যিলহজ্ব ১৪৩৬   ||   অক্টোবর ২০১৫

মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ. : কিছু শিক্ষণীয় ঘটনা-৩

মুহাম্মদ এমদাদুল হক কুমিল্লায়ী

ছাত্রাবস্থায় প্রত্যেক বিরতিতে কিতাব রচনা

লেখা-লেখি সম্পর্কে হযরত মুফতী ছাহেব রাহ. লেখেন, ‘ছাত্রাবস্থায় প্রত্যেক ছুটিতেই আমি একেকটি রিসালা লিখেছি। কোনো ছুটি তা থেকে বাদ যায়নি। যখন আমি জামাতে উলাতে পড়ি তখন হযরতুল উস্তায মাওলানা আবদুল হামীদ ছাহেবের নির্দেশে আলইকতিসাদ ফী শারহে কাসীদায়ে বানাত সুআদনামে আরবীতে একটি কিতাব লিখি এবং সুল্লামুল উলূম-এর দুর্বোধ্য বাহাস আকসে নকীয’, ‘আকসে মুসতাবীএবং তানাকুয’-এর ফার্সিতে একটি শরাহ লিখি। এছাড়া আরো অনেক রিসালা হাটহাজারীর ছাত্র যামানায় লিখি, যা দেওবন্দ যাওয়ার পর হারিয়ে যায়। দেওবন্দে যে বছর দাওরা পড়ি তার পূর্বের রমযানের ছুটিতে উমদাতুল আকওয়ালরিসালাটি লিখি। যা তৎকালীন দেওবন্দের সকল আকাবির পছন্দ করেন এবং অভিমত লিখে দেন।

বিষয়টি আরো সবিস্তারে হযরত মুফতী ছাহেব মৌখিকভাবে বলেন। ছুটির দিনগুলোতে খোলার দিন থেকেও বেশি ব্যস্ত থাকতাম। সারাদিন তাকরার মুতালাআ এবং কোনো বিষয়ে লিখা তৈরিতে ব্যয় করতাম। হাটহাজারীর ছাত্র যামানার বিভিন্ন ইলমী রচনা এরই ফল। দারুল উলূম দেওবন্দের দাওরায়ে হাদীসের বছর রমযানের বিরতিতে মাথায় রদ্দে বিদআত-এর জযবা চেপে বসল। তখন একটি বড় কাজে হাত দেওয়ার ইচ্ছা করলাম। চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকা নীলার এক বেদআতী আলেম, নাম মৌলভী যমীরুদ্দীন, প্রচলিত খয়রাতের বৈধতার উপর একটি কিতাব লিখে নাম দিয়েছে

أحسن المقال في جواز الخيرات المروجة في ملك البنجال

হাটহাজারীর ছাত্র যামানায়ই তার জবাব লিখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ফুরসত হয়নি। এ রমাযানে তা বাস্তবায়ন করার ইচ্ছায় লিখা শুরু করি। যখন মুফতী আযম হযরত মাওলানা আযীযুর রহমান ছাহেব বিষয়টি জানলেন তখন নিজেই বললেন, কিছু কিছু লিখে আমাকে শোনাতে থাক। আমি তাই করতে লাগলাম। শুনতে গিয়ে হযরত মুফতী ছাহেব সীমাহীন খুশি হতেন। এভাবে এই রিসালাটি তৈরি হয়। আলহামদুলিল্লাহ, এই রিসালার উপর হযরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ., হযরত মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী রাহ., মুফতীয়ে আযম মাওলানা আযীযুর রহমান রাহ., হযরত মাওলানা বলিয়াভী রাহ.-এর মত ব্যক্তিত্বগণ অভিমত লিখে ধন্য করেন এবং হিন্দুস্তানের শতের কাছাকাছি উলামা মাশায়েখ তার সত্যায়ন করে দস্তখত প্রদান করেন।

উল্লেখ্য, আফসোসের বিষয় বর্তমানে আমাদের হাতে ঐ রিসালাটি নেই। তাই আমরা এ মহামূল্যবান সম্পদটি থেকে যেমন বঞ্চিত সাথে সাথে এসকল অভিমতগুলো থেকেও বঞ্চিত। একজন বাংলাদেশী ছাত্রের কিতাবে ঐ সমস্ত ব্যক্তিত্বদের অভিমত, ভাবতেই বড় ভাল লাগে। তবে খুশির খবর হল, হযরত মুফতী ছাহেবের জীবনীকার হযরত মাওলানা ইযহারুল ইসলাম দা. বা. দুইটি অভিমত উল্লেখ করেছেন, যার একটি হল মুফতীয়ে আযম হযরত মাওলানা আযীযুর রহমান ছাহেবের। তিনি লিখেন,

الحمد لله وكفى وسلام على عباده الذين اصطفى أما بعد.

আমি

"عمدة الأقوال في رد ما في أحسن المقال"

পুস্তিকাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গভীর মনোযোগের সাথে শুনেছি। লেখকের তাহকীক সঠিক এবং মুহাক্কিক উলামায়ে আহনাফের মতের উপর রয়েছে। আর আহসানুল মাকাল’-এর লেখক, বিদআতের প্রচলন এবং আহলে বিদআত-এর সহযোগিতার বিষয়ে যেসব বাতুল দলীল দ্বারা প্রমাণ পেশ করেছে, ‘উমদাতুল আকওয়াল’-এর লেখক সেসবের খুব সুন্দর জবাব দিয়েছে এবং মুহাক্কিকীন উলামায়ে কেরামের বক্তব্য দিয়ে তা খণ্ডন করেছে।

جزاه الله تعالى أحسن الجزاء

আরেকটি হল, শায়খুল ইসলাম মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী রাহ.-এর। তিনি দীর্ঘ একটি অভিমত পেশ করেন। আমরা তার কিছু অংশ তুলে ধরছি। তার ভমিকা থেকেই বুঝা যায় মিশকাত পড়য়া হযরত মুফতী ছাহেবের কিতাব কোন মানে উত্তীর্ণ হয়েছিল এবং মাওলানা উসমানী রাহ.-এর মত ব্যক্তিত্বকে কেমন প্রভাবিত করেছিল। তিনি লেখেন-

আল্লাহ তাআলা এ পুস্তিকার লেখক প্রিয় ভাই মৌলভী ফায়যুল্লাহ সাল্লামাহুকে ইলম ও আমলের অনেক সুউচ্চ মাকাম দান করুন এবং ইহপরকালে উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে সফল করুন। সে আল্লাহ তাআলার তাওফীকে পূর্ণ মেধা ও বিচক্ষণতা এবং সততা ও প্রাণান্তকর চেষ্টা, শ্রমকে কাজে লাগিয়ে সমকালীন কিছু শয়তানের দোসরের ধোকা ও কট-কৌশলের মূলোৎপাটন করেছে এবং তাদের ভ্রষ্টতা ও প্রতারণার ভুবনকে সমূলে চর্ণ করে দিয়েছে...। এহেন মুহূর্তে আযীযম মৌলভী ফায়যুল্লাহ চাটগামী

یکے از کیاء طلبہ دیوبند است

যিনি দেওবন্দ-এর মেধাবী ছাত্রদের একজন...

শায়খুল ইসলাম উসমানী-এর জ্ঞানগরিমা ইলম ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে সকলেরই জানা। তাঁর মত ব্যক্তি থেকে এমন শব্দে তাকরীযপাওয়ার জন্য কেমন যোগ্যতার প্রয়োজন তা সহজেই অনুমেয়।

হেদায়ার প্রতি ভালোবাসা

হেদায়া কিতাবের সাথে হযরত মুফতী ছাহেবের গভীর সম্পর্ক ছিল। যে বছর হেদায়া পড়েছেন সে বছর তো আছেই পরবর্তীতে হাটহাজারী ও দেওবন্দ পড়াকালীনও তিনি দৈনিক হেদায়া অধ্যয়ন করতেন। শিক্ষকতার সময়ও তিনি এ ধারা বহাল রেখেছেন। সবকের জন্য মুতালাআ, ফতওয়া প্রদান ও ওয়াজ নসীহতসহ হাজারো কাজে হযরত মুফতী ছাহেবের দৈনিক রুটিন ঠাসা ছিল। তা সত্তে¡ও তিনি দৈনিক হেদায়া মুতালাআ করতেন, কোনোদিন নাগাহ হতে দিতেন না। একবারের ঘটনা- মেখল হামযা খানের বাড়িতে রাতের দাওয়াত ছিল। বর্ষাকাল ছিল বলে রাস্তায় প্রচুর কাদা ছিল, তাই রাতে বাড়ি আসতে পারলেন না। আবার সেখান থেকে হাটহাজারী মাদরাসাও নিকটে ছিল। চাইলে সকালে সেখান থেকে মাদরাসায় চলে যেতে পারতেন। কিন্তু হযরতের মামুল ছিল সকালে হেদায়া মুতালাআ করা। তাই এ মামুল ব্যাহত হবে বলে সকালে হযরত মুফতী ছাহেব হাটু কাদা ভেঙে বাড়ি আসলেন এবং হেদায়া মুতালাআ করলেন অতপর মাদরাসায় গেলেন। এভাবে তিনি কতবার পূর্ণ হেদায়া মুতালাআ করেছেন তা তাঁর নিজেরও স্মরণ নেই। জনাব মাওলানা আব্দুল গণি আকীলপূরী ছাহেব বলেন, সতের বারের কথা তো হযরতের স্মরণ আছে, কিন্তু এর বেশি আর কতবার হবে তা মনে নেই।

পরীক্ষার সম্মুখীন

দেওবন্দ থেকে আসার পর হযরত মুফতী ছাহেব কিছু পরীক্ষার মুখোমুখী হন। বিষয়টি তার স্বরচিত জীবনীতে এভাবে ইঙ্গিত করেন-দেওবন্দ থেকে ফেরার পর পরীক্ষার মুখোমুখি হই। আলহামদু লিল্লাহ ছুম্মা আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহ তাআলার দয়া ও তাঁর গায়বী সাহায্য সর্বদা সঙ্গী ছিল। অন্যথায় সীরাতে মুস্তাকীম হতে বিচ্যুত হয়ে যেতাম

এসব পরীক্ষার মধ্যে দুটি পরীক্ষা উল্লেখযোগ্য। প্রথমটির বর্ণনা হযরত এভাবে দেন-দেওবন্দ থেকে যখন চট্টগ্রাম পৌঁছলাম প্রথমে জ্যাঠা জনাব মরহুম মুন্সি কুরবান আলীর ঘরে উঠলাম। সেখানে চাচাতো ভাই ইয়ার আলী মিয়া চৌধুরী, ফয়েয আহমেদ চৌধুরী, দারোগা হামীদ যিনি আমার আলিফ বা-এর উস্তাযও এবং পেশকার বেলায়েত হাসান ও ডাক্তার রহীম বখশ সকলে মিলে আমাকে সরকারী মাদরাসায় পরীক্ষা দিয়ে সনদ নিতে বললেন। যাতেকরে ভালো রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা হয়। তারা বললেন, আপনার পরীক্ষা দেওয়া জরুরি। কারণ আপনার পিতার অবর্তমানে এ পরিবারের এতগুলো এতীম ও বিধবার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আপনার। আর আপনার আব্বার তেমন কোনো সম্পদ-সম্পত্তি নেই, যা দিয়ে আপনি সাংসারিক খরচ নির্বাহ করবেন। সাথে সাথে পরীক্ষা দিতে আপনার তেমন পড়ালেখাও করা লাগবে না। কেননা আপনার সব পড়া আছে। তাই নিশ্চিন্তে পরীক্ষা দিয়ে দিন। হযরত মুফতী ছাহেব বলেন, তাদের এ পরামর্শ আমার খুবই অপছন্দ হল। তাই আমি পরিষ্কার মাযেরাত করলাম এবং বললাম, যমযম পান করার পর নোনা পানির পাত্র কীভাবে মুখে নিবো। আমি দেওবন্দে ইলমের পাহাড়তুল্য উস্তাযদেরকে দেখেছি। তাদের ফয়যের রশ্মি এখনো আমার সামনে জ্বলজ্বল করছে। এটা কীভাবে সম্ভব, আমি তাদের দেখানো রাস্তা থেকে সরে অন্য রাস্তা ধরব। হযরত শায়খুল হিন্দ, হযরত শাহ ছাহেব, হযরত শাব্বীর আহমদ উসমানীর মত ব্যক্তিত্বদের দেখে এটা কীভাবে সম্ভব যে আমি তাদের বিপরীতে চলব? বাড়ি এসে ছোট ভাই নজীব আলীকে তাদের পরামর্শের কথা বললে সেও পরীক্ষা দিতে পীড়াপীড়ি করল। শেষে আমি তাকেও একই উত্তর দেই।

দ্বিতীয় পরীক্ষা হল, দেওবন্দ থেকে এসে কিছুদিন পর আমি হাটহাজারী মাদরাসায় তাদরীসের খেদমত শুরু করলাম এবং নিয়মতান্ত্রিক কাজ করতে লাগলাম। তৎকালে চট্টগ্রাম শহরের মাদরাসায়ে মোহসেনিয়ার বেশ সুনাম সুখ্যাতি ছিল। বলতে গেলে পুরো দেশের অন্যতম সেরা মাদরাসা ছিল। ফখরে বাঙাল মাওলানা আব্দুল হামীদ সে মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন। হঠাৎ কলকাতা আলীয়া থেকে ডাক আসলে তিনি সেখানে চলে যান। তখন মাদরাসার জন্য একজন বিদগ্ধ শিক্ষকের প্রয়োজন দেখা দিল। আমার চাচাতো ভাই জনাব ইয়ার আলী মিয়া পেশকার ঐ মাদরাসার পরিচালনা পরিষদের একজন ছিলেন। তিনি পেশকার বেলায়েত হাসানের মাধ্যমে আমার নিকট চিঠি লিখে পাঠান যে, মাদরাসার মজলিসে আমেলা আপনার প্রয়োজন অনুভব করছে তাই আপনি তড়িৎ মজলিসে আমেলার নিকট চাকরীর জন্য দরখাস্ত লিখুন। এটা আপনার জন্য সুবর্ণ সুযোগ। কেননা হাটহাজারী মাদরাসা থেকে যে ওযীফা পান তা দিয়ে আপনাদের সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ হয় না। মাওলানা আব্দুল হামীদ ছাহেব সাড়ে তিনশত টাকা পেতেন। আপনাকে প্রথমেই পঞ্চাশ থেকে শুরু করে ঐ পরিমাণ পর্যন্ত বেতন দেওয়া হবে। ঐ সময় আমি হাটহাজারী মাদরাসা থেকে পনের টাকা পেতাম। সংসারের অবস্থাও খুব নাযুক ছিল। এতদসত্তে¡ও আমার মন বলল এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে বড় পরীক্ষা। তিনি পরীক্ষা করছেন, আমি দ্বীন চাই না দুনিয়া চাই। তাই তৎক্ষণাৎ মন বলল যে, হাটহাজারী মাদরাসা ছেড়ে যদি মোহসেনিয়ায় যাই তাহলে দ্বীনকে বাদ দিয়ে দুনিয়াকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। তাই না যাওয়ার পাকা সিদ্ধান্ত নিলাম। বাকি চিন্তা হল, আমার চাচাতো ভাইদেরকে কীভাবে বিষয়টি বলব। যদি তৎক্ষণাৎ অস্বীকৃতি জানাই তাহলে তারা মনে ব্যথা পাবে। তাই তখন শুধু বললাম, ইনশাআল্লাহ আগামীকাল বলব। এই বলে ঘর থেকে মাদরাসায় রওয়ানা হলাম। পথে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হল যে, হাটহাজারীতে থাকা হবে শুধু দ্বীনের জন্য। আর এখানে আমার সকল আসাতিযা উপস্থিত। এসব বাদ দিয়ে মোহসেনিয়া যাওয়া হবে একমাত্র দুনিয়ার উদ্দেশ্য। মাদরাসা থেকে ফিরে মাওলানা যাকের ছাহেবকে বিষয়টি বললে এবং আমার মত প্রকাশ করলে তিনি খুব খুশি হলেন। সন্ধ্যায় ঘরে এসে দেখি স্বয়ং চাচাতো ভাই এসে হাজির। আমি তাকে বিষয়টি বুঝালাম যে, হাটহাজারী ছেড়ে মুহসেনিয়ায় যাওয়া দুনিয়া তালাশ মনে হচ্ছে। আর এখানে উস্তাযদের ছত্রছায়ায় থেকে বহু অভাব সয়েও দ্বীনী ব্যস্ততা গণীমত মনে করছি। আমার ধারণা ছিল তিনি আমার এমন কাটাকাটা জবাব শুনে মন খারাপ করবেন। কিন্তু আল্লাহর কী শান, তিনি আমার জবাব শুনে খুবই প্রভাবিত হলেন এবং কোর্টের বড় বড় আমলাদেরও বিষয়টি বলতে থাকলেন যে, আমার এক ভাই দুনিয়া চায় না। তারাও খুব প্রভাবিত হলেন এবং অনেকে আমাকে দেখতেও আসলেন। 

তথ্যসূত্র : হায়াতে মুফতী আযম

 

 

advertisement