রবিউল আখির ১৪২৯   ||   এপ্রিল ২০০৮

জীবিকা : গৃহের কাজেও নারী উন্নয়ন সহযোগী

ওয়ারিস রব্বানী

মার্চের ৯ তারিখে ঢাকার একটি দৈনিকের রিপোর্টের সূচনাতেই একটি গল্পের অবতারণা করা হয়েছে। গল্পটি হচ্ছে, ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ হতেই বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছে সিথিকে। আর বিয়ের পরপরই এসেছে সন্তান। তাই  স্বামী  সন্তান আর সংসার সামলে জবে ঢোকার সুযোগ হয়ে ওঠেনি তার। কিন্তু একদিন স্বামীর এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার পর সিথিকে ভাবি কি করেন প্রশ্ন করা হলে স্বামী চটজলদি উত্তর দেন ও কিছু করে না, ঘরেই থাকে। সিথি সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করে বলেন, ঘরের যাবতীয় কাজ এমনকি বাজার পর্যন্ত আমাকে করতে হয়। বাচ্চা দেখা, স্কুলে আনা-নেয়া, অসুস্থ শাশুড়ির সেবাযত্ন এসব তো আছেই। তারপরও আমি কিছু করি না?

 

এ গল্পেটির পরে যে কথাটি বলা হয়েছে সেটিই এ লেখার মূল প্রতিপাদ্য। বলা হয়েছে, সমাজে সিথিদের মতো অসংখ্য নারীকে প্রতিনিয়ত ও কিছু করে  না মন্তব্য হজম করতে হয়। অথচ  অর্থনীতিবিদদের বিবেচনায় বাংলাদেশের নারীদের গৃহস্থালি কাজের বার্ষিক মূল্য বছরে ৬৯ থেকে ৯১ বিলিয়ন ডলার। এক গবেষণায় বাংলাদেশে মোট নারীর সংখ্যা ৫৩.১ মিলিয়ন, দৈনিক কাজের সময় ১৬ ঘণ্টা ও ঘণ্টা প্রতি কাজের মূল্য ১০ টাকা ধরে এ উপাত্ত বের করা হয়েছে। রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, শিশুর যত্ন, রোগীর সেবা, ঘরের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব পালনসহ প্রতিনিয়ত নারীরা অনেক দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছেন। গৃহস্থালির এসব কাজকে অদৃশ্য শ্রম হিসেবে বিবেচনা করায় নারীদের এ ঘরোয়া অবদানকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। কিন্তু তাদের এসব মজুরিবিহীন কাজ পরিবার, সমাজ ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মুল্যায়ন শীর্ষক এক গবেষণায় এ ফলাফল বেরিয়ে এসেছে।

 

কর্মজীবী নারীর অবদান, পুরুষের পাশাপাশি কাজ করে দেশ গড়ায় নারীর কাজ এবং উৎপাদন ও উন্নয়নে নারীর ভূমিকা নামের বিষয়গুলোতে একচেটিয়াভাবে এতদিন যে কথাগুলো বলা হয়েছে  এ রিপোর্ট থেকে বুঝা গেছে, তার অনেক কিছুই ছিল একপেশে ও ফাঁপানো। নারীকে কেবল মাঠে-ঘাটে ও দপ্তরে নামিয়ে আনলেই নারী উৎপাদন ও উন্নয়নে শ্রম দিল আর ঘরে বসে ঘর সামলানোর গুরু দায়িত্ব পালন করলে সে বেকার বা ভূমিকাহীন জীবন পার করলো এটাকে একটি অমূলক ভাবনা হিসেবে সাব্যস্ত করার জন্য এ রিপোর্টটি যথার্থ ভূমিকা রেখেছে। কারণ রিপোর্টটিতে দেখা যাচ্ছে, গৃহস্থালি কাজে (নারীবাদী ও নারী অধিকারবাদীরা যেটাকে কোনো কাজ মনে করতেই চান না) নারীর ভূমিকার বার্ষিক অর্থমূল্য দাঁড়ায় ৬৯ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এ বিশাল অংকের অর্থমূল্যের কাজ তারা ঘরে-গৃহে আঞ্জাম দিয়ে উৎপাদনের অন্যান্য অংশ স্বামী, বাবা, ভাই-পুত্রদেরকে সক্রিয় রাখছেন। সহযোগিতা দিয়ে তাদের কাজের গতিকে অপ্রতিরোধ্য ও সমস্যামুক্ত রাখতে পারছেন। সফল এসব গৃহিনীর সহযোগিতা না পেলে সমাজের পুরুষরা তাদের চালিকাশক্তি ও প্রেরণা ঠিক রাখতে পারতেন না কিছুতেই। একই সঙ্গে পারিবারিক ব্যবস্থাপনাও সুরক্ষিত থাকতো না। পরিবারের নির্ভরশীল শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জীবন হতো বিশৃঙ্খলায় টালমাটাল। উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোতে সে বিশৃঙ্খলার কদাকার চেহারা আমাদের আতংকিত করে রেখেছে। একইভাবে পরিবার ব্যবস্থার মাধুর্য ব্যাপক উধাও হয়ে যেত। শিশুদেরকে হোম সার্ভিসে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ওল্ডহোমে নিক্ষেপ করতে হতো এবং পরিবারের সক্ষম সদস্যরা বিচ্ছিন্ন বন্ধনহীন এক ধরনের ব্যাকরণসিদ্ধ শুষ্ক জীবনের খাঁচায় বন্দী হয়ে যেত।

এদেশের নারীদের গৃহস্থালি কাজের অর্থমূল্য যেমন এ সত্যটি প্রকাশ করেছে যে, ঘরের জীবনে বাস করা নারীরা বেকার নন, তেমনি এতে এ সত্যও ফুটে ওঠেছে যে, নারীদের ঘরোয়া  জীবন যাপনে পরিবারের সুখ ও মাধুর্য, শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য ব্যাপকভাবে সুরক্ষিত হচ্ছে। ইসলাম নারীকে মাঠে-ময়দানে না নামিয়ে ঘরের  জীবনে অবস্থান করার যে উৎসাহ ও পরামর্শ প্রদান করেছে তার কল্যাণ ও শুভত্ব বোঝার জন্য এরকম গবেষণার হয়তো কোনই প্রয়োজন ছিল না। বিষয়টি মেনে নিলেই হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক এ গবেষণাটি আবার সংশয়বাদীদের চোখে আঙুল রেখে কিছু সত্য সুন্দর তাৎপর্য তুলে ধরেছে। যদিও এ বিষয়ক গবেষণাকারীদের উদ্দেশ্য এতটা ইতিবাচক ছিল না। 

 

 

advertisement