শাওয়াল ১৪৩৬   ||   আগস্ট ২০১৫

আমাদের বঞ্চনা ও ভোগান্তি : কিছু অপ্রিয় সত্য ও সময়ের দাবি

আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী

যে প্রশাসন, যে নেতৃত্ব, যে আইন ও বিচারব্যবস্থা, যে রাজনীতি এমনকি যে শাসনতন্ত্র দেশ জাতি ও রাষ্ট্রের তথা জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারে না, শুনতে যতই অপ্রিয় ঠেকুক না কেন, কোনো সভ্য স্বাধীন জাতির উপযুক্ত নয়। তাই আমাদেরকে কেবল ঘায়ের উপর বা জখমের উপর মলম দিয়ে আপাতত নিরাময়ের চিন্তা না করে একেবারে গোড়া থেকেই ফিরে দেখতে হবে।

বৃটিশ শাসনের আমলে আমাদের নযর ছিল বিদেশী শাসকদের শাসন ও শোষণের উপর। তাই দেশের প্রতিটি নাগরিক সমস্ত দুর্ভোগের জন্য তাদেরকেই দায়ী করেছে।

বিদেশী বেনিয়াদের শাসন-শোষণের প্রথম শিকার হয়েছিল সুবে বাংলা তথা বাংলা বিহার উড়িষ্যার অধিবাসীরা, বিশেষত এ অঞ্চলের মুসলিম নাগরিক। কারণ তাদের হাত থেকেই বিদেশীরা ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারাই ছিলেন আশংকার পাত্র। অর্থ-সম্পদ ও প্রভাব প্রতিপত্তিও তাদেরই বেশি ছিল বলে প্রতিরোধটাও তাদের পক্ষ থেকেই আসার আশংকা করত বিদেশী বেনিয়ারা। আর কার্যতঃ হয়েছেও তাই। সুদীর্ঘকাল মুসলিম শাসনাধীন থাকা প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের একটা চাপা ক্রোধ ছিল তাদের উপর। তাই নতুন শাসকদের ক্ষমতা গ্রহণকে তারা কেবল প্রভুবদল বলেই দেখেছে এবং নতুন প্রভুদের হাতে রেখে সদ্য রাজ্যহারা মুসলিম জাতিকে সর্বপ্রকার অত্যাচার ও শোষণে হাত মিলিয়েছে। নিজেদের ক্রোধ চরিতার্থ করার সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে এবং বিদেশী শাসকদের উচ্ছিষ্ট ভোগের সাথে সাথে নিজেদের প্রতিবেশী জাতির সম্পদ লুণ্ঠনের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য গড়েছে। এটা অন্যায় হলেও খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু বলা যাবে না।

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের ঠিক এক শ বছর পর সিপাহী বিপ্লব হয় ১৮৫৭ সালে। তারপরই আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লির মোঘল বাদশাহীর অবসান ঘটে। শেষ মোঘল সম্রাট কবি বাহাদুর শাহ যফর রেঙ্গুনে নির্বাসিত হন। সুবে বাংলা তথা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ছাড়া অবশিষ্ট ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন  জেঁকে বসে। 

অন্য কথায়, দীর্ঘ একটি শতাব্দীর ইংরেজ শাসন ও হিন্দু অত্যাচারী জমিদারদের অত্যাচার নিপীড়নে যখন বাংলার মুসলমানরা একেবারে নেতিয়ে পড়েছে, উঠে দাঁড়াবার সামর্থ্য পর্যন্ত হারিয়ে বসেছে, ঠিক তখনই ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশে সেই শোষণের সূত্রপাত হয়। কিন্তু ঐসব এলাকার মুসলমান তথা সর্বশ্রেণীর প্রজাদের আর পূর্ণ একটি শতাব্দীও ইংরেজ শাসনের জোয়াল বইতে হয়নি। ১৯৪৭ সালেই অর্থাৎ তার নব্বই বছরের মাথায় গোটা ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়ে যায়। ততদিনে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে মুসলমান-সমাজেও যথেষ্ট আধুনিক শিক্ষিত লোক সৃষ্টি হয়ে গেছে। ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঐ সমস্ত এলাকার ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের লোকদের দ্বারাই আমাদের এই পূর্বাঞ্চলের পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার প্রশাসনিক শূন্যতা পূরণ করা হয়েছিল।

উক্ত বাস্তব সত্যটা বিস্মৃত হওয়ার কারণেই আমরা সর্বদা পাকিস্তানী তথা পাঞ্জাবী শাসকদের দ্বারা শোষিত হওয়ার বঞ্চনাবোধে বেশী ভুগেছি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে এই পূর্ব বাংলার শাসন, আইন ও বিচারব্যবস্থা অনেকটাই হিন্দু সমাজের নব্য শিক্ষিত লোকদের দ্বারা পরিচালিত হত। তাদের বাস্তু-ত্যাগের ফলে এদেশে যে একটা বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল তা অস্বীকার করার কোনোই উপায় নেই। এদেশ থেকে যাওয়া অন্তত সাতজন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। কেবল প্রশাসনিক কর্মকর্তার শূন্যতাই নয়, আমাদের কোর্ট-কাচারী হিন্দু উকীল, ব্যারিস্টার, ম্যাজিষ্ট্রেট, জজ ও বিচারপতিশূন্য হয়। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হিন্দু অধ্যাপকশূন্য হয়। হাসপাতালগুলো ডাক্তারশূন্য হয়। ঐ সময় যদি মধ্য ভারত, উত্তর ভারত ও পশ্চিম ভারত (তথা পাকিস্তান) থেকে আগতরা ঐ শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে না আসত এবং নতুন দেশগড়ার একটা মেযাজ নিয়ে সেবা না দিতেন তাহলে আমাদের অবস্থাটা কী দাঁড়াত? তাঁদের সকলেই পাকিস্তানী ছিলেন বা শোষক ছিলেন, তাদের মধ্যে কোনো দেশপ্রেমিক ভালো লোক ছিলেন না, এমনটিও বলা যাবে না। স্বাধীনতার জোশ কমেছে, শোষণের প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে এবং আমরা অনেক ক্ষেত্রেই অন্যায় অবিচারের সম্মুখীন হয়েছি- এটা যেমন সত্য, পূর্বোক্ত সত্যটি তার চাইতে মোটেই কম সত্য বা কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।

পাকিস্তান সৃষ্টির প্রয়োজনটা আমাদের বাঙালী মুসলমানদেরই সবচাইতে বেশী ছিল। তাই এ ব্যাপারে আমাদের প্রচেষ্টা এবং অবদানটাও স্বাভাবিকভাবেই বেশী। ১৯০৬ সালে এই ঢাকারই নবাব স্যার সলীমুল্লাহর আহ্বানে এই ঢাকারই শাহবাগে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম নেতাদের সম্মেলনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠিত হয়। ১৯৪০ সালের ২৩ শে মার্চ লাহোরের মুসলিমলীগ অধিবেশনে আমাদের এই বাংলাদেশেরই নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফযলুল হকের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থিত হয়েছিল। এর কয়েকবছর পর যখন মুসলিমলীগ-নেতৃত্ব আঁচ করতে পারলেন যে, ফেডারেল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত একটি স্বতন্ত্র স্ব-শাসিত স্টেট বা রাষ্ট্ররূপে পূর্বপাকিস্তান তার অস্তিত্ব বৈরী হিন্দুভারতের সম্মুখে টিকিয়ে রাখতে পারবে না, তখনই পাকিস্তান-প্রস্তাবের স্টেট্স শব্দের বহুবচন লুপ্ত করে স্টেট বা একক রাষ্ট্রের প্রস্তাব পাশ করা জরুরি হয়ে দাঁড়াল। তখনও যিনি এ গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবটি মুসলিমলীগের ১৯৪৬ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে উত্থাপন করেছিলেন তিনিও ছিলেন একজন বাঙালী- তখনকার বাংলার প্রধানমন্ত্রী পরবর্তীতে আওয়ামি লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পাকিস্তান প্রস্তাব প্রণয়নের সাবজেক্ট কমিটিতে নজন সদস্যের মধ্যে সিলেটের আব্দুল মতীন চৌধুরীও ছিলেন। সুতরাং এ জন্যে পাকিস্তানী বা পাঞ্জাবী নেতৃত্বকে দায়ী করার উপায় নেই। এর দায়ভারও আমাদের উপরই বর্তায়।

নানা প্রশাসনিক ও কটনৈতিক মারপ্যাঁচে আমরা বাঙালীরা অনেক মার খেয়েছি, সন্দেহ নেই। কিন্তু সে জন্যে আমাদের নিজেদের দায়দায়িত্বটা নেহায়েতই কম? কেন, পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে আমাদের বিপুল সংখ্যক বাঙালী সদস্য, ক্যাবিনেটে বাঙালী মন্ত্রী-মিনিস্টাররা ছিলেন না? তাদের সকলেই কি বাঙালী বিদ্বেষী এবং অবাঙালী ছিলেন? মেধা, জ্ঞানবুদ্ধি ও কৌশলের দৈন্যের জন্যে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত ও শোষিত হয়েছি। এটা ঐতিহাসিক সত্য। তাই কথায় কথায় পাকিস্তানী ও পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ও বিদ্বেষ প্রচারের দ্বারা আমরা কোনোমতেই দায়মুক্ত হতে পারবো না। সেদিন যদি আমরা পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে না পড়ে শেরে কাশ্মীর শেখ আব্দুল্লাহর মতো তার সহপাঠী বন্ধু পÐিত জওহরলাল নেহরুর প্রতি গভীর আস্থা স্থাপনের মত করে আমরাও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক শ্লোগানে ভারতের জোয়াল কাঁধে তুলে নিতাম, তাহলে আজ আমাদের অবস্থা কি ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগুরুর রাজ্য কাশ্মীরের চাইতে একটুও ভালো হত?

(২)

আল্লাহ আল্লাহ করে ভারতবর্ষ স্বাধীন হল ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে। ১৪ই আগস্ট করাচীতে কায়েদে আজম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেলরূপে দায়িত্ব গ্রহণ করে স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। পরদিন ১৫ই আগস্ট দিল্লিতে স্বাধীন ভারতের প্রথম বড়লাটরূপে ভারতবর্ষের শেষ ইংরেজ বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটন দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নেতাদের বড় বড় গণতান্ত্রিক বুলি আওড়ানো সত্তে¡ও গোটা ভারতবর্ষে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লাখ লাখ হিন্দু-মুসলিম আত্মাহুতি দিলেন। এভাবে লাখ লাখ নাগরিকের রক্তের উপরই প্রতিষ্ঠিত হল স্বাধীন পাকিস্তান ও স্বাধীন ভারত।

পাকিস্তানের বড়লাট ছিলেন মূলত বোম্বের অধিবাসী। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী পূর্ব পাঞ্জাবের কর্ণালবাসী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুও ভারতীয় ছিলেন না, ছিলেন দেশীয় রাজ্য কাশ্মীরের অধিবাসী। যাকে পরে অনৈতিকভাবে ও জাতিসংঘের গণভোটের মাধ্যমে দেশবাসীর ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব ও ভারতের নিজের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ভারতসীমানার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানের অঙ্গিকার ছিল ইসলামী আদর্শে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার, আর ভারতের অঙ্গীকার ছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। কিন্তু প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই সেখানে মুসলমানদের উপর নির্যাতন শুরু হয়। শত শত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, আজো হচ্ছে, বিরতি নেই। সর্বশেষে চরম সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী বিজিপি বা ভারতীয় জনতা পার্টি সমগ্র হিন্দু জাতির আস্থা লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এখন ক্ষমতায়। আর পাকিস্তান ইসলামী আদর্শবাদ ইসলামী উপদেষ্টা পরিষদ-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ঐ পরিষদের প্রধান পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আল্লামা আলাউদ্দীন সিদ্দিকী আমাদের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৫/৬ বছর পূর্বেই সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন- পাকিস্তান কোনো অর্থেই একটা ইসলামী রাষ্ট্র নয়।

(৩)

মি: গান্ধীকে বাহ্যত. অনেকটা ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতন্ত্রী ও উদারমনা মনে হলেও আমরা বাংলা ও আসামের অধিবাসীরা তার সে উদারতা দেখতে পাইনি। বিহারে যখন বিরাট দাঙ্গায় শত শত হাজার হাজার মুসলমান নিধন চলছিল তখন তিনি আমাদের নোয়াখালীতে অল্প কজন হিন্দুভক্ত নিধনের প্রতিবাদে নোয়াখাীলতে এসেছিলেন শান্তি মিশনে। বাংলার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার এ মনমানসিকতার নিন্দা জানিয়ে যথারীতি পত্র লিখে তাঁকে বিহারের অধিক সংখ্যক দাঙ্গা আক্রান্ত লোকদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি তা গ্রাহ্য না করে নোয়াখালীতেই পড়ে থাকলেন।

আবুল হাশিম, সোহরাওয়ার্দী, কিরণ শঙ্কর রায় ও শরৎবোস স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁর সমর্থন ও আশীর্বাদ নিতে গেলে মহাত্মা চমকে উঠেছিলেন এবং কোনোমতেই তাতে সায় দেননি। অথচ সেটা তো পাকিস্তানের মত ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার শ্লোগান-ভিত্তিক রাষ্ট্র হতো না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিক বলে হিন্দুদের দ্বারা নিন্দিত কায়েদে আজম কিন্তু তাতে সায় দিয়েছিলেন। সাথে সাথে তিনিই চার বাঙালী নেতাকে সাবধান করে দিয়ে বলছিলেন, আমি তোমাদের মতে সায় দিয়েছি ওটা কিন্তু ভুলেও তোমরা মি. গান্ধীকে বলতে যেয়ো না। নতুবা তিনি কোনোমতেই এতে আর সায় দিবেন না। কিন্তু তা না বললেও গান্ধীজী কিন্তু আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের উদ্যোগকে সমর্থন দিতে কোনমতেই রাজী হননি।

বাংলা ও আসাম চিরদিনই ছিল পরস্পরের পরিপূরক  ঘনিষ্ঠ দুটি প্রতিবেশী প্রদেশ। তাই আমাদের জন্যে যেমন আসামের মত বনজ ও খনিজ সম্পদপূর্ণ এলাকাটির প্রয়োজন ছিল, তেমনি ব্যবসা বাণিজ্য ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে স্থলবেষ্টিত ঐ পার্বত্য প্রদেশটির আমাদের সাথে থাকাটা ছিল অধিকতর লাভজনক। গান্ধীজী আসামের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী (বর্তমানের ভাষায় মুখ্যমন্ত্রী) গোপীনাথ বড়দলটাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন- তোমরা কোনোমতেই পূর্বপাকিস্তানে যোগ দিতে রাজী হবে না! এ বাস্তবতায় পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে ঢাকায় এসে মুসলিমলীগ নেতা খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথে দেখা করার জন্যে সপ্তাহ খানেক ঢাকায়ই অতিবাহিত করেন। কিন্তু খাজা সাহেব এ সুযোগটা গ্রহণের চেষ্টা করা তো দুরের কথা, মহারাজাকে তিনি দেখাও দেননি। কংগ্রেস ও মুসলিমলীগ নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গির কী দারুণ তফাত, তারপরও ওরা অসাম্প্রদায়িক, উদার আর এরা সাম্প্রদায়িক, ক্ষুদ্রমনা! এটা কিন্তু ইতিহাস, বানোয়াট গল্প নয়।

(৪)

বিগত ৫ই জানুয়ারীর কথিত অবৈধ নির্বাচন এবং প্রধানমন্ত্রী ও সরকারী দল কথিত নিয়মরক্ষার নির্বাচন, তার পরবর্তী বিএনপি সমর্থিত বিশদলীয় সভাসমিতি এবং সরকারী নিয়ম অনিয়মের বাধা-বিপত্তি দেশবাসীকে এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে যে, বিগত অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে এর কোনো নযীর নেই। একদল হরতাল অবরোধ ঘোষণা করে এমন এক অচলাবস্থা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশকে ঠেলে দিয়েছে যে সরকার কোনোমতেই তা সামাল দিতে পারছে না। সরকারী দল জ্বালাও-পোড়াও ও ক্ষয়ক্ষতির জন্যে বিরোধীদলকে দায়ী করছে। ওদিকে বিরোধী দল বলছে, ওগুলো আমাদের কাজ নয়, খোদ সরকারই জনগণের কাছে আমাদেরকে অপ্রিয় এবং বিদেশীদের কাছে আমাদের দুর্নাম রটিয়ে দমনের স্বপক্ষে সকলের সহানুভতি লাভের চেষ্টা করছে। ওদিকে বিরোধীদলের অভিযোগ তাদের হাজার হাজার কর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করে সরকার বিরোধীদলকে নির্মূল করে নিজেদের শাসন চিরস্থায়ী করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। কাদের বয়ানে কতটুকু সত্যতা ও কটকৌশল রয়েছে তা নির্ণয় করা আমাদের মত আম-জনতার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে ভুক্তভোগী গোটা দেশ, রাষ্ট্র ও জাতি। পরস্পরে হত্যা, গুম, দোষারোপ করে। একদল বলছে তাদের প্রতিপক্ষ নিরপরাধ মানুষ পোড়াচ্ছে, সম্পদ ধ্বংস করছে, অপরদল বলছে, জনগণের অর্থে কেনা অস্ত্র দিয়ে জনগণের টাকায় পোষা পুলিশ-র‌্যাব ব্যবহার করে সরকারই বরং বেশী অন্যায় ও দুর্নাম করছে। গোটা দেশটাকে তারা বধ্যভূমি ও কারাগারে পরিণত করেছে। সকল পক্ষের সকল কথা সর্বাংশে সত্য না হলেও কিছু কিছু সত্যতা যে আছে তা ভুক্তভোগীরা তো অবশ্যই বুঝেন। ভোটাভুটির দায়-দায়িত্ব নাই বলে সরকার যেমন নির্বিকার, কোনো রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নাই বলে বিরোধীদলও নিজেদেরকে দায়মুক্ত মনে করে। কেউ দায়িত্ব না নিলেও নিরপরাধ জনগণকে তো এ দায়িত্বভার অনিচ্ছায় হলেও বয়ে ফিরতে হচ্ছে। দেশে কোনো দায়িত্বশীল সরকার থাকলে এমনটি হতে পারে না। যারাই আন্দোলনের বা সংলাপের প্রস্তাব দিচ্ছেন তাঁরা বিশ্বের চোখে জনগণের চোখে নন্দিত ও প্রশংসনীয় হলেও সরকারের চোখে, সরকারী দলের চোখে নিন্দিত। এমতাবস্থায় জনগণের সক্রিয় হওয়া ছাড়া সমাধানের কোনোই উপায় নেই।

অর্থাৎ গোড়া থেকেই আবার আমাদের ভাবতে হবে। এই স্বাধীনতা, এই স্বাধীনতার চেতনা, এই ধাঁচের গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় নীতি অনন্তকাল ধরে সয়ে সয়ে একটা অসভ্য জাতি ও ব্যর্থ রাষ্ট্ররূপে আমরা বিশ্ববাসীর করুণার পাত্রে পরিণত হব? তাই কেবল সরকার পরিবর্তনের নির্বাচন নয়, নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্যে একটি গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হওয়াই সময়ের দাবি। তা কী করে হতে পারে- সে ভাবনাই আমাদের ভাবতে হবে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, আলেম, লেখক- গবেষক

 

 

advertisement