শাওয়াল ১৪৩৬   ||   আগস্ট ২০১৫

শব্দ ও বাক্যের শক্তিমূল্য

খালিদ বেগ

যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাসী, তার উচিত উত্তম কথা বলা অথবা নীরব থাকা -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৯৪

বিশিষ্ট সাহাবী সায়্যিদুনা মুআজ ইবনে জাবাল রা. একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বললেন, আমাকে এমন একটি আমলের (পুণ্যকর্ম) কথা বলুন, যা আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে আমি রক্ষা পেতে পারব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি বাস্তবিকপক্ষেই একটি গভীর বিষয়ে জানতে চেয়েছো। কিন্তু এটা তার পক্ষে সহজ, আল্লাহ পাক যার জন্য সহজ করে দেন। আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর কোনো অংশিস্থাপন করো না। নিয়মিত সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর, রমযানের রোযা রাখ এবং হজ্ব পালন কর। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি তোমাকে পুণ্যের দরজাসমূহের কথা বলব না? রোযা হল ঢাল বা বর্ম (পাপ ও দোযখের আগুন প্রতিহত করার ক্ষেত্রে), দান-সদকা পাপকে নিভিয়ে দেয়; যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয় এবং গভীর রাত্রির নামায (নফল তাহাজ্জুদের নামায)। তারপর তিনি এই আয়াত পাঠ করলেন, তারা নিঃশব্দে বিছানা ত্যাগ করে, তারা (নিশুতি রাতে আযাবের) ভয়ে এবং (জান্নাতের) আশায় তাদের মালিককে ডাকে এবং আমি তাদেরকে যাকিছু দান করেছি তা থেকে তারা (আমারই পথে) ব্যয় করে-সূরা আস সাজদাহ  ৩২ : ১৬

তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি কি তোমাকে মূল বিষয়, সে বিষয়ের ভিত্তি এবং এর শীর্ষচূড়া সম্পর্কে কিছু বলব না? মূল বিষয় হল, ইসলাম গ্রহণ, প্রধান ভিত্তি হল সালাত এবং সর্বোচ্চ শীর্ষদেশ হল জিহাদ। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি কি বলব, এই সব কিছু কোন্ বস্তুর ওপর নির্ভরশীল? তারপর তিনি জিহ্বার দিকে নির্দেশ করে বললেন, জিহ্বাকে সংযত রাখ। হযরত মুআয ইবনে জাবাল জানতে চাইলেন, আমাদের কথাবার্তার কারণেও কি জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে? এই কথার উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অধিকাংশ মানুষকে তার মুখ নিম্নমুখী করে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে তাদের মুখনিঃসৃত পাপের কারণে-জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫৪১

কথা বলা এবং নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষমতাই মানুষকে পশুদের থেকে আলাদা করেছে। এই নিআমতের সঠিক ব্যবহার অথবা তার ব্যতিক্রমের উপরই নির্ভর করে, কে উত্তম ও সফল আর কে নিকৃষ্ট ও ব্যর্থকাম। সায়্যিদুনা মুআয রা.-এর প্রশ্ন ছিল অনন্তকালীন আখেরাতের সাফল্য সম্পর্কে। জবাবস্বরূপ, হাদীসে মানুষের সামগ্রিক জীবনের ফরয ও নফল (অপরিহার্য ও অতিরিক্ত) আমলসমূহের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদেরকে একথাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, যা ফলাফল তা সবই নির্ভর করে আমাদের জিহŸাকে সংযত রাখার উপর। অন্যভাবে বলা যায়, অসতর্ক কথাবার্তা আমাদের সমস্ত নেক আমলকে বরবাদ করে দিতে পারে। এবং এই একই বিষয় অপর একটি হাদীসে একটু অন্যভাবে বর্ণিত হয়েছে :

প্রত্যেক দিন ভোরে আদমসন্তান যখন জাগ্রত হয়, শরীরের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তার জিহ্বার মাধ্যমে বলতে থাকে, আমাদের খাতিরে আল্লাহকে ভয় কর, কারণ আমাদের নিয়তি তোমার সঙ্গে বাঁধা। তুমি যদি সোজাভাবে চল, আমরাও চলব; আর তুমি যদি ধ্বংস হয়ে যাও, আমাদেরও একই পরিণতি হবে-জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৩১

এরপরও অন্য একটি হাদীস আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, আমাদের কথা ও ভাষা-ব্যবহারের পরিণতি কত বহুদূরগামী হতে পারে।

কোনো সময় কোনো একজন ব্যক্তির কথা সুমহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় হল, কিন্তু সে উপলব্ধি করতে পারে না যে, তার কথা কত দূরে গিয়ে পৌঁছবে। (না বুঝুক) তথাপিও এই কথা তার জন্য বিচার দিবস পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণ হবে। অপর দিকে কোনো ব্যক্তি কোনো সময় এমন কথা বলল, যা মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়, যদিও সে বোঝে না, তার কথা কত দূর গিয়ে পৌঁছবে। (না বুঝুক) তথাপিও তার কথা বিচার দিবস পর্যন্ত আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হয়েই বিরাজ করবে-মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৫২৯১

ইসলামপূর্ব আরবসমাজ ছিল খুবই বাকনিপুণ সমাজ। যদিও লিখতে পড়তে জানে এমন লোকের সংখ্যা ছিল নগণ্য; কিন্তু মানুষ তাদের গদ্য ও পদ্যের ভাষা ও শব্দ নিয়ে খুবই গর্ব অনুভব করত। কোনো ব্যক্তি শুধু তার শব্দ-ব্যবহারের দক্ষতার কারণেই সামাজিক সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করত। এবং শুধু শব্দ ও ভাষা ব্যবহারের শক্তি ও পারঙ্গমতার জন্যই একজন ব্যক্তি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করতে পারত, যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারত; এবং জীবনকে এমন দৃঢ়ভাবে বেঁধে ফেলতে পারত, যা বর্তমান সময়ে অনেকখানি বড় প্রেক্ষাপটে আধুনিক প্রচারমাধ্যম যেমন পারে। কিন্তু বর্তমানে যেমন তখনো সেই শক্তি ছিল নিতান্তই অপরিপক্ব স্থলশক্তি, যা অনেকটা বন্যজন্তুর বাহ্যিক শক্তির সঙ্গে তুলনীয়।

ইসলাম এই বন্যশক্তিকে পোষ মানিয়ে নিল। স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, আমাদের প্রতিটি কথাবার্তা ফেরেশতাদের দ্বারা রেকর্ড বা বাণীবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে এবং একদিন এই রেকর্ডকৃত কথাবার্তা নিয়ে জবাবদিহিতার জন্য অবশ্যই দণ্ডায়মান হতে হবে। অতএব আমাদের এ বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, কোনো মানুষের মহত্ত্ব বাকশক্তি ও ভাষা ব্যবহারের উপর নির্ভর করে না; এটা নির্ভর করে কোনো ব্যক্তি ভাষা ব্যবহারে কতটা সাবধান ও সতর্ক, তারই উপর এবং আমাদের এটাও মনে রাখা সমীচীন যে, খারাপ কিছু বলা অপেক্ষা নীরব থাকা উত্তম আর একেবারে নিশ্চুপ থাকার পরিবর্তে ভালো কিছু বলা উত্তম।

বস্তুতই, ইসলামের স্পর্শে যে নতুন এক সমাজবিপ্লবের উদ্ভব ঘটল, তা ছিল অভাবনীয়। এমন সব মানুষ তৈরী হল, যারা কথার কী মূল্য সেটা যথার্থভাবে বুঝতে শিখল এবং এই মূল্যবোধের কারণে তারা হয়ে উঠল যুগপৎ ধর্মপরায়ণ, নির্ভীক ও ক্ষমতাধর। তাদের নীরবতা হয়ে উঠল নীরবতার এক শান্ত নিঃশব্দ হৃদয়স্পর্শী প্রতিফলন। এবং তারা তখনই কথা বলত, যখন নীরবতার মূল্যমানকে বাড়িয়ে তোলা সম্ভব। এবং এজন্যই এর মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, নীরবতা ভঙ্গ করে তারা যখন কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই কোনো কথা বলতেন, সেই কথা হয়ে উঠত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার এক একটি মুক্তা-মাণিক্য।

বর্তমানে সর্বত্রই স্কুলে স্কুলে ভাষা শিক্ষা দেয়া হচ্ছে; অর্থাৎ পড়া-লেখা ও কথা-বলা শেখা ও শেখানোর কাজে বহু শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এখন নিয়োজিত। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কোথাও কি তাদের শিক্ষকের কাছ থেকে এই শিক্ষা অর্জন করছে যে, ভাষা ব্যবহারকে কীভাবে সভ্য ও মার্জিত করে তোলা যায়? তারা কি এটা শিখছে যে, ভাষা-শক্তিকে সত্যকে বিকশিত করা এবং নৈতিকগুণের প্রসারকল্পে কাজে লাগাতে ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন করা উচিত? তাদেরকে কি কখনো শেখানো হয় যে, মিথ্যা ও অকল্যাণকে শক্তিশালী করা নয়, বরং তাকে পরাভত করার কাজেই ভাষা তার শব্দ ও বাক্য নিয়ে সক্রিয় থাকবে? না, কোথাও এই আদর্শ মাথায় রেখে ভাষা শিক্ষা দেয়া হয় না। বরং এ বিষয়টি আমরা সততই ভুলে থাকি। কিন্তু আমরা যদি এই ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে চাই, তাহলে বিষয়টিকে যথোচিত গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করা দরকার। আর এটা তো খুবই একটি গর্হিত ও গুরুতর ভুল যে, একজন ঈমানদার ব্যক্তি মনে করবে, কথা বলা একটা সস্তা ধরনের কাজ, অতএব কোনো রকম প্রাসঙ্গিকতা ছাড়া ও পরিণতির কথা না ভেবে তাৎক্ষণিক সুবিধানুযায়ী তুমি যেমন ইচ্ছা কথা বলতে পার।

বর্তমান সময়ে প্রচলিত এই মনোভাব খুব স্বাভাবিকভাবেই যে কোনো ধরণের পাপ ও অপরাধের দিকে চালিত করে। এই মনোভাব থেকেই তৈরী হয় নিরর্থক প্রতিযোগিতা, আড্ডা ও অতিকথন, অসাধুতা, অসততা, ঔদ্ধত্য, অপরকে ছোট করা, পশ্চাতে নিন্দা করা, কুৎসা রটনা, নৈতিক অবনতি, মিথ্যা ইত্যাদি। অথচ এর যে কোনো একটিকেই কুরআন এবং হাদীস জঘন্য ও মারাত্মক পাপ বলে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই সকল পাপের চিকিৎসা কী? চিকিৎসা হল ইসলামসম্মতভাবে পর্যাপ্ত দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে কথাবার্তা বলার শিক্ষাগ্রহণ। উপরন্তু দায়িত্বজ্ঞানহীন যথেচ্ছ কথা বলার মধ্যে অন্য আরো এক ধরনের বিপদ ও সমস্যা বিদ্যমান। বস্তুত, পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে সকল সমস্যার উদ্ভব ঘটে তার অধিকাংশই হয় আমাদের নিজস্ব সৃষ্টি, নাহলে তা দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা ও দায়িত্বহীন কথার অপব্যবহারে যাকে বাড়িয়ে তোলা হয়।

সত্য বটে, আধুনিক তথ্য-যোগাযোগ ব্যবস্থার যে প্রযুক্তি, তা যেকোনো সংবাদকে মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু পৃথিবী যেহেতু এই অলৌকিক কৃতিত্বের কারণে অভিভূত, সংবাদ প্রচারে গতি এবং সংবাদের গুণাগুণ ও মূল্যমান নিয়ে একটি স্বাভাবিক বিভ্রমের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা আমাদের এই ক্ষমতা নিয়ে খুব গর্বিত যে, আলোর গতিতে নানা আবর্জনা আমরা এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারি। লক্ষণীয় যে, শুধু এক ইন্টারনেটই কীভাবে তার বাজে আবর্জনা দিয়ে পৃথিবীর ওপর প্রভুত্ব করছে। আমরা বিস্ময়ে রীতিমত হতবাক যে, মিথ্যাকথনকে বিভ্রান্তিকর অথচ আকর্ষণীয় কৌশল দ্বারা কতভাবেই না পরিবেশন করা হচ্ছে! আধুনিক প্রচারযন্ত্রের যে তথ্যপ্রবাহ, সেদিকে লক্ষ করলেই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কীভাবে আমাদের চিন্তা ও কর্মের ওপর তারা আধিপত্য বিস্তার করে বসেছে। আধুনিক মানবগোষ্ঠীর জন্য এ এক কঠিন দুর্ভাগ্য! আর এইজন্যে অসাধু তথ্যপ্রবাহের এই যুগ (Information Age) আজ নৈতিক দিকনির্দেশনা লাভের জন্য ইসলামের করুণাপ্রার্থী।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর

 

 

 

advertisement