জুমাদাল উলা ১৪২৯   ||   মে ২০০৮

৭ম ভবিষ্যদ্বাণী : পারাক্লিত সম্পর্কে ঈসা আ.-এর ভাষা

মাওলানা আব্দুল মতিন

হযরত ঈসা আ. এই দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণের পূর্বমুহূর্তে লাস্ট সাফারের (ঈদুল ফেসাখ) শেষ পর্যায়ে শিষ্যদের উদ্দেশ্যে একটি মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন। যোহন/ইউহোন্না লিখিত ইঞ্জিলের চার অধ্যায়ব্যাপী (১৪-১৭) এই ভাষণের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। এ ভাষণে মূলত তিনি তাঁর বিদায় গ্রহণের পর মানব জাতিকে কোন পথ-নির্দেশকের অনুসরণ করতে হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন- তোমরা যদি আমাকে মহববত কর তবে আমার সমস্ত হুকুম পালন করবে। আমি পিতার নিকট চাইব, আর তিনি তোমাদের নিকট চিরকাল থাকবার জন্য আর একজন সাহায্যকারীকে পাঠিয়ে দেবেন। সেই সাহায্যকারীই সত্যের রূহ। দুনিয়া তাঁকে গ্রহণ করতে পারে না। কারণ, দুনিয়া তাঁকে দেখতে পায় না এবং তাঁকে জানেও না। তোমরা কিন্তু তাঁকে জান, কারণ তিনি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকেন, আর তিনি  তোমাদের  অন্তরে বাস করবেন। (যোহন, ১৪ : ১৫-১৭)

যে কথা তোমরা শুনছ তা আমার কথা নয়, কিন্তু যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন সেই পিতারই কথা। তোমাদের সঙ্গে থাকতে থাকতেই এ সমস্ত কথা আমি তোমাদের বলেছি। সেই সাহায্যকারী অর্থাৎ পাক রূহ, যাঁকে পিতা আমার নামে পাঠিয়ে দেবেন তিনিই সমস্ত বিষয় তোমাদের শিক্ষা দেবেন, আর আমি তোমাদের যা কিছু বলেছি, সেই সমস্ত তোমাদের মনে করিয়ে দেবেন। (১৪ : ২৪-২৬)

আমি তোমাদের সঙ্গে আর বেশীক্ষণ কথা বলব না। কারণ দুনিয়ার কর্তা আসছেন। আর আমার উপর তার কোন অধিকার নেই। (১৪ : ৩০)

যে সাহায্যকারীকে আমি পিতার নিকট থেকে তোমাদের নিকটে পাঠিয়ে দেব, তিনি যখন আসবেন, তখন তিনিই আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দেবেন। ইনি সত্যের রূহ, যিনি পিতা থেকে বের হন। আর তোমরাও আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দেবে, কারণ প্রথম থেকে তোমরা আমার সঙ্গে সঙ্গে আছ। (১৫ : ২৬, ২৭)

তবুও আমি তোমাদের সত্য কথা বলছি যে, আমার যাওয়া তোমাদের পক্ষে ভাল। কারণ আমি না গেলে সেই সাহায্যকারী তোমাদের নিকট আসবেন না। কিন্তু আমি যদি যাই তবে তাঁকে তোমাদের নিকট পাঠিয়ে দেব। তিনি এসে দুনিয়াকে পাপের সম্বন্ধে, নির্দোষিতার সম্বন্ধে এবং খোদার বিচারের সম্বন্ধে চেতনা দেবেন। (১৬ : ৭, ৮)

কিন্তু সেই সত্যের রূহ যখন আসবেন তখন তিনি তোমাদের পথ দেখিয়ে পূর্ণ সত্যে নিয়ে যাবেন; তিনি নিজ থেকে কথা বলবেন না। কিন্তু যা কিছু শোনেন তাই বলবেন। আর যা কিছু ঘটবে তাও তিনি তোমাদের জানাবেন। (১৬ : ১৩, ১৪)

এ দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে শিষ্যদের প্রতি ঈসা আ.-এর গভীর মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে। তাঁর প্রস্থানের পর একজন মহা পথপ্রদর্শক এ দুনিয়ায় আবির্ভূত হবেন- এই পূর্বাভাস দিয়ে তিনি যেন তাঁর বিয়োগের সংবাদে ব্যথিত শিষ্যদের মনকে প্রবোধ দিতে চেয়েছেন। বস্ত্তত দুটি মহান দায়িত্ব নিয়েই হযরত ঈসার এ দুনিয়ায় আগমন ঘটেছিল। এক. তাওরাতের হেদায়াত ও শিক্ষাকে বনী ইসরাঈল বা ইহুদীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। দুই. তাঁর পরবর্তী নবীর আগমনের সুসংবাদ প্রচার করা। এই দ্বিতীয় দায়িত্বটি এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, এ কারণে তাঁর ধর্মগ্রন্থের নাম ইঞ্জিল অর্থাৎ সুখবর রাখা হয়েছিল।

ঊষা যেমন দিনমণির সুসংবাদ নিয়ে মানুষের দ্বারে উপস্থিত হয় তেমনি তিনিও নবুওয়তের উজ্জ্বল সূর্যের আগমনবার্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ইহুদীদের উপর্যুপরি ষড়যন্ত্রের কারণে সময় কম পেলেও তিনি উপরোক্ত দুটি দায়িত্বই যথাসাধ্য আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। এ ভাষণটি দ্বিতীয় দায়িত্ব পালনেরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

হযরত ঈসা আ. নবী ছিলেন। তবে শেষ নবী ছিলেন না। তাই তাঁর পরবর্তী নবীর সুসংবাদ দিয়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ৩২৫ খৃস্টাব্দে নীকিয়া কাউন্সিলে ব্যাপকভাবে সেন্ট পলের অনুসারী খৃস্টানদের মধ্যে উলুহিয়্যাতে মসীহ (ঈসাই খোদা)-এর বিশ্বাস অনেক কিছুকে ওলট পালট করে দিয়েছে। ঈসা আ.-এর পর কোন নবীর আবির্ভাব ঘটবে এবং তাঁকে অনুসরণও করতে হবে একথাটা খৃস্টানরা মানতেও রাজি ছিল না।

ফলে এ ভবিষ্যদ্বাণীটি যাতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে না খাটে সেজন্য অনুবাদে হেরফের, সংযোজন-বিয়োজনসহ এর উদ্ভট ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর যথেষ্ট চেষ্টা তারা চালিয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও এটি মহানবী সা.-এর ক্ষেত্রে এখনও সুস্পষ্ট।

মূল আলোচনা শুরু করার পূর্বে পাঁচটি বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

এক. ঈসা আ.-এর ভাষা ছিল সুরিয়ানী (Syriac) খৃস্টজন্মের দুই আড়াই শত বছর পূর্বে সেলিউসাইড শাসনামলেই ফিলিস্তিনে হিব্রু ভাষার পরিবর্তে সুরিয়ানী ভাষার প্রচলন শুরু হয়। সাধারণ জনগণ ঐ ভাষায়ই কথা বলতেন। ৭০ খৃস্টাব্দে জেরুজালেম দখলের পর রোমীয় সেনাপতি টিটাস (Titus) যে ভাষণ সেখানে দিয়েছিলেন গ্রীক ভাষায়, সুরিয়ানী ভাষায় সেটা তরজমা করতে হয়েছিল। সুতরাং ঈসা আ. তাঁর শিষ্যদের যা বলার সেটা যে ঐ সুরিয়ানী ভাষায়ই বলেছিলেন সে কথা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।

দুই. এ কথা স্বীকৃত যে, যোহনের ইঞ্জিল রচিত হয়েছিল গ্রীক ভাষায়। কিন্তু সেই মূল গ্রীক কপিটিও আর এখন বর্তমানে নেই। এর যেসব প্রাচীন পান্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া গেছে তার কোনটিই ৪র্থ শতাব্দীর পূর্বের নয়। আর এটাও স্বীকৃত যে, খৃস্টানরা নিজেদের ইঞ্জিলে ইচ্ছামতো সংযোজন-বিয়োজন ও পরিবর্তন করাকে বৈধ ও সংগত মনে করত। (দ্র. ইনসাইক্লোপেডিয়া বৃটানিকা, বাইবেল শীর্ষক প্রবন্ধ)

তিন. বাইবেলের গ্রন্থকার-অনুবাদকগণ নামগুলোরও অনুবাদ করে দেন। নতুন নিয়ম (New Testament) কে বাংলায় সুখবর, আরবীতে ইঞ্জিল ও ইংরেজীতে গসপেল বলা এর বড় প্রমাণ। কুরআনকে কিন্তু সকল ভাষায় কুরআনই বলা হয়।

চার. ভবিষ্যদ্বাণীটি যার সম্পর্কে করা হয়েছে গ্রীক বাইবেলে তাকে পারাক্লীতস শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলা অনুবাদে সহায়সাহায্যকারী লেখা হয়েছে। তবে বাংলা বাইবেলে ফুটনোটে লেখা হয়েছে- ক. পক্ষ সমর্থনকারী, উকিল। (গ্রীক পারাক্লীতস। উর্দূ অনুবাদে লেখা হয়েছে-

شفیع ۔ وکیل ۔ مددگار۔

১৮২১, ৩১ ও ৪৪ খৃস্টাব্দে লন্ডন থেকে প্রকাশিত আরবী বাইবেলে বারাক্লীত বা ফারাকলীত

(الفارقليط أو البارقليط)

লেখা হয়েছে। খৃস্টান লেখক ইউসুফ ইলয়াস আলমারূনী তৎপ্রণীত তুহফাতুল জীল ফী তাফসীরিল আনাজীল গ্রন্থে- যা ১৮৭৭ সালে বৈরূত থেকে প্রকাশিত- বারাক্লীত শব্দই উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এর অর্থ হল-

الشفيع :(সুপারিশকারী)

الوسيط :(মধ্যস্থতাকারী)

المحرض :(উদ্বুদ্ধকারী)

المحرك :(চেতনাদানকারী) ও

المعزى :(সান্ত্বনা দানকারী)।

১৮৭৬ সালে মোসেল থেকে প্রকাশিত আরবী বাইবেলেও ঐ ফারাকলীত শব্দটিই লেখা হয়েছে। সর্বপ্রথম ১৮২৫, ১৮২৬ সালে এবং আরো পরে ১৮৬৫ ও ১৮৯৭ সালে বৈরূত থেকে প্রকাশিত আরবী সংস্করণ ফারাকলীত-এর পরিবর্তে (আল-মুআযযী) শব্দটি উল্লেখ করা হয়। (দ্র. ইজহারুল হক, ৪ খ. ১১৮৬)

প্রাচীন ইংরেজী অনুবাদে এই স্থানে (১৪ : ১৫) পারাক্লীত অর্থ লেখা হয়েছে Comforter (সান্ত্বনাদানকারী), কিন্তু যোহনের ১ম পত্রে উল্লেখিত পারাক্লীত অর্থ লেখা হয়েছে এডভোকেট। আল্লাহ জানেন কেন এ পার্থক্য। অগাস্টাইন ও তরতোলিয়ান এডভোকেট অর্থকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। অরাইজিন (Origen) কোথাও এর অর্থ করেছেন Corsolator, কোথাও Deprecater। কিন্তু অন্যান্য ভাষ্যকাররা এই অর্থ প্রত্যাখ্যান করেছেন। কেউ কেউ এর অর্থ লিখেছেন Teacher, Apsistant, । এ ট্রাইকট তাঁর লিটন ডিকশনারি অব দি নিউ টেস্টামেন্টে এর দুটি অর্থ উল্লেখ করেছেন। ১. Intercessor (মধ্যস্থ, পক্ষসমর্থক), ২. Defender (রক্ষাকর্তা)। পরিশেষে নিউ ওয়ার্ল্ড ট্রানস্লেশন (ইং, বাইবেল) এ এর অর্থ লেখা হয়েছে Helper

পাঁচ. পারাক্লীত শব্দ ছাড়াও গ্রিক ভাষায আরেকটি শব্দ আছে যা- পেরাক্লীত। এই দুই শব্দের উচ্চারণ ও লেখ্যরুপ কাছাকাছি। পেরাক্লীত অর্থ হচ্ছে প্রশংসিত। এদিকে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গুণবাচক নাম-উপাধী অনেক হলেও তাঁর প্রকৃত নাম দুটি-মুহাম্মদ ও আহমাদ। উভয় নামেরই অর্থ প্রশংসিত

হযরত ঈসা আ. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমন  সংবাদ দান করেছেন আহমাদ নামে। কুরআন হাকীমে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে এসেছে। দেখুন সূরা সফ : ৬ । কিন্তু ইঞ্জিলের লেখক ও অনুবাদকগণ যেহেতু নামেরও অনুবাদে অভ্যস্ত তাই তারা আহমাদ নামেরও অনুবাদ করেছেন। সুরিয়ানী ভাষায় এ নামের তরজমা-মুনহামান্না আর গ্রীক ভাষায় পেরাক্লীত

ঈসা আ.-এর সুসংবাদের সুরিয়ানী তরজমা ইতিহাসে সংরক্ষিত আছে। ওখানে মুনহামান্না শব্দটিই রয়েছে। কিন্তু বর্তমান সংস্করণগুলোতে পেরাক্লীত স্থলে পরাক্লীত লিখিত আছে। বিভিন্ন আলামত থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এ পরিবর্তনটা পরবর্তী লোকদের কীর্তি। এর পিছনে যে প্রেরণা কার্যকর ছিল তা-ও স্পষ্ট। ঈসা আ.-এর সুসংবাদ মর্মগত দিক থেকে জটিল করে তোলা এবং কার সম্পর্কে সুসংবাদ তা অস্পষ্ট করে তোলা ছিল এ পরিবর্তনের উদ্দেশ্য। তবে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা, তারা তাদের উদ্দেশ্যে সফল হতে পারেনি।

ঈসা আ-এর সুসংবাদের তরজমা পারাক্লীতরে নিলেও এর দ্বারা খাতামুন্নাবীয়ীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেই নির্দেশ করে অন্য কাউকে নির্দেশ করে না।

মূল আলোচনা

এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। মুসলিম মনীষীগণ বলেছেন, এ ভবিষ্যদ্বাণীতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই বোঝানো হয়েছে। কুরআন কারীমেও ইরশাদ হয়েছে-

وَ اِذْ قَالَ عِیْسَی ابْنُ مَرْیَمَ یٰبَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ اِنِّیْ رَسُوْلُ اللّٰهِ اِلَیْكُمْ مُّصَدِّقًا لِّمَا بَیْنَ یَدَیَّ مِنَ التَّوْرٰىةِ وَ مُبَشِّرًۢا بِرَسُوْلٍ یَّاْتِیْ مِنْۢ بَعْدِی اسْمُهٗۤ اَحْمَدُ ؕ

অর্থাৎ যখন ঈসা ইবনে মারয়াম বললেন, হে বনী ইসরাঈল, নিঃসন্দেহে আমি আল্লাহর পক্ষ হতে কেবল তোমাদের প্রতি (রাসূলরূপে) প্রেরিত। আমি আমার পূর্বেকার তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং আমার পরের এক মহান রাসূলের সুসংবাদ দানকারী, যার নাম আহমদ। (সূরা সাফ, ৬)

কিন্তু খৃস্টান পন্ডিতদের অনেকেরই দাবি যে, গ্রীক পেরিক্লীত (Pereclytus) শব্দটি মুহাম্মদআহমদএর সমার্থ বোধক। কিন্তু সেটা এখানে উল্লেখ করা হয়নি। এখানে উল্লেখ করা হয়েছে পারাক্লীতস। এর অর্থ ভিন্ন। তারা এ-ও দাবি করেছেন যে, এখানে যে পারাক্লীতসের আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে সেটা দ্বারা উদ্দেশ্য হল সেই পবিত্র আত্মা যা আগুনের জিহবার আকারে হযরত ঈসার শিষ্যদের উপর নেমে এসেছিল, যখন তাঁরা পেন্টিকোস্ট (Pentecost) উৎসব উপলক্ষে একটি ঘরে সমবেত হয়েছিলেন। (দ্র. প্রেরিত, ২ : ১-৪)

এ ব্যাপারে মুসলিম মনীষীদের বক্তব্য হল- পারাক্লীতস শব্দটি ঈসা আ.-এর মূল শব্দ নয়, তার অনুবাদ মাত্র। আবার পেরিক্লীতস ও পারাক্লীতস শব্দ দুটি বানান ও উচ্চারণের দিক থেকে খুব কাছাকাছি। যেসব খৃস্টান নিজেদের ধর্মগ্রন্থে ইচ্ছামতো রদবদল করতে দ্বিধা সংকোচ করত না, অসম্ভবের কি আছে তারা পেরিক্লীতস শব্দটিকে নিজেদের মনগড়া ধর্মবিশ্বাসের পরিপন্থী মনে করে বানানে সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে পারাক্লীতস বানিয়ে ফেলেছে। আবার সেকালে যেহেতু স্বরচিহ্ন ব্যবহারের নিয়ম ছিল না তাই এও অসম্ভব নয় যে, কেউ হয়তো পাঠভ্রম বশত পেরিক্লীতসকে পারাক্লীতস পড়ে সেভাবেই তার কপিতে লিখে গেছে। আর পরবর্তী লোকেরা তারই অনুসরণ করে পারাক্লীতস লেখা অব্যাহত রেখেছে। যেহেতু প্রাথমিক কালের কোন গ্রীক ইঞ্জিল পৃথিবীর কোথাও নেই তাই মূল গ্রন্থে শব্দটি আসলে কি ছিল তা তুলনা করে দেখারও আর উপায় নেই।

মুসলিম মনীষীগণের এ বক্তব্যের পেছনে একটি জোরালো যুক্তি-প্রমাণ রয়েছে। আর তা হল ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকও (মৃত্যু- ৭৭৪ খৃ.) যোহনের ইঞ্জিলের উদ্ধৃতি দিয়ে এ ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখ করেছেন। যেখানে পারাক্লীতস এর স্থানে ঈসা আ.-এর মূল সুরিয়ানী শব্দ আলমুনহামান্না উল্লেখ করা হয়েছে। শেষে ইবনে ইসহাক বলেছেন-মুনহামান্না সুরিয়ানী শব্দ। এর অর্থ হল মুহাম্মাদ। (দ্র. ইবনে হিশাম, আস-সীরা ১ম খ. ২৩৩)

উল্লেখ্য যে, মুসলমানদের ফিলিস্তিন বিজয়ের তিনশত বছর পর পর্যন্ত ঐ অঞ্চলের খৃস্টান অধিবাসীদের ভাষা সুরিয়ানীই ছিল। খৃস্টীয় নবম শতাব্দীর দিকে আরবী ভাষা এর স্থান দখল করে। তাই ইবনে ইসহাকের মতো অনুসন্ধানী মুসলিম ঐতিহাসিকের পক্ষে মূল সুরিয়ানী শব্দটি লাভ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর যদি ধরেই নেওয়া যায় যে, মূলে পারাক্লীত শব্দটিই বিদ্যমান ছিল তথাপি বক্তব্যের পূর্বাপর এ কথার বহু প্রমাণ বহন করে যে, ঐ পারাক্লীত দ্বারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই উদ্দেশ্য, শিষ্যদের ওপর নাযিল হওয়া পাক রূহ নয়। প্রমাণগুলো নিম্নরূপ : 

এক. এ পারাক্লীত শব্দটি বাইবেল এর নতুন নিয়ম বা ইঞ্জিলে সর্বমোট পাঁচ জায়গায় ব্যবহৃত হয়। তন্মধ্যে এ ভাষণটিতে চার জায়গায় চার বার। আর পঞ্চম জায়গাটি হল যোহন লিখিত ১ম পত্র। (দ্র. ২ : ১)

এই পঞ্চম জায়গায় যোহন পারাক্লীত শব্দের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে ঈসা আ.কেই বুঝিয়েছেন। বাংলা বাইবেলে বাক্যটি এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে- পিতার কাছে আমাদের এক সহায় আছেন, তিনি ধার্মিক যীশুখৃস্ট। সহায় শব্দটির পরে তারকা চিহ্ন দিয়ে ফুটনোটে লেখা হয়েছে- বা পক্ষ সমর্থনকারী, অর্থাৎ উকিল, (গ্রীক) পারাক্লীত।

এই পারাক্লীত বা এক সহায় দ্বারা যদি রক্তে-মাংসে গড়া আল্লাহর নবী ঈসা আ. উদ্দেশ্য হতে পারেন তবে ভবিষ্যদ্বাণীতে উল্লেখিত পারাক্লীত বা আর এক সহায় দ্বারা কেন মহানবী সা. উদ্দেশ্য হতে পারেন না?

দুই. ভবিষ্যদ্বাণীটির সূচনাতেই বলা হয়েছে- তোমরা যদি আমাকে মহববত কর তবে আমার সকল হুকুম পালন করবে।

একথার উদ্দেশ্য হল সামনে পারাক্লীত সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে সেটা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা, হৃদয়ে গেঁথে রাখা এবং এর অপরিসীম গুরুত্ব উপলব্ধি করা। আরবী বাইবেল থেকে একথাটি আরো স্পষ্ট হয়। সেখানে বলা হয়েছে-

إن كنتم تحبونني فاحفظوا وصاياي

 

অর্থাৎ আমাকে মহববত করলে আমার ওসিয়ত ও নির্দেশ মেনে চল। পারাক্লীত দ্বারা পাকরূহ উদ্দেশ্য হলে একথাটি বলার কোন মানে হয় না। কারণ, ঈসা আ.-এর জীবদ্দশাতেই যে পাকরূহ শিষ্যদের উপর নাযিল হয়েছিল সেটার পুনরাগমনকে অসম্ভব মনে করার কোন সুযোগই নেই। তাছাড়া পাকরূহ কারো ওপর নাযিল হলে তার প্রভাব আপনাতেই প্রকাশ পাবে। এমতাবস্থায় প্রভাবান্বিত ব্যক্তির পক্ষে তা অস্বীকার করার কল্পনাও করা যায় না।

কিন্তু পারাক্লীত দ্বারা যদি নবী উদ্দেশ্য হয় তবে একথাটি বলার পেছনে স্পষ্ট যুক্তি পাওয়া যায়। সে যুক্তি হল- ঈসা আ. স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকে এবং নবুওতী দৃষ্টির মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন যে, যে নবী সম্পর্কে আগাম সংবাদ দেয়া হচ্ছে তাঁর আবির্ভাবকালে তাঁর (ঈসার) উম্মতের অধিকাংশ লোক অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবে। একারণেই তিনি প্রথমত বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং পরে আগমনবার্তা ঘোষণা করেন।

তিন. বলা হয়েছে- তিনি (আল্লাহ) তোমাদের নিকটে চিরকাল থাকবার জন্য আর একজন সাহায্যকারী পাঠিয়ে দেবেন।

একথাটি একজন নবী সম্পর্কেই সুন্দর খাটে। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত নবীর উপস্থাপিত শিক্ষা ও আদর্শ হবে সর্বজনীন, বিশ্বব্যাপী ও কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী। পাকরূহ সম্পর্কে একথা মোটেও খাটে না। কারণ একে তো খৃস্টানদের বিশ্বাসমতে পাকরূহ ঈসা আ.-এর খোদায়ী সত্ত্বার সঙ্গে একীভূত। তাই তার ক্ষেত্রে আর একজন কথাটি খাটে না। তা ছাড়া পাকরূহ তাদের মতে খোদার তিন সত্তার এক সত্তা অর্থাৎ খোদা। কাজেই তার ক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিবেন কথাটিও খাটে না। কারণ খোদাকে পাঠানো যায় না।

চার. তিনি বলেছেন- তিনিই সমস্ত বিষয় তোমাদের শিক্ষা দেবেন। আর আমি তোমাদের যা কিছু বলেছি সেই সমস্ত তোমাদের মনে করিয়ে দেবেন।

এ কথাটিও পাকরূহের বেলায় খাটে না। কারণ খৃস্টানদের মতে ঈসা আ.-এর উপর স্বর্গারোহনের পঞ্চাশ দিন পরই পাকরূহ তাঁর শিষ্যবর্গের উপর নেমে আসে। নতুন নিয়মের কোন পুস্তক থেকেই একথা প্রমাণিত হয় না যে, ঈসা আ. যা যা বলে গিয়েছিলেন এই পঞ্চাশ দিনে তাঁর শিষ্যরা তা ভুলে গিয়েছিলেন এবং পাকরূহের সেগুলো স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল।

পক্ষান্তরে মহানবী সা.-এর ক্ষেত্রে কথাটি খুবই প্রযোজ্য। কারণ তিনি গোটা বিশ্বের খৃস্টান সম্প্রদায়কে সেসব জানিয়ে দিয়েছিলেন। কুরআন মাজীদে ঈসা আ.-এর অনেক উক্তি তুলে ধরা হয়েছে যা বর্তমান ইঞ্জিলেও বিদ্ধৃত হয়নি।

পাঁচ. তিনি বলেছেন- আমি আর বেশীক্ষণ কথা বলব না। কারণ দুনিয়ার কর্তা আসছেন।

উল্লেখ্য, বাংলা ইঞ্জিল শরীফে এখানে দুনিয়ার কর্তা বলা হয়েছে, বাংলা বাইবেলে- জগতের অধিপতি আসিতেছেন বলা হয়েছে। উর্দূ অনুবাদে দুনিয়ার সর্দার (সরওয়ারে আলম), প্রাচীন ইংরেজী অনুবাদে The prince of this world এবং নিউ ওয়ার্ল্ড ট্রানশ্লেষনে The ruler of the world বলা হয়েছে।

একথাটিও কোনভাবেই পাকরূহের ব্যাপারে খাটে না। কারণ, ক. ঈসা আ. নিজেই পাকরূহে পূর্ণ ছিলেন। তেমনি তাঁর শিষ্যবর্গও। তাই তাঁর বলা ও পাকরূহের বলা একই কথা। এক্ষেত্রে দুনিয়ার কর্তা আসিতেছেন বিধায় আমি বেশীক্ষণ বলব না কথাটা খাটে না।

খ. পাকরূহ যেহেতু তাদের ধারণায় ঈসা আ.-এর সঙ্গে সর্বদা উপস্থিত, তাই আসিতেছেন এরও কোন অর্থ হয় না।

গ. খৃস্টানদের বিশ্বাসমতে ঈসা আ. স্বয়ং খোদা ছিলেন। যদি তাই হয় তবে দুনিয়ার কর্তা আসার কারণে খোদার কথা বন্ধ হবে কেন? মহানবী সম্পর্কে কিন্তু কথাটা পুরোপুরি খাটে। কারণ তিনি ছিলেন সকল নবীর সর্দার।

ছয়. তিনি বলেছেন- তিনিই আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দেবেন।

এ কথাটাও পাকরূহের ক্ষেত্রে খাটে না। কারণ, পাকরূহ কারো সামনেই ঈসা আ.-এর বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়নি। তাঁর যেসব শিষ্যের উপর পাকরূহ নাযিল হয়েছিল তারা তো তাঁকে (ঈসাকে) যথাযথভাবে জানতেন, চিনতেন। তাই তাদের জন্য কারো সাক্ষ্যের প্রয়োজন ছিল না। সুতরাং তাদের সামনে সাক্ষ্য দেওয়া না দেওয়া সমান। হাঁ, যারা ঈসাকে অস্বীকার করেছে তাদের জন্য বাস্তবেই এ সাক্ষ্য প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পাকরূহ তাদের কারো সামনেই সেই সাক্ষ্য দেয়নি।

পক্ষান্তরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈসা আ.-এর বিষয়ে, তার সত্যবাদী হওয়ার বিষয়ে, এমনকি তাঁর খোদা হওয়ার দাবি করা থেকে পবিত্র থাকার বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। কুরআনের একাধিক স্থানে মা ও ছেলের পূত-পবিত্র হওয়ার কথা উল্লেখিত হয়েছে। অসংখ্য হাদীসেও তা বর্ণিত হয়েছে।

হাফিজ ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন-

 

ومعلوم أن هذه الشهادة لا تكون إلا إذ شهد له شهادة سمعها الناس ولا تكون ولا تكون هذه الشهادة في قلب طائفة قليلة، ولم يشهد أحد للمسيح شهادة عامة الناس أهل الأرض وعلموا أنه صدق المسيح ونزهه عما افترته عليه اليهود وما غلت فيه النصارى. (هداية الحياري صـ127)

অর্থাৎ জানা কথা যে, এই সাক্ষ্য কেবল তখুনি সাক্ষ্যরূপে বিবেচিত হবে যখন সকল মানুষ তা শুনতে পাবে। শুধু গুটি কয়েক মানুষের হৃদয়ে থাকলে চলবে না। এভাবে ঈসা আ.-এর ব্যাপারে শুধু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই সাক্ষ্য দিয়েছেন। জগৎবাসী তা শুনেছে। তারা জানতে পেরেছে যে, তিনি ঈসাকে সত্যবাদী বলেছেন, সমর্থন করেছেন, ইহুদীদের অপবাদ এবং খৃস্টানদের বাড়াবাড়ি থেকে তাঁকে মুক্ত ঘোষণা করেছেন।

সাত. তিনি বলেছেন, আর তোমরাও আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দেবে।

একথা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, পারাক্লীত ও শিষ্যদের সাক্ষ্য হবে ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু যদি পারাক্লীত দ্বারা সেই পাক রূহ উদ্দেশ্য হয় যা ঈদুল খেমীশশীমের দিনে শিষ্যদের উপর নাযিল হয়েছিল তাহলে এই সাক্ষ্য আর ভিন্ন ভিন্ন থাকে না। কারণ পাকরূহ আগুনের জিহবার আকারে তাঁদের উপর এসে বসেছিল এবং তাঁরা সেই রূহের দেওয়া শক্তি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলেছিলেন। এমতাবস্থায় তাদের সাক্ষ্যই হয়ে যাচ্ছে হুবহু পারাক্লীতের সাক্ষ্য। পক্ষান্তরে যদি পারাক্লীত দ্বারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্দেশ্য হন তাহলে এ সাক্ষ্য ভিন্ন ভিন্নই হতে পারছে।

আট. তিনি বলেছেন- আমার যাওয়া তোমাদের পক্ষে ভাল। কারণ আমি না গেলে সেই সাহায্যকারী তোমাদের নিকট আসবেন না।

একথাটি তো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর ক্ষেত্রে খুবই স্পষ্ট। কারণ, ক. আমার যাওয়া তোমাদের পক্ষে ভাল কথাটা প্রমাণ করে যে, আগমনকারী ঈসার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হবেন আর এটা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বেলায়ই খাটে। পাকরূহের ব্যাপারে খাটে না, কেননা খৃস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী পাকরূহ পুত্র সত্ত্বা (অর্থাৎ ঈসার) থেকে নির্গত এবং মর্যাদায়ও তাঁর চেয়ে নিচ।

খ. আমি না গেলে তিনি আসবেন না বলে হযরত ঈসা পারাক্লীতের আগমনকে নিজের গমনের উপর নির্ভরশীল করেছেন। রূহের ক্ষেত্রে একথা আদৌ খাটে না। কারণ পাকরূহ তো তার সঙ্গেই থাকত। লোক লিখিত ইঞ্জিলে বলা হয়েছে- ঈসা যখন মুনাজাত করিতেছিলেন তখন আসমান খুলিয়া গেল এবং পাকরূহ কবুতরের মতো হইয়া তাঁহার উপর নামিয়া আসিলেন। (৩ : ২২)

শুধু তা-ই নয়। ঈসার জীবদ্দশায় তাঁর শিষ্যদের উপরও এই পাকরূহ নেমে এসেছিল। যোহন লিখিত ইঞ্জিলে বলা হয়েছে- ঈসা তাহাদের বলিলেন, পিতা যেমন আমাকে পাঠাইয়াছেন আমিও তেমনি তোমাদের পাঠাইতেছি। এই কথা বলিয়া তিনি শিষ্যদের উপর ফুঁ দিয়া বলিলেন, পাকরূহকে গ্রহণ কর। (২০ : ২১-২২)

সুতরাং ঈসা না গেলে যে পারাক্লীত আসবেন না তিনি পাকরূহ হতে পারেন না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই হতে পারেন সেই পারাক্লীত। কারণ তিনি ঈসা আ.-এর পরে আগমন করেছিলেন। তাঁর আগমন ঈসার গমনের উপরই নির্ভরশীল ছিল। কারণ দুই স্বতন্ত্র শরীয়তবিশিষ্ট নবী একই আমলে থাকতে পারেন না। হাঁ যদি পরের নবী পূর্বের নবীর অনুসারী হন কিংবা উভয়ে একই শরীয়তের অনুসারী থাকেন তবে একই আমলে একাধিক নবীর আগমন ঘটতে কোন অসুবিধা নেই।

আট. তিনি বলেছেন- তিনি এসে দুনিয়াকে.....চেতনা দেবেন। এ অনুবাদ বিকৃত। ইচ্ছা করেই এ বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। খৃস্টানদের চিরাচরিত অভ্যাস হল যখনই কোন মুসলমান বাইবেলের কোন ব্যাখ্যা বা শব্দকে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করেছে পরবর্তী সংস্করণে তারা সেই বাক্য বা শব্দের তরজমা বদলিয়ে দিয়েছে। এখানেও তাই হয়েছে। বাংলা বাইবেলে লেখা হয়েছে- তিনি জগৎকে দোষী করিবেন। প্রাচীন ইংরেজী অনুবাদে আছে-He will reprove the world. অর্থাৎ তিনি দুনিয়াকে দোষারোপ করবেন, ধমক দেবেন। ১৮২১, ১৮৩১ ও ১৮৪৪ খৃস্টাব্দে লন্ডন থেকে মুদ্রিত আরবী অনুবাদে উল্লেখ করা হয়েছে- يُؤَبِّجُ যার অর্থ ধমক দেবেন, তিরস্কার করবেন। ১৮৬০ সালে বৈরুতে মুদ্রিত ও ১৬৭১ সালে গ্রেট রোমে মুদ্রিত আরবী বাইবেলে উল্লেখ করা হয়েছে- يبكت

১৮১৬ ও ১৮১৫ সালে মুদ্রিত আরবী অনুবাদে বলা হয়েছে- يُلْزِمُ

১৮১৬,  ১৮২৮ ও ১৮৪১ সালের ফারসী অনুবাদেও তাই উল্লেখ করা হয়েছে। এসব অর্থই কাছাকাছি। উর্দূ অনুবাদে বলা হয়েছে-

دنیا کو قصوروار ٹھرائیگا

অর্থাৎ পৃথিবীকে দোষী সাব্যস্ত করবেন।

কোন অনুবাদেই চেতনা দেবেন বলা হয়নি। চেতনা দেবেন এই জন্যই অনুবাদ করা হয়েছে যাতে মুসলমানরা এর দ্বারা প্রমাণ পেশ করতে না পারে। কেননা অন্যান্য অনুবাদের আলোকে এ কথাটি স্পষ্টভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর ব্যাপারে প্রযোজ্য হয়। তিনি দুনিয়াবাসীকে বিশেষত ইহুদীদেরকে ধমক দিয়েছেন, শাসিয়েছেন, ভৎর্সনা করেছেন ঈসাকে বিশ্বাস না করার জন্য, তাঁর উপর অপবাদ আরোপের জন্য। পাকরূহ এসবের কিছুই করেনি। পাকরূহপূর্ণ ঈসার শিষ্যরাও করেননি। বিশেষ করে সামনের বাক্যে বলা হয়েছে আমাকে বিশ্বাস না করার কারণে তিনি ভৎর্সনা করবেন। বোঝা গেল ঈসাকে অস্বীকারকারীদেরকে তিনি ভৎর্সনা করবেন। পাকরূহ এমন কিছুই করেনি।

নয়. তিনি বলেছেন, তোমাদের নিকট আরও অনেক কথা আমার বলার আছে, কিন্তু এখন তোমরা সেগুলো সহ্য করতে পারবে না। (১৬ : ১২)

একথাটি প্রমাণ করে যে, পারাক্লীত আগমন করার পর ঐ কথাগুলো তাদেরকে বলবেন, যেগুলো তারা তখন সহ্য করতে পারতেন না। এটা পাক রূহের ক্ষেত্রে কোনভাবেই খাটে না। কারণ ঈসার স্বর্গারোহনের পর পাকরূহ বা পাকরূহে-পূর্ণ তাঁর শিষ্যদের কেউ এমন কোন কথা-চাই সেটা আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কিত হোক, বা আমল বিষয়ক-পেশ করেননি, যা খৃস্টানরা সহ্য করতে পারবে না; বরং তারা ঈসার গমনের পর ১০টি বিধান ছাড়া তওরাতকে রহিত ঘোষণা করেছেন। সমস্ত হারামকে বৈধ ঘোষণা করেছেন। (দ্র. প্রেরিত, ১৫ : ২৮, ২৯; রোমীয়, ৪ : ১৪, ১৫; ৭ : ৬; ১৪ : ১৪; ১ করিন্থীয়, ১০ : ২৩, গালাতীয়, ২ : ১৬, ২১; ৩ : ১৩)

পক্ষান্তরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর শরীয়তে এমন অনেক বিশ্বাস ও আমল রয়েছে যা অনেকে নিজেদের মেধার দুর্বলতার কারণে সহ্য না-ও করতে পারে।

দশ. তিনি বলেছেন- তিনি যখন আসবেন তখন পথ দেখিয়ে পূর্ণ সত্যে নিয়ে যাবেন। (বাংলা ইঞ্জিল শরীফ)

এখানে পূর্ণ সত্যে কথাটি ভুল তরজমা। বাংলা বাইবেলে সমস্ত সত্যে বলা হয়েছে। উর্দূতে বলা হয়েছে-

تمام سچائی کی راہ دیکھائیگا

আরবী অনুবাদে লেখা হয়েছে-

يعلمكم جميع الحق

ইংরেজী অনুবাদে আছে He will guide you into all truth.

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পথ দেখিয়ে সকল সত্যে নিয়ে যাওয়া কেবল এমন নবীরই কাজ যার শরীয়ত হবে পূর্ণাঙ্গ। আর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই হলেন এমন নবী। মানবজীবনের এমন কোন দিক নেই যে সম্পর্কে তাঁর শরীয়তে পথনির্দেশ নেই। শত্রু-মিত্র সকলেই এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। পাকরূহের কাজ এটা হতে পারে না। পাকরূহ কোন সত্যে নিয়ে যেতেও পারেনি।

এগার. তিনি বলেছেন- তিনি নিজ থেকে কথা বলবেন না। কিন্তু যা কিছু শোনেন তাই বলবেন।

একথাটি দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, পারাক্লীত এমন ব্যক্তি হবেন, বনী ইসরাঈল (ইহুদী, খৃস্টান) যাকে মিথ্যাবাদী বলবে। একারণেই ঈসা আ. তাঁর বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতার অবস্থা তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছেন। পাকরূহ সম্পর্কে এটা খাটে না। তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার সম্ভাবনাই নেই। অধিকন্তু পাকরূহ খৃস্টানদের বিশ্বাসমতে খোদায়ী সত্ত্বা। আর খোদায়ী সত্তার ব্যাপারে একথা বলা যায় না যে, তিনি যা কিছু শুনবেন তাই বলবেন। কারণ, খোদার কিছু বলতে অন্যের কাছ থেকে শুনতে হয় না। তিনি তো নিজ থেকেই সবকিছু বলবেন।

বোঝা গেল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই উল্লেখিত পারাক্লীত। তিনি খোদাও ছিলেন না। আবার তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার সম্ভাবনাও ছিল। তাই ঈসা আ. পূর্বেই তাঁর সত্যবাদিতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর এ গুণটির কথাই কুরআনে বলা হয়েছে-

وَ مَا یَنْطِقُ عَنِ الْهَوٰیؕ۝۳ اِنْ هُوَ اِلَّا وَحْیٌ یُّوْحٰیۙ۝۴

অর্থাৎ তিনি নিজ থেকে কিছু বলেন না। যা বলতে বলা হয় শুধু তাই বলেন। অন্যত্র বলা হয়েছে-

اِنْ اَتَّبِعُ اِلَّا مَا یُوْحٰۤی اِلَیَّ ؕ

আমার নিকট যে ওহী পাঠানো হয় আমি কেবল তারই অনুসরণ করি।

ড. মরিস বুকাইলি লিখেছেন- বাইবেলের ইংরেজী অনুবাদে ব্যবহৃত টু হিয়ার (শোনা) শব্দটি আসলে গ্রীক ভাষার ক্রিয়াপদে Akouo (এ্যাকুয়ো)র তরজমা। এর অর্থ শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়ে ধ্বনি গ্রহণ করা। একইভাবে টু স্পিক গ্রীক ভাষার ক্রিয়াপদ Laleo (লালিও)র তরজমা। যার সাধারণ অর্থ দাঁড়ায় ধ্বনি নির্গত করা। এরই নির্দিষ্ট অর্থ হল কথা বলা। উল্লেখ্য যে, এই শেষোক্ত ক্রিয়াপদটি গ্রীক ভাষায় রচিত ইঞ্জিলে ব্যবহৃত হয়েছে এন্তার এবং এই শব্দটির দ্বারা যীশুর বিভিন্ন ভাষণে প্রদত্ত নানা বক্তব্য ও ঘোষণার কথাই বলা হয়েছে।

এখানে তর্কশাস্ত্রের নিয়ম প্রয়োগ করলে যে কেউ দেখতে পাবেন, যোহনের ইঞ্জিলে যীশুখৃস্টের মুখ দিয়ে যে পারাক্লীতের কথা বলা হয়েছে তিনি খোদ যীশুখৃস্টের মতো রক্ত-মাংসের মানুষ ছাড়া আর কিছুই নন এবং গ্রীক ভাষায় রচিত যোহনের মূল বাইবেলে ঠিক যেভাবে উল্লেখ রয়েছে তেমনিভাবেই সেই পারাক্লীত-এরও থাকবে বাকশক্তি শ্রবণশক্তি।

অতএব এই ঘোষণার দ্বারা যীশুখৃস্ট এই মর্মেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন যে, পরবর্তীকালে আল্লাহ আর এক জন মানুষকে দুনিয়ায় প্রেরণ করবেন। যিনি হবেন- যোহনের বর্ণনামতেই একজন পয়গম্বর। তিনি মানুষের নিকট পৌঁছে দেবেন আল্লাহর বাণী। (বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান, পৃ. ১৪৪, ১৪৫)

বার. তিনি বলেছেন- আর যা কিছু ঘটবে তাও তিনি তোমাদের জানাবেন। একথাটিও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারেই খাটে, পাকরূহের ব্যাপারে আদৌ খাটে না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া ঈসা আ. এর পর অন্য কেউ এ বিষয়ে কিছু বলেনি। একমাত্র তিনিই বিস্তারিতভাবে ভবিষ্যতের ঘটনাবলি, কিয়ামতের লক্ষণসমূহ, হাশর-নাশর, কবরের আযাব ও শান্তি, জান্নাত ও জাহান্নাম, জান্নাতের নেয়ামতসমূহ ও জাহান্নামের শাস্তিতসমূহ ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন।

তের. পারাক্লীত দ্বারা যে পাক রূহ উদ্দেশ্য হতে পারে না তার আরেকটি বড় প্রমাণ হল, প্রেরিত পুস্তকের যে অধ্যায়ে ঈসার শিষ্যদের পাকরূহে পূর্ণ হওয়ার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে এবং খৃস্টানদের দাবি সেই পাকরূহই যোহনের উল্লেখ করা পারাক্লীত দ্বারা উদ্দেশ্য। উক্ত ঘটনায় এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, শিষ্যদের পাকরূহে পূর্ণ হয়ে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে দেখে উপস্থিত লোকেরা বড়ই বিস্মিত হন এবং নানা রকম মন্তব্য করতে থাকেন। তাদেরকে বোঝাবার জন্য পিতর দীর্ঘ ভাষণ দেন এবং উক্ত ঘটনা সম্পর্কে বলেন- ইহা সেই ঘটনা যাহার কথা নবী যোয়েল বলিয়াছিলেন।

ভাববার বিষয় হল, যদি পারাক্লীত দ্বারা এই পাকরূহ উদ্দেশ্য হত তবে পিতর একবারের জন্যও কেন বললেন না যে, এটাই সেই পারাক্লীত যার সম্পর্কে ঈসা ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। বিশেষত ইহুদীদের সামনে প্রদত্ত ঐ ভাষণের উদ্দেশ্যই ছিল তাদেরকে ঈসার প্রতি ঈমান আনতে উদ্বুদ্ধ করা। তাই পিতরের জন্য মোক্ষম সুযোগ ছিল উক্ত ঘটনা দ্বারা পারাক্লীতের ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হওয়ার কথা তুলে ধরে ঈসা আ.-এর হক্কানিয়াত বা সত্যবাদী হওয়ার কথা প্রকাশ করা। কিন্তু তিনি তা না করে যোয়েল নবীর ভবিষ্যদ্বাণী উক্ত ঘটনা দ্বারা পূর্ণ হওয়ার দাবি করলেন। মজার ব্যাপার হল প্রেরিত পুস্তকের লেখক লূক, যিনি এক খন্ড ইঞ্জিলের লেখক বটেন- তিনিও ঘটনাটি বর্ণনা করে মন্তব্য করছেন না যে, এর দ্বারা ঈসা মসীহের পারাক্লীত সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণীটি পূর্ণ হল। অথচ ইঞ্জিল লেখকগণ সাধারণ সাধারণ বিষয়ে ঐ ধরনের মন্তব্য করে থাকেন। (দ্র. লূক. ৩:৪; প্রেরিত, ১৩ : ৩৩-৩৫; ১৫ : ১৬; ২৮ : ২৬)

চৌদ্দ. ঈসা আ.-এর পর কোন কোন খৃস্টানের পারাক্লীত হওয়ার দাবিও প্রমাণ করে যে, পারাক্লীত পাকরূহ নয়, বরং পরবর্তী নবী। ১৭৭ খৃস্টাব্দে এশিয়া মাইনরে মন্টেন্স (Montanus) নামক জনৈক খৃস্টান সাধক ঐ দাবি করেন এবং তাঁর অনেক অনুসারীও সৃষ্টি হয়। স্যার উইলিয়াম ম্যুর ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত, উর্দূ ভাষায় রচিত ইতিহাসগ্রন্থেও এর উল্লেখ করেছেন। (বাইবেল সে কুরআন তক, ৩ খন্ড, ৩২৬)

স্যার সৈয়দ আহমাদ গার্ড ফ্রে হেগিস্ট-এর বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কিছুকাল পূর্বে মেন্স নামক আর এক ব্যক্তি পারাক্লীত হওয়ার দাবি করেছিলেন।

এমনিভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমলে যেসব খৃস্টান রাজা-বাদশাহ এই মর্মে স্বীকৃতি দিয়েছেন যে, তিনি ঈসার ভবিষ্যদ্বাণীর পাত্র কিংবা কমপক্ষে এতটুকু স্বীকার করেছেন যে, একজন নবীর আবির্ভাব ঘটবে- তাদের সে উক্তি প্রমাণ করে যে, পারাক্লীত দ্বারা পরবর্তী নবীই উদ্দেশ্য পাকরূহ নয়।

আবিসিনিয়ার খৃস্টান বাদশাহ নাজাসী বলেছেন-

أشهد أن رسول الله فإنه الذي نجد في الإنجيل وأنه الرسول الذي بشر به عبيسى بن مريم، والله! لو لا ما أنا فيه من الملك لأتيته حتى أكون أنا أحمل هعليه.

অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর রাসূল। কেননা তিনিই সেই সত্তা যাঁর উল্লেখ আমরা ইঞ্জিলে পাই এবং তিনিই সেই রাসূল যার সম্পর্কে আগাম সুসংবাদ দিয়ে গেছেন ঈসা ইবনে মারয়াম। রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যস্ততা না থাকলে আমি তাঁর কাছে পৌঁছে যেতাম এবং তার জুতা জোড়া বহন করতাম। (মুসনাদে আহমাদ, ১ম খন্ড, ৪৬১)

হেরাক্লিয়াস বলেছেন-

وقد كنت أعلم أنه خارج لم أكن أظن أنه منكم فلو أني أعلم أني أخلص إليه لتجشمت لقائه ولو كنت عنده لغسلت عن قدميه.

অর্থাৎ আমি জানি তাঁর আবির্ভাব ঘটবে। কিন্তু ভাবিনি তিনি তোমাদের আরবদের মধ্য থেকে হবেন। আমি যদি তাঁর নিকট পৌঁছতে পারব বলে জানতাম তবে কষ্ট করে হলেও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতাম এবং তাঁর নিকট থাকতে পারলে তাঁর পদ-যুগল ধুয়ে দিতাম। (বুখারী শরীফ)

একইভাবে রাজা মুকাওকিস- যিনি খৃস্টান ছিলেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পত্রের উত্তরে লেখেন-

لمحمد بن عبد الله من المقوقس عظيم القبط سلام عليك، أما بعد، فقد قرأت كتابك وفهمت ما ذكرت وما تدعو إليه وقد علمت أن نبيا قد بقي وقد كنت أظن يخرج بالشام وقد أكرمت رسولك.

অর্থাৎ কিব্তী রাজ মুকাওকিস-এর পক্ষ থেকে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ এর নামে- আপনার উপর সালাম, আম্মা বাদ, আপনার পত্র পাঠ করলাম এবং যা বলেছেন ও যে বিষয়ের প্রতি দাওয়াত দিয়েছেন তা বুঝতে পারলাম। আমি জানি একজন নবী বাকী রয়ে গেছেন। আমি ভেবেছিলাম তাঁর আবির্ভাব ঘটবে শামে। আমি আপনার দূতকে সম্মান প্রদর্শন করলাম। (আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ৪খ, ৩০৩)

এমনিভাবে জারূদ ইবনুল আলা রা.- যিনি বড় খৃস্টান পন্ডিত ছিলেন- নিজ গোত্রের লোকদের নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হাজির হয়ে বললেন-

والله، لقد جئت بالحق ونطقت بالصدق والذي بعثك بالحق نبيا وجدت وصفك في الإنجيل وبشر بك ابن البتول، الخ.

অর্থাৎ আল্লাহর কসম! আপনি সত্য নিয়ে এসেছেন, সত্য কথা বলেছেন, যিনি আপনাকে সত্যসহ নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ করে বলছি, আপনার বিবরণ আমি ইঞ্জিলে পেয়েছি এবং আপনার সম্পর্কেই সুসংবাদ দিয়ে গেছেন বাতুল (সতী-সাধ্বী)-এর পুত্র (ঈসা)। (বায়হাকী, দালাইলুন-নুবুওয়াহ, ৫ম খন্ড, ৩৩২)

পনের. পারাক্লীত দ্বারা যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই উদ্দেশ্য তার বড় আর একটি প্রমাণ বার্ণাবাসের বাইবেল। উক্ত বাইবেলে পারাক্লীত সম্পকির্ত ভবিষ্যদ্বাণীটি সবিস্তারে তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম, বংশপরিচয়, গুণরাজি, বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণাদি সম্পর্কে সুদীর্ঘ আলোচনা টানা হয়েছে। নিচে সংক্ষিপ্ত আকারে তার কিছু উদ্ধৃত করছি।

ঈসা আ. বলেছেন- আমার পর সমস্ত নবী ও মহান ব্যক্তিদের নূর আসবেন। আমি আল্লাহর সেই রাসূলের মোজার বাঁধন কিংবা তাঁর জুতার ফিতা খুলে দেয়ারও যোগ্য নই। যারা তাঁর শিক্ষা লাভ করবে তিনি তাদেরকে মুক্তি ও রহমত পৌঁছাবেন। তিনি খোদাহীন লোকদের উপর ক্ষমতা ও আধিপত্য নিয়ে আসবেন।

 

মূর্তিপূজার এভাবে বিলোপ সাধন করবেন যে, শয়তান দিশেহারা হয়ে যাবে। আমি এখন দুনিয়ায় সেই আল্লাহর রাসূলের পথ তৈরি করার জন্য এসেছি যিনি দুনিয়ার জন্য মুক্তি নিয়ে আসবেন। তিনি তোমাদের সময় আসবেন না। তোমাদের কয়েক বছর পর আসবেন, যখন আমার ইঞ্জিল এমনভাবে বিকৃত হয়ে যাবে যে, ৩০ জন লোকের ঈমানদার থাকাও কঠিন হবে। তাঁর মাথার উপর সাদা মেঘের ছায়া হবে। তিনি সেসব লোকের উপর প্রতিশোধ নিবেন যারা আমাকে মানুষ হতেও ঊর্ধ্বে কিছু গণ্য করবে। তাঁর পর আর কোন সত্য নবী আসবেন না। তবে অনেক মিথ্যা নবীর আগমন ঘটবে। তাঁর নাম হবে প্রশংসিত (মুহাম্মদ)। (দ্র. অধ্যায়-১৭-৯৭)

এ আলোচনার উপর কেউ আপত্তি তুলতে পারেন যে, যোহন লিখিত ইঞ্জিলে পারাক্লীত বা সাহায্যকারী- এর পর পাকরূহ বা পবিত্র আত্মা শব্দটিও তো যুক্ত আছে। আর এর থেকে তো এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পারাক্লীত কোন নবী নয়, আত্মাই বটে।

এর উত্তরে আমরা বলব, ড. মরিস বুকাইলিসহ অনেক বাইবেল গবেষকের মতে ঐ পাকরূহ বা পবিত্র আত্মা কথাটি পরবর্তী সংযোজন। ড. মুরিস বুকাইলি বলেন, আমরা অধুনা প্রচলিত বাইবেল গুলিতে পারাক্লীতস শব্দের সাথে কিংবা তার বদলে হোলি স্পিরিট তথা পবিত্রাত্মা বা পাকরূহ বলে যে কথাটা পাচ্ছি তা নিঃসন্দেহে পরবর্তীকালের সংযোজন এবং ঐ দুটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে একান্ত ইচ্ছাকৃতভাবেই। এর দ্বারা বাইবেলের যে বাণীতে যীশুর পর আরেকজন পয়গাম্বর আবির্ভাবের কথা বলা হয়েছিল তা পুরোপুরিভাবে ধামাচাপা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। (দ্র. বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞান, পৃ. ১৪৫)

যদি আমরা ঐ শব্দটিকে সঠিক ধরেও নেই তথাপি বলা যায় পবিত্র আত্মা দ্বারা আসলে পবিত্র পয়গাম্বরকেই বোঝানো হয়েছে। খোদ ইঞ্জিলেই রূহ বা আত্মা বলে পয়গাম্বরকে বোঝানো হয়েছে। যোহনের ১ম পত্রে লেখা হয়েছে- প্রিয় সন্তানেরা, তোমরা সমস্ত রূহকে বিশ্বাস করিও না, বরং যাচাই করিয়া দেখ তাহারা খোদা হইতে আসিয়াছে কি না। কারণ দুনিয়াতে অনেক ভন্ড নবী বাহির হইয়াছে। খোদার রূহকে তোমরা এই উপায়ে চিনিতে পারিবে- যে রূহ স্বীকার করে ঈসা মসীহ মানুষ হইয়া আসিয়াছিলেন, সেই রূহই খোদা হইতে আসিয়াছেন। (৪/১, ২)

 

মোটকথা, ঈসায়ীদের এত পরিবর্তন-পরিবর্ধন, অমূলক ব্যাখ্যা, এমনকি বিভিন্ন অপব্যাখ্যার পরও এখন এ বিষয়টি বিচক্ষণ পাঠকদের সামনে পরিষ্কার রয়েছে যে, আলোচিত ভবিষ্যদ্বাণীতে খাতামুন নাবীয়ীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই নির্দেশ করা হয়েছে। #

 

 

advertisement