জুমাদাল আখিরাহ ১৪২৯   ||   জুন ২০০৮

‘নারী উন্নয়ন নীতি’ এবং এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও প্রচারমাধ্যমের অসত্য প্রচারণা

ইবনে নসীব

দেশী-বিদেশী বহু এনজিওর প্ররোচনা ও প্রত্যক্ষ অংশীদারত্বের মাধ্যমে প্রণীত যে নীতিমালা কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছিল তা দেশের আলেম-উলামা ও সর্বস্তরের ইসলামপ্রিয় মানুষের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের পর সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করা হয়। আলেমদের পক্ষ থেকে একটি পর্যালোচনা কমিটি উপরোক্ত নীতিমালা সম্পর্কে তাদের সুপারিশ পেশ করেন। সরাসরি কুরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক অনেকগুলো ধারা চিহ্নিত  করে সেগুলো বাতিল করার দাবি জানানো হয়।

এ বিষয়গুলো যখন চলছে তখন একটি দৈনিক পত্রিকার অবস্থান হল, তারা ওই স্থগিতকৃত নীতিমালার পক্ষে বিরামহীন প্রচারণা   চালাতে   থাকে  এবং  তা  বাস্তবায়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে সচেষ্ট থাকে। প্রতিদিন উপসম্পাদকীয় পাতায় কোনো নিবন্ধ, কিংবা শেষের পাতায় কোনো নারীবাদী সংগঠনের বক্তৃতা-বিবৃতি অথবা ভিতরের পাতায় এ বিষয়ক কোনো সংবাদ নিয়মিত ছাপতে থাকে।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র নামের অবমাননাকারী ওই পত্রিকা সে সময় গণরোষের মুখে অনিচ্ছাকৃত ভুল ইত্যাদি বলে প্রথম পৃষ্ঠায় বড় শিরোনাম করেছিল, কিন্তু তাদের নিয়মিত কর্মকান্ড প্রমাণ করে যে, এরা সম্পূর্ণভাবে ইসলামবিরোধী এবং অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এ দেশে পাশ্চাত্যের জীবনধারা প্রচলিত করতে বদ্ধপরিকর। বলাবাহুল্য, ওই বিতর্কিত নীতিমালা পাশ্চাত্যের নোংরা জীবন-দর্শন রাষ্ট্রীয় ও আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করার পথে একটি সুচারু পদক্ষেপ।

ওই পত্রিকায় নিয়মিত যে প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো প্রকাশিত হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে সেগুলোতে আলোচনার নামে ব্যাপক আকারে মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। একটি দৃষ্টান্ত এ নিবন্ধে তুলে ধরছি।

গত ১৭ মে ২০০৮ শনিবার ওই পত্রিকার উপসম্পাদকীয় পাতায় নারী উন্নয়ননীতি নিয়ে অহেতুক বিতর্ক শিরোনামে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। নিবন্ধের এক স্থানে বলা হয়েছে-   

‘‘বস্ত্তত ইসলাম ধর্মের বহু ব্যাখ্যা রয়েছে এবং পবিত্র কোরআনের অসংখ্য তাফসির বিদ্যমান। ইসলামের চারটি মাজহাব-হানাফি, শাফেয়ি, হাম্বলি, মালেকি-বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভিন্ন ব্যাখ্যারই প্রতিফলন। এ ছাড়া মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নিসহ আরও অনেক বিভাজন রয়েছে। তাই ইসলাম ধর্মের অনেক স্রোত রয়েছে, যার কোনোটি অত্যন্ত রক্ষণশীল, আবার অন্যগুলো অনেক উদারপন্থী ও প্রগতিশীল। পর্যালোচনা কমিটির রিপোর্ট পড়ে মনে হয়, কমিটির সদস্যরা অত্যন্ত রক্ষণশীল ঘরানার অন্তর্ভুক্ত। এ ঘরানার ব্যক্তিরা নারীর অধিকারের প্রতি অনুদার। এদের ধারণা এমনকি অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজের (ওআইসি) ঘোষণারও পরিপন্থী।

 ‘‘১৯৯০ সালে ওআইসি ঘোষণা করে Cairo Declaration on Human Rights in Islam.

OIC Fiqh Academy-বিশ্ব স্বীকৃত আলেমদের সম্মতির ভিত্তিতে রচিত এ ঘোষণার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে :

(a) All human being form one family whose members are united by submission to God and decent from Adam. All men are equal in terms of basic human dignity and basic obligations and responsibilites, without any discrimination on the grounds of race, color, language, sex, religious belief, political affiliation, social status or other considerations ... (b) All human beings are God’s subjects, and the most loved by him are those who are most useful to the rest of his subjects, and no one has superiority over another except on the basis of piety and good deeds.’

(ক) আদম থেকে উদ্ভূত এবং আল্লাহ তাআলার প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ সমগ্র মানবজাতি এক পরিবারের সদস্য। জাতি, গোত্র, বর্ণ, ভাষা, নারী-পুরুষ, ধর্মবিশ্বাস, রাজনৈতিক আনুগত্য, সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে মূল মানবিক মর্যাদা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের দিক থেকে সব মানুষ সমান ... (খ) প্রতিটি মানুষ আল্লাহ তাআলার অধীন। সেইসব ব্যক্তিকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, যারা তাঁর সমস্ত সৃষ্টির কল্যাণে নিয়োজিত এবং শুধু ধর্মপরায়ণতা ও সৎ কর্মের ভিত্তি ছাড়া একজন মানুষ অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে না।]

‘‘এ ছাড়া ওআইসি ঘোষণার অনুচ্ছেদ ৬ (ক)-তে `Woman is equal to man in human dignity, and has rights to enjoy as well as duties to perform; she has her own civil entity and financial independence, and the right to retain her name and lineage.’

 (মর্যাদা এবং তা ভোগ করার অধিকারের পাশাপাশি কর্তব্য পালনের দিক থেকেও নারী-পুরুষ সমান। নারীর রয়েছে স্বতন্ত্র সামাজিক সত্তা বা পরিচয় এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং তার নিজের নাম ও বংশপরিচয় বজায় রাখার অধিকার।) তাই কমিটির রিপোর্ট মূল ধারার ইসলামি চিন্তার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, কারণ ইসলাম নারী-পুরুষের মৌলিক সাম্যের স্বীকৃতি দেয়। তাই নারীনীতি নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কটি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ অহেতুক।’’

এই উদ্ধৃতিতে অনেকগুলো বিভ্রান্তিকর বিষয় রয়েছে। আকীদা ও আমল অর্থাৎ বিশ্বাস ও কর্মের বিষয়ে ইসলামী শরীয়ায় একাধিক চিন্তারীতি অবশ্যই রয়েছে এবং এটা ইসলামী শরীয়ার এমন এক বৈশিষ্ট্য যা তাকে বিশ্বজনীন চরিত্র প্রদান করেছে।  কিন্তু  একাধিক  স্বীকৃত     চিন্তারীতি বিদ্যমান থাকার অর্থ কি এই যে, শুধু ইসলামের নাম যুক্ত করলেই যেকোনো চিন্তাব্যাখ্যা ইসলামে স্বীকৃত হবে? ইসলামের স্বীকৃত চিন্তারীতিগুলোর মৌলিক ঐক্য কোথায় এবং সে হিসেবে কোন কোন চিন্তারীতি স্বীকৃত এবং কোনগুলো পরিত্যাক্ত-এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণসিদ্ধ সিদ্ধান্ত অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান রয়েছে। অতএব এ বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হলেও তা খুব সহজেই উন্মোচিত হয়ে যেতে বাধ্য। এ প্রসঙ্গে অন্য কোনো সময় বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইল। এখানে  আমি শুধু মূল বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

নিবন্ধকারের বক্তব্য বিশ্ব স্বীকৃত আলেমদের সম্মতির ভিত্তিতে রচিত ... এর সূত্র ধরে বলতে পারি, বিশ্ব স্বীকৃত আলেমদের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ভিন্ন। আলোচিত ও সমালোচিত নারী উন্নয়ননীতিকে কোনোভাবেই এর দ্বারা সমর্থিত করা যায় না।

এখানে বলে নিচ্ছি যে, উপরোক্ত ঘোষণা যদিও পরে ওআইসি ফিকহ একাডেমি কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে কিন্তু মৌলিকভাবে এ ঘোষণা ওআইসি ফিকহ একাডেমি কর্তৃক রচিত নয়। এটা প্রণীত ও ঘোষিত হয়েছে ওআইসির পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠকে। মজার বিষয় এই যে,  ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর অধিকার বিষয়ে ওআইসি ফিকহ একাডেমির সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ঘোষণা রয়েছে। ওই ঘোষণার উদ্ধৃতি না দিয়ে মানবাধিকার বিষয়ক ওআইসি ঘোষণার প্রসঙ্গ উত্থাপন করা কি একান্তই অনিচ্ছাকৃত?

মানবাধিকার প্রসঙ্গে ওআইসির কায়রো ঘোষণার অনুচ্ছেদ (১) ও অনুচ্ছেদ (৬) এর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, ওই দুইটি অনুচ্ছেদের মধ্য থেকেও কিছু কথা বাদ দেওয়া হয়েছে এবং ঘোষণার শেষ দুটি অনুচ্ছেদের সরাসরি বিরোধিতা করা হয়েছে। মূল আরবী ভার্সনে অনুচ্ছেদ (১) ক-এর শেষ বাক্যটি হল- এবং বিশুদ্ধ আকীদা এই মানবিক মর্যাদা বৃদ্ধির নিশ্চয়তা প্রদান করে। কেননা এর মাধ্যমেই মানুষ ক্রমাগত পূর্ণতা লাভ করে।

সম্ভবত এই অংশটুকু নিবন্ধকারের উদার ইসলামের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আলোচিত নিবন্ধের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন-তাই আজ আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ইসলামকে উদারতা,  আধুনিকতা  ও অন্তর্ভুক্তিকরণমূলক (Inclusive) দৃষ্টিতে দেখা।

প্রশ্ন হল, এমনকি ইসলামকেও অতিক্রম করে? আহমদিয়া মুসলিম জামাত কি এরই একটি দৃষ্টান্ত? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ইসলাম একটি আদর্শের নাম। সেই আদর্শকে অতিক্রম করে গেলে তথাকথিত উদারতাআধুনিকতা থাকে, কিন্তু ইসলাম থাকে না।

ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে দুটি ধারা রয়েছে। (ক) ধারাটির অনুবাদ আরবী ভার্সন থেকে তুলে দিচ্ছি :

মানবিক মর্যাদার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান। এবং তার যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি অধিকারও রয়েছে। তার রয়েছে সামাজিক সত্ত্বা এবং স্বতন্ত্র আর্থিক নিরাপত্তা। আর নাম ও বংশ-পরিচয় সংরক্ষণের অধিকার।

তুলনা করে পড়লে দেখা যায়, নিবন্ধকার তরজমায় সূক্ষ্ম পার্থক্য এনেছেন। এক ধরনের শব্দগত অসাধুতা। ইসলামের স্বীকৃত দর্শন থেকে সরিয়ে ভিন্ন অর্থে প্রবাহিত করে দেওয়ার অপচেষ্টা।

নারীর স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন এবং তার মর্যাদা ও পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ থাকার নিশ্চয়তা রয়েছে তার গৃহে অবস্থানের মধ্যে। নারীর জন্য এটাই ইসলামের মৌলিক বিধান। আর এজন্যই তাঁর ভরণ-পোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব স্বামীর উপর অর্পিত হয়েছে।

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের এই দিকটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে কুরআন মাজীদে এসেছে- তরজমা :পুরুষগণ নারীদের তত্ত্বাবধায়ক।

যারা ইসলামের এই দর্শনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করতে পারেন না তারা একেই নারীর অধস্তনতা নামে আখ্যায়িত করে থাকেন এবং একটি ভুল ধারণা দেওয়ার প্রয়াস পেয়ে থাকেন। অথচ সামান্য চিন্তা করলেই দেখা যায়, যে বিষয়টিকে অধস্তনতা বলে আখ্যায়িত করে ঘৃণা ও উত্তেজনা সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হচ্ছে সেটাই আমাদের বাস্তব জীবনের সকল অঙ্গনে ব্যাপকভাবে অনুসৃত। এর মাধ্যমেই সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রয়েছে। আর তা কেবল নারীর ক্ষেত্রে নয়, পুরুষের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান। নিবন্ধকারের ভাষায় বললে বিষয়টিকে এভাবে বলতে হয়, সন্তান পিতা-মাতার অধস্তন, ছাত্র শিক্ষক-শিক্ষিকার অধস্তন। কর্মচারী কর্তার অধস্তন। প্রশ্ন হল, জীবনের সকল অঙ্গনেই যখন এই  অধস্তনতা বিস্তৃত তখন শুধু স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে এ নিয়ে এতটা মাতামাতির পিছনে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নেই তো?  আসলে তত্ত্বাবধান ও আনুগত্যকে অধস্তনতা নাম দেওয়াটাই ভুল।

এ প্রসঙ্গে শেষ তথ্যটি হল আলোচিত নিবন্ধে উপরোক্ত অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় ধারাটি উল্লেখ করা হয়নি।  ধারাটি হল-

পরিবারের ভরণ-পোষণ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পুরুষের উপর অর্পিত।

আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ওআইসির উপরোক্ত ঘোষণায় এমন কিছু নেই যার মাধ্যমে আলোচিত নীতিমালাকে সমর্থিত করা যায়; বরং সততা রক্ষা করে উদ্ধৃত করা হলে ওই ঘোষণার অনুচ্ছেদগুলো থেকেই উল্টোটা প্রমাণিত হয়। অতএব পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ কিংবা আলেম-উলামার বর্তমান অবস্থানকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক প্রমাণ করার চেষ্টা জাজ্জ্বল্যমান মিথ্যাচার ও তথ্যসন্ত্রাস ছাড়া আর কিছুই নয়।

ওআইসির উপরোক্ত ঘোষণার শেষ দুটি অনুচ্ছেদের বাংলা অনুবাদ তুলে দিচ্ছি :

(২৪) এই ঘোষণায় যেসব অধিকার ও স্বাধীনতা সাব্যস্ত হয়েছে তা ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।

(২৫) এ ঘোষণার যেকোনো দফার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তই একমাত্র সূত্র বলে বিবেচিত হবে।

ইতোপূর্বে বলেছিলাম, নারীর অধিকার, দায়িত্ব ও অবদান প্রসঙ্গে ওআইসি ফিকহ একাডেমির স্বতন্ত্র ঘোষণা রয়েছে। অথচ অধিক প্রাসঙ্গিক হওয়া সত্ত্বেও আলোচিত নিবন্ধে ওই ঘোষণার কোনো উদ্ধৃতি উল্লেখিত হয়নি। মূল আরবী পাঠ থেকে ঘোষণাটির বাংলা অনুবাদ তুলে দিচ্ছি :

সপ্তম ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত নং ১০/৭ অনুযায়ী ১৪১৫ হিজরীর যিলকদ১৭-১৯ মোতাবিক ১৯৯৫ এপ্রিল ১৭-১৯ তারিখে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসলামী সমাজের উন্নয়নে নারীর ভূমিকা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভায়  যে  সকল  প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল সেগুলো (ফিকাহ একাডেমির) ফতোয়া বিভাগের নবম ও দশম অধিবেশনে সংশোধিত রূপে অনুমোদন করা হয়।

নারী জাতি সম্পর্কে ইসলাম যে সকল মূল্যবোধ গ্রহণ করেছে এবং যেগুলোর উপর নারী বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন, বিশেষত কায়রো ও বেইজিং সম্মেলন এবং পরবর্তী অন্যান্য সম্মেলন আঘাত হেনেছে সেগুলো রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এবং এ সকল ঘৃণিত হামলা প্রতিহত করার জন্য যে সকল ইসলামী বক্তব্য ও বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে  সেগুলোর আলোকে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার শাখা সংগঠন ইসলামী ফেকাহ একাডেমির দ্বাদশ অধিবেশন (সউদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত, ২৫ জুমাদাল উখরা থেকে পয়লা রজব ১৪২১ হিজরী মোতাবেক ২৩-২৮ সেপ্টেম্বর ২০০০ খৃ.) নিম্নো্ক্ত সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করেছে।

(১) এমন একটি সমাজ বিনির্মাণ ইসলামের মৌলিক লক্ষ্যসমূহের অন্যতম যে সমাজের গঠন ও উন্নয়নে নারী-পুরুষের পরিপূরক অবস্থান থাকবে। নারীর ব্যক্তিত্ব ও অনুভূতি এবং তার যোগ্যতা ও জীবনযাত্রার প্রধান দায়িত্বের সঙ্গে পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ মানদন্ডের ভিত্তিতে সাব্যস্ত সকল অধিকার ইসলাম নারীকে প্রদান করে।

ইসলামী চিন্তাধারায় সমাজ হচ্ছে এমন একটি একক প্রতিষ্ঠান, যেখানে সার্বিকভাবে নারী-পুরুষ পরস্পরের পরিপূরক শক্তিরূপে কাজ করে। আর কুরআন ও সুন্নাহ ইসলামী উম্মাহর সকল সংবেদনশীল অংশের অবিভাজ্যতার উপর গুরুত্বারোপ করে। সুতরাং ইসলামী সমাজে নারী ও পুরুষ প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব এবং স্বতন্ত্র অবস্থান।

(২) শরীয়তসম্মত বিবাহের  মাধ্যমে গঠিত পরিবারই হল একটি বিশুদ্ধ সমাজ গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর। তাই পরিবারের অন্য সকল ব্যাখ্যা ও পদ্ধতি এবং উপরোক্ত শরীয়তসম্মত বন্ধন ছাড়া অন্য সকল বন্ধন ও সম্পর্ক ইসলাম প্রত্যাখ্যান করে।

পারিবারিক বন্ধনের ভিত্তি ও সমৃদ্ধির পিছনে নারীর অবদান মৌলিক তার মাতৃত্ব ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের কারণে।

(৩) জীবনযাত্রায় নারীর স্বাভাবিক দায়িত্ব হচ্ছে মাতৃত্ব। এ দায়িত্ব তার পক্ষে পূর্ণাঙ্গরূপে পালন করা এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে উত্তমরূপে গড়ে তোলা সম্ভব হবে না যদি সে তার সকল ইসলামী অধিকার প্রাপ্ত না হয়।

(৪) মানবিক মর্যাদার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষে কোনো তারতম্য নেই। নারীর যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনি অধিকারও রয়েছে, যা তার স্বভাব, মনোদৈহিক গঠন ও যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। নারী-পুরুষ প্রত্যেকের রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তবে ইসলামী শরীয়তের পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্বগুলোর ক্ষেত্রে তারা একে অন্যের পরিপূরক।

(৫) জীবনের সকল অঙ্গনে নারীর মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। বিভিন্ন পরিবেশে নারীর সঙ্গে যে নিপীড়নমূলক আচরণ প্রচলিত রয়েছে তা বন্ধ করতে হবে। যথা : পারিবারিক নির্যাতন, পতিতাবৃত্তি, অশ্লীল ছবি, যিনা-ব্যভিচার, নারীর  বাণিজ্যায়ন, যৌন নিপীড়ন ইত্যাদি, যা ঐ সকল সমাজে ব্যাপক আকারে দেখা যায়; যারা নারী মর্যাদার অবমাননা করে এবং শরীয়ত-প্রদত্ত অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করে। এসকল ঘৃণ্য বিষয়ের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।

(৬) নারীর ইতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে  প্রচারমাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করতে হবে। এবং মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনে নারীর ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। নারীর ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে এমন সকল শ্লোগান প্রতিহত করতে হবে।

(৭)  নারী ও অন্যসব দুর্বল শ্রেণীর উপর সব ধরনের নির্যাতন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষত মুসলিম নারীদের বিষয়ে যারা সর্বদা বিভিন্ন সশস্ত্র লড়াইয়ে, হানাদার শ্রেণীর আগ্রাসনে, দারিদ্র ও বিভিন্ন জাতির অর্থনৈতিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে।                                                                                                   

(৮) নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া ব্যাপক পর্যায়ে উন্নতি-অগ্রগতি সম্ভব নয় এবং সে উন্নতির ধারাবাহিকতাও বজায় রাখা সম্ভব নয়। সুতরাং বাইরের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক রীতিনীতি ও চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটানোর যাবতীয় অপতৎপরতা অবশ্যই প্রতিহত করতে  হবে। ইসলামের নারী বিষয়ক বিধান ও চিন্তাধারার বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার বিভিন্ন মহল থেকে চলছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ  করতে হবে।

(৯) মুসলিম নারীর ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার ক্ষেত্রে এবং হিজাব গ্রহণ করা ও সম্ভ্রম বজায় রাখাসহ যেকোনো ধর্মীয় নিদর্শন ধারণের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ জানাতে হবে।

(১০) নারীর শরীয়তসম্মত অধিকার এবং ইসলামী বিধানের দাবি পূরণার্থে সকল স্তরে নারীর শিক্ষাঙ্গন পুরুষের শিক্ষাঙ্গন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে।

(১১) উপরোক্ত প্রতিটি দফার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের মৌলিক উৎসগুলোই একমাত্র সূত্র বিবেচিত হবে।

বিষয়গুলো সামনে রেখে পর্যালোচনা করলে অস্পষ্ট থাকে না যে, নারী-উন্নয়ন নীতিমালা নামে যে বিষয়গুলো গোটা জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়ার আয়োজন চলছে এর একটি বিরাট অংশ বিশ্ব স্বীকৃত আলেমদের সম্মতিক্রমেই কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী। এ বিষয়ে যারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন এবং এদেশের নিষ্ঠাবান আলেম-উলামাকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে হেয়-প্রতিপন্ন করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা মূলত ইসলামী জীবন-দর্শন সম্পর্কেই বীতশ্রদ্ধ। তাদের কর্তব্য হল এভাবে মিথ্যাচারের আশ্রয় না নিয়ে খোলামেলা নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করা। এই সৎসাহস তারা অর্জন করবেন-এটুকুই কামনা।


 

 

advertisement