী ইয়াসীন আমাকে জানায়-সাথে সাথে মেয়েটিকে মুফতী সাহেব হুজুরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি তাকে খুব শাসালেন এবং তার হাতে ফূঁ দিতে থাকলেন। আস্তে আস্তে তার হাতটি সোজা হয়ে গেল। মুফতী সাহেবের ইন্তিকালের পর তার কবর কোথায় হবে এ নিয়ে বড় ধরনের বিতর্কের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। হুজুরের এলাকার লোকেরা বলল-তার কবর হবে আমাদের শিমরাইল কান্দি কবরস্থানে। এ ব্যাপারে তারা কাউকে ছাড় দিতে রাজি ছিল না। অপরদিকে অন্যরা চাচ্ছিলেন, মাদরাসার জন্য চির কুরবান মুফতী সাহেব যেন মাদরাসার পার্শ্বেই শুতে পারেন। আল্লাহ তাআলার কুদরতী ফয়সালায় অবশেষে হযরতকে মাদরাসার সুশীতল ছায়াঘেরা পরিবেশেই শোয়ানো হল।

 

advertisement