রবিউল আখির ১৪৩১   ||   এপ্রিল ২০১০

বাইতুল্লাহর ছায়ায় - ৩

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) সালাম পেশ করে যারা বের হয়ে আসছে, তাদের মুখমণ্ডলই বলে দেয়, কার এটা বিদায় সালাম ও আখেরি নাযরানা, আর কে আবার ফিরে আসবে সালামের নতুন নাযরানা পেশ করার জন্য আজ দুপুরে, সন্ধ্যায়, এশার পর এবং আগামী কাল। তাই তো আমার দেশেরই এক ভাই জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি বিদায় সালাম পেশ করেছেন? কথা বলতে সত্যি তখন খুব কষ্ট হয়, মাথা নেড়ে বললাম, হাঁ। তিনি বললেন, ‘আল্লাহ আবার আপনাকে ফিরে আসার তাওফীক দান করুন। আমি মাত্র গতকাল এসেছি। দেখতে দেখতে আমারো সময় শেষ হয়ে যাবে।’ কী আশ্চর্য সমবেদনা! প্রতিটি শব্দ থেকে ঝরে পড়ছিলো- তোমার বিরহ-ব্যথায় হে ভাই, আমিও ব্যথিত! অত্যন্ত সত্য করে সেদিন অনুভব করেছিলাম জাগতিক শোকের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, এমন আত্মিক শোকার্ততার সময়ও সান্ত্বনা ও সমবেদনার প্রয়োজন হয়। সমবেদনা প্রকাশকারী আমার ঐ ভাইটির সঙ্গে আর কখনো দেখা হয়নি, হয়ত হবেও না, কিন্তু তার কথা আমার মনে আছে, মনে থাকবে। সেদিন তাকে বলেছিলাম, জাযাকাল্লাহ! এখনো বলি, যেখানেই তুমি থাকো হে ভাই, আল্লাহ তোমাকে উত্তম বিনিময় দান করুন, আমীন। রওযা শরীফ থেকে বের হওয়ার দরজা দিয়ে একটু পূর্বে সরে এসে দাঁড়ালে সবুজ গম্বুজ দেখা যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে অপলক নেত্রে তাকিয়ে ছিলাম সবুজ গম্বুজের দিকে। তখন আমি আশ্চর্য এক তন্ময়তার মাঝে ছিলাম পূর্ণ সমাহিত। আমি এবং আমার সামনে উপরে সবুজ গম্বুজ ছাড়া আর সবকিছু যেন হারিয়ে গিয়েছিলো তখন। আমার চোখের তারায় ছিলো সবুজের ছায়া, আর হৃদয়ের পাতায় ছিলো সবুজের ছোঁয়া। সবুজে সবুজে আমার সর্বসত্তা যেন সবুজ হয়ে গিয়েছিলো। ঠিক তখন আমার ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠলো, ‘চিন্তা করো কেন! এ বিচ্ছেদ ও দূরত্ব তো শুধু চোখের, হৃদয়ের নয়। যেখানেই তুমি যাবে, তোমার বাইরে থাকবে সবুজের ছায়া, তোমার ভিতরে থাকবে সবুজের ছোঁয়া। তোমার দেহকে ভর করে ‘আমি’ আবার আসবো এই সবুজের পবিত্র পরশে।’ তখন অপূর্ব এক প্রশানি-তে আমি যেন অবগাহন করলাম। আশ্চর্য! আমার প্রতি এত সদয়, কে এই ভিতরের ‘আমি’?! চিরকাল কেন আমরা তাকে ভুলে থাকি দেহের পঙ্কিলতায় ডুবে থেকে?! এখনো মনে পড়ে বিদায়ের সেই মুহূর্তটি, যখন সবুজ গম্বুজ চলে গেলো চোখের আড়ালে, আর দেখা হলো না! আর দেখা হবে কি না, জানা হলো না! তারপর জিদ্দায় পড়ে থাকা হলো দুই দিন। হায়, জীবনের কী মূল্যবান সময় ছিলো সেই দু’টি দিন! আনন্দ-বেদনার মিশ্রণে কী মধুময় ছিলো সেই দু’টি দিন! বিদায় হয়েও যেন বিদায় হলো না! চোখের আড়াল হয়েও যেন আড়াল হলো না। দূরে এসেও যেন কাছে আছি! না দেখেও যেন একটু ঝলক, একটু ঝিলিক দেখছি! এত দিন যেন দিনের আলোতে ফুল দেখেছি এবং ফুলের সুবাস গ্রহণ করেছি। এখন যেন রাতের আঁধারে ফুলের দেখা নেই, কিন্তু আছে ফুলের সুবাস! এবং তা একই রকম মিষ্টি সুবাস! ফুলের সুবাস পেতে কি ফুলের দেখা পেতে হয়! আমাদের সামনে যখন চলছে ‘কে কার আগে’ টিকেট পাওয়ার কাড়াকাড়ি, আমরা তখন ভাবছি, থাকি না পড়ে আরো একটা দিন! কে জানে, আর আসা হবে কি না কোনদিন! কিন্তু কে বোঝবে তাঁর রহস্য-লীলা! যারা আগে আসার জন্য করলো তাড়াহুড়া এবং হুড়াহুড়ি, তাদের অনেকে পড়ে থাকলো আরো দু’দিন, আর আমরা যারা ‘ফুল না দেখেও, ফুলের সুবাস পেতে’ পড়ে থাকতে চাইলাম আরো একটা দিন, তাদের বলা হলো, যাও বিমানে ওঠো। *** আমরা বিমানে উঠলাম এবং দেশের মাটিতে ফিরে এলাম। কে জানতো, আমার আল্লাহ এখানেও আমার জন্য সাজিয়ে রেখেছেন অচিন-নীয় একটি সৌভাগ্য! বিমানবন্দরে প্রথম যে আলিঙ্গনটি আমি লাভ করলাম তা ছিলো আমার প্রাণপ্রিয় হযরত পাহাড়পুরী হুযুরের বুক থেকে। তখন কী মনে হলো! মনে হলো, এ আলিঙ্গন থেকেই আবার আমার স্বপ্ন দেখা শুরু হলো! এভাবেই আমি ফিরে এলাম এবং ফিরে এলো আমার স্বপ্ন দেখা! বুকের সঙ্গে বুক যদি লেগে থাকে, বুকের ভিতরে স্বপ্নের প্রদীপ জ্বলতেই থাকে এবং স্বপ্নের প্রদীপ আলো ছড়াতেই থাকে। হজ্বের কাফেলার ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে এমন ঘটনা। প্রাণপ্রিয় উস্তায ফিরে আসছেন হজ্বের সফর থেকে, আর স্নেহধন্য ছাত্র অপরিসীম ব্যাকুলতায় দাঁড়িয়ে আছে সেযুগে নৌবন্দরে এবং এযুগে বিমানবন্দরে! প্রাণপ্রিয় উস্তাযকে সে বরণ করবে এবং তাঁর বুকের উষ্ণ উত্তাপ গ্রহণ করবে। কিন্তু এমন ঘটনা ক’বার ঘটেছে যে, উস্তায অপেক্ষায় আছেন আল্লাহর ঘর দেখে ফেরা তাঁর ‘অভাগা’ ছাত্রটিকে বুকের আলিঙ্গন দান করার জন্য! তাই সেদিন মনে হয়েছিলো, আমার জন্য এটা আল্লাহর বিশেষ দান, বুকের স্বপ্নপ্রদীপ নতুন করে প্রজ্বলিত করার জন্য এবং সেই স্বপ্নপ্রদীপ থেকে নতুন করে আলো লাভ করার জন্য! জীবনে স্বপ্ন দেখা কখনো শেষ হয় না। আমাদের জীবনে দিন-রাত আছে; আমাদের স্বপ্নেরও আছে দিন-রাত। যখন শুধু স্বপ্ন দেখি তখন হলো স্বপ্নের আঁধার রাত, স্বপ্ন যখন পূর্ণ হয় তখন হলো স্বপ্নের আলোকিত দিন। জীবনে যেমন আসে রাতের পর দিন, স্বপ্নেরও আসে আঁধার রাতের পর আলোকিত দিন। জীবনের দিন-রাতের মত এভাবেই চলতে থাকে স্বপ্নের রাত-দিন। জীবন যখন শেষ হবে তখনই শুধু শেষ হবে আমাদের স্বপ্ন দেখা! কালো গিলাফের এবং সবুজ গম্বুজের স্বপ্ন লালন করা! জানি না, এ কোন্ নেশা! এ কেমন পিপাসা! পেয়ালায় যত ঠোঁট ভেজাও তত নেশা জমে, যত পান করো তত পিপাসা জমাট বাঁধে! এভাবে আশিক বান্দার, প্রেমের নেশায় মাতাল হওয়া এবং মিলনের পিপাসায় কাতর হওয়া দেখতে আল্লাহর হয়ত ভালো লাগে! *** আবার দিন যায়, মাস যায় এবং যায় একটি দু’টি করে কয়েকটি বছর। আমি শুধু স্বপ্ন দেখি, দেখতেই থাকি! অন্তরের ব্যাকুলতায়, অস্থিরতায় এবং বিরহের দহনযন্ত্রণায় দগ্ধ হই, হতেই থাকি! আমি স্বপ্ন দেখি জেগে জেগে এবং স্বপ্ন দেখি ঘুমের আঙ্গিনায়। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা আমাকে বেদনায় দগ্ধ করে, আর ঘুমের আঙ্গিনার মধুর মধুর স্বপ্ন সেই বেদনায় শীতল প্রলেপ বুলিয়ে দেয়! বান্দার সঙ্গে আল্লাহর কী যে আদর-মায়ার এবং মমতা ও ভালোবাসার সম্পর্ক! হায় বান্দা, তবু তুমি বোঝো না, গাফলাতের ঘোর থেকে তবু তুমি জাগো না! একদিন অবশ্যই তুমি জেগে ওঠবে, মৃত্যুর আঁধারে চোখের দৃষ্টি যখন ঘোলা হয়ে যাবে, কিন্তু তখন বড় বেশী দেরী হয়ে যাবে। তার আগেই জেগে ওঠো বান্দা, জেগে ওঠো! *** এক দুই করে দীর্ঘ পাঁচটি বছর পার হয়ে যায়, আবার হৃদয়ের সব বাঁধ ভেঙ্গে যায়, আর তখনই মাওলার ডাক এসে যায়! আল্লাহ উত্তম বিনিময় দান করুন আলহাজ আব্দুল ওয়াদূদকে। জীবনের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন ইলম ও আহলে ইলমের দরদী। তাঁরা তাঁকে মুহব্বত করতেন, তিনি তাঁদের শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর ছোট ছেলেটি, মুহম্মদ, পড়তো আমাদের মাদরাসাতুল মাদীনায়। একদিন তিনি বললেন, ‘আগামী রামাযানে আমার এই ছেলেকে নিয়ে আল্লাহর ঘরে যাওয়ার নিয়ত করেছি। আপনি তার উস্তায, আপনিও চলুন আমাদের সঙ্গে। আমি আনন্দে হাসবো, না খুশিতে কাঁদবো! এমন ভালো কথা মানুষ বলতে পারে মানুষকে! আল্লাহর ঘরে মানুষ নিয়ে যেতে পারে মানুষকে! আসলে ডাক আসে মাখলূকের নয়, খালিকের! মানুষের কণ্ঠস্বরে আসলে ধ্বনিত হয় তাঁরই ডাকের ধ্বনি। বান্দার সঙ্গে পর্দা করা তাঁর খুব পছন্দ। তিনি পর্দার আড়াল থেকে ডাকেন, পর্দার আড়াল থেকে দান করেন। বান্দাকে তিনি দেখেন, দেখা দেন না। দুনিয়ার যিন্দেগিতে পর্দার এই আড়ালটুকু বড় আনন্দের, যদি বান্দা বুঝতে পারে পর্দা এবং পর্দাওয়ালাকে! বান্দা যদি বুঝতে পারে, আকাশে ভাসমান মেঘ বৃষ্টি দেয় না; বৃষ্টিদাতা আছেন মেঘের আড়ালে। জমিতে ফেলে রাখা বীজ ফল ও ফসল দেয় না; তিনি আছেন বীজের আড়ালে। মৃত্যুর পর যখন শুরু হবে আখেরাতের অনন্ত জীবন তখন এ আড়ালটুকু আর থাকবে না। আপন তাজাল্লিতে আল্লাহ তখন বান্দার সামনে আত্মপ্রকাশ করবেন। আল্লাহর দীদার লাভ করে বান্দা তখন ধন্য হবে। এত দিনের মিলন-তৃষ্ণার পর বান্দার কলব তখন পূর্ণ তৃপ্তি লাভ করবে। এত দিন সৃষ্টির সৌন্দর্যে মুগ্ধ বান্দা তখন বিমুগ্ধ হবে স্রষ্টার সৌন্দর্যে। জান্নাতে নাকি বসবে সেই সৌন্দর্যের বাজার! হে আল্লাহ, সেই বাজারের সেই সৌন্দর্যের প্রতীক্ষায় পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যের মোহজাল ছিন্ন করে এগিয়ে যাওয়ার তাওফীক তুমি আমাদের দান করো, আমীন। বলছিলাম পর্দার আড়ালের কথা। এটা যারা বুঝতে পারে তারা বড় সৌভাগ্যবান। আল্লাহর শোকর, বড়দের ছিটেফোঁটা সামান্য যা ছোহবত, তারই বরকতে মেঘ-বৃষ্টির লুকোচুরি এবং বীজ ও ফসলের রহস্যলীলা কিছুটা হলেও বুঝতে পারি; ধ্বনি ও প্রতিধ্বনির পার্থক্য কিছুটা হলেও হৃদয় অনুভব করে। তবে আল্লাহর দান যখন যাকে উপলক্ষ করে নেমে আসে তার প্রতিও কৃতজ্ঞ থাকা সঙ্গত। সে কৃতজ্ঞতা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই প্রতি কৃতজ্ঞতা। তাই তো আল্লাহর পেয়ারা হাবীব বলেছেন, ‘মানুষের প্রতি যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।’ বাংলায় আমাদের শব্দ শুধু একটি, ‘কৃতজ্ঞতা’; উর্দুভাষাকে ধন্যবাদ, তাতে আছে আলাদা দু’টি শব্দ, শোকর ও শুকরিয়া। আল্লাহর জন্য শোকর, বান্দার জন্য শুকরিয়া। শোকর আদায়ের পর আমরা যেন শুকরিয়াও জ্ঞাপন করি। শুকরিয়া যেন ভুলে না যাই, আবার শোকর ও শুকরিয়া যেন একাকার না হয়ে যায়। জানি না, এসব কথা সফরনামার উপযোগী কি না, কিন্তু কলমের ঝর্ণাধারার প্রবল প্রবাহের মুখে বাঁধ তৈরী করা ঠিক কি না, তাও তো জানি না! যাক ফিরে আসি আগের কথায়। আলহাজ্ব আব্দুল ওয়াদূদ যখন বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে আপনিও চলুন আল্লাহর ঘরে’, তখন আমার অবস্থা হলো, ‘মুখে হাসি, চোখে পানি’। আনন্দের আতিশয্যে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, আর শুধু বলতে পারলাম, জাযাকাল্লাহ্! হৃদয়ের অঙ্গনে আবার শুরু হলো আশা ও আশঙ্কার তরঙ্গদোলা এবং আবেগ ও উৎকণ্ঠার ‘আবির খেলা’! বাইরের আমি বলি, ‘শেষ পর্যন্ত হবে তো!’ ভিতরের আমি বলে, ‘ভয় কী, তিনি আছেন তো!’ ধীরে ধীরে সৌভাগ্যের দিনটি সত্যি সত্যি এলো। সেটা ছিলো রামাযানপূর্ব শুক্রবার। মাদরাসায় আগের দিনের দুঃখজনক একটি ঘটনায় আব্বা ছিলেন কিছুটা নয়, অনেকটা নারায। তাই মনটা ছিলো অত্যন্ত ভারাক্রান্ত। জীবনের এই এক বড় ‘ট্রাজেডি’। ঘটনার নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকে না, তাকেই বহন করতে হয় ঘটনার দায়। আমি শুধু বলতে পারলাম হে আল্লাহ! তুমি সব জানো, তোমারই ‘দুই অঙ্গুলির মাঝে’ আমার, মা-বাবার এবং অন্যসবার হৃদয়। তুমি সব সংশোধন করে দাও। আব্বা বিদায় দিলেন ভার-আক্রান্ত হৃদয়ে, আমি বিদায় নিলাম ভারাক্রান- হৃদয়ে। আমার মা! তিনি বিদায় দিলেন যেন মমতার একটুকরো আঁচল সঙ্গে দিয়ে। বাবারা কখনো কখনো কেমন যেন হয়! মায়েরা কখনোই ‘কেমন’ হতে পারে না। মায়েদের মুখ দেখে বিশ্বাস হয়, মাতৃহৃদয় যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর ক্ষমা থেকে মানুষ কখনো বঞ্চিত হতে পারে না। মাতৃমমতা আসলে পৃথিবীতে স্রষ্টার মমতারই ছায়া। আম্মা বিদায় দিলেন আর বললেন, চিন্তা করিছ না, সব ঠিক হইয়া যাইবো। এবং পনেরো দিন পর আল্লাহর ঘর থেকে ফিরে এসে দেখি সব ঠিক হয়ে গেছে! আব্বা ঘুমিয়ে ছিলেন, আমার আওয়ায পেয়ে কীভাবে উঠলেন এবং ছুটে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আমার মাথায় তখন জেগে উঠলো এক ‘দুষ্ট’ চিন্তা, ‘দুঃখের সময় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ‘মা’! সুখের সময় মা দাঁড়িয়ে থাকেন একটু দূরে, তাঁকে ডেকে আনতে হয় কাছে! দুর্ভাগা সন্তান যদি না ডাকে, দূর থেকে শুধু দৃষ্টি দিয়েই বর্ষণ করেন মমতার শিশির। আমার মা এগিয়ে এলেন না, আমি কাছে গেলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছেন আম্মা! আম্মা বললেন, তোর আব্বা তোর জন্য অস্থির আছিলো, তোর জন্য অনেক দোয়া করছে। এমনই হয়! মায়েদের নিজের কথা বলার অবসর হয় না, কখনোই না! পাঠকের জন্য আমি আসলে ‘একটি যন্ত্রণা’! ঘটনার শুরু-শেষ, আমার কলমে সব গুলিয়ে যায়! কোথায় শুরু, কোথায় শেষ, আমি নিজেই বুঝতে পারি না। কী লিখবো, কীভাবে লিখবো তাও ঠিক রাখতে পারি না। ভিতর থেকে যেন একটা প্রবাহ আসে। সেই প্রবাহে আমি শুধু ভেসে যাই। পাঠক হয়ত ঝর্ণার কিনারে দাঁড়িয়ে থাকে, আর আমাকে হারিয়ে ফেলে। তবু পাঠক আমাকে গ্রহণ করেন এবং আমার কলমকে বরণ করেন, হয়ত শুধু এজন্য যে, তাদের হৃদয়ের কিছু কথা উঠে আসে আমার কলমে। তারা যা বলতে চান, হয়ত আমার কলম সেগুলো কিছুটা হলেও তুলে ধরে। যাক ফিরে আসি আগের কথায়। আব্বা-আম্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথের উপর এসে দাঁড়ালাম। তখনো ছিলো সেই হাঁটা পথটি, বাড়ী থেকে খেয়াঘাট, সেখান থেকে কেল্লার বাজার। গাড়ীতে ওঠবো হঠাৎ মনে হলো আমার প্রিয় ছাত্র মুনিরের কথা। বেচারা দু’একদিনের মধ্যে রওয়ানা হবে হিন্দুস্তানের নদওয়াতুল উলামা। আমি পাশে থেকে বিদায় জানাতে পারলে ভালো হতো। মনে তো পেরেশানির ঝড় ছিলো, তাই বিস্মৃত হয়ে পড়েছিলাম তার কথা। কিন্তু কোথায় সে! দেখি একটু দূরে, একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ ... ! ডেকে কাছে আনলাম এবং দু‘আ দিয়ে, সান্ত্বনা দিয়ে বিদায় নিলাম। বললাম, চিন্তা করো না, দেখো, গায়ব থেকে সব ইন্তিযাম হতে থাকবে ইনশাআল্লাহ! সেখান থেকে ধানমণ্ডি হাজী আব্দুল ওয়াদূদের বাড়ী। সেখানে এসে বুঝতে পারলাম, কাকে বলে সফর এবং সফরের আয়োজন! বেশ উপভোগ করার মত এবং বর্ণনা করার মত দৃশ্য! অবশ্য মন যদি তখন অন্যকিছুতে নিমগ্ন না থাকে। তিনি আমাকে দিয়ে মুনাজাত করালেন এবং বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো। বিমানবন্দরে জুমার নামায হলো। নামাযের পর সিঁড়ি বেয়ে বিমানে আরোহণ করছি। হঠাৎ মনে হলো, জান্নাতে শহীদানের রূহ পাখীর ভিতরে করে উড়ে বেড়াবে। আমরা কি তাহলে বাইতুল্লাহর শহীদান! ডানা-মেলা এই পাখীটির ভিতরে করে মনের আনন্দে আমরা উড়ে যাবো মেঘের রাজ্য পার হয়ে সেই সুদূরে, আল্লাহর ঘর যেখানে! মনের কল্পনা কত অদ্ভুত! কোত্থেকে কোথায় চলে যায়! কল্পনার এই যে আনন্দহিল্লোল সেও তো আমার আল্লাহরই দান! শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর! এই রকম পাখীর ভিতরে আমাদের রূহ যেন উড়ে বেড়ায় জান্নাতের এখানে সেখানে, সবখানে! সেই সফরে বিমানের ভিতরে একটি ঘটনা এখনো আমাকে নাড়া দেয়। আমার মা -আল্লাহ তাঁকে হায়াতে তাইয়েবা দান করুন এবং হযরত পাহাড়পুরী হুযূরের আম্মাকে চিরশানি- দান করুন- নিজের হাতে ‘রুটি ও ব্যঞ্জন’ তৈরী করে দিয়েছিলেন। হাজী আব্দুল ওয়াদূদ বললেন, ‘হঠাৎ খুব ক্ষুধা পেয়েছে।’ কারো ক্ষুধা পেয়েছে, এটা কি খুশী হওয়ার মত কোন খবর! আমি খুশী হলাম, এজন্য যে, তাতে অপ্রত্যাশিত একটি সুযোগ তৈরী হলো আমার মুহসিনকে একটু সেবা করার। আমি কৃতার্থ চিত্তে সামান্য রুটি-ব্যঞ্জনের সেই ‘অসামান্য’ খাবার তাঁর সামনে পেশ করলাম। তিনি এত খুশী হলেন যে ...! ক্ষুধা ও খাদ্য দু’টোই যে আল্লাহর অতি বড় নেয়ামত সেদিন আরেকবার অন-র দিয়ে উপলব্ধি করার সুযোগ হলো। আমি আবার আল্লাহর শোকর আদায় করলাম। হাজী সাহেব খুশী হবেন ভেবে বললাম, ‘আমার আম্মা আমাদের জন্য নিজের হাতে তৈরী করে দিয়েছেন।’ বলেই বিব্রত হলাম। কারণ তাঁর চোখ দু’টো ছলছল করে উঠলো। অদ্ভুত এক ভারাক্রান- কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আপনার আম্মা আছেন, আমার আম্মা নাই। আমারও যদি মা থাকতো ...।’ সেদিন আরেকবার আমার এই বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো যে, মায়ের জন্য মাতৃহারা শিশুর চোখ যেমন ছলছল করে তেমনি ছলছল করে ষাট বছরের বুড়ো মানুষেরও চোখ। দূর অতীতে হারিয়ে যাওয়া মায়ের ধূসর স্মৃতিও যখন একজন বুড়ো মানুষের মনে পড়ে তখন তারো বুকের শুকনো পাঁজরে কষ্টের সুর বাজে! তারো প্রাণে কিসের যেন হাহাকার জাগে! আমার বাবা খুব বড় কোন কষ্টের সময় একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, এর জন্যই কি আমার মা আমাকে লালন-পালন করেছিলেন! আল্লাহর শোকর, আমি এবং আমার মা, আমরা দু’জনই এখনো আছি মায়ের আঁচলের ছায়ায়! *** আবেগের তোড়ে অনেক দূর ভেসে যাওয়া, এ আমার বড় এক দুর্বলতা; হয়ত মধুর দুর্বলতা। যাক, ফিরে আসি আগের কথায়। বিমানের ভিতরে তখন এবং এখন যে পার্থক্যটা দেখি, এখানে তা বলতে ইচ্ছে করছে। এখন বাইতুল্লাহর যাত্রীরা বিমানে বসে মোবাইল চর্চায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কত রকম কথা, ‘আমরা বিমানে ... এই তো এখনই...!’ ‘মদীনায় নাকি..., শালটা দিয়ে দিলে ভালো হতো।’ ‘হাঁ, হাঁ, ... নেমেই সিম নিয়ে নেবো।’.... তখন মোবাইলের যন্ত্রণা ছিলো না। তাই বিমানের ভিতরে এসব ‘আলাপ ও প্রলাপ’ ছিলো না। শুধু ছিলো লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক-এর সুমধুর গুঞ্জন! কী আশ্চর্য তন্ময়তা ছিলো মাত্র বছর কয়েক আগেও বাইতুল্লাহর সফরে! আমার মনে হয়, ভিতরের শুভ্রতার কারণে তখন ইহরামের লেবাসেও ছিলো এখনকার চেয়ে বেশী শুভ্রতা! তখন বিমানের ভিতরে যে ‘কাশফুল’ দেখতাম, সত্যি বলছি এখন আর তা দেখতে পাই না। হয়ত আমার দৃষ্টির অস্বচ্ছতা! হয়ত তার সঙ্গে আরো কিছু! *** সবকিছু এখনো যেন ছবির মত স্পষ্ট! জিদ্দা বিমানবন্দরে অবতরণ করে আমরা যখন পবিত্র মক্কায় হারামের সামনে পৌঁছলাম তখন মধ্যরাত। চারদিকে আশ্চর্য এক স্বপ্নময়তা! এত নীরবতা, এত নির্জনতা মক্কা শরীফে তো কখনো হয় না! এ এক নতুন অভিজ্ঞতা! যারা আশিক, প্রেমিক ও মজনু, মক্কা তাদের কাছে প্রতিবারই মনে হয় নতুন। হারামকে মনে হয়, এবার যেন নতুন সাজে সজ্জিত! আর আল্লাহর ঘর বাইতুল্লাহ! তাকে তো মনে হয় অবগুণ্ঠিতা এক... নাহ, কলম এখানে সংযত থাকুক। আমি তো জানি না, কোথায় আদবের সীমারেখা! তাই হৃদয়ের অনুভূতি হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে রাখাই নিরাপদ। আমি আশিক ও প্রেমিক নই, আর মজনু হওয়ার দাবী তো শুধু ধৃষ্টতা; তবু .. তবু সেদিন সবকিছু আমার কাছে মনে হয়েছিলো নতুন! চারদিকে কিসের যেন নতুন প্রস্তুতি, নবআয়োজন! সবকিছু শান্ত, প্রশান্ত। মানুষ আছে, শব্দ নেই। নৈশব্দের আশ্চর্য এক গভীরতায় সকলেই যেন আত্মসমাহিত। মাতাফে অবতরণ করে যখন আমি হারিয়ে গেলাম তাওয়াফের সেই পরিচিত তরঙ্গদোলায় তখন আমার বিশ্বাস হতে চাইলো না যে, এসব কিছু বাস্তবেই ঘটেছে! আমি আল্লাহর ঘরে এসেছি! আমি আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করছি! এ যেন এক মধুর স্বপ্ন! আমি যেন ঘুমের ঘোরে এক মধুর স্বপ্নে বিভোর! প্রিয় পাঠক, সর্বান্তকরণে কামনা করি, এমন সুমধুর ‘বাস্তব স্বপ্ন’ তোমার জীবনে বারবার যেন আসে। তুমিও দু‘আ করো আমার জন্য। পাঁচ বছর আগে দেখেছিলাম, হারামের নিকটবর্তী সব ভবন ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বিরাট এলাকা তখন উন্মুক্ত। ধারণা ছিলো, হাজী মিযানের সেই ঘরটি দেখতে পাবো, যেখানে হজ্বের সফরে হযরত হাফেজ্জি হুযূর (রাহ.) ছিলেন। কিন্তু তার চিহ্ন পর্যন্ত নেই। পাঁচ বছরেই হজ্বের ব্যবস্থাপনায় বিরাট পরিবর্তন এসেছে। আগে হজ্বের মুসাফিররা নিজেদের ব্যবস্থায় নিজেদের বিবেচনামত ঘর নিতে পারতো। তাতে বেশ সুবিধা ছিলো। পাঁচ বছর পরে অবস্থা ছিলো অন্য রকম। প্রতিটি হাজী তখন মুআল্লিমের হাতে...। তাতে হাজীদের অবস্থা যেমনই হোক হাজী মিযানের মত লোকদের অবস্থা ছিলো বড় করুণ। মনে আছে আমাকে দেখে হাজী মিযান সেবার কেঁদে ফেলেছিলেন। দেখে অবাক হয়েছিলাম, মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে একজন জমজমাট মানুষ কীভাবে এমন বিধ্বস্ত চেহারায় পরিণত হতে পারে! তার তখন কাজ বলতে কিছু নেই। বাংলাদেশে যাকে বলে ‘পথে বসা অবস্থা’ সেটারই যেন বাস্তব নমুনা ছিলেন হাজী মিযান। তার চোখের পানিতে আমারও চোখে পানি এসে গিয়েছিলো। মনটাই শুধু কেঁদেছিলো, করার কিছু ছিলো না, দু‘আ ছাড়া। বারবার মনে পড়ছিলো, হযরত হাফেজ্জি হুযূর (রাহ,) এর ওছিলায় এ মানুষটির দস্তরখানে বসেছিলাম। আজ তার ...। পাঁচ বছর আগে তবু তো মানুষটিকে দেখতে পেয়েছিলাম। এবার সেই মানুষটিরও খোঁজ পেলাম না। হয়ত কাজ জুটাতে না পেরে দেশে ফিরে গিয়েছেন, কিংবা...। যেখানেই থাকুন আল্লাহ তাকে ভালো রাখুন। এমনকি পাঁচ বছর আগে আমরা চারজনের কাফেলা যেখানে ছিলাম, পাহাড়ের মত কিছুটা উঁচুতে, তারও কোন চিহ্ন নেই। বিশাল টাওয়ার উঠেছে সেখানে। প্রথম সফরে রামাযানের চব্বিশ তারিখে একেবারে একা একমুসাফির এসেছিলাম। তখন যে দোকানের মালিক দয়া করে আমার ব্রিফকেসটি আমানত রেখেছিলেন পাঁচ বছর আগে হজ্বের সফরে তার অসুস্থতার খবর পেয়েছিলাম। বাড়ীর ঠিকানা নিয়ে তাকে দেখেও এসেছিলাম। তিনি খুব খুশী হয়েছিলেন। দু‘আ চেয়েছিলেন যেন ঈমানের সঙ্গে এবং আসানির সঙ্গে মওত নছীব হয়। এবার দোকানটি নেই, ভাঙ্গা পড়েছে। বাড়ীর ঠিকানা মনে থাকার কথা নয়। একদিন প্রায় সারা দিন ব্যয় করে অনেক খোঁজাখুজি করে তার বাড়ীতে গিয়েছিলাম। বাড়ীর লোকেরা অবাক! আমি পরিচয় দিয়ে বললাম, পাঁচ বছর আগে তাকে দেখে গিয়েছিলাম, তিনি তখন শয্যাশায়ী ছিলেন। তারা জানালো, তার কয়েক দিন পরেই তিনি ইন্তিকাল করেছেন। বড় ভালো মানুষ ছিলেন। আল্লাহ তাকে জান্নাত নছীব করুন, আমীন। *** ফিরে আসি আগের কথায়। চারদিকে এত যে পরিবর্তন, আগের কোন কিছুই প্রায় চেনা যায় না, কিন্তু হারামের ভিতরে প্রবেশ করে সবকিছু মনে হলো পরিচিত এবং আপন। হাঁ, ঐ তো উম্মে হানি। অবনত দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখন চোখ তুলে দৃষ্টিপাত করলেই আমি দেখতে পাবো কালো গিলাফে ঢাকা আমার আল্লাহর ঘর। এখানে কোন পরিবর্তন নেই। যেমন দেখেছি দশ বছর আগে তেমনি দেখেছি পাঁচ বছর আগে এবং ইনশাআল্লাহ তেমনি দেখবো এখন। এই সামান্য সময়টুকু জীবনের বড় দুর্লভ সময়। বাইতুল্লাহর দীদার হাছিল হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তটুকু! অন্তর্চক্ষে তো হাজার হাজার মাইল দূর থেকেও দেখতে পেতাম, যেমন দেখতে পাচ্ছি এখন বাইতুল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি অবনত রেখে। এখন আমি মাথা উঠালেই চোখের সামনে দেখতে পাবো আল্লাহর ঘর। সে জন্য একটু প্রস্তুতি দরকার। এ চোখে কত গোনাহ করেছি। এ চোখ কি এখন গ্রহণ করতে পারবে আল্লাহর ঘরের জামাল ও সৌন্দর্য! হে আল্লাহ তুমি তাওফীক দান করো। বহু দূর থেকে দয়া করে, মায়া করে তুমি আমাকে এনেছো, তোমার ঘরের সামনে দাড় করিয়েছো। এখন বাকি শুধু নযর ওঠানো। তোমার ঘরের প্রতি হে আল্লাহ, আমার প্রথম দৃষ্টি যেন হয় শুভ দৃষ্টি! জ্যোতির্ময় দৃষ্টি! আমার পহেলা নযর যেন হয় নেক নযর! নূর নযর! আমি চোখ তুলছি হে আল্লাহ! ধীরে ধীরে খুব কোমলভাবে, আল্লাহর কাছে চেয়ে চেয়ে দৃষ্টি উপরে উঠাতে লাগলাম। প্রথমে চোখের তারায় দেখা গেলো কালো গিলাফের সামান্য একটু আভাস, তারপর আরেকটু প্রকাশ, তারপর পরিপূর্ণ উদ্ভাস! চোখের সামনে এখন আমার আল্লাহর ঘর! আল্লাহুম্মা যিদ বাইতাকা হাযা... হাজী আব্দুল ওয়াদূদকে আল্লাহ রহম করুন, আমাকে তিনি সামান্য হলেও মুহব্বত করতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘জীবনে বহুবার আল্লাহ আমাকে তাঁর ঘরে এনেছেন, কিন্তু আল্লাহর ঘরের দিকে নযর করার এমন স্বাদ আর কখনো পাইনি।’ আমি বললাম, এর কারণ আর কিছু নয়, শুধু এই যে, যিনি আমাদেরকে আদর করে, মায়া করে, মুহব্বত করে বাইতুল্লাহ দান করেছেন এবং বাইতুল্লাহকে দেখার জন্য চোখের দৃষ্টি দান করেছেন, তাকাবার আগে তাঁর কাছে আমরা তাওফীক চেয়েছিলাম। তিনি আমাদের তাওফীক দান করেছেন। আসলে বাইতুল্লাহর দিকে নযর করার আগে একটু সময় দরকার প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য। আমরা প্রস্তুতি ছাড়াই তাকিয়ে ফেলি। ফলে আমাদের তাকানোটা হয়ে যায় শুধু নযর, নেক নযর হওয়ার খুব একটা সুযোগ থাকে না, আর নূর নযর, সে তো অনেক পরে! সামান্য সময়ের মোরাকাবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে যদি চোখের ময়লা কিছুটাও আমরা ছাফ করে নিতে পারি এবং আল্লাহর কাছ থেকে তাওফীক হাছিল করতে পারি তাহলে এই ময়লা চোখের ময়লা নযরই আল্লাহর রহমতে হয়ে যায় নেক নযর এবং এমনকি হয়ে যেতে পারে নূর নযর! আমি কথাগুলো বললাম, আমার চোখে পানি এলো না; হাজী আব্দুল ওয়াদূদ শুনলেন, তার চোখে পানি এসে গেলো। চোখের পানি আগেও দেখেছি, কিন্তু চোখের পানি যে হয় এত সুন্দর তা আগে অনুভব করেছি, মনে পড়ে না। আল্লাহর শোকর, তখনই আমার মনে হলো, এই চোখের পানিটা থেকে ফায়দা হাছিল করা দরকার। আমি বললাম, ‘আপনার ওছিলায় আজ আমি আল্লাহর ঘরের সামনে, আপনি দু‘আ করুন, আল্লাহ যেন এই গোনাহগার বান্দাকে কবুল করেন। তিনি বুকে জড়িয়ে ধরে দু‘আ করলেন। দোষে-গুণে মানুষটি বড় ভালো ছিলেন। আমরা আরো ভালো হলে তিনি হয়ত আরো ভালো হতেন। আল্লাহ তার কবরকে ঠাণ্ডা রাখুন। আমার পক্ষ থেকে এবং অন্য যারা তার সামান্য ইহসানও পেয়েছে তাদের সবার পক্ষ হতে আল্লাহ তাকে ‘আহসানুল জাযা’ দান করুন, আমীন। আল্লাহর ঘরের কত সফরসঙ্গী আমার চোখের সামনে রওয়ানা হয়ে গেলেন আখেরাতের সফরে! আমার সময় কখন, আমি জানি না। হে আল্লাহ, তখন আমার বড় প্রয়োজন তোমার সঙ্গ! তোমার মা‘ইয়্যাত! *** সেই সফরে আমার ছাত্রের সামনেই কয়েকবার আমি তার বাবার জুতা বহন করেছিলাম, শুধু এ জাযবায় মাগলুব হয়ে যে, এই মানুষটির ওছিলায় আমি আল্লাহর ঘরে এসেছি। প্রথমবার তিনি খুব বিব্রত হলেন, আমি বললাম, অন্তত এজন্য একটু সুযোগ দিন যে, আপনি আমার বাবার সমান বয়সের। তিনি সুযোগ দিলেন, আর ছেলেকে বললেন, ‘টিপু, এলেম তুমি আর কদ্দুর পাইবা, হুযূরের কাছ থেকে এইগুলা শিখে নাও।’ একজন লিখেছেন, ‘হজ্বের সফরনামা লেখা বড় ঝুঁকিপূর্ণ। তাতে বলার মত অনেক কথা থেকে যায়, আবার না-বলার মত কিছু কথা এসে যায়।’ কথাটা ঠিক। তবে আমার সান্ত্বনা এই যে, আমি লিখছি বহু বছর পর এবং আমার হুযূরের হুকুমে। সুতরাং আশা করি, ভুল যা হবে আল্লাহ মাফ করে দেবেন। সেই সফরের একটি অদ্ভুত বিষয় ছিলো এই যে, পরিচিত, অর্ধপরিচিত যার সাথেই দেখা হয়, তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনাকে কে এনেছে?’ আশ্চর্য প্রশ্ন, কখনো শুধু অবাক হই, কখনো সঙ্গে ব্যথিত হই। এমন পবিত্র স্থানে এমন পবিত্র সময়েও কি আমরা অপ্রয়োজনীয় কৌতুহলগুলো এড়িয়ে চলতে পারি না! তাহলে কবে, আর কবে! তো কোতূহলী প্রশ্নের উত্তরে কখনো বলি, আমাকে যিনি এনেছেন তাকে আপনি চেনেন, তবে তার নাম এখন বলবো না। কখনো পাল্টা প্রশ্ন করি, আপনাকে কে এনেছে? তিনি বলেন, ‘আমাকে কেউ আনেনি, আমি নিজের খরচে এসেছি।’ ‘আচ্ছা!’ - আমি অবাক হই, আমার অবাক হওয়া দেখে প্রশ্নকারী আরো অবাক হয়। একদিন খবর পেলাম, আমার প্রিয় উস্তায সুলতান যাওক ছাহেব এসেছেন এবং ঢাকা হোটেলের কাছকাছি অবস্থান করছেন। যিনি খবরদাতা তিনিই আমাকে শেষ রাতে হুযূরের কাছে নিয়ে গেলেন। হুযূর প্রথম কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর দাঁড়িয়ে আমাকে বুকে নিলেন। নিলেন তো নিলেন! আমিও আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হতে চাই না, তিনিও মুক্ত করেন না! দৃশ্যটি যারা দেখলো তারা অবাক! এ ওকে জিজ্ঞাসা করে, কে ইনি?! যখন শোনে, যাওক ছাহেবের ছাত্র, তখন আরো অবাক! তাদের দোষ কী! এ যুগে এমন দৃশ্য আসলেই যে দুর্লভ! পরবর্তী সফরে উম্মে হানিতে আল্লাহর ঘর দেখা যায়, এমন স্থানে আমি হুযুরের কাছে বসা। তিনি এমন কিছু অন্তরঙ্গ আচরণ করলেন যে, মজলিসে উপস্থিত লন্ডনপ্রবাসী একভদ্রলোক অবাক হয়ে হুযূরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি কে? জবাবে হুযূর বললেন, ‘ইনি আমার সারা জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র!’ কথাটা আমি শুনলাম, আর আল্লাহর ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, তোমার শোকর হে আল্লাহ! তোমার শোকর! মজলিসে ছিলো আমার ছাত্র আল-মারকাযুল ইসলামী-এর মাওলানা শহীদুল্লাহ এবং মাওলানা ইলয়াস খান। আমি তাদের বললাম, ‘তোমরা সাক্ষী থেকো, প্রয়োজন হলে কেয়ামতের দিন এই সনদ আমি কাজে লাগাবো।’ আমার জন্য এটা আল্লাহর অতি বড় দান যে, আমার আসাতেযা কেরাম, আজীবন তাঁদের কাছে আমি যেমন পেয়েছি স্নেহ ও মমতা তেমনি পেয়েছি আস্থা ও সম্মান, যা পরিচিত-অপরিচিত অনেকের কাছে মনে হয় অবাক বিষয়। আসলে এ পুঁজি ভেঙ্গে ভেঙ্গেই পার করছি জীবনের দিনগুলো। ফিরে আসি যাওক ছাহেব হুযূরের আলিঙ্গনের কাছে। সেই আলিঙ্গন থেকে যে স্বাদ ও লয্যত এবং যে নূর ও নূরানিয়াত আল্লাহ দান করেছিলেন সে জন্য এখনো আমি আল্লাহর শোকর আদায় করি। আলিঙ্গন শেষে হুযূর আমাকে খুব কাছে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছো? কবে এসেছো? সম্ভবত তৃতীয় প্রশ্নটি ছিলো, ‘কে তোমাকে এনেছে’? এ প্রশ্ন করার হক হুযূরের আছে। তাই একটুও খারাপ লাগেনি, বরং কিছুটা যেন খুশি হলাম সেই কথাটি বলার সুযোগ পেয়ে যা এর আগে আর কাউকে বলিনি। হুযূরের কানের কাছে মুখ নিয়ে অন্যরা শুনতে না পায় এমনভাবে বললাম, প্রতিটি শব্দ খুব ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে বললাম, আ-মা-কে এ-নে-ছে-ন আ-মা-র আল্লাহ! হুযূর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, আল-হামদুলিল্লাহ! তারপর বললেন, ওছিলা কে? বললাম, হাজী আব্দুল ওয়াদূদ। আলিম-ওলামাদের মহলে তিনি সবার সুপরিচিত। হুযূর বললেন, আমি খুব খুশী হলাম, আল্লাহ তাকে জাযায়ে খায়র দান করুন। এ জন্যই বলছিলাম, হুযূরের এ প্রশ্ন করার অধিকার আছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এর আগে বা পরে আর কোন সফরে কারো কাছ থেকেই এমন প্রশ্নের সম্মুখীন আমি হইনি। গায়বের হিকমত ও রহস্য গায়বই জানে। *** ওমরা আদায় করে সকাল দশটার দিকে আমরা রওয়ানা হলাম মদীনা শরীফের উদ্দেশ্যে। হাজী আব্দুল ওয়াদূদের সঙ্গে ভাই মাছীহুল্লাহর ছিলো বিশেষ কিছু সম্পর্ক। তিনি মদীনা শরীফ থেকে জিদ্দা এসেছিলেন আমাদের ইস্তিকবাল করতে। তার গাড়ীতেই আমরা জিদ্দা থেকে মক্কায় এসেছিলাম। তার সঙ্গেই চলেছি মদীনায়, আমার সোনার মদীনায়! পথ এবং পথের দু’পাশের মরুভূমি ও পাহাড়-পর্বত সব আমার পরিচিত, তবু যেন সবকিছু নতুন! মনে হলো, মরুভূমির সৌন্দর্য এবং পর্বতমালার রূপ-ঐশ্বর্য জীবনে এই প্রথম দেখা হলো! এ তো সেই মরুভূমির বালুকণা, যা ধন্য হয়েছে হিজরতকালে আমার পেয়ারা নবীর পবিত্র পদস্পর্শে! এ তো সেই পাহাড়-পর্বত, যা তখনো ছিলো এবং আমার পেয়ারা হাবীবের দৃষ্টি-পরশে স্নিগ্ধ হয়েছিলো। সেই দৃষ্টি-পরশের স্নিগ্ধতা এই সব পাহাড়-পর্বতের দিকে তাকিয়ে আজো তারা অনুভব করেন, আল্লাহ যাদের দান করেছেন অন্তর ও অন্তর্দৃষ্টি। মক্কা-মদীনার মুসাফির যারা তাদের গাড়ী থামে পথিমধ্যের যে কোন বিশ্রামস্থলে। প্রয়োজন হলে সেখানেই তারা খাবার খেয়ে নেয়। আমাদের দুপরের খাবার মক্কা শরীফ থেকে সঙ্গে নেয়া হয়েছিলো। কারণ ভাই মাসীহুল্লাহর পরিকল্পনা ছিলো অন্যরকম। পথে একস্থানে তিনি পথ ছেড়ে মরুভূমির বালুতে গাড়ী চালিয়ে একটি পাহাড়ের পাদদেশে থামলেন। মরুভূমির তপ্ত আবহাওয়ায় পাহাড়ের ছায়া যে কত আরামদায়ক তা সেদিন অনুভব করতে পেরেছিলাম। নির্জন পাহাড়ের ছায়ায় বসে দুপুরের খাবার গ্রহণ করছিলাম, কিন্তু মন আমার চলে গিয়েছিলো বহু দূরে। আমি যেন বহু যুগ আগের মেষচরানো কোন আরব বেদুঈন। মেষ চরাতে চরাতে ক্লান- হয়ে পাহাড়ের কোলে এসে বসেছি ঠণ্ডা ছায়ায় একটু জিরিয়ে নিতে, আর সেই ফাঁকে দুপুরের খাবার খেতে। আমাদের খাবার যদিও ছিলো ভুনা মুরগী ও নরম রুটি, তবু আমি তাতে স্বাদ পেয়েছিলাম সেই শুকনো রুটির, যা খাওয়া হতো এমনিতে, কিংবা একটা দু’টো খেজুর দিয়ে। মরুভূমির প্রানে- পাহাড়ের ছায়ায় সেদিন যে সামান্য সময়টুকু আমরা যাপন করেছিলাম, আমার কাছে তা ছিলো পৃথিবীর যে কোন দেশের যে কোন মনোরম স্থানের আয়েশি সময়ের চেয়ে অনেক বেশী প্রিয়, শুধু এই অনুভূতিটুকুর জন্য যে, নিশ্চয় আমার পেয়ারা নবী কখনো না কখনো কোন না কোন পাহাড়ের ছায়ায় একটু বসেছিলেন, একটু বিশ্রাম গ্রহণ করেছিলেন। আগে মরুভূমিতে ঘাস দেখিনি এবং জলাশয় দেখিনি। কিছুদিন আগে নাকি আকস্মিক বৃষ্টি হয়েছিলো। তারই ফল এখনকার এই সবুজ, এই জলাশয়। এ দৃশ্যটির কথাই পড়েছি আরব জাহেলিয়াতের কবিতায়। এইটুকু পানি এবং কয়েক ছোপ ঘাস, তারই জন্য গোত্রে গোত্রে নাকি লড়াই হতো। পানির জন্য রক্ত হতো পানির মত প্রবাহিত। গাড়ী চলছে মসৃণ পথে পূর্ণ গতিতে। আমি জানালাপথে কখনো তাকিয়ে আছি ধু-ধু মরুভূমির দিকে, কখনো দূরের পাহাড়গুলোর দিকে। কখনো সৌভাগ্যের কথা ভেবে শোকর আদায় করি এবং ভক্তিরসে আপ্লুত হযে দুরূদ পড়ি- ‘আল্লাহুম্মা ছাল্লি আলা মুহাম্মদ, ওয়া ‘আলা আলি মুহাম্মদ, কামা ছাল্লাইতা ‘আলা ইবরাহীমা ওয়া ‘আলা আলি ইবরাহীম, ইন্নাকা হামীদুম্-মাজীদ।’ এভাবে দেখতে দেখতে এসে গেলো কোবার মসজিদ। গাড়ী যখন কোবার মসজিদ অতিক্রম করছে, আমি তখন নতুন পুলকে পুলকিত এবং নতুন শিহরণে শিহরিত। হাজী আব্দুল ওয়াদূদ নবী-প্রশস্তির অনেক কবিতা জানতেন, উর্দূ ও ফার্সি। তাতে যেমন ছিলো ‘সূয ও সায’ তেমনি ছিলো ‘দরদ ও গোদায’। যেমন ছিলো জ্বলন ও যন্ত্রণা তেমনি ছিলো করুণ সুরের মূর্ছনা। সেসব কবিতা আমার জানা ছিলো না। শুধু মনে আছে এই পঙক্তিটি- ‘বা‘দ আয খোদা বুযুর্গ তুঈ কিছ্ছা মুখতাছার’। আর মনে আছে- ‘খাকে ইয়াছরিব আয দো ‘আলাম খোশতর আস্ত’। কোবায় সুবিস্তৃত খেজুর বাগান আগেও ছিলো সবুজ, এখন যেন তা আরো সবুজ, আরো সজীব! কিছুটা বাতাস আছে। খেজুরগাছের মাথাগুলো বাতাসে দুলছে। যেন তারা অজানা কোন আনন্দে মাতোয়ারা! অজানা হবে কেন! এ তো তাদের মদীনার পড়শী হওয়ার আনন্দ! বাগানে বেশ ছায়া আছে। কিছু মানুষ এখানে সেখানে খেজুর গাছের ছায়ায় বসে আছে। সম্ভবত তারা কোবার যিয়ারাতে এসেছে। এখন তো কোবা থেকেই মদীনার আবাদি শুরু হয়ে যায়। আবেগে আনন্দে, মদীনার স্নিগ্ধ বাতাসের স্পর্শে আমি এমন পুলকিত ও শিহরিত হলাম যেন জীবনে এই প্রথম সোনার মদীনায় আমার প্রবেশ। দুরূদে তখন এমন স্বাদ যেন ঠোঁট থেকে মধু ঝরছে- ‘ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।’ প্রথমবার যেমন ভয়ে বুকটা দুরু দুরু কাঁপছিলো, সেই একই কম্পন এখনো অনুভব করলাম, যদি ভুল হয়ে যায়! যদি আদবের লেহায ছুটে যায়! যখন দেখতে পেলাম সবুজ গম্বুজ, সেই একই রকম আত্মহারা হলাম, যেন এই প্রথম দেখতে পেলাম। এই সবুজ গম্বুজ আমি তো আমার মনের পর্দায় প্রতিদিন দেখি! আমি তো প্রতিদিন এই সবুজের স্নিগ্ধতা অনুভব করি! তবু মনে হলো, আজ এই প্রথম! এই সবুজের স্বপ্ন আমি চিরকাল দেখে যাবো। স্বপ্ন থেকে যখন জাগবো, আবার স্বপ্ন দেখবো। সবুজের স্বপ্নই হবে আমার সারা জীবনের স্বপ্ন। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, বাবুস্সালাম দিয়ে প্রবেশ করে যখন ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হলাম তাজদারে মদীনা ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওযা শরীফের অভিমুখে, পথ যেন আর ফুরাতে চায় না! এত সামান্য পথ এত দীর্ঘ কীভাবে মনে হয়! আসলে পথের দৈর্ঘ্যটা ছিলো সময়ের! ঐ পথে তখন আমি যেন অতিক্রম করছি চৌদ্দশ বছরের সুদীর্ঘ পথ। ধীরে ধীরে আমি যেন নবজন্ম লাভ করছি! এক এক কদম আগে বাড়ছি, আর একটু একটু করে যেন পরিশুদ্ধ হচ্ছি। বাবুস্সালাম থেকে শুরু হওয়া এই পথটুকু উম্মতের জন্য আসলেই যেন পরিশুদ্ধির পথ। এই পথটুকু পার হতে হতে, তাপ-অনুতাপে এবং শোচনা-অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হতে হৃদয়-অন্তর যেন পাক পবিত্র হয়ে যায়। উম্মতের জন্য এ পথটুকু হয়ত মেহেরবান আল্লাহ এ জন্যই রেখেছেন। তাই নবীর রওযা যিয়ারাতের সময় এ পথটুকু আমাদের পাড়ি দিতে হবে পাপ-জর্জরিত জীবনের প্রতি কুণ্ঠিত হয়ে, হৃদয়ে অনুশোচনার উত্তাপ নিয়ে এবং পেয়ারা নবীর শাফা‘আত লাভের আকুতি নিয়ে। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, রওযা শরীফের পাক মোকামে যখন হাযির হলাম, আমি যেন সবকিছু ভুলে গেলাম, নিজেকে, নিজের পরিপার্শ্বকে! সবকিছু আমার পরিচিত, তবু যেন সবকিছু নতুন! সবচিহ্ন মুছে গেলো বর্তমানের! এখন সবকিছু যেন অতীতের! এমনকি আমার এই শরীরী অসি-ত্বটাও যেন সুদূর অতীতের! ভক্তি-মুহব্বত ও বিনয়-আদবে বিগলিত হয়ে দুরূদ ও সালামের নাযরানা পেশ করলাম। ‘আছ্-ছালাতু ওয়াস্সালামু ‘আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ!’ হয়ত হাজী আব্দুল ওয়াদূদের ভক্তি-মুহব্বতের বরকতে সেদিন রওযা শরীফের মোকামে বেশ কিছু সময় অবস্থানের খোশ- কিসমত হলো। শৃঙ্খলারক্ষাকারী কেউ আমাদের সরে যেতে বললো না, অথচ নাযরানা পেশকারী মানুষের সংখ্যা ছিলো প্রচুর। কেবলামুখী হয়ে হাজী আব্দুল ওয়াদূদ দু‘আ করলেন, জারজার হয়ে কাঁদলেন এবং কেঁদে জারজার হলেন। বড় ‘সূয ও গোদায’ এবং দরদ-ব্যথা ছিলো তার দু‘আ-মুনাজাতে! পাঁচ বছর পর আবার প্রবেশ করলাম রিয়াযুল জান্নার টুকরায়। এখানেও যেন হলো নবপ্রবেশ। এখানেও অনুভবের একই রকম শিহরণ! আবেগের একই রকম তরঙ্গ! পবিত্রতার একই রকম অনুভূতি! এবং প্রাপ্তির একই রকম তৃপ্তি! জান্নাতের সকল নেয়ামত যেমন চিরনতুন, দুনিয়ায় জান্নাতের এই বাগিচাটিও চিরনতুন থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক! হাজী আব্দুল ওয়াদূদ এখন দুনিয়াতে নেই, তার ছেলেটি কী অবস্থায় আছে, আমার জানা নেই। তার কি মনে পড়ে মসজিদে নববীতে ছুফফার মাকামে তাকে আমি আল্লাহর কালামের তরজমা পড়িয়েছিলাম! আমার দিলের বড় তামান্না ছিলো এই ছেলেটি যেন আলিম হয়, বা-আমল আলিম, তার বাবার কলিজা যেন ঠাণ্ডা হয়। কামনা করি, অন্তত তার সন্তান যেন আলিম হয়। সেবার আমরা মদীনায় আম্বরিয়া এলাকায় ভাই মাসীহুল্লাহর বাসায় ছিলাম। মাসজিদুন্নবী থেকে বেশ দূরে ছিলো। রাতে সাহরী খেয়ে তাহাজ্জুদের সময় আমি একা রওয়ানা হতাম। শীতের হিমেল হাওয়া প্রাণমন শীতল করে দিতো। মনে হতো আগের যুগের মদীনায় গভীর রাতে আমি পথ চলেছি মসজিদুন্নবীর উদ্দেশ্যে! বড় পবিত্র ও অন্তর আলো-করা মনে হতো ঐ সময়টুকু। একটি আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতায় সেবার আমি খুবই আপ্লুত হয়েছিলাম। আম্বরিয়া থেকে মসজিদে নববী পর্যন্ত হেঁটে আসার সুযোগ আমার কখনো হয়নি, আমারও না, অন্য কারোই না, যদিও আমার খুব ভালো লাগতো হেঁটে হেঁটে আসতে। হারাম-অভিমুখী কোন না কোন গাড়ী পথচারীর সামনে এসে দাঁড়ায় এবং সসম্মানে তাকে তুলে নেয়। ‘আন্দায’টা থাকে এমন যেন আমাকে গাড়ীতে নিতে পেরে তিনি কৃতার্থ হলেন। ‘তুমি মসজিদে নববীর যাত্রী, আমি যে তোমাকে সঙ্গে নিতে পেরেছি সে আমার পরম সৌভাগ্য।’ সেবার যে কয়দিন আল্লাহ তা‘আলা মদীনা শরীফে রেখেছিলেন, প্রতি রাত্রে আমার এ সুখকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। কোন না গাড়ী কোমলভাবে পাশে এসে থেমেছে এবং একটি বিনয়-মধুর সম্ভাষণ শুনেছি, ‘দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন, আমিও হারামে যাচ্ছি। আরো মধুর অভিজ্ঞতা হয়েছিলো প্রতিদিন ইফতারের সময়। মদীনার বাসিন্দারা একেকজন বিরাট বিরাট দস্তরখান বিছাতেন। সেই দস্তরখানে রোযাদারদের তারা টেনে টেনে আদর-আবদার করে বসাতেন, যেন আমি তার কত প্রিয়! যেন কতকালের চেনা-জানা আমাদের! কখনো বড় মধুর বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতাম! দু’দিনের দু’টি ঘটনা তো কোনদিন ভুলতে পারবো না! ডান দিক থেকে এক দস্তরখানের দিকে হাত ধরে অনুরোধ করছেন নূরানী চেহারার এক বৃদ্ধ, অন্যদিক থেকে একই ভাবে হাত ধরে অনুনয় করছে ছোট্ট এক শিশু। হায়, তখন আমি যদি দু’ভাগ হয়ে যেতাম এবং দুই প্রজন্মের উভয় প্রতিনিধিকে খুশী করতে পারতাম! শেষে বৃদ্ধ লোকটি শিশুটিকে খুশী করার জন্যই যেন বললো, ঠিক আছে, তুমি ঐ দস্তরখানে বসো। শিশুটি বৃদ্ধের উদ্দেশ্যে বললো, শোকরান! ছোট্ট শিশুটির কোমল কণ্ঠের সেই শোকরান এখনো অপূর্ব এক রিনিঝিনির অনুভূতি সৃষ্টি করে আমার অন্তরে। শোকরান! কোথায় বাঙ্গালীর নীরস ধন্যবাদ, কোথায় ইংরেজের কর্কশ... আর কোথায় আরবের সুমধুর শোকরান! বিভিন্ন দস্তরখানের মেযবান তার বাচ্চা ‘সৈনিকদের’ পাঠিয়ে দিতেন মসজিদের দরজায়, যাও, আবদার করে করে মেহমানদের নিয়ে আসো। যে যত বেশী মেহমান আনবে সে তত বেশী পুরস্কার পাবে। মসজিদের দরজায় আছরের পর থেকেই শুরু হতো এ মধুর প্রতিযোগিতা। অনেক সময় আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতাম এ মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। দু’একবার আমাকে মীমাংসাও করতে হয়েছে কে কোন রোযাদারের হাত আগে ধরেছে! একদিন তো আমি নিজেই পড়ে গেলাম বিপদে। ইফতারের তখন বেশী বাকি নেই। একটু ‘তাড়িয়ে’ যাচ্ছি যাতে আমাদের দস্তরখান অর্থাৎ ভাই মাসীহুল্লাহর দস্তরখান পৌঁছতে পারি। মসজিদের প্রবেশ পথেই একটি বালক আমার হাত ধরে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, ‘তুমি যদি আমার সঙ্গে আসো তাহলে আল্লাহকে আমি বলে দেবো, তুমি খুব ভালো মানুষ!’ ভিতরে খুশির কী যে এক আলোড়ন হলো! একটি মাসুম বাচ্চা যদি আল্লাহর কাছে সাক্ষ্য দেয় যে, আমি ভালো মানুষ তো এর চেয়ে সৌভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে! নিজের দস্তরখানের কথা ভুলে গিয়ে আমি তার সঙ্গে রওয়ানা হলাম। যেতে যেতে বুঝলাম তার এই অদ্ভুত আবদারের কারণ! আজ সে একজনও মেহমান তার বাবার দস্তরখান হাযির করতে পারেনি। যার হাত ধরে সে-ই ‘আফওয়ান’ বলে চলে যায়। তাই তার মনটা আজ বড় বিষণ্ন। প্রতিদিন ইফতারের সময় আমি এসব দৃশ্য দেখতাম, আর ভাবতাম, রোযাদারকে এই সমাদরের এবং মেহমানকে এমন আদর-কদরের পাক জাযবা নিয়ে যারা বড় হবে তারা আগামী দিনের কত ভালো মানুষ হবে! মেহমান নাওয়াযির এরকম পবিত্র অনুভূতি কি খুঁজে পাওয়া যাবে আমাদের দেশে বড় বা ছোট কারো মধ্যে। প্রিয় পাঠক, তুমি হয়ত বলবে, ওদের তো এখন তেলের ছড়াছড়ি! এখন তো ওরা সম্পদের মাঝে খায় গড়াগড়ি! তাই পারে মেহমানদারি করতে এবং মেহমাননাওয়াযি দেখাতে! তাহলে চলো দেখি, অতীত কী বলে?! এই মদীনাতেই তো সুদূর অতীতে ঘটেছিলো বাতি নেভানোর ঘটনা! ছাহাবী মসজিদে নববী থেকে মেহমান নিয়ে ঘরে এসেছেন। স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী আছে ঘরে মেহমানের সামনে পেশ করার মত? স্ত্রী বললেন, শুধু বাচ্চাদের পরিমাণ সামান্য খাবার আছে। স্ত্রী তখন ভুলিয়ে ভালিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে দিলেন, আর নিজেরা বুদ্ধি করলেন, মেহমানকে নিয়ে যখন দস্তরখান বসবো, তুমি সলতে ঠিক করার ছলে বাতি নিভিয়ে দিয়ো, যাতে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি, আর মেহমান তৃপ্তির সঙ্গে খেতে পারেন। বুদ্ধিমতী স্ত্রী তাই করলেন। মেহমান বুঝতেই পারলেন না, কী কৌশলে এক ক্ষুধার্ত পরিবার তার মেহমানদারি করেছে। কিন্তু আলো-অন্ধকার সব অবস্থায় যিনি দেখেন তিনি তো সবই দেখতে পেয়েছিলেন এবং অহীর মাধ্যমে তাঁর পেয়ারা হাবীবকে সব জানিয়ে দিয়েছিলেন! তাই পরদিন আল্লাহর নবী সেই ভাগ্যবান ছাহাবীকে বললেন, তোমাদের বাতি নিভিয়ে দেয়া আল্লাহ খুব পছন্দ করেছেন। তখন তো মদীনায় সম্পদের ছড়াছড়ি ছিলো না, ছিলো অনাহার ও দারিদ্র্যের বাড়াবাড়ি! আসল কথা, মদীনা তখনো ছিলো হৃদয়-সম্পদে ধনী, এখনো তাই। আচ্ছা, এটা তো ছাহাবা-যুগের ঘটনা! এবার তাহলে বলি কয়েক শ বছর পরের ঘটনা! কোন্ কিতাবে পড়েছি, মনে নেই, তবে আমি নিজে পড়েছি, মদীনার যিয়ারাতে এসে তুর্কিস্তানের মুসাফির মেহমান হলেন মদীনার এক দরিদ্র পরিবারে। সেই পরিবার তার মেহমানদারি করছিলো এমন দরাজদিলির সাথে যে, তিনি বুঝতেই পারেননি পরিবারটির আসল অবস্থা কী ছিলো। একদিন তিনি দেখেন, মদীনার বাজারে তার মেযবান ঘরের পুরোনো জিনিস বিক্রি করছেন। হাকীকত বুঝতে পেরে তার তখন স্তব্ধ হওয়ার পালা। মেযবান যেন দেখতে না পান এভাবে তিনি সেখান থেকে সরে পড়লেন। বিদায়ের দিন মেহমান একথলিয়া আশরাফি পেশ করলেন হাদিয়া বলে। তাতে মেযবানের চোখে পানি এসে গেলো। ঝরঝর করে তিনি কেঁদে ফেললেন এবং মেহমানের হাত ধরে কাতর কণ্ঠে বললেন, আমার মেহমানদারিতে কী ত্রুটি ছিলো যে, এখন বিদায় বেলা তুমি আমাকে কষ্ট দিচ্ছো! প্রিয় পাঠক, এখানে রহস্য বিত্তের নয়, চিত্তের। চৌদ্দশ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নবুয়তের যামানা থেকে হিজায মদীনা অনেক দূরে চলে এসেছে। তবু অতীতের সেই চরিত্র ও স্বভাব এবং সেই চিত্র ও ছাপ কিছু না কিছু এখনো রয়ে গেছে। মেহমানদারি হয়ত আমরাও করতে পারবো, কিন্তু পারবো কি বুদ্ধি করে বাতি নিভিয়ে দিতে, কিংবা আশরাফির থলে ফিরিয়ে দিতে?! আরব মেযবানের সেই কৃতার্থ অভিব্যক্তি কোথায় পাবো আমরা, যা প্রাচীন আরবের কবি প্রকাশ করেছেন এভাবে- العبد الضيف ما دام نازلا ــ ولا شيمة لى غيرها العبدا মেহমান যতক্ষণ আমার ঘরে থাকেন, আমি মেহমানের গোলাম বনে থাকি/ আমার আর কোন স্বভাবে গোলামির ছাপ নেই। (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement