জুমাদাল উলা ১৪৩৭   ||   ফেব্রুয়ারি ২০১৬

তাফসীরে জালালাইন-এর টীকাকার কে?

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

 الحمد لله، وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد!

তাফসীরে জালালাইনের টীকাকার ও ব্যাখ্যাকার তো মাশাআল্লাহ অনেক আছেন। কিন্তু আমাদের এশিয়া উপমহাদেশে

"تعليقات جديدة من التفاسير المعتبرة لحل جلالين"

নামে যে টীকা সর্বত্র পাওয়া যায় তার সংকলক কে? প্রায় দশ বছর আগে মাসিক আলকাউসারের শিক্ষার্থীদের পাতায় এ প্রশ্নটি করা হয়েছিল। এর উত্তরে তখন আমাদের জানা নেইবলা হয়েছিল।

তবে পরবর্তীতে এ বিষয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত ছিল। হিন্দুস্তানের প্রসিদ্ধ ও বিজ্ঞ ইতিহাসবিদ হযরত মাওলানা নূরুল হাসান রাশেদ কান্ধলভী দামাত বারাকাতুহুমকেও এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি আহমাদ আলী সাহারানপুরী রাহ. কর্তৃক সংকলিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সে সম্ভাবনা থেকে ফিরে আসেন। আর এটাই বাস্তবসম্মত। কারণ, প্রথমত এর পক্ষে কোন দলীল-প্রমাণ ছিল না। দ্বিতীয়ত বিভিন্ন মুনকার ও ভিত্তিহীন বর্ণনা ও বক্তব্যে পূর্ণ এই হাশিয়া হযরত মাওলানা আহমদ আলী সাহারানপুরীর হওয়া সম্ভব নয়।

১৪৩৪ হিজরীতে দ্বিতীয়বার যখন দারুল উলূম দেওবন্দ যাওয়ার সুযোগ হয় তখন দারুল উলূমের কুতুবখানা থেকে ইস্তিফাদা করার চেষ্টা করেছি। হাশিয়া ছাড়া প্রকাশিত জালালাইনের একাধিক এডিশন এবং বিভিন্ন প্রকাশক কর্তৃক প্রস্তুতকৃত হাশিয়াসহ প্রকাশিত জালালাইনের বিভিন্ন এডিশন দেখার পর বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।

১৩৭৬ হিজরীতে দেওবন্দের এক কুতুবখানার মালিক করাচি থেকে প্রকাশিত হাশিয়া সম্বলিত জালালাইন কিতাবটি ফটোকপি করে প্রকাশ করেন। এরপর দেওবন্দওয়ালাদের থেকে কখনো আমদানি করে আবার কখনো ফটোকপি করে ঢাকায় প্রকাশিত হয়েছে। আফসোস যে, কোনো কোনো প্রকাশক অন্য প্রকাশকের শ্রম-সাধনার উপর হস্তক্ষেপ করার সময় অনেক ক্ষেত্রে পূর্বের প্রকাশকের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত রাখে না।

যাইহোক, সে সফরে দারুল উলূম দেওবন্দের কুতুবখানায় করাচি থেকে প্রকাশিত নুসখাটি সচক্ষে দেখেছি। এর শুরুতে পূর্ণ পৃষ্ঠাজুড়ে প্রকাশকের ভূমিকাও রয়েছে। প্রকাশক ছিল নূর মুহাম্মাদ,  اصح المطابع وكارخانۂ تجارت كتب

করাচি থেকে প্রকাশিত নুসখার প্রচ্ছদপৃষ্ঠায় লিখিত বক্তব্য ও প্রকাশক নূর মুহাম্মাদ নকশবন্দির ভূমিকা থেকে বোঝা যায়, এই হাশিয়াটি ১৩৬৮ হিজরীতে ছাপা হয়েছে। আর নূর মুহাম্মাদ সাহেব তা কারো মাধ্যমে সংকলন করিয়েছেন। কিছু প্রকাশকের অভ্যাসই হল সম্মানি মেটানোর পর লেখকের নাম উল্লেখ করার প্রয়োজন  বোধ না করা। তেমনি একসময় লেখকদেরও অভ্যাস ছিল বে-মওকা বিনয় প্রদর্শন করতে গিয়ে নিজের নাম প্রকাশ না করা। যে কারণেই হোক এই প্রচলিত হাশিয়ার শুরু বা শেষে হাশিয়া সংকলকের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

টীকার ভিতরে প্রাসঙ্গিকভাবে কোথাও টীকাকারের নাম এসেছে কি না তা আমার জানা নেই। করাচির কয়েকজন প্রবীণ আলেমের কাছেও জানতে চেষ্টা করেছি যে, নূর মুহাম্মাদ রাহ. কাকে দিয়ে এই টীকা সংকলন করিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ বলতে পারেননি।

করাচিতে প্রস্তুতকৃত ও ১৩৬৮ হিজরীতে প্রকাশিত এই টীকা দেওবন্দের জনৈক প্রকাশক ১৩৭৬ হিজরীতে ফটোকপি করে ছেপেছেন। আফসোস যে, টীকার শুরু-শেষ কোথাও মূল প্রকাশকের নাম-নিশানাও অবশিষ্ট রাখা হয়নি।

করাচিতে এখনও নূর মুহাম্মাদ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত নুসখা প্রকাশিত হচ্ছে এবং তার নামসহই প্রকাশিত হচ্ছে। নূর মুহাম্মাদের অনুমতিক্রমে কদীমী কুতুবখানা থেকে ফটোকপি করে প্রকাশিত এই হাশিয়ার এক নুসখা মুহতারাম হযরত মাওলানা ইবরাহীম হাসান ছাহেব -যীদা মাজদুহুম-এর কাছেও আছে। এই প্রবন্ধ লেখার সময় ঐ নুসখাটি অধমের কাছে ছিল। আল্লাহ তাআলা তাঁকে উত্তম বিনিময় দান করুন।

দেওবন্দের প্রকাশকগণ যদি অন্তত পূর্বের প্রকাশকের শুধু ভূমিকাটুকুই বহাল রাখতেন, তাহলে বর্তমান প্রচলিত নুসখার টীকাকার কেÑ তা অনুসন্ধানের জন্য আমাদের এত মেহনত-পরিশ্রম করতে হত না।

এখানে এ কথাও উল্লেখ করা জরুরি মনে করছি যে, বর্তমান হাশিয়ার প্রকাশক নূর মুহাম্মদ মরহুম তার ভূমিকায় এই হাশিয়ার পরিচয় দিতে গিয়ে অতিরঞ্জনের শিকার হয়েছেন। অবশ্য হিন্দুস্তান ও বাংলাদেশের ফটোকপি সংস্করণে সেই ভূমিকাটি নেই। তবে করাচি থেকে প্রকাশিত নুসখার প্রচ্ছদপৃষ্ঠায় যে উর্দু ইবারত ছিল এ সংস্করণগুলোতে তা উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকার কোনো প্রকাশক তা আরবীতেও রূপান্তর করে দিয়েছেন।

প্রকাশকের দাবি হল, হাশিয়াটি হাদীস ও তাফসীরের গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি থেকে সংগৃহিত। এমনও দাবি করা হয়েছে যে, এটি একটি জামে তাফসীর। ভূমিকায় এ কথাও স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে যে, এটি বিশুদ্ধ ও নির্ভুল হওয়ার বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়েছে।

বাস্তবে এ তিনটি দাবিই আপত্তিকর। হাশিয়ায় সামগ্রিকভাবে হাদীস ও তাফসীরের কিছু নির্ভরযোগ্য কিতাবের উদ্ধৃতি এসেছে বটে, কিন্তু যতগুলো উৎসগ্রন্থ থেকে এই হাশিয়া সংকলন করা হয়েছে তার সবগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। এর ভেতর অনেক কিতাব এমনও আছে, যার মধ্যে গলদ-সহীহ সব ধরনের বর্ণনা ও বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। আর আফসোসের বিষয় এই যে, টীকাকার ঐসব কিতাব থেকে অনেক মুনকার রেওয়ায়েত ও বক্তব্য নকল করে দিয়েছেন। বিশেষ করে রূহুল বয়ান’-এর মতো গাইরে মুসতানাদ ও অনির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে অনেক বেশি নকল করেছেন। এ কারণে এর বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতার দাবি সঠিক নয়।

অন্যদিকে জামে হওয়া বা না হওয়া একটি আপেক্ষিক বিষয়। তাই এ বিষয়ে আমি তেমন আপত্তি করব না। তবে আহলে ইলমমাত্রেরই জানা যে, কোনো তাফসীরের ব্যাপারে জামে হওয়ার দাবি কতটা স্পর্শকাতর। আর এই হাশিয়ার ব্যাপারে জামে তাফসীর হওয়ার দাবি করা আরও বেশি আপত্তিকর।

প্রকাশক নূর মুহাম্মাদ সাহেব জালালাইনের আগের নুসখাগুলির অনেক শেকায়েত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘তা ছাড়া জালালাইনের জামিউল বয়ানওয়ালা নুসখায় আহলে ইলমের জন্য দুটি সংক্ষিপ্ত তাফসীর (জালালাইন ও জামিউল বয়ান) এবং কিছু সংক্ষিপ্ত হাশিয়া ছাড়া আর কোনো ফায়েদা ছিল না...অথচ হাজী মুহাম্মাদ শফী ইবনে হাজী মুহাম্মাদ সায়ীদের তত্ত্বাবধানে মাতবায়ে মাজীদী কারপুর থেকে জামিউল বয়ানওয়ালা যে নুসখা ছেপেছিল তার হাশিয়ায় ইরাবুল কুরআনএবং শায়খুল ইসলাম সালামুল্লাহ দেহলভী রাহ.-কৃত আরবী হাশিয়া কামালাইন’ (বা তার গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচিত অংশগুলো) ছিল। ঐ নুসখার প্রথম পৃষ্ঠায়ই লেখা আছে,

تفسير الجلالين مع "الكمالين" الذي ألفه الفاضل الأجل المحدث الشيخ سلام الله الدهلوي.

শাহ ছাহেব (কাশ্মীরী) রাহ. ফায়যুল বারীতেশায়খুল ইসলাম সালামুল্লাহ দেহলবীর এই হাশিয়ার অনেক প্রশংসা করেছেন,

وانتقد حاشية علي القاري رحمه الله تعالى، المسماة بالجمالين، وهي مطبوعة أيضا (قاله الراقم)

মাতবায়ে মাজীদী থেকে মুহাম্মাদ শাফী ছাহেব মারহুম এবং তাঁর ভাই মুহাম্মাদ রফী মুহাম্মাদ সামী-এর তত্ত্বাবধানে জালালাইনের আরও একটি এডিশন  إفادات جديدة مفيدة নামে একটি হাশিয়াসহ ছাপা হয়েছে। এই হাশিয়া খুব সম্ভব মওলবী জাফর আলী নাগীনবী কর্তৃক প্রস্তুতকৃত। পৃ ৪৩, ৫০ ৩৬৬- এমনভাবে তার নাম এসেছে, যাতে মনে হয় তিনিই এই হাশিয়া প্রস্তুত করেছেন। والله أعلم

এমনিভাবে মাতবায়ে মুজতাবায়ী দিল্লী থেকে ১৩২৫ হিজরীতে আব্দুল আলী মিদরাসী-এর তাসহীহ (تصحيح) আব্দুল আহাদ সাহেবের তত্ত্বাবধানে যে নুসখা ছেপেছিল তাতেও আরবী কামালাইনসহ তাফসীরের কিতাবাদির সহায়তায় প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন হাশিয়া ছিল। করাচির নুসখার প্রকাশক নূর মুহাম্মাদ যে হাশিয়া প্রস্তুত করিয়েছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাতবায়ে মাজীদী ও মাতবায়ে মুজতাবায়ী থেকে প্রকাশিত হাশিয়াগুলির উপর ভিত্তি করেই তা প্রস্তুত করা হয়েছে। আর এই হাশিয়ায় নতুন যেসব টীকা যুক্ত করা হয়েছে কোনো তালিবে ইলম যদি হিম্মত করে মাতবায়ে মাজীদী ও মাতবায়ে মুজতাবায়ীর হাশিয়াগুলির সাথে তা মুকারানাকরে দেখে তাহলে দেখতে পাবে, এই সংযোজিত অংশে মুফীদ ও জরুরি কথা কতটুকু আর মুনকার ও অপ্রয়োজনীয় কথা কত।

নিজ নিজ খেদমত অনুযায়ী আল্লাহ তাআলা সকল প্রকাশককে তাঁর শায়ানে শান জাযা দান করুন। আর তাদের থেকে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে গেছে আল্লাহ তা ক্ষমা করে দিন। আমীন।

নূর মুহাম্মাদ নকশবন্দী নতুন করে লিপিকর দিয়ে জালালাইন লেখাননি। তবে তার দাবী এই যে, তিনি মতনের তাসহীহ করেছেন। লিসানে হালবা লিসানে কালের মাধ্যমে তাসহীহে তামের দাবী তো আমাদের দেশের ঐ প্রকাশকেরাও করেন যারা নূর মুহাম্মাদ সাহেবের নুসখার ফটোকপির ফটোকপি ছাপেন। তবে সবাই শুরুতে বা শেষে কিছু না কিছু যুক্ত করেন। এতেই তারা তুষ্ট, বরং পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট। কিন্তু কথা হল, প্রথম ছাপাও তাসহীহে তাম, দ্বিতীয় ছাপাও তাসহীহে তাম, তৃতীয় ছাপাও তাসহীহে তাম। সবই তাসহীহে তামকীভাবে হয়? তবে অনেক প্রকাশক এমনও আছেন যারা শুধু হুবহু ফটোকপি করে ছেপে দেন। নিজেদের পক্ষ থেকে কোনো কিছু যুক্তও করেন না, তাসহীহের দাবীও করেন না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মাতবায়ে মাজীদী থেকে জালালাইনের দ্বিতীয় যে এডিশন বের হয়েছে তার পৃষ্ঠা ২-এ সূরা বাকারার আয়াত সংখ্যা সম্পর্কে একটি হাশিয়া উল্লেখ করা হয়েছেÑ

"منشأ هذا الاختلاف اختلاف المصحف الكوفي و غيره في رؤوس الآي"

কিন্তু নূর মুহাম্মাদ সাহেব কর্তৃক প্রকাশিত নুসখা ও সেই নুসখা থেকে ফটোকপি করে যে নুসখাগুলো ছাপা হয়েছে তাতে "وغيره" শব্দটি নেই। এতে অর্থ একেবারেই বদলে যায়।

و إن كان في أصل العبارة تجوُّز أيضا، فإن المراد بالمصحف الكوفي -كما يتبادر من اللفظ- ليس المصحف الذي أرسله عثمان رضي الله تعالى عنه لأهل الكوفة، وإنما المراد المصاحف التي أعلمت الآيات فيها على طريقة أئمة العدد من أهل الكوفة، فمنشأ الاختلاف ليس اختلاف المصاحف، وإنما اختلاف طريق العد فيما بين أئمة العدد، وهو من اختلاف التنوُّع، مبني على التوقيف النبوي وتعليم أكابر الصحابة رضي الله تعالى عنهم، كما تقرر في محله. (قاله الراقم)

আশা করছি, আমাদের এই উপমহাদেশে প্রচলিত হাশিয়ায়ে জালালাইনের মুহাশ্শী ও টীকাকার সম্পর্কে এখন এতটুকু বয়ান যথেষ্ট হবে। এর চেয়ে বেশি নির্দিষ্ট করে বলার মত তথ্য-উপাত্ত এখন আমার কাছে নেই।

মাতবায়ে মাজীদীর উভয় নুসখা আশরাফুল উলূম বড়কাটারার মাকতাবায় ছিল। সেই নুসখাদ্বয় থেকেই মুতালাআ করা হয়েছে। আর মাতবায়ে মুজতাবাঈ-এর এডিশন ছিল বেরাদারে আযীয মুনশী মুহাম্মাদ মহিউদ্দীন এর কাছে। আল্লাহ তাআলা সবাইকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমীন। 

 

 

advertisement