মুহাররম ১৪৩৭   ||   নভেম্বর ২০১৫

প্রতিবেশী : খুনঝরা ধর্মনিরপেক্ষতার বিচিত্র রূপ

ওয়ারিস রব্বানী

প্রবীন তোগাড়িয়া। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আন্তর্জাতিক নির্বাহী চেয়ারম্যান। অনেক বড় নেতা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মনিরপেক্ষ দেশভারতের সবচেয়ে বড় নেতা। তার কদরই তো আলাদা। মানুষের কল্লা পড়ে যেত পারে, তার কথা মাটিতে পড়ে না। এই তিনিই গত ২৩ অক্টোবর বলেছেন, গরু জবাই করে কেউ ভারতে থাকতে পারবে না। এ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি থাকা উচিত নয় যে মুলায়ম সিং যাদব বা অখিলেশ সিং যাদব কিংবা নরেন্দ্র মোদি এসব লোককে রক্ষা করতে পারবে। নরেন্দ্র মোদিও গরু জবাইকারীকে রক্ষা করতে পারবে না।

বাবরী মসজিদ ধ্বংসকারী ও মুসলিমবিরোধী বহু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উদগাতা দলটির নাম বিজেপি। ভারতীয় জনতা পার্টি। সেই বিজেপি মোদীর নেতৃত্ব ভারত নামক রাষ্ট্রের ক্ষমতায় বসার পর থেকেই শুরু হয়েছে বিশেষ বিশেষ উন্মাদনার মহড়া। কোনো কোনো প্রদেশে আইন পাশ করা হয়েছে গরু জবাই করলে ফাঁসি দেওয়া হবে। কোনো কোনো নেতা-নেত্রী বলেছেন, অ-হিন্দুদের ভারতছাড়া করতে হবে। কেউ কেউ আবার মুসলমানদের নির্বীজকরণ করার হুমকিও দিয়ে বসেছিলেন। সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড। ফাঁসি দিয়ে, পিটিয়ে-পাটিয়ে আর অস্ত্রোপচার করে হলেও এক ধর্মনিরপেক্ষহিন্দুরাজ কায়েমের মহা জযবা। খুনঝরানো সে জযবা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এরই জের ধরে গত ২৮ সেপ্টেম্বর দিল্লীর কাছে উত্তর প্রদেশের নয়ডার বিসাদা গ্রামে গরুর গোশত খাওয়া ও ফ্রিজে রেখে দেওয়ার মিথ্যা প্রচার দিয়ে মুহাম্মাদ আখলাক (প্রথম আলোর ভাষায় : ইকলাখ) নামের এক প্রবীণ মুসলমানকে বাড়ি থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তার ছেলেকেও হত্যার উদ্দেশ্যে পিটিয়ে মুমূর্ষু করে দেওয়া হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, রাস্তায় দুজন মানুষ নগ্ন হয়ে কুঁকড়ে পড়ে আছেন। রাতে একটি মন্দির থেকে প্রচারণা চালানো হয়েছিল। পরে সাম্প্রদায়িক উন্মত্ত হিন্দুরা (প্রথম আলোর ভাষায় : উত্তেজিত জনতা) এসে ভয়ংকর এই ঘটনা ঘটায়। অথচ গরুর গোশতের পুরো বিষয়টিই ছিল গুজব। ফ্রিজে রাখা গোশত পরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেটি ছিল খাসির। হায়রে ভারত! হায়রে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা!!

একটা পরিকল্পিত মিথ্যা রটনার ভিত্তিতে এতবড় ঘটনার জন্ম দিলেও সরকারের মন্ত্রীরা এর পরপর বলেছেন অদ্ভুৎ সব কথা! বলেছেন, এসব যারা ঘটিয়েছে তারা নির্দোষ। বাচ্চা শিশু। তাৎক্ষণিক উত্তেজনার বশে এ হত্যাকাণ্ড করেছে। এটা মারাত্মক কোনো ঘটনা নয়।কেউ কেউ বলেছেন, ‘গরু জবাই করলে তো এমন ঘটবেই। এর মধ্যে অবশ্য বিজেপির বাইরের কোনো কোনো দলের নেতা এসব কাণ্ডে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাভেঙ্গে পড়ছে বলে আশংকা ব্যক্ত করেছেন। প্রতিবাদে কোনো কোনো লেখক রাষ্ট্রীয় পদক ফেরত দিয়েছেন। কিন্তু তাতে হিন্দু মহাসভা, শিবসেনা ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কিছুই যায় আসেনি। এমনকি গুজরাট-দাঙ্গার মহা নায়ক (?) ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মোদি সাহেব পর্যন্ত মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। কিছু বলার সময়ই নাকি তিনি পাননি। দুসপ্তাহ পর এক-দুশব্দের বিবৃতিতে বিষয়টিকে ছুঁয়ে গেলেও আখলাক হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ নিয়ে তেমন কিছুই বলে সময় নষ্ট করতে চাননি। আতংক, হিংস্রতা আর অপমান-প্রহারের মধ্যেই ভারতীয় মুসলমানদের দিন পার হচ্ছে। পার্লামেন্টেও কোনো কোনো মুসলিম সদস্যের ওপর শারীরিক হামলা চালিয়েছে বিজেপির সাংসদরা। শিবসেনা জায়গায় জায়গায় মুসলমানদের পিটাচ্ছে, বাধা দিচ্ছে, পণ্ড করছে। অপূর্ব এক ধর্মনিরপেক্ষতারউৎসব চলছে ভারত জুড়ে।

ভারত-বন্দনাকারীরা মুখ রসালো করে বলে থাকেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মনিরপেক্ষদেশ। কেউ কেউ তো আজন্ম আয়েশের ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেন, মহান ভারতবর্ষ। আহা! একটা দেশ এখনো পর্যন্ত পশু-নিরপেক্ষ হতে পারলো না, গরু-নিরপেক্ষ হতে পারলো না! সে দেশটাই হয়ে গেল ধর্মনিরপেক্ষ! এটাও লোকের বিশ্বাস করতে হবে। তোগাড়িয়ার মতো  কাণ্ডারীরা মহান খুনীর (!) ভাষায় কীভাবে কথা বলেনÑ আসুন একটু দেখি। তিনি বললেন, ‘কেউ আইন লংঘন করে হিন্দু-অনুভতিকে অপমান করতে চাইলে তার জবাব পাওয়া যাবে। কেউ সহিংস হবে, কেউ শান্ত হয়ে থাকবেÑ এটা ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করবে। কিন্তু প্রতিক্রিয়া অবশ্যই আসবে।

সাম্প্রদায়িক খুনী ও খুনের উস্কানিদাতারাই উপমহাদেশের বড় ধর্মনিরপেক্ষজন। আজকাল তা-ই দেখা যাচ্ছে। তাদের কথাই বিচার। তাদের কথাই মাপকাঠি। এজন্যই তারা যখন বললো, আখলাক হত্যার ঘটনা তাৎক্ষণিক উত্তেজনা থেকে সংঘটিত, অতএব খুনীরা নির্দোষ, তখন ভারতীয় মিডিয়াও সেদিকেই মনোযোগ দিল। কিন্তু ভারতের সংখ্যালঘু বিষয়ক জাতীয় কমিশন ঘটনা তদন্ত করে গত ২২ অক্টোবর জানিয়েছে, ‘এ ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত, তাৎক্ষণিক উত্তেজনাপ্রসূত নয়।বেচারা কমিশন! তাদেরও হয়তো উপায় ছিল না এইসব মহান হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতাদের কষা ছক থেকে বের হওয়ার। তা না হলে কী দরকার উত্তেজনা আর পূর্ব-পরিকল্পনা দেখার। ভারতের মতো সাম্প্রদায়িক উন্মত্ত একটি দেশে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা আর পূর্বপরিকল্পনার কী পার্থক্য? অতি অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতীয় এক শ্রেণির বর্ণ হিন্দুরা তো অপর ধর্মীয়দের বিরুদ্ধে সব সময়ই উত্তেজিত থাকে। তাতে কী হলো? আমাদের দেশে রামুর মতো ছোট ঘটনায় (যে ঘটনায় কেউ নিহত হয়নি) কেউ কি বৈধতার জন্য এ অজুহাত খুঁজেছে যে এটা তাৎক্ষণিকভাবে ঘটেছে নাকি তার পেছনে ছিল পূর্ব পরিকল্পনা? নির্বিশেষে সবাই সে ঘটনার নিন্দাই করেছে। অথচ অবাক হয়ে দেখছি, সব বিবেচনা ও মূল্যবোধই এখন তোগাড়িয়াদের পায়ের নিচে চলে গেছে। এর ফল কি খুব ভালো? 

 

 

advertisement