সফর ১৪৩৭   ||   ডিসেম্বর ২০১৫

পোশাক : পোশাক-নির্দেশনার অজুহাত!

খসরূ খান

গত চার-পাঁচ বছরে এরকম ঘটনা আরো ঘটেছে। তবুও এ ঘটনায় কিছু ভিন্নতা চোখে পড়েছে। এবার কেবল হিজাব বা বোরকা পরতে মেয়েদের নিষেধ করা হয়নি। সঙ্গে ছেলেদেরও মানা করা হয়েছে পাঞ্জাবি-পায়জামা, টুপি-পাগড়ি পরে ক্যাম্পাসে ঢুকতে। ইসলাম ধর্মীয় পোশাক হিসেবে পরিচিত পোশাকগুলো পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওইসব পোশাক পরে ক্লাসেও যাওয়া যাবে না। পরীক্ষাও দেওয়া যাবে না। এত বড় প্রগতিশীল কাজটি কোথায় করা হলো? এই ঢাকার পাশে টঙ্গী-আইইউবিএটি নামের একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সাহেব পোশাক নির্দেশনাজারি করে কঠোরভাবে সেটি পালনে লেগে পড়েছেন। ঘটনা গত অক্টোবরের।

প্রতিবাদের মুখে সংবাদ সম্মেলনে ভিসি সাহেব বলেছেন, তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা পাঞ্জাবি, টুপি, বোরকা প্রভৃতি ধর্মীয় পোশাক পরতে পারবে না। তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাইলে ওসব বাদ দিয়েই আসতে হবে শিক্ষার্থীদের। ভিসির জারি করা পোশাক নির্দেশনায় (ড্রেসকোড) একথাও বলা হয়েছে যে ছেলেদের ক্লীন শেভ্ড হতে হবে- দাড়ি রাখা চলবে না।

গত চার-পাঁচ বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের হিজাব ব্যবহার বা বোরকা পরা নিয়ে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। নাটোরের একটি স্কুলে বাধ্যতামূলক বোরকা ব্যবহার নিয়ে প্রথমে উচ্চ আদালত থেকে স্বপ্রণোদিত একটি রায় দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, হিজাব বা বোরকা বাধ্যতামূলক করা যাবে না। প্রায় চার-পাঁচ বছর আগের ঘটনা ছিল সেটি। বহু বিতর্কিত ও সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতির বেঞ্চ থেকে এই রায়টি দেওয়া হয়েছিল। এরপর শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হয়েছিল এ বিষয়ে একটি পরিপত্র। ওই পরিপত্রে বলা হয়েছিল, বোরকা পরতে বাধ্যও করা যাবে না, বাধাও দেওয়া যাবে না। কিন্তু বোরকা পরতে বাধ্য করার পথ বন্ধ হলেও বাধা দেওয়ার ঘটনা ঠিকই ঘটে চলছিল। একশ্রেণীর বোরকাবিদ্বেষী শিক্ষিতজন যেন উঠে পড়েই লেগেছিল। কিন্তু এবারের পদক্ষেপ আরো একধাপ অগ্রসর। এবার ছেলেদেরকে টুপি-পাঞ্জাবি, পাগড়ি পরতেও নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ ছেলে কিংবা মেয়ে নয়- ধর্মীয় (ইসলামী) কোনো পোশাক বা বৈশিষ্ট্য কেউ ধারণ করতে পারবে না। ভিসি এ-ও বলেছেন যে, এসব পোশাকে জঙ্গিবাদী তৎপরতা চালানো হয়, এজন্যই এসব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত যারা বোরকা বা হিজাব ব্যবহারে বাধা দিয়েছেন তারাও এমন জঙ্গিবাদীঅজুহাত খাড়া করেননি। এবার সেটাও করে দেখানো হলো। ভিসি বলেছেন ড্রেসকোডের কথা, কিন্তু সঙ্গে ছেলেদের দাড়ি রাখতেও নিষেধ করেছেন। তবে কি দাড়িও এখন পোশাকের মধ্যে পড়ে গেল? তা না হলে পোশাক নির্দেশনার শ্লোগান দিয়ে বোরকা টুপি-দাড়ি একসঙ্গে সব নিষিদ্ধ করা হলো কোন যুক্তিতে?

এতে বোঝা যায়, ড্রেসকোড বা পোশাক নির্দেশনা আসলে একটি ছদ্মবেশ। মূল বিষয় হচ্ছে ইসলাম ধর্মীয় প্রতীক ও পরিচিতি নিষিদ্ধ করা। সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের এক প্রধানকর্তা তার বিরাট ক্ষমতা দেখালেন। এদেশে এখন এমন পাতি ক্ষমতাধররাই কি শক্তিমান? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার সঙ্গী অন্য মন্ত্রীরা প্রায়ই বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কি তাহলে বোরকাহীনতা, টুপি-পাগড়ি, দাড়ি-হীনতা? আইইউবিএটির কর্তারা বীরদর্পে ধর্মীয়পোশাক ও পরিচিতি নিষিদ্ধ করে দিলেন। অসহায় ছাত্র-ছাত্রীরা মানববন্ধন করল। আবেদন-নিবেদন করল। ভিসি পাত্তাই  দিলেন না। উল্টো ঝাল ঝেড়ে বললেন, ড্রেসকোড মেনে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি হতে চাইলে হবে, পছন্দ না হলে তাদের জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে এগুলো অনুমোদন করা হয়। ভিসি মহোদয়ের এ কথায় অবশ্য বোঝা গেল, দেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়-পরিচালক এসব ধর্মীয় পোশাক ও পরিচিতিকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বাধা মনে করেন না। আরো বোঝা গেল, এসব পোশাক নিষিদ্ধ করায় আইনী কিংবা সরকারি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। থাকলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পোশাক অনুমোদিত হতে পারত না। এমনকি এটাও বোঝা গেল যে অন্য ভিসি সাহেবরা এসব পোশাক দেখে তার মতো ভীত ও সংকুচিতও হয়ে পড়েন না। সুতরাং ধর্মীয় পোশাক নিয়ে যা যা করার, নিজ দায়িত্বে তিনিই করেছেন। এমন ক্ষুদ্রাত্মা ভিসি সাহেবের জন্য আমাদের করুণা জমা রইল।

আর ড্রেসকোডের অজুহাত? এতো সম্পূর্ণই এক-পাক্ষিক, মনগড়া ও অযৌক্তিক একটি অজুহাত। কারণ, এই কোডটা এত শাশ্বত ও অনতিক্রম্য হিসেবে কে ধার্য করেছে? তিনিই তো। সুতরাং এটা ঠিকঠাক করে নিলেই তো তিনি পারেন। তখন তার কোডও ঠিক থাকবে। শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় পোশাক পরে ক্যাম্পাসেও যেতে পারবেন। ধর্মীয় কিংবা মানবাধিকার নাকচ করার মতো ড্রেসকোড তো আসলে কোনো কোডই নয়। বরং সে কোডের সবটুকুই বর্বরতা। এমন বর্বরতার পক্ষে যারা অবস্থান নেন, তারাই কি তবে ভদ্রলোক! শিক্ষিত সমাজ গড়ার কারিগর! হায়!! 

 

 

advertisement