জুমাদাল উলা ১৪২৯   ||   মে ২০০৮

ফলপ্রসূ শাস্তি

সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে এক বার শাস্তিদান অন্যভাবে দশ বার শাস্তিদানের চেয়ে অধিক ফলপ্রসূ। বরং তা বারবার শাস্তিদান থেকে মুরববীকে রক্ষা করে। অতএব যখন সন্তানের সঙ্গে কঠিন হতে হয় এবং শাস্তি দিতে হয় তখন নিজের মমতাকে সংযত রাখা কর্তব্য। যাতে শাস্তির উদ্দেশ্য ব্যাহত না হয়ে যায়। -আবিদা

এক গ্রীষ্মে নানাজী একটি বড় বাড়ি ভাড়া নিলেন। বাড়িটি ছিল জর্দানের বাগানঘেরা এক শ্যামল পরিবেশে। নিজ শহর দামেস্ক যাওয়া সে সময় তাঁর জন্য নিষিদ্ধ ছিল। বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য এই সুন্দর বাগানবাড়িটি তিনি ভাড়া নিয়েছিলেন। আমরা সেখানে বেশ কিছুদিন অত্যন্ত আনন্দের মধ্যে কাটিয়েছি।  তবে একটি অসুবিধা  এই ছিল যে, বাড়িটিতে বিদ্যুৎ ছিল না। অতএব বিদ্যুৎচালিত কোনো কিছু, যেমন ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি ব্যবহার করারও সুযোগ ছিল না। এদিকে আমরা ছোটরা সারাদিন বাগানে খেলা করতাম। আঙ্গুরঝাড় ও সবুজ গাছের নিচে অতি আনন্দের মধ্যে আমাদের দিন কেটে যেত। সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফিরতাম তখন কাপড়-চোপড় ধুলাবালিতে, আঙ্গুর ও বিভিন্ন ফলের রসে একদম ময়লা হয়ে যেত। আমরা ঘরে ফিরে গোসল করতাম এবং ঘুমিয়ে যেতাম। আর আমাদের মায়েরা বালতিভর্তি ময়লা কাপড় রাত জেগে পরিষ্কার করতেন।

সকাল বেলা আমরা পেয়ে যেতাম পরিষ্কার শুকনো কাপড়। বাইরে যাওয়ার আগে মায়েরা বলে দিতেন, সাবধানে খেলা করবে। প্রতিদিন যেন কাপড় ধুতে না হয়। কিন্তু বাগানে যেয়ে খেলায় এমনই মগ্ন হয়ে পড়তাম যে, মায়েদের কথা বেমালুম ভুলে যেতাম। এরপর সন্ধ্যা বেলায় ঘরে ফিরতাম যথারীতি ময়লা কাপড় নিয়ে। তো আমাদের মায়েরা এখন কী করবেন?

 

বারবার মনে করিয়ে দিবেন। রাগান্বিত হয়ে ধমক দিবেন। প্রহার করবেন। ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিবেন। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই ফলপ্রসূ হয় না। শিশুরা খুব সহজেই এগুলো ভুলে যায়।

বিষয়টা যখন নানাজীর কানে গেল তখন তিনি কী করলেন?

তিনি এর সমাধান বের করলেন তার নিজস্ব ভঙ্গিতে। একবার, মাত্র একবার তিনি পদ্ধতিটি প্রয়োগ করলেন। তবে দৃঢ়তার সঙ্গে, কিছুটা যেন কাঠিন্যও ছিল তাতে। কিন্তু এতে এমনই কাজ হল যে, এরপর থেকে আমরা একদম সচেতন হয়ে উঠলাম। খেলার আনন্দে বিভোর হয়ে মায়েদের কষ্ট ভুলে যাওয়ার  যে প্রবণতা আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল তা একেবারেই দূর হয়ে গেল। ঘটনাটি বলি,

এক সন্ধ্যায় আমরা খেলাধুলা করে যথারীতি ঘরে ফিরেছি। ক্লান্ত, শ্রান্ত, দুচোখ ঘুমে ভারাক্রান্ত। এমন সময় নানাজী এসে বললেন, প্রত্যেকে নিজ নিজ কাপড় ধুয়ে ঘুমোতে যাবে। আমরা সচকিত হয়ে উঠলাম এবং আতঙ্কিত হয়ে আবেদন জানালাম যে, আজকের মতো আমাদের ক্ষমা করুন। আমাদের প্রচন্ড ঘুম পেয়েছে। কিন্তু না! নানাজীর কথায় নড়চড় নেই...! আমরা তখন বাধ্য হয়ে কাপড় ধুতে বসলাম যেভাবে প্রতি রাতে আমাদের মায়েরা বসতেন।

সে সন্ধ্যা বড়  কষ্টের সন্ধ্যা ছিল। দুচোখ ঘুমে ফেটে যাচ্ছিল। অনেকবার আমাদের মায়েরাও এসে সুপারিশ করেছেন, যেন এবারের মতো আমাদের নিষ্কৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু নানাজী তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। শেষে অনেক কষ্টে, অনেক দুঃখে কাপড় ধোয়া সমাপ্ত হল।

সেই এক সন্ধ্যার শাস্তি। এরপর সারা গ্রীষ্ম সচেতন হয়ে কাটিয়েছি। সে সন্ধ্যায় আমরা হারে হারে টের পেয়েছি, প্রতিদিন রাতে কাপড় কাঁচতে আমাদের মায়েদের কেমন কষ্ট হত।

হয়তো সে সন্ধ্যায় নানাজীকে একজন রুক্ষ কঠিন মানুষ হিসেবে দেখা গিয়েছিল, কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরাও কি এই রুক্ষতাটুকু ছাড়া আমাদের অবস্থা পরিবর্তন করতাম?

 

 

advertisement