মুহাররম ১৪৩৭   ||   নভেম্বর ২০১৫

‘চান্দ্রমাস’ : একটি পর্যালোচনা- ৫ : হিলালের বিকৃতি এবং একসাথে বহু বিভ্রান্তি

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

[ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ এনামুল হক সাহেবের বইয়ের পর্যালোচনা সংক্ষেপে লেখা সত্তে¡ও দীর্ঘ হয়ে গেল। চুলচেরা বিশ্লেষণসহ এমন দীর্ঘ পর্যালোচনা মাসিক পত্রিকায় মুনাসিব মনে হচ্ছে না। এজন্য হিলালের বিকৃতিবিষয়ক আলোচনাতেই এই লেখা সমাপ্ত করতে চাচ্ছি। সুতরাং আগামী ডিসেম্বর সংখ্যায় ইনশাআল্লাহ এ লেখার সর্বশেষ কিস্তি ছাপা হবে।

উত্তম ছবরের পরিচয় দেওয়ার জন্য পাঠকবর্গের শোকরগুযারি করছি। Ñপ্রবন্ধকার]

নতুন চাঁদকাকে বলে?

কেউ বলতে পারেন, ইঞ্জিয়ার সাহেব হিলালের বিকৃতি ইচ্ছা করে করেননি, বরং নতুন চাঁদ ও নিউমুন শব্দদ্বয়ের বাহ্যিক অর্থ থেকে ধোঁকায় পড়েছেন। তিনি ভেবেছেন, চাঁদ দর্শনযোগ্য হওয়া পর্যন্ত বিলম্ব করলে চাঁদ তো আর নতুন থাকে না, পুরাতন হয়ে যায়। অথচ শরীয়ত বলেছে, নতুন চাঁদ দিয়ে মাস শুরু করতে। তাই বাধ্য হয়ে তিনি বলছেন, নতুন চাঁদ দর্শনযোগ্য হওয়ার আগেই অমাবস্যা থেকে মাস শুরু করতে হবে। কিন্তু এ বাহানা এজন্য চলবে না যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে নতুন চাঁদ শুরুই হয় দর্শনযোগ্য হওয়ার পর। তাই দর্শনযোগ্য হওয়ার অপেক্ষার কারণে তা পুরাতন হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া নতুন-এর অর্থ কি এতই সীমিত যে, ব্যস মুহূর্তের মধ্যেই একটা জিনিস পুরনো হয়ে যাবে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তার বইয়ের এক জায়গায় কী লিখেছেন দেখুনÑ

চন্দ্রের বেলায় এই রকম হিসাব মোটেও প্রযোজ্য নয়। কারণ নবচন্দ্র প্রতি মাসে পৃথিবীতে একবারই মাত্র দেখা যাবে। বারবার নবচন্দ্র উদিত হবার কথা যারা বলছেন তারা মহাভুলের মধ্যে অযৌক্তিক বসবাস করছেন।” (চান্দ্রমাস, পৃ.৩১, পর্ব ১৯, ৭ম সংস্করণ)

এই বক্তব্য নবম সংস্করণে এভাবে বদলে দিয়েছেন :

চন্দ্রের বেলায় এই রকম হিসাব মোটেও প্রযোজ্য নয়। কারণ নবচন্দ্র প্রতি মাসে পৃথিবীতে একবারই মাত্র জ্ঞানের চোখে দেখা যাবে। বারবার নবচন্দ্র উদিত হবার কথা যারা বলছেন তারা মহাভুলের মধ্যে অযৌক্তিক বসবাস করছেন।” (চান্দ্রমাস, পৃ.৩৭, পর্ব ১৯, ৯ম সংস্করণ)

কিন্তু এর বিপরীতে পর্ব: ১১, অনুচ্ছেদ: ৫ -এ লিখেছেন,

পৃথিবীর যে কোন স্থানে প্রথম যখন নূতন চাঁদ দেখা যাবে তাকেই বলা হবে নবচন্দ্র। (পৃ.২৪ ৭ম সংস্করণ; পৃ.৩০ ৯ম সংস্করণ)

আবার নবম সংস্করণের ১৭২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,

কারণ সেক্ষেত্রে প্রথমটা হবে নবচন্দ্র দর্শন; আর দ্বিতীয় ও তৃতীয়টা হবে পুরাতন চন্দ্র দর্শন। পুরাতন চন্দ্র দেখে মাস আরম্ভ এবং রোযা ও ঈদ করা যায় না।” (চান্দ্রমাস, পৃ.১৭২, ৭ম সংস্করণ)

বোঝা গেলো, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এমন কাঁচা লোক নন যে, কেবল নয়াএবং নবশব্দ থেকে ধোঁকায় পড়বেন। এবং নতুনএর তাল সামলাতে গিয়ে কুরআন ও সুন্নাহর হিলাল’ (ধনুকাকৃতির উজ্জ্বল চাঁদ)-কে মিহাক’ (অন্ধকার চাঁদ) বানিয়ে দেবেন। মূলত তিনি যা করেছেন জেনে বুঝেই করেছেন। না হলে এতটুকু কথা কে না বোঝে যে, নতুন এবং পুরানো একটি আপেক্ষিক বিষয়। যদি হিন্দু এবং ইহুদীরা অমাবস্যার মাঝে সৃষ্ট সূর্য ও চন্দ্রের সম্মিলনের মুহূর্ত থেকে চান্দ্রমাস আরম্ভ করে, তো তাদের নবচন্দ্র তখন থেকে শুরু হয়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু এতে করে কি এটা আবশ্যক হয়ে পড়ে যে, মুসলমানদের নবচন্দ্রও হতে হবে সেটি। মুসলমানদের নবচন্দ্র তো হলো অমাবস্যা শেষ হওয়ার পর দৃশ্যমান ধনুকাকৃতির চাঁদ। দর্শনযোগ্য হওয়ার অপেক্ষার কারণে এটা কীভাবে পুরানো হয়ে যাবে যে, তার নতুনত্ব ধরে রাখার জন্য কিতাবুল্লাহ, হাদীস ও সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মতের অকাট্য বিধানকে পরিবর্তন করে হিলালের জায়গায় মিহাককে এবং দেখা’-এর স্থানে গণনাকে ইসলামী চান্দ্রমাসের ভিত্তি সাব্যস্ত করা জরুরি হয়ে পড়বে? বলি, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এবং তার সমমনা লোকদের উম্মতে মুসলিমাকে ইহুদী এবং হিন্দুদের অনুগামী বানানোর এত সখ কেন?

নিউমুনএর কী অর্থ?

এখন দেখার বিষয়, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কি নিউমুনশব্দ দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছেন? অর্থাৎ ইংরেজি কুরআন তরজমাসমূহে الأهلة  (আল-আহিল্লাহ) -এর তরজমায় নিউমুনসশব্দ দেখে এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুনমনে করে বসেছেন?!

এখানেও আমি এ কথাই বলবো, সম্ভাবনা তো আছে, তিনি কোনো ধরনের বিভ্রমের শিকার হয়েছেন, কিন্তু আপনি যখন তার বইয়ের এই বক্তব্যটি পড়বেন তখন কী বলবেন? যেখানে ৭৪ নং প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশ তিনি দাঁড় করিয়েছেন, “‘এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুনএবং ইসলামিক নিউমুনএর মধ্যে তফাত কি?”

উত্তর লিখেছেন:

জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন চাঁদ শুরু হয় চাঁদের অদেখা সময়ের মাঝখানে। আর কিছু ইসলামী বিদ্বান ব্যক্তি কর্তৃক কথিত ইসলামিক নতুন-চাঁদ শুরু হয় চাঁদের অদেখা সময় শেষ হওয়ার পরে। একই মাসে একটা চাঁদের কখনো ২ টা নতুন-চাঁদ থাকতে পারে না। এজন্যই  চাঁদের অদেখা সময়টাকে ইংরেজীতে বলা হয় New moon, dark অথবা Black-moon নয়। আরবীতে এই অদেখা সময়ের কোন নাম নেই। আল্লাহ আমাদের জন্য একটা চাঁদ সৃষ্টি করেছেন, যার একটা শুরু ও শেষ আছে এবং যার সাহায্যে আমরা একটা চান্দ্রমাস হিসাব (Calculate) করব। চাঁদ দেখে চান্দ্রমাস শুরু করার কোন হাদীস নেই। কোরআন আমাদেরকে নতুন-চাঁদ দেখে মাস শুরু করতে বলে না, হিসাব করতে বলে। এই জ্ঞান প্রকাশিত অথবা জানার আগে অস্থায়ী ভিত্তিতে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অন্য ব্যবস্থা আমাদেরকে করতে হয়েছে। সেগুলো উপরোক্ত সত্য উদঘাটনের পর এখন আর  গ্রহণযোগ্য থাকতে পারে না।” (চান্দ্রমাস, পৃ. ২১৩-২১৪)

বোঝা গেল নিউমুনের আভিধানিক ও পারিভাষিক উভয় অর্থ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের জানা আছে। আর আভিধানিক অর্থের প্রেক্ষিতেই হিলালের তরজমা হতে পারে নিউমুন। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব গায়ের জোরে এই অর্থটিকে মাত্র কতিপয় ইসলামী বিদ্বানের মত বলে প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছেন। অথচ হিলালের এই অর্থটি কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত অর্থ এবং এটিই তার অনুসৃত ও সর্বজনসম্মত অর্থ। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব একে এ কথা বলে ছুড়ে ফেলছেন যে, ‘এক চাঁদের দুটো নতুন চাঁদ হতে পারে না। যদি বাস্তবেই এক চাঁদের মধ্যে দুটি পর্যায় নতুন বলে গণ্য হতে না পারে তাহলে ঐ পর্যায়টিই নতুন বলে গণ্য হবে, যাকে শরীয়ত ইসলামী চান্দ্রমাসের সূচনা সাব্যস্ত করেছে। আর সেটা হচ্ছে হিলাল। সেক্ষেত্রে মিহাক’ (অমাবস্যা)-এর পর্যায়টি হল পুরানো মাসের অংশ। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ইসলামী চান্দ্রমাসের পরিবর্তে ইহুদি এবং হিন্দুদের চান্দ্রমাসকে গ্রহণ করতে চান। সেজন্য মিহাকতথা (অমাবস্যা)-কে নতুন চাঁদ বলতে গোঁ ধরেছেন। এই হলো ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের দর্শন। অর্থাৎ দুটি নতুন চাঁদ হতে পারে না। তাহলে কী করা যাবে? তাহলে উম্মতে মুসলিমা যাকে নতুন চাঁদ বলে সেটাকে বাদ দিতে হবে। আর ইয়াহুদী ও হিন্দুদেরটা গ্রহণ করতে হবে! তার ধর্ম-জ্ঞান ও ধর্মীয় আত্মমর্যাদাবোধের জন্য সত্যিই তাকে মাশাআল্লাহ দিতে হয়।

আর এও বড় আশ্চর্য হঠকারী ব্যাপার যে, আরবীতে নাকি অমাবস্যার কোন নাম নেই। অথচ আরবীতে অমাবস্যার অনেকগুলো নাম রয়েছে। প্রসিদ্ধ নাম মিহাকএবং সারারবা ইস্তিসরার। একটি বিখ্যাত উক্তি আছে:

دروغ گورا حافظہ نباشد

একদিকে কুরআনে কারিমের শব্দ أهلة (আহিল্লাহ, যা  هلال-এর বহুবচন)-কে বানিয়ে দিচ্ছেন অমাবস্যার চাঁদ। অন্যদিকে বলছেন, অমাবস্যার কোনো আরবী নাম নেই!

আসলে অমাবস্যার আরবী নাম তো আছে, কিন্তু সেটা হিলালনয়; ‘মিহাক’, ‘সারার’, ‘ইস্তিসরার’, ‘দাআদি’, ‘আদ-দাজা’, ‘আদ-দাহমাইত্যাদি। পুরো অমাবস্যার কিংবা তার একেকটি রাতেরও পৃথক পৃথক নাম রয়েছে। আর খাছ জ্যোতির্শাস্ত্রীয় নিউমুন (Conjunction)-এর জন্য আরবীতে ইকতিরানইজতিমাশব্দাবলী কয়েক শতাব্দী ধরে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। আল-বেরুনীও তার গ্রন্থসমূহে এই শব্দই ব্যবহার করেছেন।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তার উত্থাপিত প্রশ্ন-৭৪ -এর উত্তর দিতে গিয়ে আরো যা লিখেছেন তা এতটাই নির্জলা মিথ্যা এবং তা এত ভয়ানক স্পর্ধায় ভরা, যার পর্যালোচনা করার মত ভাষা আমার নাই। এর ভয়াবহতার প্রতি ইঙ্গিত করে কিছু কথা ইতোপূর্বে লেখা হয়েছে। এখন শুধু কামনা, আল্লাহ তাআলা তাকে আকলে সালীম (সুস্থ বিবেক) ও সিরাতে মুস্তাকীমের নিআমত দান করুন এবং আমাদের সবাইকে সীরাতে মুস্তাকীমের উপর অবিচল রাখুন। আমীন।

প্রাসঙ্গিক কথা দীর্ঘ হয়ে গেল। আমি বলতে চাচ্ছিলাম, এই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ যে, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব أهلة (আহিল্লাহ)-এর তরজমায় নিউমুনস শব্দ দেখে ধোঁকায় পড়েছেন এবং একে এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুনধারণা করে বসেছেন। যদি এই সম্ভাবনাটিকে মেনেও নেয়া হয়, তবুও এই অযুহাতে তিনি ক্ষমা পেতে পারেন না। কারণ যদি তিনি আরবী অভিধানসমূহ (আরবী-আরবী) দেখতে অপারগ হয়ে থাকেন, তথাপি তিনি কি অন্যান্য ভাষার অভিধানসমূহে হিলালএবং নিউমুন’-এর অর্থ অনুসন্ধান করতে পারতেন না? কুরআনের ইংরেজী অনুবাদকারীদের তাফসীর সংক্রান্ত টীকাগুলোতে নজর বুলাতে পারতেন না? যে দেখি, ‘নিউমুনদ্বারা কী উদ্দেশ্য নিয়েছেন তারা? যে লোক দশ-বিশটা ইংরেজী অভিধানও ঘাটতে পারে না, কুরআনের বিশ-ত্রিশটি ইংরেজি অনুবাদ দেখে নেওয়ার মত অবসরও যার নেই, তাজদীদ ও সংস্কারের ময়দানে অবর্তীণ হওয়ার কী দরকার ছিল তার?

তার বইয়ের ১১১ নং পৃষ্ঠায় অভিধান কী বলে?’ শিরোনামে যে দুচারটি অভিধানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যদি শুধু সেগুলোতে উদ্ধৃত তথ্য-উপাত্তগুলোই হুবহু বুঝে নিতেন এবং তাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতেন তবুও ভুল করা বা বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ থাকতো না।

বইয়ের ২১৬-২১৯ পৃষ্ঠায় আয়াত ২ : ১৮৯ -এর তরজমাসমূহের যে তালিকা পেশ করা হয়েছে, যদি তাতে উল্লিখিত ইংরেজী তরজমাসমূহের টীকাগুলো দেখে নিতেন এবং অন্যান্য আরো কিছু নির্ভরযোগ্য তরজমাসমূহেও দৃষ্টি দিতেনÑ যদি এরূপ করতেন তাহলে  তো কোনো অবস্থাতেই ভুল বুঝার সুযোগ থাকতো না। তবে বিভ্রান্তি সৃষ্টির ইচ্ছা থাকলে সেটার প্রতিকার তো কারো হাতে নেই।

অভিধানে হিলালের অর্থ

প্রথমে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের উল্লিখিত অভিধানগুলো থেকে হিলাল’-এর অর্থ উদ্ধৃত করছি :

১. ডিক্শনারি অফ ইসলাম :

আমরা এ অভিধানের ১৮৮৫ সালের মুদ্রিত কপি দেখেছি।  সেখানে লেখা আছে:

HILAL (هلال) The new moon, A Term used for the first three days of the month

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব The new moon লিখে বাকীটা ফেলে দিয়েছেন!! তা ফেলে দিন, তবে থমাস পেট্রিক (Thomas Patrick) হিলাল’-কে এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুনবলেননি যা তার বক্তব্যে স্পষ্ট। বরং দর্শনযোগ্য নতুন চাঁদই বলেছেন। (Dictionary of Islam by Thomas Patrick (1838-1911) page: 175, W.H. ALLEN &  Co. LONDON, 1885)

২. এ ডিক্শনারি এন্ড গ্লোসারি অফ দ্যা কোরান :

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এই অভিধানের যে সংস্করণের উদ্ধৃতি পেশ করেছেন তা আমরা দেখেছি। (একাডেমি পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ১৯৮৭ খৃ.) তাতে পুরো বক্তব্য এভাবে আছে :

هلَّ To appear. أهلة plur. of هلال. . A New moon, or according to some the moon during the first and last two or three nights; at other times the moon is called قمر”.

(A Dictionary and glossary of the Koran, by john penrice (1818-1892), page 154 © Academic publisher, 1987.)

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এই পুরো বক্তব্য থেকে শুধু A New moon -কে গ্রহণ করেছেন। অথচ এ বক্তব্যে একেতো দৃশ্যমান হওয়া(To appear) শব্দটি স্পষ্টভাবে রয়েছে। আবার পূর্বাপরের ইঙ্গিত থেকেও এ কথা সুস্পষ্ট যে, এখানে এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুনের নাম-নিশানও নেই।

৩. আল মাওরিদ :

এটি ইংরেজী-আরবী অভিধান। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এখান থেকে হিলাল’-এর অর্থ উদ্ধৃত করেছেন: Crescent । আশ্চর্যের বিষয়, ইংরেজী-আরবী অভিধানে  তিনি হিলালশব্দ কী করে পেলেন? ড. মুনীর বালাবাক্কী তার আল-মাওরিদ অভিধানে Crescent -এর আরবী লিখেছেন هلال :

Crescent : هلال

New moon : (১) هلال (২) اليوم الأول من الشهر العبري

(Al-Mawrid, by Munir Ba’albaki, ©1998, Dar el-ilm lilmalayin, Beirut, Lebanon)

বুঝা গেল, ইংরেজী নিউমুনশব্দের দুটি অর্থ রয়েছে। এক. هلال অর্থাৎ দৃশ্যমান উজ্জ্বল ক্রিসেন্ট মুন। দুই. হিব্রæ মাসের প্রথম দিন। কিন্তু আরবী হিলাল’ -এর অর্থ শুধু একটিই। আর তা হল ক্রিসেন্ট মুন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব মাওরিদের হাওয়ালা তো দিচ্ছেন, কিন্তু প্রমাণ করতে চাচ্ছেন যে, মুসলমানদেরও ইহুদীদের মত হিব্রæ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী চান্দ্রমাস Conjunction থেকে শুরু করতে হবে! নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক।

যাহোক, দেখাতে চাচ্ছিলাম, ‘নিউমুনশব্দ থেকে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেনÑ বিষয়টি তেমন নয়। তিনি যেসকল অভিধানের উদ্ধৃতি দিয়েছেন সেখানে স্পষ্ট করেই লেখা আছে  যে, ‘হিলালএস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুনএক নয়।

৪. The School Dictionary (English-Arabic) by : Elias A. Elias & Ed. E. Elias মাওরিদের ন্যায় এখানেও তিনি ইংরেজী-আরবী অভিধান থেকে هلال -এর অর্থ উদ্ধৃত করেছেন।

هلالcrescent, new moon, first moon of the month.

Elias School Dictionary (আরবী-ইংরেজী, ইংরেজী-আরবী)-এর ২০১৫ এর মুদ্রণ আমাদের সামনে রয়েছে। অভিধানটির আরবী-ইংরেজী অংশে هلال -এর অর্থ লেখা হয়েছে,

هلال، غرة القمر:             crescent [1]     ــ قمر أوائل الشهر :          new moon

এখানে উল্লেখ করা হবি সড়ড়হ থেকে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ফায়েদা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ আরবীতে তো লেখা আছে قمر أوائل الشهر অর্থাৎ মাসের প্রথম দিকের (দুই তিন রাতের) দৃশ্যমান চাঁদ।

অভিধানটির ইংরেজী-আরবী অংশে crescent -এর অর্থ লেখা হয়েছে :

هلال  * نام، متزائد          crescent         এবং new moon - এর অর্থ লেখা হয়েছে:

 هلال    new moon      (Elias School Dictionary, page: 69 (crescent), 196 (new moon) ©Elias Modern Publishing House 2015, Egypt)

 

A. Elias -এর আরো কয়েকটি অভিধান রয়েছে, যেমন

৫. قاموس إلياس العصري (عربي- إنجليزي) Elias Modern Dictionary (Arabic-English) )) এ থেকেও উদ্ধৃত করছি। তাতে লেখা আছে:

هلَّ، أَهَلَّ: ظهر  To appear; come out  

هلَّ الشهر: بدأ To begin (with the appearance of the new moon.)

استهلَّ الشهر: ظهر هلاله To begin,       (a month, by the appearance of the new moon

هلال: غُرَّةُ القمر Crescent moon: The moon in her first quarter . 

هلال: قمر أوائل الشهرNew moon 

هلال: قمر أواخر الشهر Old moon

(Elias Modern Dictionary (Arabic-English), © 1982, page: 762, Dar Al-jil, Beirut, Lebanon)

এতটুকু স্পষ্ট করার পরও A. Elias -এর অভিধানের উদ্ধৃতি ব্যবহারকারী যদি হিলালকে অমাবস্যা বানিয়ে দেয়, তবে কি একেও আমরা ভুল বোঝাবুঝি বলবো?

এখানে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের উদ্ধৃতি দেওয়া অভিধানগুলো থেকেই মূল হাকীকত তুলে ধরা হল। আরো দুএকটি হাওয়ালা পেশ করছি।

৫. এ্যারাবিক-ইংলিশ ডিক্শনারি অফ কোরানিক ইউজেস :

এ অভিধানে হিলালের অর্থ দেখুন :

 ل/ل/ه/ h-l-l new moon, (of the moon) to appear for the first time; (of the month) to start; crescent, crescent-shaped; to come forth; to exalt God, to invoke God’s name upon an animal at the moment of slaughter; …

أهلة ahillatun [pl. of n.  هلال hilal] new moon, the crescent moons (variously designated by philologists as the moon of either the first, the third or the seventh nights, along with that of the second night and the 26th and 27th nights), stages of the moon (2:189)  يسئلونك عن الأهلة قل هي مواقيت للناس والحج they ask you [prophet] about the crescent moons -say, ‘They show appointed times for people, and for the pilgrimage.’

(Arabic-English Dictionary of Qur’anic Usage, by Elsaid M. badawi; Muhammad Abdel Haleem, © 2008, page 988-989, Brill, Boston)

৬. Al-Mawrid -এর লেখক Dr. Munir Ba’albaki -এর ছেলে Dr. Rohi ba`albaki (আমেরিকান ইউনিভার্সিটি, লেবানন-এর প্রফেসর) তার আল মাওরিদ-এ মডার্ন এ্যারাবিক-ইংলিশ ডিক্শনারি-তে লিখেছেন :

هلال (من القمرcrescent, new moon, half-moon

crescent - এর পর কমা দিয়ে new moon লেখা হয়েছে। উদ্দেশ্য হল, উভয়টিই সমার্থক শব্দ। হিলালঅর্থে নিউমুনহল ক্রিসেন্ট’-এর সমার্থক। ড. রূহী বালাবাক্কী অভিধানটির ভূমিকায়  লিখেছেন, কোন শব্দের কয়েকটি ইংরেজী অর্থের মাঝে যদি কমা (,) হয় তাহলে উদ্দেশ্য, এ শব্দগুলো সমার্থবোধক। আর যদি সেমিকোলন (;) হয় তবে এর উদ্দেশ্য হল, এগুলো পরস্পর কাছাকাছি অর্থের অথবা কিছুটা ভিন্ন, সমার্থক নয়। দেখুন তার বক্তব্য :

"تفصل بين الكلمات الإنكليزية المترادفة فاصلة (،). أما الشولة المنقوطة (؛) فتفصل بين الكلمات الإنكليزية  ذات الدلالة المختلفة اختلافاً يسيراً أو بين ظلال المعاني المتقاربة ولكن دون أن تكون مترادفة."

(Al-Mawrid A modern arabic-english dictionary, by Dr. Rohi ba` albaki, page: 12 © 2005 Dar-el ilm, Lilmalayin, Lebanon)

লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, ‘হিলালের অর্থগুলোর মধ্যে ড. রূহী ক্রিসেন্টনিউমুনÑ এ দুয়ের মাঝে কমা (,) ব্যবহার করেছেন, সেমিকোলন (;) ব্যবহার করেননি। সুতরাং বুঝা গেল, এ দুটি শব্দ সমার্থক। সারকথা এই দাঁড়াল যে, ‘হিলালের মধ্যে এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুন’ -এর অর্থ কল্পনাই করা যায় না। হিলাল হচ্ছে মিহাকপরবর্তী ক্রিসেন্টমুনকিংবা মিহাকের আগের ক্রিসেন্টমুন। তবে যেই হিলালদিয়ে মাস আরম্ভ হয় তা মিহাকের পরের পশ্চিমাকাশের হিলাল’; ‘মিহাকের আগের পূর্বাকাশের হিলালনয়।

৭. গবেষণা বিভাগ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রকাশিত  আরবী-বাংলা অভিধানের বক্তব্যও দেখুন :

هلَّ الهلالُ:                           নতুন চাঁদ উঠল

هلَّ الشهرُ:                           চান্দ্রমাস শুরু হল

هل:          চান্দ্রমাসের আরম্ভ, নতুন চাঁদের উদয়

هلال:

নতুন চাঁদ, মাসের প্রথম দুই রাত কিংবা প্রথম থেকে তৃতীয় বা সপ্তম রাত বা মাসের শেষের দুই রাত অর্থাৎ ছাব্বিশ-সাতাশের তারিখের চাঁদকে هلال বলা হয়, অবশিষ্টাংশ রাতের চাঁদকে قمر বলা হয়।

(আরবী-বাংলা অভিধান, গবেষণা বিভাগ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, জুন-২০০৬, ২য় খÐ, পৃষ্ঠা ১০২৭)

৮. আল ফারাইদুদ দুররিয়্যিা (আরবী-ইংরেজি)

هلَّ هلاً: To fall heavily (rain). To appear (new moon). To begin (lunar month). To rejoice …  

 

أهلَّ، إهلالاً، وأُهلَّ To appear (new moon).  To raise the voice in saying لبيك (Here I am)  

...هلال ج أهلة وأهاليل: New moon,          Crescent of the moon. The two first or two last days of a lunar month. Anything crescent- shaped.                               

(الفرائد الدرية في اللغتين العربية والإنكليزية Arabic-English dictionary for the use of students. by The Rev. F. J.G. Hava, S.J. page 824, © 1899, Catholic press, Beyrut)

৯. এ কম্প্রিহেনসিভ পারসিয়ান-ইংলিশ ডিক্শনারি :

هلَّhall (v.n.), Appearing (the new moon); shouting for joy;                 

هلَّ هلَّhill, The beginning of a month, the appearance of the new moon.    هلال: halal, hilal, The  beginning of a shower;                                         

  _hilal (v.n. 3 of هلَّ) Agreeing (with one) by The month, or from month to month, or new moon to new moon. The new moon : also the moon on the wane, especially the first and last two or three days (the moon being called qamar the rest of the month); the point of spear; a two headed hunting spear.

(A Comprehensive Persian- English dictionary by F. Steingass. Ph.D. (1825-1903), page; 1505, Fifth Impression - 1963, Routledge & kegan paul limited, London.)

১০. এ ডিক্শনারি অফ মডার্ন রিটেন এ্যারাবিক :

To Appear, come up, show (new moon); to begin, set in (month) … to appear (new moon)

هلال :pl.  أهلة ، أهاليل new moon; half moon, crescent; parenthesis; any crescent shaped object.                   

هلاليٌّ: crescent shaped lunate, sickle-shaped.

(A dictionary of modern written Arabic by hans wehr (1909-1981), Edited by J. Milton cowan (1907-1993), page: 1030, 3rd printing, Macdonald & Evans limited, London.)

১১. অরটাবেটস এ্যারাবিক-ইংলিশ ডিক্শনারি :

هلّ، يَهُلُّ، هلاّ : To rain heavily, Appear (new moon); begin with the new moon (lunar month). Rejoice; shout, cry out....

أهلَّ:To appear (new moon); look at the new moon. praise god .             

...

هلال ج أهلة وأهاليل: New moon; the first or last quarter of the moon. crescent. [parenthesis]                    

[Wortabet’s Arabic-English dictionary, by William Thomson wortabet with the collaboration of Rev. john wortabet. M.D. and Professor Harvey porter. phd., librairie du liban, Beirut.(1984)]  

উদাহরণস্বরূপ শুধু বারোটি অভিধানের উদ্ধৃতি পেশ করা হল। বিষয়টি এমনিতেও স্পষ্ট ছিল, তারপরও ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের খাতিরে উদ্ধৃতিগুলো পেশ করা হল। মোটকথা হিলালের অর্থের মধ্যে এমন কোনো  ধোঁয়াটে বা ধূম্রাচ্ছন্ন ভাব নেই যে, কেউ তাকে চিনতে পারবে না। হিলালবাঁকা ও চিকন তো বটে কিন্তু সুস্পষ্ট ও প্রকাশিত। নতুবা পৃথিবী থেকে তা কীভাবে দেখা যাবে? এটা বড়ই মূর্খতা যে, কেউ মিহাক’ (অমাবস্যা) এবং হিলাল’ (দৃশ্যমান ধনুকাকৃতির উজ্জ্বল চাঁদ) -এর মাঝেও পার্থক্য করতে পারবে না!

ইংরেজী অভিধানে নিউমুন’ -এর অর্থ

এবার নিউমুনএর অর্থ দেখুন:

১) শর্টার অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিক্শনারি :

New:

new moon:

(a) The moon when it appears as a slender crescent shortly after its conjunction with the sun.

(b) The time when this occurs; Astronomy: The Time at which the moon is in conjunction with the sun.

(c) The ancient Hebrew festival celebrated at the time of the new moon.

(Shorter Oxford English Dictionary, Vol. 2, page: 1914, Fifth Edition, 2002©, Oxford university press)

আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি, ‘নিউমুনের প্রচলিত ও আভিধানিক অর্থ, দর্শনযোগ্য ধনুকাকৃতির চাঁদ। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় সম্মিলনের অবস্থা (Conjunction)-কে নিউমুনবলা হয়।

২) দ্যা অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিক্শনারি :

new moon:

1. The moon when first seen as a slender crescent shortly after its conjunction with the sun.

2. The time when the new moon appears; also Astron. (Astronomy) The Time at which the moon is in conjunction with the sun.

b. The festival celebrated by the ancient Hebrews at the time of the new moon.

(The Oxford English Dictionary, Vol. 7, page: 119, OXFORD at the clarendon press, printed in the great Britain at the university press oxford, First Published 1933, reprinted 1961)

তের খণ্ডের এই বিশাল অভিধানে ধনুকের আকৃতিতে প্রথম দৃষ্টিগোচর হওয়া চাঁদকেই নিউমুনের মূল অর্থ বলা হয়েছে। আর কনজাঙ্কশান বা সম্মিলন অবস্থাকে নিউমুনের এস্ট্রোনমিক্যাল পারিভাষিক অর্থ হিসাবে দেখানো হয়েছে। সুতরাং ২ : ১৮৯ আয়াতে الأهلة এর তরজমায় নিউমুনসকে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কিসের ভিত্তিতে এস্ট্রোনমির পারিভাষিক অর্থের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন?

সামনে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ কিছু ইংরেজি অভিধান থেকে নিউমুনের অর্থ লক্ষ্য করুন। সবাই এ শব্দের মূল অর্থটিই লিখেছেন, অর্থাৎ দৃশ্যমান ধনুকাকৃতির প্রথম চাঁদ। শাস্ত্রের বিশেষ পারিভাষিক অর্থকে তারা উল্লেখই করেননি।

৩) ক্যামব্রিজ এ্যাডভান্সড লার্নারস ডিক্শনারি :

new moon:

the moon when it is shaped like a Crescent, or a time when it is shaped like this: it was dark now and the silver of a new moon could be seen overhead. the team discovered that the planet is 0.02º c warmer at full moon then at new moon.

(Cambridge Advanced Learner’s Dictionary, page: 957, 3rd Edition, © Cambridge University press 2008)

৪) অক্সফোর্ড ইংলিশ রেফারেন্স ডিক্শনারি :

new:

new moon 1. the moon when first seen as a crescent after conjunction with the sun.

2. the time of its appearance

(Oxford English Reference Dictionary, Edited by judy pearsall and Bill Trumble, page: 976, © Oxford university press 1995, Oxford, Newyork)

৫) নিউ অক্সফোর্ড এ্যাডভান্সড লার্নারস ডিক্শনারি :

new moon 1. the moon when it looks like a thin curved shape (= a crescent)

2. the time of the month when the moon has this shape.

(New Oxford Advanced Learner’s Dictionary by A.S. Hornby (1898-1978) page 1025 7th Edition 2005, © Oxford university press 2005)

৬) কলিন্স কোবিল্ড এ্যাডভান্সড লার্নারস ইংলিশ ডিক্শনারি :

new moon : A new moon is the moon when it first appears as a thin curved shape at the start of its four-week cycle.

The new moon is also the time of the month when the moon appears in this way.

(Collins COBUILD Advanced Learner’s English Dictionary, page: 961, 5th Edition 2006, Harper Collins Publishers, Glasgow Great Britain.)

৭) লংম্যান ডিক্শনারি অফ কনটেম্পোরারি ইংলিশ :

new moon: 1. the moon when it first appears in the sky as a thin Crescent.

2. the time of the month at which  the moon is first seen.

(Longman dictionary of contemporary English, page:1105, 4th Edition with writing assistant 2005, pearson education limited, England.)

৮) চ্যাম্বারস কম্প্যাক্ট ডিক্শনারি :

new moon: 1. the moon when it is  visible as a narrow waxing crescent.

2. the time when the moon becomes visible in this form.

(Chambers Compact Dictionary, page: 526, © chambers harrap publishers Ltd. 2005)

আপনি হয়ত লক্ষ্য করেছেন, এ সব অভিধানে নিউমুনের অর্থ শুধুই দর্শনযোগ্য ধনুকাকৃতির চাঁদকে বলা হয়েছে। সম্মিলন অবস্থার (Conjunction) অর্থ লেখাই হয়নি। কারণ তা বিশেষ একটি শাস্ত্রীয় পরিভাষা। সাধারণ অভিধানে এ ধরনের অর্থ উল্লেখ করা জরুরি নয়।

কিছু কিছু অভিধানে যদিও উভয় অর্থ লেখা হয়েছে কিন্তু সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়নি যে, এটি হল আভিধানিক এবং প্রচলিত অর্থ আর এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের পারিভাষিক অর্থ। এটা হচ্ছে অভিধানগুলোর দুর্বলতা। এ ধরনের তিনটি অভিধানের উদ্ধৃতি দেখুন:

৯) দ্যা ওয়ার্ল্ড বুক ডিক্শনারি :

New moon: 1. the moon when seen as a thin crescent with the hollow side on the left.

2. the moon when its dark side is towards the earth, appearing almost invisible: At times of new moon the moon is between us and the sun.

(The World Book Dictionary, v. 02, page: 1400, 1980 Edition, World Book Childcraft International Inc, printed in USA)

১০) দ্যা ইন্টারন্যাশনাল ওয়েব্স্টার নিউ এনসাইক্লোপেডিক ডিক্শনারি :

New moon: 1. the period of time when the moon is in a direct line between the sun and the earth so that its illuminated side is not visible from the earth; the moon shortly after the phase when it is visible as a crescent.

 (The International Webster new Encyclopedic Dictionary of the English Language & library of useful knowledge, page: 640, © 1971, Tabor house, Newyork)

১১) দ্যা রেন্ডম হাউজ ডিক্শনারি :

New moon: 1. the moon either when in conjunction with the sun or soon after, being either invisible or visible only as a slender crescent.

2. the phase of the moon at this time.

 (The Random House Dictionary of the English Language, page: 963, © 1983, Editor in chief: jess stein, random house, Newyork)

মোটকথা, কুরআন-সুন্নাহ, ইসলামী ফিকহ ও শরীয়তের শব্দ হচ্ছে হিলালএবং এর অর্থ একেবারেই পরিষ্কার। মিহাকশেষ হওয়ার পর পৃথিবী থেকে দর্শনযোগ্য ধনুকাকৃতির নতুন চাঁদ।

যারা হিলালের তরজমা নিউমুনকরেছেন, স্পষ্টতই এ দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য আভিধানিক ও প্রচলিত অর্থে নিউমুন। একে এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুনবানিয়ে দেওয়া পরিষ্কার জালিয়াতি। অভিধানে হিলাল এবং নিউমুন শব্দদ্বয়ের অর্থের মধ্যে এমন কোনো শক-সন্দেহ নেই যে, তাতে কেউ ধোঁকায় পড়বেন। যেমনটি পাঠক অভিধানের বেশ কিছু উদ্ধৃতিতে  দেখেছেন। উদ্ধৃতি তো রয়েছে প্রচুর, শুধু উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি পেশ করা হল।

ইংরেজী অনুবাদকগণকেই জিজ্ঞাসা করুন

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নিজেই কুরআনের কয়েকটি অনুবাদ থেকে ২ : ১৮৯ আয়াতের সংশ্লিষ্ট অংশের অনুবাদ উল্লেখ করেছেন। তিনি তাদেরকে এবং অন্য আরো অনুবাদককে এ কথা জিজ্ঞেস করতে পারতেন, ‘হিলালের অনুবাদে নিউমুনলিখে আপনারা কী উদ্দেশ্য নিয়েছেন? (যদি বাস্তবেই তার কাছে বিষয়টি অস্পষ্ট হয়ে থাকে)। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব চান্দ্রমাসের ২১৬ পৃষ্ঠার তালিকায় সর্বপ্রথম আল্লামা ইউসুফ আলীর অনুবাদ উল্লেখ করেছেন। সামনে গিয়ে ৫ম নম্বরে আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলীর অনুবাদ উল্লেখ করেছেন। তিনি লক্ষ্য করেননি যে, উভয় তরজমা এক ও অভিন্ন এবং একই ব্যক্তির অনুবাদ। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যে কপি থেকে প্রথম উদ্ধৃতিটি উল্লেখ করেছেন, তাতে অনুবাদকের নাম এভাবে A. Yusuf Ali লেখা হয়েছে। তিনি A. কে আল্লামা বানিয়ে দিয়েছেন। অথচ A. এখানে আব্দুল্লাহ এর সংক্ষেপিত রূপ। অনুবাদের ঐ কপির শেষে অনুবাদকের সংক্ষিপ্ত জীবনী আরবীতে লেখা আছে। সেখানে স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে

المترجم في سطور

ترجمة عبد الله يوسف علي

যা হোক, বলতে চাচ্ছিলাম, আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলীর অনুবাদটি শুধু অনুবাদ নয়। তার নাম তো হল, ‘দ্যা হলি কুরআন ট্র্যান্সলেশন এন্ড কমেন্ট্রি। তো ২ : ১৮৯ আয়াতের সংশ্লিষ্ট অংশের তরজমা আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলীর অনুবাদে এভাবে আছে :

“They ask thee concerning the new Moons. Say, they are but signs to mark fixed periods of time in (the affairs of) men, and for pilgrimage.”

পরে তিনি নিউমুনশব্দের উপর ২০২ নং টীকা লিখেছেন:

...

As a measure of time, where the lunar calendar is used, the new moon is one great sign, for which people watch with eagerness. Muslim festivals, including the pilgrimage, are fixed by the appearance of the new moon.

(The Holy Quran, Translation and commentary, by A. Yusuf Ali (1872-1953) published by American trust publications for the muslim student’s association of the united states & Canada, page: 75. 2nd edition, © june, 1977)

জনাব আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী টীকায় কত স্পষ্টভাবে লিখেছেন, ‘নিউমুনদেখেই মুসলিমদের হজ্বসহ অন্যান্য সন্দেহপূর্ণ তারিখগুলো নির্দিষ্ট করা হয়। তিনি এও বলেছেন যে, চান্দ্র ক্যালেন্ডারের ক্ষেত্রে নিউমুনএকটি অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্য লোকেরা চাঁদ দেখার প্রতি খুবই গুরুত্ব দেয়।

এই টীকাটি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের উল্লিখিত কপিতেই রয়েছে। এমনিভাবে মালিক ফাহাদ কমপ্লেক্স থেকে প্রকাশিত সংশোধিত সংস্করণেও রয়েছেÑ যার উদ্ধৃতি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তালিকার ৫ম নম্বরে প্রদান করেছেন!!

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তালিকার ৬ষ্ঠ নাম্বারে আহমাদ আলী-এর অনুবাদের উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। আহমাদ আলী নিউমুনবলে কী উদ্দেশ্য নিয়েছেন তা ২ : ১৮৫ আয়াতের فمن شهد منكم الشهر -এর তরজমা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি এর তরজমায় লিখেছেন:

... so when you see the new moon you should fast the whole month;

(Al-quran A contemporary translation by Ahmed ali, page: 33, Oxford university press, Bombay KalcattaMmadras, © 1987)

আয়াতের এ অনুবাদ প্রচলিত শাব্দিক অনুবাদ থেকে কিছুটা ভিন্ন, কিন্তু অশুদ্ধ নয়। আরবী ভাষায় الشهر কে هلال এর অর্থে ব্যবহার করা হয়। এখানে আমরা শুধু এটুকু দেখাতে চেয়েছি যে, অনুবাদক জনাব আহমাদ আলী নিউমুনদ্বারা দর্শনযোগ্য ধনুকাকৃতির নতুন চাঁদই বুঝিয়েছেন। অমাবস্যার চাঁদ নয়।

আর এ কথা শুধু আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী ও আহমাদ আলীর বেলাতে নয় বরং যারাই আরবী হিলালশব্দের অনুবাদ নিউমুনকরেছেন, তাদের সকলের উদ্দেশ্য ছিল এটাই। এখানে নিউমুনবলে এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুনউদ্দেশ্য নেওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না!

পাঠকগণ নিজেরাও কুরআনে কারীমের ইংরেজী অনুবাদ দেখতে পারেন যেগুলোতেهلال  - এর অনুবাদ নিউমুনশব্দের মাধ্যমে করা হয়েছে এবং টীকা, ব্যাখ্যায় (অথবা ২ : ১৮৫-এর অনুবাদের মাধ্যমে) পরিষ্কার ভাষায় নিউমুন দেখার কথাও বলে দেয়া হয়েছে। বলাবাহুল্য যে, ‘নিউমুনদিয়ে যদি অমাবস্যার চাঁদই উদ্দেশ্য হত তাহলে দেখার কথা কেন লিখবেন? উদাহরণ স্বরূপ দেখুন:

১. তফসীরে মাজেদী :

Tafsir ul Qur’an translation and commentary of the holy Qur’an, by maulana Abdul Majid Daryabadi, First Edition: 1991, published by Darul ishaat, Urdu bazar Karachi-1, Pakistan.

২. তফসীরে মারেফুল কুরআন :

Ma’ariful Qur’an A comprehensive commentary on the holy Qur’an, by Maulana Mufti Muhammad Shafi, Translated by Muhammad Shamim, Revised by Maulana Muhammad Taqi Usmani, © 1998 Maktaba-e- Darul-Uloom,Karachi

৩. তাফসীরে উসমানী :

The Noble Qur’an, Tafseer-e-Usmani, English Translated by: Ashfaq Ahmad, 1st Edition-1992, Idara Ishaat-e-Diniyat (p) Ltd., Delhi

৪. ট্র্যান্সলেশন অফ দ্যা মিনিং অফ দ্যা নোবেল কুরান :

Whoever of you sights (the crescent on the first night of) the month (of Ramadan i.e, is present at his home), he must observe saum (fasts) the month. (2: 185, page: 37)

(Translation of the meaning of the Noble Quran in the English Language, by Muhammad Taqi-ud-din al-hilali, Dr. Muhammad Muhsin Khan, © 1419 h, King Fahad Complex for the printing of the Holy Quran, Madinah, K.S.A)

৫. দ্যা কুরান ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যান্সলেশন :

So whoever sights (the new moon of) the month, let him fast it.. (2: 185, page : 46-47)

(The Quran Saheeh International Translation, Edited by A.B. Al-Mehri, © 2010, Maktabah Booksellers and publishers, Birmingham, United Kingdom)

যেহেতু নিউমুনজ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় সম্মিলন অবস্থা (Conjunction) ও চাঁদের জন্ম বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয় এবং আজকাল এই পরিভাষা সাধারণ মানুষের নিকটও পরিচিত, তাই  এ  ক্ষেত্রে যেন কোনো বেখবর লোক ধোঁকায় পতিত না হয় কিংবা আমানত ও দিয়ানতের দৈন্যের ফলে অন্যকে ধোঁকা দেওয়ার সুযোগ না পায়, সেজন্য অনেক ইংরেজী অনুবাদকগণ হিলাল(هلال)-এর তরজমা নিউমুনের স্থলে ক্রিসেন্টঅথবা ক্রিসেন্ট মুনশব্দের মাধ্যমে করেছেন।

উদাহরণস্বরূপ জামিয়া আল-আযহারের রচনা ও অনুবাদ বিভাগ কতৃর্ক সংশোধিত ড. মুহাম্মদ মুহাম্মদ আল-খাতিব-এর অনুবাদ মাআনিল কুরআনিল কারীমে২ : ১৮৯ নং আয়াতের তরজমা এভাবে লেখা হয়েছে:

They ask you of the Crescent moons. Say: they are times fixed for mankind and for pilgrimage ... (2 : 189, page : 37)

(The Bounteous Koran, by Dr. M.M. Khatib, Authorised by Al Azhar, 1984, First published 1986, Macmillan press, London )

আরো দেখুন:

১. দ্যা কুরান, এ নিউ ট্র্যান্সলেশন :

(The Quran, A new translation by M.A.S. Abdel Haleem, © M.A.S. Abdel Haleem 2004, 2005, Oxford University Press)

২. টুওয়ার্ডস আন্ডার্স্টেন্ডিং দ্যা ইভার গ্লোরিয়াজ কুরান:

(Towards Understanding The Ever-Glorious Quran, by Muhammad Mahmud Ghali, Ph.D, Revised by: Ali Ali Ahmad Shaban Ph.D, Ahmad Shafiq Al-Khatib Ph.D, Aelfwine Acelas Mischler M. A., Third Edition 2003, Dar An-nashr for Universities- Egypt.)

৩. দ্যা নোবেল কুরান :

(The Noble Quran, A new Rendering of its Meaning in English by Abdalhaqq and Aisha Bewley, © 1432Ah /2011Ce Abdalhaqq and Aisha Bewley, Diwan press, Norwich, England.)

৪. দ্যা কুরান, ট্রান্সলেশন টু ইংলিশ :

(The Quran, translated to English by Talal Itani, © 2009-2012 Talal A. Itani, Published by Clear Quran, Dallas, Beirut)

মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানীর ইংরেজী অনুবাদ

হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুমও কুরআনুল কারীমের ইংরেজী তরজমা করেছেন। যা দ্যা মিনিংস অফ দ্যা নোবেল কুরআন (The Meanings of the Noble Qur’an with explanatory notes) নামে প্রকাশিত হয়েছে। এতে هلال এর তরজমা নিউমুনশব্দের মাধ্যমে করা হয়েছে। জানা কথা যে, তিনিসহ সকল ইংরেজী অনুবাদক এর দ্বারা অমাবস্যার পর দর্শনযোগ্য ধনুকাকৃতির নতুন চাঁদকেই বুঝিয়েছেন। তারপরও সংশয়বাদীদের সংশয় নিরসনের জন্য বর্তমান যুগের সর্বজনমান্য এই ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের কাছে এ বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, এ শব্দ দ্বারা আপনার কী বুঝানো উদ্দেশ্য? আমাদের এখানে তো অনেকে হিলালকে এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুনবানিয়ে ফেলছেন?

তিনি উত্তরে লিখেছেন,“যেসকল ইংরেজী অনুবাদক هلال -এর অনুবাদ নিউমুনকরেছেন, তারা আভিধানিক অর্থই উদ্দেশ্য নিয়েছেন, ঐ অর্থ নয় যা অমাবস্যার অবস্থাকে বুঝায়। তাই এর দ্বারা জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষার নিউমুনবুঝাÑ যা অমাবস্যার মধ্যে হয়ে থাকেÑ কোনোভাবেই ঠিক নয়। হিলালশব্দের ধাতুমূলের মধ্যেই প্রকাশিত হওয়ার অর্থ রয়েছে। ফলে কোনভাবেই একে অমাবস্যার অবস্থাবুঝানোর জন্য ব্যবহার করা যাবে না। আর এই তরজমা থেকে এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুনের মাধ্যমে চান্দ্রমাস শুরু করার প্রমাণ পেশ করা বিলকুল গলদ।

আমিও ইংরেজী তরজমাতে নিউমুনশব্দটি আভিধানিক অর্থ হিসেবেই উল্লেখ করেছি, আর যেহেতু এটাকে ভুল ব্যবহার করা হচ্ছে, তাই ইনশাআল্লাহ সামনে এর স্থলে ক্রিসেন্টমুন লিখে দেয়া হবে। (২২/০১/১৪৩৬ হি.-তে লেখা হযরতের চিঠিটি লেখকের কাছে সংরক্ষিত আছে।)

হিলালের অর্থ বর্ণনা এবং হিলালের অর্থ বিকৃতি নিয়ে পর্যালোচনা করার জন্য এ পরিমাণ আলোচনাও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। আল্লাহ তাআলা একে কবুল করুন এবং সংশয় সৃষ্টিকারীদের অপচেষ্টাকে দূরীভত করুন। আমীন।

যেমনটা পূর্বেও বলেছিলাম, এসব আলোচনা শুধু সংশয় নিরসনের জন্যই পেশ করা হল। নতুবা যেমনটি  বেশ কয়েকবার ইঙ্গিত করেছি যে, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নিজেও হিলালের আভিধানিক ও শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত অর্থ ভালোভাবেই জানেন। এ বিষয়ে তার কয়েকটি সুস্পষ্ট বক্তব্য পিছনে উল্লেখ করা হয়েছে, আর কিছু সামনে আসছে। এখানে শুধু একটি বক্তব্য উল্লেখ করছি :

তিনি তার বইয়ের ৫ম অধ্যায়ে লিখেছেন:

নবচন্দ্র কখনো হ্রাস পায় না, আর বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে সেটা আর নবচন্দ্র থাকে না। তাই নবচন্দ্র হ্রাস-বৃদ্ধি হবার প্রশ্ন আসে না।” (চান্দ্রমাস, পৃষ্ঠা: ২১৫)

যদি হিলালনবচন্দ্রতার কাছে অমাবস্যার চাঁদ হয়ে থাকে তাহলে হ্রাস-বৃদ্ধির প্রসঙ্গ তিনি কেন ওঠালেন?

যদি হিলাল’ (নবচন্দ্র) অমাবস্যার পরের ধনুকাকৃতির উজ্জ্বল চাঁদ না হয় তাহলে তিনি কী করে বললেন যে, বৃদ্ধি পেলে তা আর নবচন্দ্র থাকে না। অমাবস্যার চাঁদ কি বৃদ্ধি পেতে পারে? তা তো অন্ধকারাচ্ছন্নই থাকে? অন্ধকার যদি বৃদ্ধি পায় তাহলে আরো অন্ধকার হবে। আর নবচন্দ্রের মধ্যে আলো না থাকলে তিনি কীভাবে বললেন, তা কখনো হ্রাস পায় না? বেচারা গায়ের জোরে যতই বলতে চাচ্ছেন যে, ‘হিলালমানে হচ্ছে অমাবস্যার চাঁদ কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় কলম থেকে তার মনের সুপ্ত কথাটাই বেরিয়ে আসছে।

নবচন্দ্র বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথেই তা পুরাতন হয়ে যায়Ñ এই দর্শন ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ব্যক্তিগত দর্শন। তিনি তো একবার এ কথাও বলেছিলেন, অমাবস্যার চাঁদই নতুন চাঁদ। দর্শনযোগ্য হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলে তা পুরাতন হয়ে যাবে। এখন বলছেন, আলো বৃদ্ধি পেলে পুরাতন হবে। তিনি তার বইয়ের ১৭২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, যারা সর্বপ্রথম নবচন্দ্র দর্শন করেন সেটাই নবচন্দ্রের দর্শন। পরে যারা দেখবেন সেটা পুরাতন চন্দ্র দর্শন হবে।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের এই বইয়ের একটি পুরাতন সংস্করণ ৩০-৪-২০০৭ ইং তারিখে দেয়া তার স্বাক্ষরসহ আমাদের কাছে আছে। ঐ সংস্করণের ভূমিকাতেও তিনি এ কথা বলেছেন যে, “প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে বিষয়টাকে একেক আলেম একেকভাবে বুঝেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন এবং একেকভাবে অনুসরণ করতে বলেছেন। ফলে মুসলিম উম্মাহ তথা পুরা মানবজাতির মধ্যে যুগ যুগ ধরে বিভেদ সৃষ্টি হয়ে আছে, আর মুসলিম ধর্ম পালনে অহেতুক বিড়ম্বনা ভোগ করতে হচ্ছে। মানবসৃষ্ট এই সমস্যার সহজ সমাধান একান্ত জরুরী বিধায় এই পুস্তকখানা লেখার কাজে হাত দিতে হলো।” (পৃষ্ঠা ৮)

বইটির ঐ সংস্করণের  পরিশিষ্টের প্রথম অধ্যায়ে ২ : ১৮৯ নং আয়াতের অনুবাদ ও তফসীর এভাবে লিখেছেন:

আয়াতের অর্থ: লোকেরা আপনাকে জিজ্ঞাসা করে নবচন্দ্র সম্পর্কে। বলে দিন, ইহা (নবচন্দ্র) সময় নির্ধারণ করার মাধ্যম, মানবজাতির জন্য (লিন্নাছ) এবং হজ্জের জন্য।

ব্যাখ্যাসহ মন্তব্য:

এই আয়াতে আল্লাহ চন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহারের কথা বলেছেন। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করতে পারে নূতন চন্দ্রোদয়, চন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধি বা এর সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। এর জবাবে আল্লাহ বলছেন, এই চাঁদ সারা বিশ্বের মানুষের জন্য মাস গণনা করার মাধ্যম। নূতন চন্দ্রোদয় দিয়ে মাস আরম্ভ হবে[2] এবং এর বৃদ্ধি ও হ্রাস দিয়ে মাস শেষ হবে[3]। ফলে পরবর্তী মাস আরম্ভ হবে আরেক নূতন চন্দ্রোদয় দিয়ে। এ ভাবে জিলহজ্জের চান্দ্রমাস আরম্ভ হবে আরেক নূতন চন্দ্রোদয় দিয়ে। এ ভাবে জিলহজ্জের চান্দ্রমাস আরম্ভ হলে হজ্জের দিন তারিখ নির্ধারণ করা যাবে। এই চান্দ্রমাস কোন দেশ বা এলাকার ভিত্তিতে হবে না। সারা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য এই ব্যবস্থা করেছেন আল্লাহ। তাই বিশ্বের যে কোন স্থানেই নূতন চন্দ্রোদয় হলে সারা পৃথিবীতে চান্দ্রমাস আরম্ভ হয়ে যাবে।[4]

অথচ এই সহজ বিষয়টা সঠিক ব্যাখ্যার অভাবে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্যের সৃষ্টি হয়ে আছে, যা অনতিবিলম্বে দূর করা দরকার[5]। তাহলে সারা বিশ্বে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং একই সাথে বা দিনে (একই সময়ে নয়) ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালিত হবে।” (চান্দ্রমাস, পৃষ্ঠা ৩১-৩২, ৩০-৪-২০০৭ ইং তারিখের স্বাক্ষরসহ প্রচারিত কম্পোজ সংস্করণ। যার ব্যপারে তিনি লিখেছিলেন, বইখানা আগামী ১৫-৬-০৭ তারিখের মধ্যে প্রেসে যাবে।)

পরবর্তী সংস্করণগুলোতে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব অনেক কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন। আমার প্রশ্ন হল, আপনি ঐ কম্পোজ কপিতে যা কিছু লিখেছেন তাও ভুলসংশোধনের উদ্দেশ্যে এবং মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিদ্যমান বিভেদ ও অনৈক্য দূর করার উদ্দেশ্যেই লিখেছিলেন। তাহলে সেটা আবার পরিবর্তন করার প্রয়োজন হল কেন?

আয়াতের অনুবাদে আপনি হিলালমাওয়াকিতকোনো শব্দের অনুবাদেই সমূহলিখেননি। মাওয়াকিত’-এর অর্থ সূচনাকারীঅথবা আরম্ভকারীকিছুই বলেননি। হিলালকে অমাবস্যাও বললেন না। তারপরও সে সময় আপনার দৃষ্টিতে এ আয়াতের মাধ্যমে আপনার দাবী (বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করতে হবে) প্রমাণিত হয়েছিল। তাহলে পরে তাতে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার প্রয়োজন পড়ল কেন?

স্বাভাবিক নিয়ম তো হল, কোনো কিতাবের পরবর্তী সংস্করণ পূর্বের চেয়েও বেশি নির্ভুল ও অধিকতর ভালো হয়। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ উল্টোÑ তার বইয়ের প্রত্যেক পরবর্তী সংস্করণ পূর্ববর্তী সংস্করণের চেয়ে ভুল-ত্রæটি ও বিকৃতির দিক দিয়ে শুধু অগ্রসরই হচ্ছে!

পূর্ববর্তী ঐ সংস্করণের বক্তব্য উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এটা দেখানো যে, প্রথম থেকেই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সামনে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট ছিল যে, ‘হিলালঅমাবস্যার চাঁদ নয় বরং অমাবস্যার পরের দর্শনযোগ্য ধনুকাকৃতির উজ্জ্বল চাঁদের নাম হচ্ছে হিলাল। এর বিপরীতে তিনি যা কিছু লিখছেন সবই নিজের মনের বিরুদ্ধে লিখছেন।

তারপরও বাস্তবেই যদি কোনো বিভ্রমের শিকার তিনি হয়ে থাকেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ আল-বেরূনীর বক্তব্য, হিলালের বিকৃতির পর্যালোচনায় উল্লিখিত সুস্পষ্ট তথ্য-উপাত্তগুলো এবং স্বয়ং তার গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত বক্তব্যগুলো যদি চিন্তা ও ফিকিরের সাথে পড়েন, ইনশাআল্লাহ বিভ্রম দূর হয়ে যাবে।

وما توفيقي إلا بالله، عليه توكلت وإليه أنيب.

[চলবে ইনশাআল্লাহ]

 

নোট : প্রবন্ধের এই কিস্তিতে অনেক ইংরেজী অভিধানের উদ্ধৃতি এসেছে। বিভিন্ন লাইব্রেরী থেকে এই উদ্ধৃতিগুলো সংগ্রহ করে দিয়েছে আমার ছাত্র সায়ীদুল হক ইবনে মোছাদ্দেক হোসাইন। এগুলোর মর্ম উদ্ধার এবং উপযুক্ত স্থানে এগুলোর ব্যবহার করতে পূর্ণ সহযোগিতা করেছে। আল্লাহ তাআলা তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

তাছাড়া এই প্রবন্ধে বিভিন্নভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছেন দেশ বিদেশের অনেকে। সকলের নাম নিতে গেলে পত্রিকার পাতায় আরো দুই তিন পৃষ্ঠা দরকার। আল্লাহ তাআলা সকলকে এবং সকলের খেদমতকে কবুল করুন। অন্য কোনো প্রসঙ্গে ইনশাআল্লাহ বিস্তারিত শুকরিয়া আদায় করব। 

جزاهم الله تعالى خيرا وشكر سعيهم في الدنيا والآخرة.

 



[1]  GUv wKšÔ G‡÷ªvbwgK¨vj wbDgyb bq, eis wµ‡m›U wbDgyb| Aviex‡Z ¯úóB e‡j‡Qb wZwb قمر أوائل الشهر   hv wµ‡m›U gy‡bi Rb¨B cÖ‡hvR¨, G‡÷ªvbwgK¨vj wbDgy‡bi Rb¨ †Kv‡bvfv‡eB cÖ‡hvR¨ bq| (Ave`yj gv‡jK)

2 A_v©r beP‡›`ªi D`q †`‡L| H ms¯‹i‡Yi ïiæ‡Z 10g c„ôvq BwÄwbqvi mv‡ne wj‡L‡Qb: ÒZvB wnRix gvm MYbv Ki‡Z nq P‡›`ªv`q †`‡L|Ó G e³e¨ 7g ms¯‹i‡YI ûeû Gfv‡eB i‡q‡Q| †`Lyb, c„ôv 15, ce© 1|

[3]  BwÄwbqvi mv‡ne hv‡K Ôe„w× I n«vmÕ ej‡Qb, mvaviY cÖPj‡b Zv‡K n«vm I e„w× ejv nq| Ab¨iv cÖPwjZ GB eY©bvixwZ MÖnY K‡i‡Qb| cieZx© ms¯‹iY¸‡jv‡Z BwÄwbqvi mv‡ne mK‡ji Dci wei³ n‡q‡Qb, †Kb Zviv n«vm-e„w× †j‡Lb? A_P wZwb wb‡RB GKUz Av‡M wj‡L G‡m‡Qb P‡›`ªi n«vme„w×|

[4]  BwÄwbqvi mv‡ne! GUv Avcbvi `vex| Avqv‡Z G wel‡q ¯úó wKQz †bB| wnjvj mKj gvby‡li Rb¨B wgKvZ| wKšÔ mK‡j Zvi †_‡K wgKv‡Zi dv‡q`v Gfv‡e AR©b Ki‡Z n‡e †h, cÖ‡Z¨K GjvKvi gvbyl cÖ_g `k©‡bi A‡cÿvq _vK‡e Ges H cÖ_g `k©b †_‡K cÖ‡Z¨‡K Zvi mgq wba©viY Ki‡e| GUv GKwU AwZwi³ welq hvi e¨vcv‡i Avqv‡Z Kvixgv wbðzc| hLb gvby‡li Rb¨ cÖ_g `k©‡bi †LuvR †bIqv m¤¢e wQj bv ZLbI wnjvj wgKvZ wQj| mK‡jB Gi Øviv wgKv‡Zi dv‡q`v AR©b KiZ| Avqv‡Ziللناس  -Gi g‡a¨ H hvgvbvi †jv‡KivI AšÍfz©³ wQ‡jv| GRb¨ للناس k‡ãi gva¨‡g BwÄwbqvi mv‡ne †h evievi GKB w`‡b †ivhv I C‡`i K_v cÖgvY Ki‡Z Pv‡ÓQb Zv †Kv‡bvfv‡eB G AvqvZ w`‡q cÖgvY nIqvi bq|

[5]  wKšÔ Avcbvi ÔmwVK e¨vL¨vÕi we‡ivwaZv AvcwbB †Zv  cieZx© ms¯‹i‡Y K‡i‡Qb!

 

 

advertisement