হাদীস : “যে ইমামের পেছনে নামায পড়ে ইমামের কেরাতই তার কেরাত”
এটি হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ. (১৩২-১৮৯হি.)ও তাঁর ‘আলআছার’ গ্রন্থে তা বর্ণনা করেছেন। তাঁর সনদে হাদীসটির আরবী পাঠ নিম্নরূপ :
أخبرنا أبو حنيفة قال : حدثنا أبو الحسن موسى بن أبي عائشة، عن عبد الله بن شداد بن الهاد، عن جابر بن عبد الله رضي الله عنهما قال : صلى رسول الله صلى الله عليه وسلم، ورجل خلفه يقرأ، فجعل رجل من أصحاب النبي صلى اللهُ عليه وسلم ينهاه عن القراءة في الصلاة، فقال : أتنهاني عن القراءة خلف نبي الله صلى الله عليه وسلم، فتنازعا حتى ذكر ذلك للنبي صلى الله عليه وسلم، فقال النبي صلى الله عليه وسلم : من صلى خلف إمام ، فإن قراءة الإمام له قراءة.
অর্থাৎ ইমাম মুহাম্মাদ আবু হানীফা থেকে, তিনি আবুল হাসান মূসা ইবনে আবী আয়েশা থেকে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ ইবনে হাদ থেকে, তিনি জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়েছেন। তাঁর পেছনে এক লোক কুরআন পড়তে আরম্ভ করল। তখন এক সাহাবী তাকে নামাযে (ইমামের পেছনে) কুরআন পড়তে নিষেধ করলে সে বলল, তুমি কি আমাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে কুরআন পড়তে নিষেধ করছ? এভাবে দুজনের মাঝে তর্ক হলে বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উল্লেখ করা হল। তিনি বললেন, যে ইমামের পেছনে নামায পড়ে ইমামের কেরাতই তার কেরাত। -কিতাবুল আছার, ইমাম মুহাম্মদ ১/১১১, হাদীস ৮৬
এখানে আমরা দেখলাম, মূসা ইবনে আবী আয়েশা রাহ. থেকে এই হাদীসটি আবু হানীফা রাহ. বর্ণনা করেছেন এবং তাতে জাবির রা.-এর উল্লেখ আছে। [1]
মূসা ইবনে আবী আয়েশা রাহ. থেকে ইমাম সুফিয়ান ছাওরী ও শারীক ইবনে আবদুল্লাহ নাখায়ীও এই হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তাতেও জাবির রা.-এর উল্লেখ আছে।
বর্ণনাটি এই-
قال أحمد بن منيع : أنبأنا إسحاق الأزرق، حدثنا سفيان وشريك، عن موسى بن أبي عائشة، عن عبد الله بن شداد، عن جابر : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : من كان له إمام ، فقراءة الإمام له قراءة [2].
অর্থাৎ ইমাম আহমদ ইবনে মানী ইসহাক আলআযরাক থেকে, তিনি সুফিয়ান (ছাওরী) ও শারীক (ইবনে আবদুল্লাহ) থেকে, তিনি মূসা ইবনে আবী আয়েশা থেকে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ থেকে, তিনি জাবির রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যার ইমাম আছে ইমামের কেরাতই তার কেরাত। -ইতহাফুল খিয়ারাতিল মাহারা, বূসীরী (আলমাতালিবুল আলিয়া’র সাথে মুদ্রিত) ২/৪৫০
শিহাবুদ্দীন বূসীরী রাহ. (৮৪০হি.) বলেন,
إسناد حديث جابر الأول يعني إسناد ابن منيع صحيح على شرط الشيخين.
‘আহমদ ইবনে মানীর সনদ সহীহাইনের (বুখারী-মুসলিমের) সনদের সমমানের।’
মূসা ইবনে আবী আয়েশা রাহ.-এর আরেকজন শাগরিদ তলহাও এই হাদীস তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন এবং তাতেও জাবির রা.-এর উল্লেখ আছে।
বর্ণনাটি এই-
قال البيهقي : أخبرنا أبو عبد الله الحافظ، أنا أبو علي الحافظ، نا عبد الله بن سليمان بن الأشعث، نا عبد الملك بن شعيب بن الليث بن سعد، نا ابن وهب، حدثني الليث بن سعد، عن طلحة، عن موسى بن أبي عائشة، عن عبد الله بن شداد بن الهاد، عن جابر، أن رجلا صلى خلف رسول الله صلى الله عليه وسلم في الظهر أو العصر يعني فقرأ، فأومى إليه رجل فنهاه فأبى، فلما انصرف قال : أتنهاني أن أقرأ خلف النبي صلى الله عليه وسلم؟ فتذاكرا ذلك حتى سمع النبي صلى الله عليه وسلم، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : من صلى خلف إمام ، فإن قراءة الإمام له قراءة.
অর্থাৎ ইমাম বায়হাকী আবু আবদুল্লাহ (হাকেম) থেকে, তিনি আবু আলী থেকে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে সুলায়মান ইবনে আশয়াছ থেকে, তিনি আবদুল মালিক ইবনে শুআইব ইবনে লাইছ ইবনে সা‘দ থেকে, তিনি (আবদুল্লাহ) ইবনে ওয়াহাব থেকে, তিনি তলহা থেকে, তিনি মূসা ইবনে আবী আয়েশা থেকে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ থেকে, তিনি জাবির রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, এক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে যোহর বা আসরের নামাযে কুরআন পড়েছে। একজন তাকে ইশারা করে নিষেধ করলেন। কিন্তু সে তা মানল না। নামায শেষে সে বলল, তুমি কি আমাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে কুরআন পড়তে নিষেধ করছ? এভাবে দুজন আলোচনা শুরু করলে একপর্যায়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শুনলেন। তখন তিনি বললেন, যে ইমামের পেছনে নামায পড়ে ইমামের কেরাতই তার কেরাত। -আলকিরাআত খালফাল ইমাম, বায়হাকী পৃ. ১৪৯
এই তলহা সম্ভবত তলহা ইবনে আবু সায়ীদ আলইসকানদারী। তার থেকে লাইছ ইবনে সা‘দ রাহ. বর্ণনা করেন। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ইমামগণ তার প্রশংসা করেছেন।
ইমাম আহমদ বলেন, ‘তার থেকে লাইছ ইবনে সা‘দ ও ইবনুল মুবারক বর্ণনা করেছেন। আমি তার মধ্যে কোনো সমস্যা মনে করি না।’ ইমাম আবু যুরআ বলেন, ‘তিনি ছিকা।’ ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী বলেন, ‘তিনি পরিচিত।’ ইবনে হিব্বান তাকে ‘আছছিকাত’ গ্রন্থে (৬/৬৮৯) উল্লেখ করেছেন।
দেখুন : আলইলাল ওয়া মারিফাতুর রিজাল ২/৫৩০; আলজারহু ওয়াততা‘দীল, ইবনে আবী হাতেম ৪/ ৪৭৬-৪৭৭; তাহযীবুল কামাল ৯/২৪২
মূসা ইবনে আবী আয়েশা রাহ.-এর আরেকজন শাগরিদ ইসরাইল ইবনে ইউনুসও একই হাদীস তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর বর্ণনাটিও তাঁদের বর্ণনার প্রায় সমর্থনে।
বর্ণনাটি এই-
قال الطحاوي : حدثنا أبو بكرة قال : ثنا أبو أحمد قال : ثنا إسرائيل، عن موسى بن أبي عائشة، عن عبد الله بن شداد، عن رجل من أهل البصرة، عن رسول الله صلى الله عليه و سلم نحوه.
অর্থাৎ ইমাম তহাবী আবু বাকরা থেকে, তিনি আবু আহমদ থেকে, তিনি ইসরাইল (ইবনে ইউনুস) থেকে, তিনি মূসা ইবনে আবী আয়েশা থেকে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ থেকে, তিনি বসরাবাসী একজন থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রায় অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। -শরহু মাআনিল আছার ১/৩৫৫
আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ পর্যন্ত এই হাদীসের সনদ সহীহ।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে জন্মগ্রহণ করেছেন। আর সাহাবায়ে কেরামের অভ্যাস ছিল, দুআ ও বরকতের জন্য তাঁরা শিশুসন্তানদের/শিশুদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যেতেন। তবে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কি না সেটা বিশেষভাবে প্রমাণিত নয়। এজন্য তাঁকে কেউ কেউ তাবেয়ীদের মধ্যে গণ্য করেছেন আর কেউ কেউ সাহাবীদের মধ্যে।
তিনি ওমর ইবনে খাত্তাব, মুআয ইবনে জাবাল, আলী, হামযা, আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আয়েশা, মায়মুনা ও উম্মে সালামা রা. প্রমুখ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। [3] কোনো তাবেয়ী থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন বলে জানা যায় না। এসব কারণে رجل من أهل البصرة (জনৈক বসরাবাসী ) -এর সাহাবী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
সনদের প্রাসঙ্গিক আলোচনা
এই হাদীসের সনদ সহীহ, এর রাবীগণ সকলেই ছিকা। এবং হাদীস সহীহ হওয়ার পাঁচ শর্ত এতে বিদ্যমান। ইমাম বদরুদ্দীন আইনী রাহ. (৮৫৫ হি.) বলেন,
حديث أبي حنيفة حديث صحيح
‘আবু হানীফা রাহ.-এর বর্ণনাকৃত হাদীসটি সহীহ হাদীস।’ ইবনুল হুমাম রাহ. (৮৬১ হি.) বলেন,
رفعه أبو حنيفة بسند صحيح
‘এটি আবু হানীফা রাহ. সহীহ সনদে মারফূ হিসেবে (জাবির রা.-এর উল্লেখসহ) বর্ণনা করেছেন।’ দ্রষ্টব্য. ফাতহুল কাদীর ১/৩৩৮; আলবিনায়া ২/৩১৭
ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.সহ আরো অনেকে এটি দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. ‘আলআছার’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন,
وبه نأخذ، وهو قول أبي حنيفة رضي الله عنه
‘এ হাদীস অনুযায়ীই আমাদের আমল এবং এটিই আবু হানীফা রা.-এর বক্তব্য।’
এই হাদীস থেকে বোঝা গেল, ইমামের কুরআন পড়াই মুকতাদীর জন্য যথেষ্ট। মুকতাদীর আলাদাভাবে কুরআন পড়ার প্রয়োজন নেই। [4]
এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, জাবির রা. এই হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে কথাটি বর্ণনা করেছেন অর্থাৎ যে ইমামের পেছনে নামায পড়ে ইমামের কেরাতই তার কেরাত- কাছাকাছি শব্দে বেশ কয়েকজন সাহাবী-তাবেয়ী একই ফতোয়া দিয়েছেন, যা থেকে বোঝা যায়, এটি সুন্নাহ থেকেই গৃহীত এবং খাইরুল কুরূনে তা খুবই প্রসিদ্ধ ছিল। আর এর মর্ম-উদ্দেশ্য তো বিভিন্ন হাদীসে এবং অনেক সাহাবী-তাবেয়ীর ফতোয়ায় বর্ণিত হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, ইমামের কেরাতই মুকতাদীর পক্ষে যথেষ্ট- এটি সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীন-যুগের ‘আমলে মুতাওয়াতির’ (যুগ পরম্পরায় চলে আসা ব্যাপক ও অনুসৃত কর্মধারা)-এর মাধ্যমে প্রমাণিত। এর বিশুদ্ধতা তাঁদের কাছে ছিল এক স্বীকৃত বিষয়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, যায়েদ ইবনে ছাবিত, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ ও আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. প্রমুখের আমলও এ অনুযায়ীই ছিল। যদি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুকতাদীকে ইমামের পেছনে কুরআন পড়ার নির্দেশ দিতেন, তাহলে তাঁদের সেটা জানা থাকত। এবং তাঁরা সে অনুযায়ীই আমল করতেন আর মানুষকে শেখাতেন। অথচ তাঁদের আমল ছিল ইমামের পেছনে কুরআন না পড়া এবং তাঁরা মানুষকে এরই তালীম দিয়েছেন।
তো বিষয়বস্তুর দিক থেকে আলোচিত হাদীসটির বিশুদ্ধতা সাহাবা-তাবেয়ীন-যুগের ‘আমলে মুতাওয়াতিরে’র মাধ্যমে প্রমাণিত। এবং এর বিশুদ্ধতা তাঁদের কাছে ছিল এক স্বীকৃত বিষয়। সেই সঙ্গে এটি যে সনদে বর্ণিত হয়েছে সেটাকেও বিভিন্ন মুহাদ্দিস সহীহ বলেছেন। এ সত্তে¡ও কিছু সংখ্যক হাদীস বিচারক ইমাম এর উপর সনদগত কিছু আপত্তি উত্থাপন করেছেন। এগুলোর যুক্তিসঙ্গত জবাব বিদ্যমান ছিল। এবং বিভিন্ন মুহাদ্দিস তা পেশও করেছেন, যাঁদের মধ্যে এমন কিছু মুহাদ্দিসও রয়েছেন, যাঁরা কেরাত খালফাল ইমামের প্রবক্তা। এ সত্তে¡ও কিছু সংখ্যক মানুষকে ঐসব আপত্তির পুনরাবৃত্তি করতে দেখা যায়। এজন্য মুনাসিব মনে হয়েছে, বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার জন্য নমুনাস্বরূপ কিছু আপত্তি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু পর্যালোচনা করা।
এই হাদীসে কি জাবির রা.-এর উল্লেখ সহীহ নয়?
অনেক জোরেশোরে এই আপত্তি করা হয় যে, এই হাদীসে জাবির রা.-এর উল্লেখ ‘সহীহ’ নয়! কোনো রাবী তা ভুলে বাড়িয়ে দিয়েছে! অর্থাৎ হাদীসটি মুরসাল!
আপত্তির উদ্দেশ্য সম্ভবত এই যে, আলোচিত হাদীস দ্বারা ইমামের পেছনে কুরআন না পড়া তখনই প্রমাণিত হবে যখন জাবির রা.-এর উল্লেখ ‘সহীহ’ হবে। সুতরাং এটি যখন সহীহ নয় তখন এর দ্বারা দলীল পেশ করাও সঠিক হবে না। অথচ এই বর্ণনায় জাবির রা.-এর উল্লেখ ভুল বলে দাবি করা ভুল। তা সঠিক বলে ধরে নেওয়া হলেও এই হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করা যাবে। (এ সম্পর্কে কিছু কথা সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ)
এই হাদীসে জাবির রা.-এর উল্লেখ কেন ‘সহীহ’ না? এটি কে বাড়িয়েছে? এ সম্পর্কে দারাকুতনী রাহ.-এর বক্তব্যের সারসংক্ষেপ এই যে, মূসা ইবনে আবী আয়েশা রহ.-এর ছিকা শাগরিদ সুফিয়ান ছাওরী, শুবা, ইসরাইল ইবনে ইউনুস, শারীক ইবনে আবদুল্লাহ নাখায়ী, আবু খালেদ দালানী, আবুল আহওয়াছ, সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা, জারীর ইবনে আবদুল হামীদ প্রমুখ হাদীসটি জাবির রা.-এর উল্লেখ ছাড়া বর্ণনা করেছেন। (তাঁর ধারণামতে) শুধু আবু হানীফা ও হাসান ইবনে উমারা জাবির রা.-এর উল্লেখসহ বর্ণনা করেছেন। আর এঁরা দুজনই (তাঁর ধারণামতে) যয়ীফ!? সুতরাং ওঁদের বর্ণনাই সহীহ!
তো দারাকুতনী রাহ.-এর মতে এই হাদীসে জাবির রা.-এর উল্লেখ সহীহ না হওয়ার কারণ, তিনি ধারণা করেছেন, এই হাদীসটি জাবির রা.-এর উল্লেখসহ বর্ণনার ক্ষেত্রে আবু হানীফা ও হাসান ইবনে উমারা একা। অথচ এ বর্ণনায় আবু হানীফা ও হাসান ইবনে উমারা রাহ. একা নন, বরং তাঁদের তিন-চারজন মুতাবি রয়েছে। মূসা ইবনে আবী আয়েশা রাহ.-এর শাগরিদ ইমাম সুফিয়ান ছাওরী, শারীক ইবনে আবদুল্লাহ ও তলহাও এই হাদীস তাঁর থেকে জাবির রা.-এর উল্লেখসহ বর্ণনা করেছেন। [5] সুতরাং দারাকুতনী রাহ.-এর এই ধারণা ভুল যে, এই হাদীস জাবির রা.-এর উল্লেখসহ বর্ণনার ক্ষেত্রে আবু হানীফা ও হাসান ইবনে উমারা একা।
এমনিভাবে তাঁর এই ধারণাও ভুল যে, আবু হানীফা রাহ. যয়ীফ। এটি তিনি বাস্তবতা ও শাস্ত্রের কেন্দ্রীয় ইমামদের বিপরীত বলেছেন। আবু হানীফা রাহ. হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও ছিকা ছিলেন। বরং তিনি ছিলেন বিশিষ্ট হাফিযুল হাদীস ও হাদীস-সুন্নাহর ইমাম। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কোনো প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। এর জন্য প্রয়োজন একাধিক খণ্ডবিশিষ্ট কিতাব। এবং বিভিন্ন ভাষায় তা লেখাও হয়েছে। পাঠকগণ ঐসব কিতাব পাঠ করতে পারেন। এখানে আমি খুব সংক্ষেপে কয়েকটি কথা আরয করছি।
এক. আবু হানীফা রাহ. ফিকহে ইসলামীর অনুসৃত ইমাম, বরং এর প্রথম সংকলক। ১২০ হিজরী থেকে এখন পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ তাঁর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনুযায়ী কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ করে আসছে, যার মধ্যে যেমন রয়েছে সাধারণ মানুষ তেমনি রয়েছেন উঁচুপর্যায়ের ফকীহ, মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, মুআররিখ, কবি-সাহিত্যিক, বিচারক ...। এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শহরে তাঁর মাযহাব অনুযায়ী ফতোয়া ও কাযা জারি হয়েছে। অন্যান্য মাযহাবের বিশ্লেষকগণ ফিকহী মতামতের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে তাঁর মতও গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন।
আর কারো ফিকহে ইসলামীর ইমাম হওয়ার জন্য হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তার শুধু যব্ত ও ইতকানই যথেষ্ট নয়, বরং তার হাদীস শাস্ত্রের অগাধ জ্ঞান থাকা, বিপুলসংখ্যক হাদীস ও আছার মুখস্থ থাকা, রেওয়ায়েতের বিচার-বিশ্লেষণ ও যাচাই-বাছাইয়ে ইমামের স্তরে উপনীত হওয়া জরুরি। এ ছাড়া কারো ‘মুজতাহিদ ইমাম’ হওয়া অসম্ভব। সুতরাং আবু হানীফা রাহ. ফিকহে ইসলামীর ইমাম হওয়া যেমন মুতাওয়াতির তেমনি ইমাম হওয়ার যেসব অনিবার্য গুণ ও বৈশিষ্ট্য সেগুলো তাঁর মধ্যে বিদ্যমান থাকাও মুতাওয়াতির। যার অনিবার্য দাবি হল, তিনি শুধু যাবিত ও মুতকিন রাবীই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন হাদীস ও সুন্নাহর ইমাম, যাঁরা সাধারণ জরহ-তাদীলের ঊর্ধ্বে হয়ে থাকেন, তাঁরা বরং অন্যদের জরহ-তাদীল করেন।
দুই. আবু হানীফা রহ.-এর যাবিত ও মুতকিন রাবী হওয়া, হাদীস ও সুন্নাহর ইমাম হওয়া সনদগত মুতাওয়াতিরের মাধ্যমেও প্রমাণিত। সনদগত মুতাওয়াতির কতজন দ্বারা প্রমাণিত হয় এ ব্যাপারে মতভেদ থাকলেও সর্বোচ্চ মত হল সত্তরজন। অথচ আবু হানীফা রহ.-এর প্রশংসাকারীদের সংখ্যা সত্তরের অধিক, যাঁদের সকলেই কিংবা অধিকাংশই হলেন প্রসিদ্ধ ও উচ্চস্তরের ইমাম। তাঁর তাকওয়া-খোদাভীতি, হিফয-ইতকান, বিশ্বস্ততা-নির্ভরযোগ্যতা, ইমামত-পাণ্ডিত্য প্রমাণিত হওয়ার জন্য এঁদের পাঁচজন কিংবা দশজনের প্রশংসাই যথেষ্ট।
ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন (১১৪হি.), হাম্মাদ ইবনে আবী সুলায়মান (১২০হি.), মিসআর ইবনে কিদাম (১৫৫হি.), আয়্যুব সাখতিআনী (১৩১হি.), সুলায়মান ইবনে মেহরান আলআমাশ (১৪৮হি.), শুবা ইবনুল হাজ্জাজ (১৬০হি.), সুফিয়ান ছাওরী (১৬১হি.), হাসান ইবনে সালেহ (১৬৯হি.), সায়ীদ ইবনে আবী আরূবা (১৫৬হি.), হাম্মাদ ইবনে যায়দ রাহ. (১৭৯হি.)-এই দশজনের প্রশংসাই তো যথেষ্ট। এই পর্বত-প্রমাণ ইলম ও হিফয, তাকওয়া ও তহারতের অধিকারী ইমামগণ কোনো বিষয়ে সাক্ষ্য দিলে এঁদের সাক্ষ্যই তো কবুল করা হবে। এর বিপরীত সাক্ষ্য নিঃসন্দেহে প্রত্যাখ্যাত হবে।
এঁদের সঙ্গে এঁদের মত পর্বত-প্রমাণ ইলম ও হিফয, তাকওয়া ও তহারতের অধিকারী আরো দশজন ইমাম- আবদুল্লাহ ইবনে শুবরুমা (১৪৪হি.), ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ আলকাত্তান (১৯৮হি.), আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১৮১হি.), যুহাইর ইবনে মুআবিয়া (১৭২হি.), আবদুল মালিক ইবনে আবদুল আযীয ইবনে জুরায়জ (১৫০হি.), আবদুর রায্যাক (২১১হি.), মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস শাফেয়ী (২০৪হি.), ওকী ইবনুল র্জারাহ (১৯৭হি.), সুফিয়ান ইবনে উয়ায়না রাহ. (১৯৮হি.)-কে যোগ করলে প্রশংসাকারীর সংখ্যা হবে বিশ।
এঁদের অধিকাংশই তাঁকে দেখেছেন, তাঁর থেকে কুরআন-সুন্নাহর ইলম গ্রহণ করেছেন। এঁদের মধ্যে ‘উসূলে সিত্তা’র ছয় ইমাম বুখারী, মুসলিম...এর শায়খ, তাঁদের শায়খদের শায়খও রয়েছেন। এঁরা সকলেই তাঁর তাকওয়া, ইলম, ফিকহ ও হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্যতার উচ্ছ¡সিত প্রশংসা করেছেন। নিম্নে কয়েকজনের প্রশংসা উল্লেখ করা হল।
১. (ইমাম সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা ও ওকী ইবনুল জাররাহ প্রমুখের উস্তায) ইমাম মিসআর ইবনে কিদাম (১৫৫হি.) বলেন, ‘আমরা আবু হানীফার সঙ্গে হাদীস অন্বেষণ করেছি তো তিনি আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেছেন। আমরা তার সঙ্গে যুহদ অর্জনে নিমগ্ন হয়েছি তো আমাদের চেয়ে অগ্রগামী হয়ে গেছেন। এবং আমরা তার সঙ্গে ফিকহ হাসিল করেছি তো তিনি কী (অসাধ্য সাধন) করেছেন তা তো তোমরাই দেখছ।’[6] -মানাকিবু আবী হানীফা ওয়া সাহিবায়হি আবী ইউসুফ ওয়া মুহাম্মাদ, ইমাম যাহাবী পৃ. ৪৩
২. (ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ আলকাত্তান, আবদুর রহমান ইবনে মাহদী প্রমুখের উস্তায) শাইখুল ইসলাম ইমামুল হুফ্ফায ইমাম সুফিয়ান ছাওরী বলেন, ‘আবু হানীফা (রাহ.) ছিকা রাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের মধ্যে সেটা গ্রহণ করতেন যা তাঁর নিকট ‘সহীহ’। [7] এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলের মধ্যে শেষটি গ্রহণ করতেন। এবং যার উপর ক‚ফার আলেমগণকে পেয়েছেন সেটা গ্রহণ করতেন। এরপর একশ্রেণির লোক তার নিন্দা করেছে। আল্লাহ আমাদের সকলকে মাফ করুন।’ -ফাযাইলু আবী হানীফা ওয়া আখবারুহু ওয়া মানাকিবুহু, ইবনে আবিল আওয়াম পৃ. ৯৯; আলইনতিকা, ইবনে আবদুল বার পৃ. ২৬২
৩. (ইমাম ইবনুল মুবারক ও ওকী ইবনুল জাররাহ প্রমুখের উস্তায) ইমাম হাসান ইবনে সালেহ (১৬৯হি.) বলেন, ‘আবু হানীফা (রাহ.) ছিলেন (কুরআন-সুন্নাহর) সমঝদার ও পরিপক্ব আলেম। তাঁর কাছে রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীস ‘সহীহ’ প্রমাণিত হলে তা ছেড়ে অন্য কিছু অবলম্বন করতেন না।’[8] -ফাযাইলু আবী হানীফা ওয়া আখবারুহু ওয়া মানাকিবুহু, ইবনে আবিল আওয়াম পৃ. ৮৬; আলইনতিকা, ইবনে আবদুল বার পৃ. ১৯৯
৪. (সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা, মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়া যুহলী ও ইবনুল মাদীনী প্রমুখের উস্তায) ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে দাউদ আলখুরাইবী (২১৩হি.) বলেন, ‘মুসলমানদের উপর ওয়াজিব, নামাযে আল্লাহর কাছে আবু হানীফা (রাহ.)-এর জন্য দুআ করা।’ রাবী বলেন, এরপর তিনি মুসলমানদের জন্য তাঁর হাদীস ও ফিকহ সংরক্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন। -তারিখে বাগদাদ ১৩/ ৩৪৪; তাহযীবুল কামাল ২৯/৪৩২
৫. ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন (২৩৩হি.)-কে আবু হানীফা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘তিনি ছিকা। তাঁকে যয়ীফ বলতে আমি কাউকে শুনিনি। এই যে শুবা পত্রমারফত তাঁকে নির্দেশ করছেন যেন (প্রেরিতকে) তিনি হাদীস বর্ণনা করেন। আর শুবা তো শুবাই!’ -আলইনতিকা, ইবনে আবদুল বার পৃ. ১৯৭
তিনি অন্যত্র বলেন, ‘আবু হানীফা ছিকা। তিনি শুধু এমন হাদীসই বর্ণনা করেন যা (ভালভাবে) ইয়াদ করেন। আর যা (ভালভাবে) ইয়াদ করেন না তা বর্ণনা করেন না।’ -তারিখে বাগদাদ ১৩/৪৪৯; তাহযীবুল কামাল ২৯/৪২৪
৬. ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী (২৩৪হি.) বলেন, আবু হানীফা (রাহ.) থেকে সুফিয়ান ছাওরী, ইবনুল মুবারক, হাম্মাদ ইবনে যায়েদ, হুশাইম ইবনে বাশীর, ওকী ইবনুল জাররাহ, আব্বাদ ইবনুল আওয়াম ও জাফর ইবনে আউন বর্ণনা করেছেন। এবং তিনি ছিকা, তাঁর মধ্যে কোনো সমস্যা নেই।’ -জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ইবনে আবদুল বার ২/১০৮৩
তিন. এ বক্তব্যগুলো থেকে পরিষ্কার যে, আবু হানীফা রাহ. হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ছিলেন এবং তাঁর সময়ের উঁচুপর্যায়ের হাফিযুল হাদীস ছিলেন। এটি আরো স্পষ্ট হয় তবাকাতুল হুফ্ফায (হাফিযুল হাদীসদের স্তর) বিষয়ে যে সকল হাফিযুল হাদীস ইমাম গ্রন্থ রচনা করেছেন তাঁদের কর্মপন্থা থেকে- তাঁরা সকলেই তাঁদের কিতাবে আবু হানীফা রাহ.-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
হাফেয শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ যাহাবী (৭৪৮হি) ‘তাযকিরাতুল হুফ্ফায’ কিতাবে (১/১৬৮) আবু হানীফা রাহ.-এর জীবনী লিখেছেন। কিতাবের শুরুতে তিনি বলেছেন, ‘এটি ইলমে নববীর বাহকদের ছিকা সাব্যস্তকারীদের এবং রাবীদের জরহ-তাদীল ও রেওয়ায়েতের যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যাঁদের ইজতিহাদের শরণাপন্ন হতে হয় তাঁদের আলোচনা।’
হাফেয শামসুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে আবদুল হাদী (৭৪৪হি.) ‘তবাকাতু উলামাইল হাদীস’ কিতাবে (১/২৬০-২৬২) তাঁর জীবনী লিখেছেন। কিতাবের শুরুতে তিনি বলেছেন, ‘এটি একটি সংক্ষিপ্ত কিতাব। এতে সাহাবা, তাবেয়ী ও তাঁদের পরবর্তী এমন কিছু হাফিযুল হাদীসের আলোচনা থাকবে, যাঁদের সম্পর্কে ইলমে হাদীসের সাথে সংশ্লিষ্টদের অজ্ঞ থাকার অবকাশ নেই।’
এমনিভাবে হাফেয শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর (ইবনে নাছিরুদ্দীন) (৮৪২হি.) ‘আততিবয়ান লিবাদীআতিল বায়ান’ গ্রন্থে,[9] মুহাদ্দিস ইউসুফ ইবনে হাসান ইবনে আহমদ ইবনে আবদুল হাদী (ইবনুল মিবরাদ) (৯০৯হি.) ‘তবাকাতুল হুফ্ফায’ গ্রন্থে[10] ও হাফেয জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. (৯১১হি.) ‘তবাকাতুল হুফ্ফায’ গ্রন্থে (পৃ. ৮০-৮১) তাঁর জীবনী লিখেছেন এবং প্রশংসা করেছেন।
এ থেকে বোঝা গেল যে, আবু হানীফা রাহ. ঐ সকল হাফিযুল হাদীসদের একজন, ইলমে হাদীসের সাথে সংশ্লিষ্টদের যাঁদের সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার সুযোগ নেই। এবং রাবীদের জরহ-তাদীল ও রেওয়ায়েতের যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যাঁদের শরণাপন্ন হতে হয়।
সারকথা এই যে, দারাকুতনী রাহ.-এর এই ধারণা যেমন ভুল যে, এ হাদীস জাবির রা.-এর উল্লেখসহ বর্ণনার ক্ষেত্রে আবু হানীফা ও হাসান ইবনে উমারা একা, তেমনি এই ধারণাও ভুল যে, আবু হানীফা রাহ. যয়ীফ। আবু হানীফা রাহ. কেবল যাবিত ও মুতকিন রাবীই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন উচ্চস্তরের হাফিযুল হাদীস ও হাদীস-সুন্নাহর ইমাম। আর এধরনের ইমামদের একক বর্ণনা কবুল করা মুজতাহিদ ইমামগণ তো বটেই, ইলমে জরহ-তাদীল ও ইলালেরও অনেক ইমামের মাযহাব। অথচ এ বর্ণনায় আবু হানীফা রাহ. একা নন, তাঁর অন্তত তিনজন সমর্থনকারীও রয়েছে। সুফিয়ান ছাওরী, শারীক ইবনে আবদুল্লাহ আননাখায়ী ও তলহা ইবনে আবু সায়ীদ আলইসকানদারী এ বর্ণনায় তাঁর সমর্থন করেছেন।
বূসীরী রাহ. বলেন ...‘মূসা ইবনে আবী আয়েশা থেকে এই হাদীস মওসূল রূপে (জাবির রা.-এর উল্লেখসহ) বর্ণনার ক্ষেত্রে হাসান ইবনে উমারা একা নন; যেমনটি মুসনাদে আহমদ ইবনে মানী‘ ও মুসনাদে আবদ ইবনে হুমাইদ-এর উদ্ধৃতিতে আগে উল্লেখিত হয়েছে।’ -ইতহাফুল খিয়ারাতিল মাহারা ২/৪৫২
ইমাম ইবনুল হুমাম রাহ. বলেন, ‘সুফিয়ান ছাওরী, শারীক...ও আবুয যুবাইর এটি সহীহ সনদে মারফূ তথা জাবির রা.-এর উল্লেখসহ বর্ণনা করেছেন। ...আর ছিকা রাবী (মারফূ হিসেবে) একা বর্ণনা করলেও তা গ্রহণ করা জরুরি। কারণ (মুরসালের বিপরীত) মারফূ তথা মওসূল একটি যিআদাহ। আর ছিকা রাবীর যিআদাহ গ্রহণযোগ্য। সুতরাং এই হাদীস কেন গ্রহণযোগ্য হবে না- যখন এর রাবী (আবু হানীফাহ রাহ.) একা নন?’ -ফাতহুল কাদীর ১/৩৩৯
এরপরও যদি কেউ খামোখা এই পীড়াপীড়ি করেন যে, আলোচিত হাদীসটি মওসূলরূপে তথা জাবির রা.-এর উল্লেখসহ সহীহ নয়; বরং তা মুরসাল- তাহলে আমরা বলব, এধরনের মুরসাল নিঃসন্দেহে দলীলযোগ্য। কারণ এটি অতি উঁচু পর্যায়ের তাবেয়ীর মুরসাল, বরং কেউ কেউ তাঁকে সাহাবীদের মধ্যে গণ্য করেছেন। যেমনটি আগে উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. (৭২৮হি.) ‘মাজমূউ ফাতাওয়া’ (২৩/২৭১-২৭২)-এ স্পষ্ট বলেছেন, ‘এই মুরসালের রাবী বড় তাবেয়ীদের অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের মুরসাল চার ইমামসহ অন্যান্য ইমামদের সর্বসম্মতিক্রমে দলীলযোগ্য। এজাতীয় মুরসাল দ্বারা দলীল পেশ করার বৈধতার কথা ইমাম শাফেয়ী রাহ. স্পষ্টই বলেছেন।’
আরেকটি আপত্তি
কিতাবুল আছার, ইমাম আবু ইউসুফ-এ আলোচিত হাদীসটির সনদ এভাবে উল্লেখিত হয়েছে-
عن أبي حنيفة، عن موسى بن أبي عائشة، عن عبد الله بن شداد بن الهاد، عن أبي الوليد، عن جابر بن عبد الله...
অর্থাৎ ইমাম আবু ইউসুফ আবু হানীফা থেকে, তিনি মূসা ইবনে আবী আয়েশা থেকে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ থেকে, তিনি আবুল ওলীদ থেকে, তিনি জাবির রা. থেকে...
দারাকুতনী ও বায়হাকী রাহ. এ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করে বলেন, এই আবুল ওলীদ মাজহুল!
এই আপত্তির ভিত্তি হল, দারাকুতনী ও বায়হাকী রাহ. ধারণা করেছেন, আবুল ওলীদ আলাদা একজন রাবী, যিনি জাবির রা. থেকে এই হাদীস বর্ণনা করেছেন আর তার থেকে আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ বর্ণনা করেছেন। এ ধারণাটি সৃষ্টি হয়েছে মূলত আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ ও আবুল ওলীদের মাঝে "عن" (থেকে) শব্দটি যোগ হওয়ায়, যা হয়ত কোনো লিপিকারের অসতর্কতার ফল। আবুল ওলীদ আলাদা কেউ নন, আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ নিজেই আবুল ওলীদ- এটি তাঁর উপনাম (كنية)। ইমাম হারিছী সংকলিত ‘মুসনাদে আবু হানীফা’ কিতাবে সনদটি এভাবে আছে-
عن عبد الله بن شداد بن الهاد أبي الوليد، عن جابر بن عبد الله...
-মুসনাদে আবু হানীফা ১/৪১০, ৪১৪, ৪১৮, ৪২১
এ থেকে পরিষ্কার যে, আবুল ওলীদ আলাদা কেউ না। হাকেম আবু আবদুল্লাহ রাহ. (৪০৫হি.) ‘মারিফাতু উলূমিল হাদীস ওয়া কাম্মিয়াতি আজনাসিহি’ (পৃ. ৫০৬)-এ "عن" বিশিষ্ট বর্ণনাটি উদ্ধৃত করে পরিষ্কার বলেছেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ নিজেই আবুল ওলীদ। রাবীদের নাম চেনার ব্যাপারে যারা অবহেলা করে তাদেরই এধরনের ভুল হয়।’[11] ইমাম যাহাবী রাহ. ‘আলমুকতানা ফী সারদিল কুনা’ কিতাবে (পৃ. ১৯) হাকেমের এ কথার সমর্থন করেছেন।
আরো দ্রষ্টব্য. কিতাবুল কুনা ওয়াল আসমা, আবু বিশর দূলাবী ২/১৪৩; তারীখে বাগদাদ ৯/৪৭৩; তাহযীবুল কামাল ১৫/৮২; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৩/৪৮৮; তাহযীবুত তাহযীব ৫/২৫১
অন্য রাবীর সূত্রে
এ কথাটি অর্থাৎ “যার ইমাম আছে ইমামের কেরাতই তার কেরাত” জাবির রা. থেকে অন্য সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে।
বর্ণনাটি এই-
حدثنا مالك بن إسماعيل، عن حسن بن صالح، عن أبي الزبير، عن جابر، عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : كل من كان له إمام، فقراءته له قراءة.
অর্থাৎ ইমাম ইবনে আবী শাইবা মালেক ইবনে ইসমাইল থেকে, তিনি হাসান ইবনে সালেহ থেকে, তিনি আবুয যুবাইর থেকে, তিনি জাবির রা. থেকে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, যার ইমাম আছে তো ইমামের কেরাতই তার কেরাত। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩৮২৩
এখানে আমরা লক্ষ করলাম, হাসান ইবনে সালেহ রাহ. থেকে এই হাদীসটি মালেক ইবনে ইসমাইল বর্ণনা করেছেন এবং তাতে হাসান ইবনে সালেহ ও আবুয যুবাইরের মাঝে কোনো মাধ্যম নেই।
হাসান ইবনে সালেহ রাহ. থেকে ইমাম আবু নুআইম (ফযল ইবনে দুকাইন)ও এই হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তাতেও উভয়ের মাঝে কোনো মাধ্যম নেই।
বর্ণনাটি এই-
حدثنا أبو نعيم، حدثنا الحسن بن صالح، عن أبي الزبير، عن جابر، عن النبي صلى الله عليه وسلم ... فذكره.
অর্থাৎ ইমাম আবদ ইবনে হুমায়দ আবু নুআইম থেকে, তিনি হাসান ইবনে সালেহ থেকে, তিনি আবুয যুবাইর থেকে, তিনি জাবির রা. থেকে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন ...। এরপর তিনি পাঠ উল্লেখ করেছেন। -ইতহাফুল খিয়ারাতিল মাহারা, বূসীরী ২/৪৫১
এমনিভাবে তাঁর আরেকজন ছিকা শাগরিদ আসওয়াদ ইবনে আমেরও এই হাদীস তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন এবং তাতেও কোনো মাধ্যম নেই।
বর্ণনাটি এই-
حدثنا أسود بن عامر، أخبرنا حسن بن صالح، عن أبي الزبير، عن جابر، عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : من كان له إمام، فقراءته له قراءة.
অর্থাৎ ইমাম আহমদ আসওয়াদ ইবনে আমের থেকে, তিনি হাসান ইবনে সালেহ থেকে, তিনি আবুয যুবাইর থেকে, তিনি জাবির রা. থেকে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, যার ইমাম আছে...। -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৪৬৪৩
সনদের প্রাসঙ্গিক আলোচনা
এই হাদীসের সনদ সহীহ, এর রাবীগণ সকলেই ছিকা। আবদুর রহমান ইবনে কুদামা রাহ. (৬৮২হি.) বলেন,
هذا إسناد صحيح متصل رجاله كلهم ثقات
‘এটি একটি সহীহ ও মুত্তাসিল সনদ, এর বর্ণনাকারীগণ সকলেই ছিকা।’ হাফেয ইবনুত তুরকুমানী রাহ. (৭৫০হি.) বলেন, هذا سند صحيح ‘এটি একটি সহীহ সনদ।’
শিহাবুদ্দীন বূসীরী রাহ. বলেন,
إسناد حديث جابر الأول صحيح على شرط الشيخين، والثاني على شرط مسلم.
‘জাবির রা.-এর হাদীসের প্রথম সনদ তথা আহমদ ইবনে মানীর সনদ সহীহাইনের সনদের সমমানের আর দ্বিতীয়টি তথা আবদ ইবনে হুমাইদের সনদ সহীহ মুসলিমের সনদের সমমানের।’ বদরুদ্দীন আইনী রাহ. বলেন, هذا سند صحيح ‘এটি একটি সহীহ সনদ।’
দেখুন : আশ্শরহুল কাবীর ২/১১; আলজাওহারুন নাকী (আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকীর সাথে মুদ্রিত) ২/১৫৯-১৬০; ইতহাফুল খিয়ারাতিল মাহারা, বূসীরী ২/৪৫১; নুখাবুল আফকার ২/৫৫৫
হাসান ইবনে সালেহ থেকে এই হাদীসটি আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ইউনুস ও ইসহাক ইবনে মনসুরও বর্ণনা করেছেন। এঁদের বর্ণনায় আছে, হাসান ইবনে সালেহ এটি জাবির জু‘ফী ও লাইছ ইবনে আবী সুলাইম থেকে বর্ণনা করেছেন, তাঁরা আবুয যুবাইর থেকে, তিনি জাবির রা. থেকে...। দ্রষ্টব্য. শরহু মাআনিল আছার ১/৩৫৬; আলকামিল ফী যুআফাইর রিজাল ৭/২৩৭
এজন্য কেউ কেউ বলতে চাচ্ছেন, এ থেকে বোঝা যায়, হাসান ইবনে সালেহ রাহ. এ হাদীসটি আবুয যুবাইর থেকে সরাসরি শুনেননি, বরং জাবির জু‘ফী ও লাইছ ইবনে আবী সুলাইমের মাধ্যমে শুনেছেন। আর এঁরা দুজনই যয়ীফ। [12]সুতরাং...
কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে, হাসান ইবনে সালেহ ও আবুয যুবাইর পরস্পরের স্পষ্ট সমসাময়িক। আবুয যুবাইরের মৃত্যু ১২৮ হিজরীতে আর হাসান ইবনে সালেহের জন্ম ১০০ হিজরীতে, মৃত্যু ১৬৯-এ। এজন্য হাফেয ইবনুত তুরকুমানী রাহ. বলেছেন, ‘আবুয যুবাইর থেকে তাঁর শোনার সম্ভাবনা আছে। আর জুমহুরের মাযহাব হল, কেউ যদি এমন কারো থেকে রেওয়ায়েত করে যার সাথে তার সাক্ষাতের সম্ভাবনা আছে তাহলে তার রেওয়ায়েত মুত্তাসিল হিসেবে বিবেচিত হবে। সুতরাং এখানে এ কথাই বলা হবে, হাসান ইবনে সালেহ এই হাদীস আবুয যুবাইর থেকে সরাসরি এবং জাবির জু‘ফী ও লাইছ ইবনে আবী সুলাইমের মাধ্যমে দুইভাবেই শুনেছেন। তাই কখনো মাধ্যম ছাড়া বর্ণনা করেছেন, কখনো মাধ্যম সহকারে।’ -আলজাওহারুন নাকী ২/১৬০
এ সত্তে¡ও যদি ধরে নেওয়া হয়, এটি তিনি সরাসরি শুনেননি, বরং জাবির জু‘ফী ও লাইছ ইবনে আবী সুলাইমের মাধ্যমে শুনেছেন তবু তা আবু হানীফা রাহ.-এর হাদীসের সমর্থক বর্ণনা হিসেবে খুবই গ্রহণযোগ্য। লাইছ ইবনে আবী সুলাইমের বর্ণনা তো নিঃসন্দেহে সমর্থক বর্ণনা হিসেবে গ্রহণযোগ্য। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। ইমাম বুখারী রাহ. ‘সহীহ’ গ্রন্থে তাঁর হাদীস সমর্থক বর্ণনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুসলিম রাহ. ‘সহীহ’ গ্রন্থে তাঁর হাদীস অন্য রাবীর সঙ্গে মিলিয়ে এনেছেন।
এমনিভাবে জাবির জু‘ফীর বর্ণনাও বহু মুহাদ্দিসের মতে সমর্থক বর্ণনা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। তিনি হাদীস জালকারী ছিলেন না। [13] তার ব্যাপারে চূড়ান্ত কথা হয়তো সেটাই যা ইবনে আদী রহ. ‘আলকামিল ফী যুআফাইর রিজাল’ কিতাবে (২/৩৩৬) বলেছেন, ‘তার অনেক রেওয়ায়েত আছে। তার থেকে (সুফিয়ান) ছাওরী অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। ছাওরী অপেক্ষা শুবা কম বর্ণনা করেছেন। তার থেকে আরো বর্ণনা করেছেন যুহাইর, শারীক, হাসান ইবনে সালেহ, ইবনে উআয়না, কূফাবাসী ও অন্যান্যরা। তার ব্যাপারে মানুষের সবচেয়ে বড় আপত্তি, তিনি রাজআত তথা আলী রা. দুনিয়াতে আবার আসবেন বলে বিশ্বাস করতেন। ছাওরী তার থেকে প্রায় ৫০ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তার থেকে বর্ণনা করতে কেউই উপেক্ষা করেনি। আমি তার বর্ণনায় অতি মুনকার রেওয়ায়েত দেখিনি। এ সত্তে¡ও তিনি ‘সিদকে’র চেয়ে দুর্বলতার বেশি নিকটবর্তী।’
সুতরাং এরূপ দুজন রাবী মেলার কারণে হাদীসটি হাসানস্তরে উপনীত হতে পারে। সম্ভবত এজন্যই ইমাম বদরুদ্দীণ আইনী রহ. ‘নুখাবুল আফকার’ (২/৫৫৬)-এ এটিকে مسند صحيح ‘সহীহ ও মুত্তাসিল সনদ বিশিষ্ট’ বলেছেন।
আরেকটি আপত্তি
সম্প্রতি কেউ কেউ এই আপত্তিও করছেন যে, আবুয যুবাইর (মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম ইবনে তাদরুস) মুদাল্লিস ছিলেন। আর মুদাল্লিসের "عن" শব্দে বর্ণনাকৃত হাদীস যয়ীফ।
এটি খামোখা একটি আপত্তি (সম্ভবত এজন্যই যে কজন ইমাম এই হাদীসের সনদ সম্পর্কে আপত্তি করেছেন তাঁদের কেউই এই আপত্তি উত্থাপন করেননি)। কারণ আবুয যুবাইর রাহ. এ পর্যায়ের মুদাল্লিস নন যে, তাঁর "عن" শব্দে বর্ণনাকৃত হাদীস যয়ীফ হয়ে যাবে। তিনি হয়ত দ্বিতীয় স্তরের মুদাল্লিসদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। অর্থাৎ যাদের "عن" শব্দে বর্ণনাকৃত হাদীস ইমামগণ কবুল করেন। বরং বিভিন্ন মুহাদ্দিস তাঁর মুদাল্লিস হওয়া একেবারে অস্বীকার করেছেন। এবং এর স্বপক্ষে তাঁরা অনেক যুক্তিসঙ্গত দলীল-প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। এখানে সংক্ষেপে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হল।
এক. তাদলীসের ব্যাপারে ইমাম শুবা রাহ.-এর কঠোরতা কারো অজানা নয়। তিনি আবুয যুবাইরের কিছু জরহ করলেও তাদলীসের অভিযোগ একেবারেই করেননি। অথচ আবুয যুবাইরের চারশ’ হাদীস তাঁর ইয়াদ ছিল। আবুয যুবাইর ‘প্রসিদ্ধ মুদাল্লিস’ হলে তিনি তা অবশ্যই উল্লেখ করতেন।
দুই. ইমাম বুখারী, উকাইলী. ইবনে হিব্বান, ইবনে আদী প্রমুখ তাঁর জীবনী লিখেছেন। কিন্তু তাঁদের কেউই তাঁকে ‘প্রসিদ্ধ মুদাল্লিস’ বলা তো দূরের কথা তাদলীসের অভিযোগই উত্থাপন করেননি।
তিন. ইমাম মুসলিম রাহ. ‘সহীহ’ গ্রন্থে আবুয যুবাইরের সূত্রে জাবির রা. থেকে প্রচুর হাদীস বর্ণনা করেছেন, যাতে বেশকিছু "عن" শব্দে বর্ণনাকৃত হাদীসও আছে।
চার. ইমাম তিরমিযী, ইবনে খুযায়মা, ইবনে হিব্বান প্রমুখ তাঁর "عن" শব্দে বর্ণনাকৃত হাদীসকে সহীহ বলেছেন, এর দ্বারা দলীল পেশ করেছেন।
এ কারণগুলোসহ আরো বিভিন্ন কারণে তাঁকে তৃতীয় স্তরের মুদাল্লিসদের মধ্যে গণ্য করা এবং কেবল "عن" থাকার কারণেই তাঁর হাদীস প্রত্যাখ্যান করে দেওয়া (যেমনটি শায়খ আলবানী ও তার অনুসারীরা করছেন) খুবই আপত্তিকর।
বিস্তারিত জানতে দেখুন, মানহাজুল মুতাকাদ্দিমীনা ফিততাদলীস, নাছির বিন হামদ আলফাহদ পৃ. ৮৭-৯৬; তাম্বীহুল মুসলিম ইলা তাআদ্দিল আলবানী আলা সহীহি মুসলিম, মাহমুদ সায়ীদ মামদুহ; আলকাশিফ, হাফেয যাহাবী (তাহকীক: শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা) তরজমা নং ৫১৪৯-এর টীকা
সারকথা এই যে, আলোচিত হাদীসটি আবু হানীফা রাহ.-এর সূত্রের মতো আবুয যুবাইর রাহ.-এর সূত্রেও সহীহ। একাধিক মুহাদ্দিস একে সহীহ বলেছেন। আর কেউ কেউ এর সনদগত যে ইল্লত উল্লেখ করেছেন তা কোনো প্রভাবক ইল্লত নয়। আর যদি ধরেও নেওয়া হয় তা প্রভাবক ইল্লত তবু তা সমর্থক বর্ণনা হিসেবে খুবই গ্রহণযোগ্য।
শায়খ আলবানী (১৪২০হি.) আলোচিত হাদীসের মর্ম-ব্যাখ্যায় ভিন্নমত পোষণ করলেও[14] এটিকে দলীলযোগ্য বলেছেন। তিনি ‘ইরওয়াউল গালীল’ কিতাবে (২/২৭৭) এ হাদীসের বিভিন্ন সূত্র সম্পর্কে বিশদ পর্যালোচনা করার পর লিখেছেন-
ويتلخص مما تقدم أن طرق هذه الأحاديث لا تخلوا من ضعف، لكن الذي يقتضيه الإنصاف والقواعد الحديثية أن مجموعها يشهد أن للحديث أصلاً، لأن مرسل ابن شداد صحيح الإسناد بلا خلاف، والمرسل إذا روي موصولاً من طريق أخرى اشتد عضده وصلح للاحتجاج به كما هو مقرر فى مصطلح الحديث، فكيف وهذا المرسل قد روي من طرق كثيرة...
অর্থাৎ ‘সারকথা এই যে, এই হাদীসগুলোর সূত্রসমূহ একেবারে দুর্বলতা মুক্ত নয়। কিন্তু ইনসাফ ও হাদীস শাস্ত্রের নীতির দাবি এই যে, বিভিন্ন সূত্রের সমষ্টি এ সাক্ষ্য দেয় যে, হাদীসটির ভিত্তি আছে। কেননা (আবদুল্লাহ) ইবনে শাদ্দাদের মুরসাল বর্ণনাটির সনদ সহীহ, এতে কোনো দ্বিমত নেই। আর মুরসাল হাদীস ভিন্ন সনদে মওসুল হিসেবে বর্ণিত হলে তার শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং তার দ্বারা দলীল দেওয়া যায়। যেমনটি হাদীসের পরিভাষা সংক্রান্ত শাস্ত্রে স্থিরিকৃত। সুতরাং এ মুরসালটি কেন দলীলযোগ্য হবে না যখন তা অনেক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে...।’
‘আসলু সিফাতিন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ কিতাবে (১/৩৫৬-৩৫৭) তিনি আরো সুন্দর বলেছেন। সেখানে তিনি আহমদ ইবনে মানীর বর্ণনাটি ইবনুল হুমামের বরাতে উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘এটি প্রমাণিত হলে হাদীসটি মওসুল হিসেবেই সহীহ হবে এবং বোঝা যাবে আবু হানীফা (রাহ.) এ বর্ণনায় একা নন। অন্যথায় তা সহীহ সনদ বিশিষ্ট মুরসাল। এবং এ মুরসালের বর্ণনাকারী আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ বড় ও ছিকা তাবেয়ীদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় জন্মগ্রহণ করেছেন এবং ফকীহদের মধ্যে গণ্য ছিলেন।’ এরপর তিনি ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর এ বক্তব্য ‘এটি বড় তাবেয়ীর মুরসাল। এধরনের মুরসাল চার ইমামসহ অন্যান্য ইমামদের সর্বসম্মতিক্রমে দলীলযোগ্য। ইমাম শাফেয়ী রাহ. এজাতীয় মুরসাল দ্বারা দলীল পেশ করা বৈধতা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন।’ উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘বিশেষ করে এর বিভিন্ন সূত্র আছে যা পরস্পরকে শক্তিশালী করে।’
তাঁর আলোচনার আরবী পাঠ এই-
أقول : إذا ثبت ذلك فالحديث صحيح موصولاً ويكون أبو حنيفة لم ينفرد به ، وإلا فهو مرسل صحيح الإسناد ، ثم إن مرسِله عبد الله بن شداد من كبار التابعين الثقات، ولد على عهد النبي صلى الله عليه وسلم، وكان معدوداً في الفقهاء...َ
قلت: ولا سيما وأن له طرقاً أخرى يشد بعضها بعضاً...
শুরুতে বলেছিলাম, জাবির রা. এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে কথাটি বর্ণনা করেছেন, কাছাকাছি শব্দে বেশ কয়েকজন সাহাবী-তাবেয়ী একই ফতোয়া দিয়েছেন। আর এর অর্থ-মর্ম তো বিভিন্ন হাদীসে এবং অনেক সাহাবী-তাবেয়ীর ফতোয়ায় বর্ণিত হয়েছে। এখানে কিছু হাদীস ও আছার উল্লেখ করা হল :
১. ইমরান ইবনে হুছাইন রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের নামায পড়েছেন আর তাঁর পেছনে এক ব্যক্তি سبح اسم ربك الأعلى পড়তে লাগল। নামায শেষ করে তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কে পড়েছে? এক ব্যক্তি বলল, আমি। তখন তিনি বললেন, আমি ধারণা করেছি, তোমাদের কেউ কুরআন পড়ায় আমার সঙ্গে টানাটানি করছে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৯৮
সনদসহ হাদীসটির আরবী পাঠ এই-
حدثنا محمد بن المثنى ومحمد بن بشار قالا : حدثنا محمد بن جعفر، حدثنا شعبة، عن قتادة قال : سمعت زرارة بن أوفى يحدث عن عمران بن حصين أن رسول الله صلى الله عليه وسلم صلى الظهر، فجعل رجل يقرأ خلفه بسبح اسم ربك الأعلى، فلما انصرف قال : أيكم قرأ أو أيكم القارئ؟ فقال رجل : أنا فقال : قد ظننت أن بعضكم خالجنيها.
২. আতা ইবনে ইয়াসার থেকে বর্ণিত, তিনি যায়েদ ইবনে ছাবিত রা.-কে ইমামের সঙ্গে মুকতাদী কুরআন পড়বে কি না জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে তিনি বললেন, কোনো নামাযেই ইমামের সঙ্গে মুকতাদী কুরআন পড়বে না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৭৭
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
حدثنا يحيى بن يحيى ويحيى بن أيوب وقتيبة بن سعيد وابن حجر ، قال يحيى بن يحيى: أخبرنا. وقال الآخرون : حدثنا إسماعيل، وهو بن جعفر، عن يزيد بن خصيفة، عن ابن قسيط، عن عطاء بن يسار أنه أخبره أنه سأل زيد بن ثابت عن القراءة مع الإمام، فقال : لا قراءة مع الإمام في شيء.
আরো দেখুন, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩৮০৪, ৩৮০৮, ৩৮০৯; শরহু মাআনিল আছার (নুখাবুল আফকারসহ) ২/৫৭০-৫৭১
৩. আবু ওয়াইল থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি আবদুল্লাহ (ইবনে মাসউদ) রা.-এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, আমি কি ইমামের পেছনে কুরআন পড়ব? তিনি বললেন, নামাযে মগ্নতা আছে। আর ঐ ব্যাপারে ইমামই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩৮০১
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
حدثنا أبو الأحوص، عن منصور، عن أبي وائل قال : جاء رجل إلى عبد الله، فقال : أقرأ خلف الإمام؟ فقال له عبد الله : إن في الصلاة شغلا، وسيكفيك ذاك الإمام.
আরো দেখুন, শরহু মাআনিল আছার (নুখাবুল আফকারসহ) ২/৫৬৬-৫৬৮; আলহুজ্জা আলা আহলিল মাদীনা ১/১১৯, ১২০; মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক, হাদীস ২৮০৩
বদরুদ্দীন আইনী রাহ. ‘নুখাবুল আফকার’ কিতাবে (২/৫৬৬) বলেন,
أخرجه من أربع طرق ثلاثتها صحاح
‘ইমাম তহাবী রাহ. এটি চার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে তিনটি সহীহ।’ (সহীহ তিনটির মধ্যে আলোচিত সূত্রটিও রয়েছে)
৪. নাফে থেকে বর্ণিত, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-কে যখন জিজ্ঞাসা করা হত, ইমামের পেছনে কি কেউ কুরআন পড়বে? উত্তরে তিনি বলতেন, তোমাদের কেউ যখন ইমামের পেছনে নামায পড়ে তো ইমামের কেরাতই তার জন্য যথেষ্ট। আর যখন একা পড়ে তখন তাকে কুরআন পড়তে হবে। রাবী বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. ইমামের পেছনে কুরআন পড়তেন না। -মুআত্তা মালেক ১/৭৬
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
مالك، عن نافع : أن عبد الله بن عمر كان إذا سئل : هل يقرأ أحد خلف الإمام؟ قال : إذا صلى أحدكم خلف الإمام فحسبه قراءة الإمام، وإذا صلى وحده فليقرأ. قال : وكان عبد الله بن عمر لا يقرأ خلف الإمام.
আরো দেখুন, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩৮০৫; মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক, হাদীস ২৮১২, ২৮১৫; শরহু মাআনিল আছার (নুখাবুল আফকারসহ) ২/৫৬৯-৫৭০
বদরুদ্দীন আইনী রাহ. ‘নুখাবুল আফকার’-এ (২/৫৬৯) বলেন,
هذا إسناد صحيح في غاية الصحة
‘এটি অতি উচ্চস্তরের সহীহ সনদ।’
৫. ওয়াহাব ইবনে কায়সান থেকে বর্ণিত, তিনি জাবির (রা.)-কে এ কথা বলতে শুনেছেন, যে ব্যক্তি নামায পড়ল কিন্তু তাতে সূরা ফাতেহা পড়ল না সে যেন নামাযই পড়েনি, তবে যদি সে ইমামের পেছনে নামায আদায় করে। -মুআত্তা মালেক ১/৭৫
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
مالك، عن أبي نعيم وهب بن كيسان، أنه سمع جابر بن عبد الله يقول : من صلى ركعة لم يقرأ فيها بأم القرآن فلم يصل، إلا وراء الإمام.
ইমাম মালেক রাহ.-এর সূত্রে ইমাম তিরমিযী রাহ. (২৭৯হি.)ও এটি তাঁর ‘সুনান’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন,
هذا حديث حسن صحيح
‘এই হাদীসটি হাসান সহীহ।’
আরো দেখুন, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩৮০৭; শরহু মাআনিল আছার (নুখাবুল আফকারসহ) ২/৫৭০
৬. আবু জামরা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবনে আব্বাস রা.-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ইমাম আমার সামনে আছেন (অর্থাৎ আমি তার ইকতিদায় আছি) এ অবস্থায় কি আমি কুরআন পড়ব? উত্তরে তিনি বললেন, না। -শরহু মাআনিল আছার ১/৩৫৯
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
حدثنا ابن أبي داود قال : ثنا أبو صاح الحراني قال : ثنا حماد بن سلمة، عن أبي جمرة قال : قلت لابن عباس : أقرأ والإمام بين يدي؟ فقال: لا.
বদরুদ্দীন আইনী রাহ. ‘নুখাবুল আফকার’-এ (২/৫৭১) বলেন,
هذا إسناد صحيح
‘এটি একটি সহীহ সনদ।’
৭. আমর ইবনে র্মুরা থেকে বর্ণিত, আবু ওয়াইল রাহ. বলেন, ইমামের কেরাতই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩৮২২
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
حدثنا يحيى بن سعيد القطان، عن مسعر، عن عمرو بن مرة، عن أبي وائل قال : يكفيك قراءة الإمام.
৮. আইয়ুব সাখতিয়ানী থেকে বর্ণিত, মুহাম্মদ ইবনে সীরীন রাহ. বলেন, আমি ইমামের পেছনে কুরআন পড়াকে সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত মনে করি না -প্রাগুক্ত, হাদীস ৩৮১৫
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
حدثنا الثقفي، عن أيوب، عن محمد قال : لا أعلم القراءة خلف الإمام من السنة.
নিমাভী রাহ. (১৩২২হি.) বলেন, إسناده صحيح‘এর সনদ সহীহ।’ -আছারুস সুনান পৃ. ১৩৬
৯. ওলীদ ইবনে কায়স বলেন, আমি সুআইদ ইবনে গাফালা রাহ.-কে জিজ্ঞাসা করলাম, আমি কি যোহর ও আসরের নামাযে ইমামের পেছনে কুরআন পড়ব? তিনি বললেন, না।
- প্রাগুক্ত, হাদীস ৩৮১৭
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
حدثنا الفضل، عن زهير، عن الوليد بن قيس قال : سألت سويد بن غفلة : أقرأ خلف الإمام في الظهر والعصر؟ قال : لا.
নিমাভী রাহ. বলেন, إسناده صحيح ‘এর সনদ সহীহ।’ -প্রাগুক্ত
১০. হাম্মাদ ইবনে আবী সুলায়মান থেকে বর্ণিত, আলকামা ইবনে কায়স রহ. কখনো ইমামের পেছনে উম্মুল কুরআন বা অন্য কোনো সূরা পড়েননি। না উচ্চস্বর বিশিষ্ট নামাযে, না নি¤œস্বর বিশিষ্ট নামাযে, না শেষ দুই রাকাতে। -কিতাবুল আছার, ইমাম মুহাম্মদ ১/১০৯, হাদীস ৮৪
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
أخبرنا أبو حنيفة قال: حدثنا حماد، عن إبراهيم قال: ما قرأ علقمة بن قيس قط فيما يجهر فيه، ولا فيما لا يجهر فيه، ولا في الركعتين الأخريين أم القرآن، ولا غيرها خلف الإمام.
নিমাভী রাহ. বলেন, إسناده صحيح ‘এর সনদ সহীহ।’ -প্রাগুক্ত
১১. মুগীরা ইবনে মিকসাম থেকে বর্ণিত, ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. ইমামের পেছনে কুরআর পড়া অপছন্দ করতেন এবং বলতেন, ইমামের কেরাতই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩৮১৬
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
حدثنا هشيم، عن مغيرة، عن إبراهيم أنه كان يكره القراءة خلف الإمام، وكان يقول : تكفيك قراءة الإمام.
১২. ইসরাইল ইবনে ইউনুস থেকে বর্ণিত, আবু ইসহাক সাবেয়ী রাহ. বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর শাগরিদগণ ইমামের পেছনে কুরআন পড়তেন না। -মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক, হাদীস ২৮১৩
সনদ সহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
عبد الرزاق، عن إسرائيل، عن ابي إسحاق قال : كان أصحاب عبد الله لا يقرؤون خلف الإمام.
বলাবাহুল্য, এ শিক্ষা তাঁরা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. (সহ কূফা শহরে অবস্থানকারী অন্যান্য ফকীহ সাহাবী) থেকেই গ্রহণ করেছেন।
[1] আবু হানীফা রাহ. থেকে এ হাদীসটি ইমাম আবু ইউসুফ, মুহাম্মদ ইবনুল হাসান, হাসান ইবনে যিয়াদ, যুফার ইবনে হুযাইল, আবদুল্লাহ ইবনে ইয়াযিদ আলমুকরী, মক্কী ইবনে ইবরাহীম, আসাদ ইবনে আমর, ইসহাক ইবনে ইউসুফ আলআযরাক, ইউনুস ইবনে বুকাইর প্রমুখ জাবির রা.-এর উল্লেখসহ বর্ণনা করেছেন।
দ্রষ্টব্য. কিতাবুল আছার, ইমাম আবু ইউসুফ পৃ. ২৩-২৪; আলহুজ্জা আলা আহলিল মাদীনা, ইমাম মুহাম্মদ ১/১১৮; কিতাবুল আছার, ইমাম মুহাম্মদ ১/১১১; মুসনাদে আবু হানীফা, হারেছী ১/৪০৬, ৪১০, ৪১১, ৪১২, ৪১৩, ৪১৬; সুনানে দারাকুতনী ২/১০৭, ১১০, ১১১; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী ২/১৫৯; জামিউল মাসানীদ ১/৩৩৪
শুধু ইবনুল মুবারক রাহ.-এর সূত্রে এটি তাঁর থেকে জাবির রা.-এর উল্লেখ ছাড়া বর্ণিত হয়েছে। তবে এটি (প্রমাণিত হলে) কোনো প্রভাবক ত্রুটি নয়। আবু হানীফা রাহ. হাদীসটি হয়ত দুইভাবেই বর্ণনা করেছেন। যেমনটি আরো কেউ কেউও করেছেন।
[2] জনৈক ‘গবেষক’ লিখেছেন, এ বর্ণনাটি যয়ীফ। এতে সুফিয়ান ছাওরী ও শারীক ইবনে আবদুল্লাহ রয়েছেন। আর এঁরা দুজনই মুদাল্লিস! এরপর তিনি কয়েকটি কিতাব (তবাকাতুল মুদাল্লিসীন, জামিউত তাহসীল, আলমুদাল্লিসীন, আবু যুরআ ইরাকী, আলমুদাল্লিসীন, সুয়ূতী) -এর উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
এটি একেবারে খামোখা একটি আপত্তি। সুফিয়ান ছাওরী ও শারীক ইবনে আবদুল্লাহ রাহ. এমন মুদাল্লিস নন যে, শুধু "عن" শব্দে বর্ণনার কারণেই এঁদের হাদীস যয়ীফ হয়ে যাবে। কারণ এঁদের তাদলীসের সংখ্যা কম। এজন্য মুদাল্লিসদের স্তর বিষয়ে যেসকল হাফেযে হাদীস কিতাব লিখেছেন, তাঁরা সবাই-ই উভয়কে দ্বিতীয়স্তরের মুদাল্লিসদের মধ্যে গণ্য করেছেন। অর্থাৎ যাদের "عن" শব্দে বর্ণনাকৃত হাদীস ইমামগণ কবুল করেছেন- একে সহীহ বলেছেন বা এর দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। শুধু "عن" শব্দ থাকার কারণেই তা প্রত্যাখ্যান করে দেননি।
এ কথা স্বয়ং তার উদ্ধৃত কিতাবগুলোতেই বিদ্যমান আছে। হাফেয আলায়ী রাহ. ‘জামিউত তাহসীল’ (পৃ. ১০৭)-এ শারীক ইবনে আবদুল্লাহ সম্পর্কে বলেন, ‘তাঁর তাদলীস বেশি নয়।’ হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ‘তারীফু আহলিত তাকদীস বিমারাতিবিল মাউসূফীনা বিততাদলীস (পৃ. ১৯১-এ) সুফিয়ান ছাওরী সম্পর্কে ইমাম বুখারী রাহ.-এর এ কথা উদ্ধৃত করেছেন, ‘তাঁর তাদলীস কতই না কম!’
[3] দ্রষ্টব্য. আলইসতীআব ফী মারিফাতিল আসহাব, ইবনে আবদুল বার ৩/৯২৬; উসদুল গাবাহ ফী মারিফাতিস সাহাবা, ইবনুল আছীর ২/৬২০; আলইসাবা ফী তাময়ীযিস সাহাবা, ইবনে হাজার ৫/১৩
[4] কিছু সংখ্যক ‘গবেষক’ বলেছেন, এই হাদীসের অর্থ হল, যার ইমাম আছে তার ইমামের কেরাত ইমামেরই কেরাত! কারণ ‘লাহু’ সর্বনামটির ইঙ্গিত নিকটতম বিশেষ্য ইমামের দিকে হওয়াটাই ব্যাকরণের দৃষ্টিতে যুক্তিযুক্ত!! অতএব ইমাম সূরা ফাতেহা পড়লে তা কেবল ইমামের জন্যই হবে!!! -
ইলমে নাহব-এর সাথে সম্পর্ক রাখা ব্যক্তি মাত্রই জানেন যে, সর্বনাম (ضمير اسم) সবসময় নিকটতম বিশেষ্যকে ইঙ্গিত করে না। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দূরবর্তী বিশেষ্যকেও ইঙ্গিত করে। একটি ক্ষেত্র হল, এমন কোনো দলীল বিদ্যমান থাকা যাতে বোঝা যায় যে, এ সর্বনামটির ইঙ্গিতের স্থান নিকটতম বিশেষ্য নয়; বরং দূরবর্তী বিশেষ্য। আর এখানে তা আছে। من كان له إمام বাক্যে উল্লেখিত (له) সর্বনামটি যাকে ইঙ্গিত করে পরবর্তী বাক্য فقراءة الإمام له قراءة -এ উল্লেখিত (له) সর্বনামটিও তাকেই ইঙ্গিত করবে। আর বলাবাহুল্য, প্রথম (له) সর্বনামটি মুকতাদীকে ইঙ্গিত করে। সুতরাং দ্বিতীয় (له) সর্বনামটিও তাকেই ইঙ্গিত করবে, إمام কে নয়। অন্যথায় من كان له إمام (যার ইমাম আছে) বাক্যটি অর্থহীন হয়ে পড়ে। কারণ তখন হাদীসটির অর্থ দাঁড়াবে, যার ইমাম আছে ইমামের কেরাত ইমামেরই কেরাত। কথার শুরু ও শেষ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন!
তাছাড়া আলোচনার শুরুতে হাদীসটির যে পূর্ণ পাঠ (প্রেক্ষাপটসহ) উল্লেখ করা হয়েছে তাতে একটু চিন্তা করলে যে কেউই বুঝতে পারবেন যে, এই হাদীসের উদ্দেশ্য, ইমামের কেরাতই যে মুকতাদীর জন্য যথেষ্ট তা জানানো। উম্মাহর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আলেমগণ সকলেই এ মর্মই বুঝেছেন। ঐ নবআবিষ্কৃত অর্থহীন ব্যাখ্যা কেউই করেননি। যেসকল ফকীহ ও মুহাদ্দিস কেরাত খালফাল ইমামের মত অবলম্বন করেছেন তারাও করেননি। বরং তারাও সে কথাই বলেছেন যা এর স্বাভাবিক ও প্রসিদ্ধ অর্থ।
[5] পাঠকগণ এসব বর্ণনা আগে দেখে এসেছেন।
[6] এই সেই মিসআর ইবনে কিদাম, যাঁর ব্যাপারে শুবা রাহ.-এর মত ইমাম ও হাফিযুল হাদীস বলেছেন, আমরা তাঁকে (মজবুত ইয়াদ ও নিখুঁত বর্ণনার কারণে) মুছহাফ বলতাম।’ -আলজারহু ওয়াততাদীল, ইবনে আবী হাতেম ১/১৫৪
ইবরাহীম ইবনে সায়ীদ আলজাওহারী বলেন, ‘শুবা ও ছাওরীর মাঝে ইখতিলাফ হলে উভয় বলতেন, আমাদেরকে মীযান তথা তুলাদণ্ড মিসআর ইবনে কিদামের কাছে নিয়ে চলো।’ -আলমুহাদ্দিসুল ফাসিল বাইনার রাবী ওয়াল ওয়ায়ী পৃ. ৩৯৫
[7] সুফিয়ান ছাওরী রাহ. আবু হানীফা রাহ. সম্পর্কে যে কথাটি বলেছেন স্বয়ং আবু হানীফা রাহ. নিজের ব্যাপারে একই কথা বলেছেন। ‘আমি কিতাবুল্লাহ অনুযায়ী আমল করি যখন (সিদ্ধান্ত) তাতে পাই। অন্যথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও তাঁর থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীস মোতাবেক আমল করি, যা ছিকা রাবীদের সূত্রে ছিকা রাবীদের হাতে ছড়িয়ে আছে। কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোনোটিতে না পেলে সাহাবীগণের মধ্যে যার কওল আমার পছন্দ হয় গ্রহণ করি, যার কওল পছন্দ হয় না গ্রহণ করি না। তবে তাঁদের কওল ছেড়ে দিয়ে অন্যের কওল গ্রহণ করি না...।’ -আখবারু আবী হানীফা ওয়া আসহাবিহি, ছায়মারী পৃ. ১০; আলইনতিকা, ইবনে আবদুল বার পৃ. ২৬৪; ফাযাইলু আবী হানীফা ওয়া আখবারুহু ওয়া মানাকিবুহু, ইবনে আবিল আওয়াম পৃ. ৯৮
[8] সুফিয়ান ছাওরী ও হাসান ইবনে সালেহ রহ.-এর এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, আবু হানীফা রহ. তাঁদের কাছে হাদীসের ইমামদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যাঁরা রেওয়ায়েতের যাচাই-বাছাই এবং রাবীদের জরহ-তাদীল করেন।
ছাওরী রহ.-এর বক্তব্যে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। আর তা এই যে, ছাওরী রহ.-এর দৃষ্টিতে আবু হানীফা রহ.-এর নিন্দা যারা করেছে তারা অন্যায় করেছে এবং ভুল ধারণার শিকার হয়েছে। একারণে তিনি ঐ নিন্দাকারীদের জন্য মাগফিরাতের দুআ করছেন।
[9] মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস, শায়খ মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নোমানী রাহ. পৃ. ৬০
[10] প্রাগুক্ত পৃ. ৬১
[11] দারাকুতনী ও বায়হাকী রাহ. যদি হাকেম রাহ.-এর এই কিতাবের শরণাপন্ন হতেন তাহলে এই ‘লাহনে জালী’ থেকে বেঁচে যেতেন।
[12] মুসনাদে আবদ ইবনে হুমাইদ (মুনতাখাব)-এর বর্ণনা দ্বারাও (যদি তাতে লিপিকারের কোনো ভুল না হয়ে থাকে) আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ ও ইসহাক ইবনে মনসুরের বর্ণনার সমর্থন হয়।
[13] যদিও কেউ কেউ তার ব্যাপারে كذاب শব্দ ব্যবহার করেছেন (ইমাম আবু হানীফাও তার সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করেছেন)। কারণ আরবীতে এ শব্দটি হাদীস বর্ণনায় মিথ্যা বলার অর্থে যেমন ব্যবহৃত হয় তেমননি অন্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়। জাবির জু‘ফীর ক্ষেত্রে এটি সম্ভবত অন্য অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি আলী রা. দুনিয়াতে আবার আসবেন বলে বিশ্বাস করতেন। সম্ভবত এ কারণেই কেউ কেউ তাকে كذاب বলেছেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. (২৪১ হি.) পরিষ্কার বলেছেন, ‘জাবির জু‘ফী সম্পর্কে আপত্তি করা হয়েছে তার মতের কারণে, হাদীসের কারণে নয়।’ -দেখুন, সুনানে দারাকুতনী ২/২১৬; মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ২৩/৩২৫
[14] তাঁর মতে এই হাদীসে জাহ্রী নামাযের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ইমামের কেরাত মুকতাদীর জন্য জাহরী নামাযে যথেষ্ট, সিররী নামাযে নয়। অথচ ইমাম মুকতাদীর জন্য জাহরী নামাযে যেমন ইমাম তেমনি সিররী নামাযেও। সুতরাং এটিকে জাহরী নামাযের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা সঙ্গত না।