সফর ১৪৩৭   ||   ডিসেম্বর ২০১৫

প্যারিস : সাদা সভ্যতার কালো দাগ

ওয়ারিস রব্বানী

প্যারিস হামলার প্রসঙ্গটি খবর হিসেবে পুরনো হয়ে গেছে। ১৩ নভেম্বর রাত নয়টা বিশ থেকে দশটা পর্যন্ত প্যারিসের ছয়টি জায়গায় হামলা চালানো হয়। এতে দেড়শর বেশি মানুষ নিহত হয়। আহত হয় কয়েকশ। হামলার পর প্যারিস প্রথমে হতভম্ব ও পরে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। এর একদিন পরই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওঁলাদ ঘোষণা করেন, ‘এ হামলার নির্দয় প্রতিশোধ নেওয়া হবে।পাশাপাশি বিশ্বের অন্য নেতারাও বড় বড় রণহুংকার দেন। প্রথম ধাক্কাতেই সিরীয় মুসলিম শরণার্থীদের অভিবাসন বন্ধের সিদ্ধান্ত ব্যক্ত হয়। আর এর পরপরই পৃথিবীব্যাপী জঙ্গিবাদ দমনের নামে মুসলিম নিগ্রহের নানা সিদ্ধান্ত, আহ্বান ও প্রস্তাবনা উচ্চারিত হতে থাকে। আজকের ইউরোপ-আমেরিকার সভ্য রাজা-মহারাজাদের কদাকার ও জিঘাংসাপ্রবণ চেহারা এতে উন্মোচিত হতে শুরু করে। আর এভাবেই প্যারিস-হামলার চেয়ে হামলা পরবর্তী জেদ ও হম্বিতম্বিই বড় খবরে পরিণত হয়।

পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, প্যারিস-হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস (ইসলামিক স্টেট) নামের বহুল আলোচিত একটি সংগঠন। দুদিন পর ইউরোপে তারা আরো হামলা চালাবে বলে অডিও-ভিডিও বার্তাও সম্প্রচার করা হয়েছে। ব্যস একারণেই এর সঙ্গে ঢালাওভাবে সারা দুনিয়ার মুসলমানদের দোষারোপ ও আক্রমণের নগ্ন মহড়া শুরু হয়েছে। খোদ আমেরিকাতেই অদ্ভুত রকম হুংকার শোনা যাচ্ছে বড় বড় নেতার মুখে। এভাবেই পশ্চিমাদের সাদা সভ্যতার কালো মুখের দাগ প্রকাশ্যে চলে আসছে। ২৩ নভেম্বর ঢাকার প্রথম আলোএ বিষয়ে একটি মন্তব্যধর্মী লেখা প্রকাশ করেছে ১১-এর পাতায়। সে লেখার দুটি চয়ন এখানে তুলে ধরা যায়।

... যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে পাড়ার পাদরি-সবাই দেশটাকে স্বর্গ হিসেবে বর্ণনা করতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। আমেরিকার সবকিছু ভালো, এত ভালো যে, সে যখন খারাপ কিছু করে, সেটাও নাকি আসলে অন্যের ভালোর জন্যই করে। যেমন ভিনদেশে আক্রমণ। যারা আক্রান্ত, তারা ঠিক বোঝে না, এটা তাদের ভালোর জন্যই করা হয়েছে। - তো এই আমেরিকার একদল মানুষের খুব কদর্য একটা রূপ বেরিয়ে এসেছে। যাঁদের কথা বলছি, তাঁরা সবাই নামজাদা রাজনীতিবিদ, তাঁদের কেউ কেউ আবার দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে চান। প্যারিসে ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামের সন্ত্রাসী সংগঠনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর এঁরা চেঁচানো শুরু করেছেন, এদেশের মুসলিমদের নজরদারি বাড়াতে হবে। সিরিয়া থেকে যেসব উদ্বাস্তু ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে, তাদের মধ্যে বেছে বেছে শুধু খ্রিস্টানদের ঢুকতে দেওয়া হবে, মুসলমান হলে তার জন্য দরজা বন্ধ। ৩০টির মতো অঙ্গরাজ্যের গভর্নররা বলেছেন, তাঁরা কেউ কোনো সিরিয় উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেবেন না। এঁদের মধ্যে নিউজার্সির গভর্নর ক্রিস্ট বলেছেন, এমনকি তিন বছরের বাচ্চাও যদি এসে বলে, প্লিজ ঢুকতে দাও, তিনি তাকে ঢুকতে দেবেন না।

মার্কো রুবিও নামের আরেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্বকার্ডকেও এক মাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি দাবি করেছেন, না, শুধু মসজিদের ওপর নজরদারি করলে চলবে না। মুসলমানরা একসঙ্গে জড়ো হয়, এমন যে কোনো স্থানের ওপর নজরদারি করতে হবে। ক্যাফে, রেস্তোরাঁ বা ইন্টারন্যাট ক্যাফে, যেখানেই মুসলমানরা মিলিত হয় ও ঘোঁট পাকায়- এমন সব জায়গা বন্ধ করে দিতে হবে। এঁদের কথা শুনে আমার সকালে ঘুম থেকে উঠে বসা লোলচর্মবিশিষ্ট এই হেওয়ার্থের কথা মনে হয়েছে। এই আমেরিকার বাইরের চেহারাটা যত আলো ঝলমলে, তার ভেতরে ঠিক ততটা অন্ধকার।

ইউরোপ-আমেরিকার আক্রমণবাদী নেতাদের বাইরে অন্যদের বেলায় ঘটেছে আরেক ঘটনা। প্যারিস-হামলার পর দেশে-বিদেশে বহু রাজনীতিক, দার্শনিক ও সুধীজন (পশ্চিমা মাপকাঠিতে যারা গ্রহণযোগ্য) পর্যন্ত বলেছেন, এমন হামলা ঘটতেই পারে। ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিনসহ আরব ও মুসলিম বিশ্বে রক্ত ঝরানোর যে ধারাবাহিক খেলা পশ্চিমারা চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে ক্ষুব্ধ, পীড়িত ও হতাশ মানুষেরা মরিয়া চোরাগোপ্তা হামলার পথ বেছে নিতেই পারে। পশ্চিমাদের উচিত নিজেদের কর্মপন্থা বদল করা। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক আলোচিত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক তার সাম্প্রতিক একটি কলামে লিখেছেন-আমরা সবসময় ঘোষণা করছি, আমরা যুদ্ধে লিপ্তহয়েছি। বলা হচ্ছে, আমাদের নির্দয় হতে হবে। আমাদের তাদের ভূখণ্ড আক্রমণ করতে হবে, তা না হলে তারা আমাদের ভখণ্ড আক্রমণ করবে। কিন্তু সেই দিন আর নেই যে আমরা অন্যের দেশ আক্রমণ করে নিজ দেশে নিরাপদ থাকতে পারব। নিউইয়র্ক, প্যারিস, মাদ্রিদ, লন্ডন, ওয়াশিংটনে হামলার ঘটনা আমাদের সে কথাই জানান দেয়। [২৪ নভেম্বর-১৫ প্রথম আলো]

পশ্চিমা গণমাধ্যম ও নেতারা এক রকম চাইলেও প্যারিস হামলার পর কীভাবে কীভাবে যেন অন্যমুখি মূল্যায়নই বেশি হয়েছে। হামলার ভয়াবহতার পাশাপাশি সামনে এসেছে ফ্রান্স ও পশ্চিমা শক্তির আগ্রাসী হঠকারিতার ফিরিস্তিও। সহানুভতির সঙ্গে পুনর্মূল্যায়নের কথামালাও উচ্চারিত হয়েছে। ঢালাও করণের বহু হুংকার সত্তে¡ও শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মাঝে আগাগোড়া সমস্যাটি স্থির মস্তিষ্কে ভাবার প্রেরণা জাগ্রত হয়েছে। ভাবনার এই জাগরণকে তো আমরা অশুভ লক্ষণ বলতে পারি না। হামলার ঘটনা অবশ্যই নিন্দনীয়। সে সঙ্গে ভাবনার জাগরণও প্রশংসনীয়। মূল কারণ ও উপলক্ষসহ রক্তপাতের সব আয়োজন বন্ধ হোক- আমাদের তো সেটাই চাওয়া উচিত। ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন এবং প্যারিস, লন্ডন, নিউইয়র্ক-কোথাও রক্ত না ঝরুক। আমরা সেটাই চাই। 

 

 

advertisement