জুমাদাল উলা ১৪২৯   ||   মে ২০০৮

একজন মিয়াজীর দরকার

ইসহাক ওবায়দী

ইসলামের ওপর লেখালেখি, ওয়াজ-নসীহত তো আর কম হচ্ছে না। তাই আজ আর লেখা নয়, একটি করুণ ঘটনা শুনাচ্ছি। ভারতের উর্দূ মাসিক আরমগাঁ পত্রিকার ১৯৯৮ সালের দাওয়াতী এক বিশেষ সংখ্যায় মায়েল খায়রাবাদী নামের একজন লেখক ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন।

আজ থেকে প্রায় ৩০/৩৫ বছর পূর্বে ভারতের উত্তর প্রদেশের বস্তী নামের একটি জেলার একটি গ্রাম থেকে হিন্দু ঠাকুররা বারটি মুসলিম পরিবারকে মারধর করে উচ্ছেদ করে দিয়েছিল। তাদের ঘর-বাড়ি ও মসজিদ ভেঙ্গে-চুড়ে মিসমার করে ফেলেছিল। ঘটনাটি খুব মর্মান্তিক হওয়ায় তখনকার পত্র-পত্রিকায় প্রধান শিরোনাম হয়ে খবর প্রকাশিত হয়। মুসলমানদের এত বড় মর্মান্তিক একটি দুর্ঘটনার কথা পত্রিকায় পড়ে অনেক মুসলমান বিষয়টি জানতে ও বুঝতে গিয়েছিলেন। এ বিষয়ে যখন ঠাকুরদের প্রশ্ন করা হল, ঠাকুররা তখন এক দীর্ঘ কাহিনীর অবতারণা করল। তারা বলল, আমাদের সম্মানিত পূর্বপুরুষরা মোগল আমল থেকেই এখানকার রাজা ছিলেন। কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা উসুল করতে তাঁদের খুব কষ্ট হত। কৃষকরা বড় অবাধ্য ছিল। কিছু ডাকাত আবার তাদের পিছনে ছিল। রাজার পক্ষ থেকে খাজনা উসুলের জন্য লোকজন যেত, ডাকাতদের সহায়তায় কৃষকরা তখন মারামারি, খুনাখুনিতে লিপ্ত হয়ে যেত। অনেক খুন-খারাবীর পর কখনো কখনো অর্ধেক অথবা তিন ভাগের একভাগ খাজনা উসুল করা সম্ভব হত।

আমাদের রাজা সাহেব প্রতি বছর দিল্লীতে শাহী দরবারে যেতেন। সেখানে মুসলিম রাজা ও নওয়াবদের সাথে তাঁর দেখা-সাক্ষাত হত। সাক্ষাতকালে খাজনা উসুলের ব্যাপারে মত বিনিময় হত। একবার আমাদের রাজা সাহেব শাহী দরবার থেকে আসার সময় সাথে করে একজন মিয়াজীকে নিয়ে আসলেন। মিয়াজীর পরিবারটি খুব ছোট। স্ত্রী, একটি যুবতী মেয়ে ও দুটি শিশু ছেলে। ঠাকুররা বলল, ঐ যে পুরাতন নিম গাছটি দেখা যাচ্ছে, তার ছায়ায় বসে মিয়াজী নিজের সন্তানদের তালীম দিতেন। আমাদের পূর্বপুরুষরা তাদের সন্তানদেরকেও পাঠালেন এবং বললেন, তাদের ফার্সী পড়িয়ে দিন। ফার্সী তখন আজকের ইংরেজির মতো রাজভাষা ছিল বলে হিন্দুরাও তা যথেষ্ট শিখত। মিয়াজীকে একটি ঘর এবং দশ বিঘা ক্ষেত, সাথে ক্ষেত করার মতো একজন লোকও দেওয়া হয়েছিল। মিয়াজী শিশুদেরকে তালীম দেওয়ার সাথে সাথে তরবিয়ত বা দীক্ষাও দিতেন। যেমন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাতাপিতাকে সালাম বা প্রণাম করবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে। প্রতিদিন গোসল করবে। চুরি এবং মিথ্যা থেকে দূরে থাকবে। বড়দের সম্মান করবে। একে অপরে মিলেমিশে থাকবে ইত্যাদি। মিয়াজীর এই তালীম-তরবিয়তের প্রভাব শিশুদের ওপর পড়তে লাগল। গ্রামের মানুষের দৃষ্টিতে শিশুদের একটা অবস্থান সৃষ্টি হতে লাগল। হিন্দুদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে মিয়াজী জানতে পারলেন যে, স্বর্গ-নরকের বিশ্বাস এখানেও আছে। তখন শিশুদের তিনি নরকের ভয় দেখাতেন এবং স্বর্গলাভের লোভ দেখাতেন। এমন এমন গল্প শোনাতেন যাতে সততার দীক্ষা থাকত। শিশুরাও এ সমস্ত গল্প তাদের বাসা-বাড়িতে গিয়ে শোনাত এবং ভগবানের চর্চা আমাদের ঘরগুলিতেও হতে লাগল। মিয়াজী জুমআর দিন গ্রামে গাশত করতেন। ঘরে ঘরে গিয়ে শিশুদের মা-বাবার সাথে দেখা করতেন এবং খাসভাবে এই উপদেশ দিতেন যে, তোমরা আপন শিশুদেরকে যেভাবে বানাতে চাও, নিজেরাও তদ্রূপ হয়ে যাও। সবশেষে বললেন, শিশুরা কি বড়দের অনুকরণ করে না?

ঠাকুররা আগত মুসলমানদের উদ্দেশ্যে আরো বললো, এখন শুনুন আরেকটি ঘটনা। আশপাশে প্রসিদ্ধ জংগুয়া নামের এক ডাকাত তার ছেলেকে নিয়ে মিয়াজীর কাছে আসল এবং বলল, মিয়াজী! আমার বাচ্চাকে কি ফার্সী পড়িয়ে দিবেন? মিয়াজী বললেন, কেন নয়, অবশ্যই পড়াব। মিয়াজীর উত্তর শুনে ডাকাত জাংগুয়া বলল, তবে আমি তো খারাপ লোক, তাই রাজা সাহেব তা পছন্দ করবেন না। মিয়াজী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তুমি বাচ্চাকে পাঠিয়ে দাও। আমি রাজা সাহেব থেকে অনুমতি নিয়ে নেব। জাংগুয়ার ছেলে যখন মিয়াজীর কাছে পড়ার জন্য আসল, ঠিকই তখন রাজপুতেরা মিয়াজীর কাছে শেকায়েত করল। কিন্তু মিয়াজী বললেন, বিচক্ষণতার দাবি হচ্ছে, জাংগুয়ার ইচ্ছা পূরণ করা। আপনারা দেখবেন, আগামী বছর জাংগুয়া সকলের আগে খাজনা দিবে। হয়েছেও তাই। বৎসর পূর্ণ হওয়ার পর সত্যিই জাংগুয়াই সকলের আগে খাজনা নিয়ে আসল এবং বলল, বাপ আমার! এখন থেকে খাজনার ব্যাপারে আপনি আর কষ্ট  করবেন না। লোক পাঠানোর  প্রয়োজন নেই। আমি সব খাজনা উসূল করিয়ে দিব। আমাদের রাজা সাহেবের সবচেয়ে বেশি চিন্তা তাকে নিয়েই ছিল। তিনি বিষয়টিকে মিয়াজীর কারামত মনে করলেন। তারপর তো এই গ্রামে মিয়াজীর কারণে একটি পাঠশালাই হয়ে গেল।

ঠাকুররা আবার বলল, এরপর আরেকটি ঘটনা শুনুন। যার দ্বারা আমাদের এখানে একটি বিপ্লব হয়ে গেছে। একদিন মিয়াজী আমাদের পূর্ব পুরুষদের বললেন, আগামীকাল আমার মেয়ের বিয়ে। বিয়েতে আপনারাও অংশ নিবেন। আমাদের পূর্বপুরুষরা দুঃখ করে বললেন, আমাদেরকে আগে কেন বলেননি? আপনার মেয়ে তো আমাদেরই মেয়ে। আমরা ধুমধাম করে তাকে রুখসত করতাম। শহর থেকে নাচ-গানের জন্য গায়িকা ডেকে আনতাম, পাচক আসত, আতশবাজি আসত। মিয়াজী বললেন, ইসলামী তরীকায় বিয়ে-শাদী অত্যন্ত সাদাসিধে হয়। বরের সাথে মাত্র পাঁচজন লোক আসবেন। তাদের খাবার ঘরেই রান্না করা হবে। আর নাচ-গান ও আতশবাজি ফযুল খরচের কাজ। এটা ইসলামে নিষিদ্ধ।

 

তাই তার প্রয়োজন নেই। সত্যিই খুব সাদাসিধেভাবেই বিয়েটা হল। বিয়ের পর বরের বাবা কনের মহর বাবদ ছাপ্পান্ন টাকা দশ আনা কনেকে নগদ বুঝিয়ে দিয়ে তাকে রুখসত করিয়ে নিয়ে গেল। আমাদের পূর্বপুরুষরা ঐ টাকার ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলেন যে, এটা কী? তাঁদেরকে বলা হল, মহরের টাকা এভাবে দিয়ে দেয়াটা অত্যন্ত জরুরি। হিন্দুদের বিয়ের বিপরীত এই বিয়ের খুব ধুম পড়ে গেল এবং কয়েকটি গরীব রাজপুতদের খান্দান মুসলমান হয়ে গেল।

 

হিন্দু পন্ডিতরা তখন আমাদের পূর্ব পুরুষদের সাবধান করলেন যে, এই মিয়াজীকে এখানে বসবাস করতে দেয়া ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষরা পন্ডিতদের কথা কানে নিলেন না।

এখন সংক্ষেপে শুনুন যে, উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে যে সমস্ত বড় বড় প্রসিদ্ধ আলেম-ওলামা দেখতে পাচ্ছেন, তাঁদের পূর্বপুরুষদেরকে যারা মুসলমান বানিয়েছিলেন, তারা এই মিয়াজীর সুপুত্ররাই ছিলেন। কিন্তু আফসোস, শত আফসোস! মিয়াজীর আওলাদ এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাদের বারোটা পরিবার বা খান্দান হয়ে গেছে। এরা সবাই দুই বছরের মধ্যে এমন খারাপ হয়ে গেছে যে, দুই বছর পূর্বে এখানকার খারাপ চামাররাও এমন ছিল না। সংক্ষেপে এতটুকু বুঝে নিন যে, এরা নামকা মুসলমান, কাজে কাফের। তাদের এ অবস্থা দেখে আমরা তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছি। আপনারা তাদেরকে মুসলমান মনে করলে করতে পারেন, কিন্তু আমরা তাদেরকে মুসলমান মনে করাটা ইসলামের অসম্মান মনে করি। আপনারা যান এবং ঐ ধরনের একজন মিয়াজী পাঠিয়ে দিন। আমরা তাকে ঐ বারো পরিবারের সমস্ত জায়গীর বুঝিয়ে দিব।

এরপর লেখক মায়েল খায়রাবাদী সাহেব অত্যন্ত অনুতাপের সাথে বলেছেন যে, বড়ই আফসোসের কথা, এই ঘটনার পর আজ প্রায় পঁচিশ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে, (এখন প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর) আমরা এখনো সেখানে একজন মিয়াজী পাঠাতে সক্ষম হইনি। এটা এত বড় এক ট্রাজেডি, যা নিয়ে আমাদের আলেম সমাজের চিন্তা-ফিকির করা অতীব জরুরি। আজ কুরআনে কারীমের তাফসীরের কোনো অভাব নেই, ইসলামী সাহিত্যের দ্বারা লাইব্রেরি ও পাঠাগারগুলো ভরে গেছে। আজ সমাজ বদলের শ্লোগান যে সে দিয়ে বেড়াচ্ছে। সামাজিক আচার-আচরণ ঠিক করার ব্যাপারে কত কত বই-পুস্তক এবং পত্রিকা বের হচ্ছে কিন্তু মাফ করবেন-

وَ اَنْتُمُ الْاَعْلَوْنَ اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ۝۱۳۹

এর কোথাও কি এরচেয়ে বেশি উত্তম তাফসীর নজরে পড়বে,  যা এক মিয়াজী উত্তর প্রদেশের বস্তী নামক জেলার একটি অজপাড়াগাঁয়ে নিজের ব্যক্তিগত আমলের নমুনা দ্বারা পেশ করেছিলেন? আজ একজন মিয়াজীর খুব প্রয়োজন। #

 

 

advertisement