জুমাদাল আখিরাহ ১৪২৯   ||   জুন ২০০৮

হযরত কুছাম ইবনে আববাস রা. ও ইমাম বুখারী রহ.এর মাযারে কিছুক্ষণ

ইসহাক ওবায়দী

৮ অক্টোবর ১৯৮৬ঈ.। আজ তাশকন্দ থেকে আমাদের আসল জায়গা সমরকন্দে যাওয়ার কথা। বেলা ১১:২৫ মিনিটে  বিমান ডানা মেলল সমরকন্দের পথে। তাশকন্দ থেকে সমরকন্দের দূরত্ব ৩০০ কিলোমিটার। ১২:২৯ মিনিটে সমরকন্দে অবতরণ করি। একটু বলে রাখা দরকার যে, তাশকন্দ শহরটি হল সমতল ও পুরনো গাছ-গাছালিতে ভরা সুন্দর অট্টালিকার শহর। আর আমাদের সেমিনারের স্থল আজারবাইজানের রাজধানী বাকু হচ্ছে কিছুটা পাহাড়ী আর কিছুটা সাগর পাড়ে অবস্থিত একটি মনোরম শহর। বাকুকে অনেকটা গ্রীসের রাজধানী এথেন্সের মতো মনে হয়েছে আমার। উঁচু নিচু ভূমি ও সাগরতীর মিলিয়ে আমাদের বন্দরনগরীর কথা স্মরণ করা যায়। সমরকন্দ শহরও অনেক পুরাতন, তবে উঁচু প্রাসাদের সংখ্যা এখানে তুলনামূলক কম বললেই চলে। এখানে অধিকাংশ বাড়িঘর একতলা বিল্ডিং, উপরে টিনের ছাউনী। তবে সবকটা শহরই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, যেন ঝকঝক করছে।

সমরকন্দ এয়ারপোর্টে নেমেই বাসে সোজা চলে গেলাম শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হযরত ইমাম বুখারী রাহ.-এর মাযারে। সড়কপথে বোখারা ও তাশকন্দ যাওয়ার পথে কিছু দূর গিয়ে ডানে মোড় নিলেই সুদূর গ্রামের মধ্যে একটি গ্রামের নাম খারতং। বোখারার শাসকের ছেলেকে রাজপ্রাসাদে গিয়ে পড়াতে সম্মত না হওয়ায় শাসক হযরত ইমাম বোখারীর ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাই তিনি হিজরত করে সমরকন্দের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। খারতং আসার পর জানতে পারলেন যে, সমরকন্দের শাসকও তার ওপর অসন্তুষ্ট। তিনি তখন মহান আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে এই মুহূর্তে তাকে তার সান্নিধ্যে উঠিয়ে নেওয়ার জন্য দোয়া করেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়ে যায়। আর খারতঙ্গের মতো একটি পাড়া গাঁ হয়ে যায় বিশ্ব পর্যটকদের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। ইমাম বোখারী রাহ.-এর মাযার এই গ্রামকে ধন্য করেছে এবং বিশ্বের ইতিহাসে তার নামটি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে।

মাযারে গিয়ে আমি প্রথমে অযু-এস্তেঞ্জা সেরে নিলাম। তারপর মসজিদে গিয়ে দুই রাকাত নফল নামায পড়লাম। মরহুম হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ সাহেবও তাই করলেন। মাযারে গিয়ে আবেগ আর রাখতে পারলাম না। সারাটা জীবন যার নাম শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করছিলাম, আজ তারই মাযারের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। একপর্যায়ে মোনাজাতের মধ্যে কান্নার  শব্দ বেড়ে যায় এবং জোরে কাঁদতে থাকি। মিসবাহ সাহেব আরবীতে কবিতা আবৃত্তি করছিলেন আর কাঁদছিলেন, আমি তার দোয়ায় আমীন আমীন বলছিলাম।  আমাদের কান্নার মতো এভাবে হয়তো কাউকে কাঁদতে দেখেনি বলে টিভিক্যামেরা ও পত্র-পত্রিকার ক্যামেরাগুলো ইচ্ছামতো ছবি তুলছিল। আমাদের অবস্থা তখন এমন ছিল যে, এসবের দিকে নজর দেওয়ার মতো মন-মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। যোহরের আযান হলে সবাই মিলে জামাতে নামাজ আদায় করে দলবদ্ধভাবে সকলের সাথে আনুষ্ঠানিক যিয়ারতে শরীক হই। আমাদের এই দলে লিবিয়ার দাওয়াহ ব্যবস্থার প্রধান ড. আহমদ শরীফ ও কুয়েতের মন্ত্রী জনাব খালেদ সাত্তারও ছিলেন। মসজিদ সংলগ্ন ডান দিকেই মাযারটি অবস্থিত। মাযারের দুই পাশে লম্বা বিল্ডিং দেখতে মাদরাসার মতো দেখায়। তবে তা মাদরাসা নয়, লাইব্রেরি। পৃথিবীর অনেক দেশেরই ছাপানো কুরআন শরীফ এখানে রয়েছে। দেখলাম, ঢাকার এমদাদিয়া লাইব্রেরি কর্তৃক ছাপানো নূরানী কুরআন  শরীফও সেখানে আছে। আর আছে হযরত ইমাম বোখারী রাহ.-এর লেখা বিভিন্ন কিতাবপত্র।

শ্বেত পাথরে বেষ্টিত কবরের মাথার পাশে একটা লম্বা কালো পাথরের গায়ে আরবীতে ইমাম বোখারীর নসবনামা লেখা আছে। সাদাসিধা অথচ ভাবগম্ভীর পরিবেশে শুয়ে আছেন হাদীস শাস্ত্রের অবিস্মরণীয় ইমাম হযরত আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বোখারী রাহ.।

মসজিদের ইমাম সাহেবের নাম ওসমান ইবনে রহীমজান। মসজিদের দক্ষিণ পাশে গাছের নীচে বড় বড় চকিতে গদি বিছানো আছে। দেখতে অনেকটা গ্রাম্য খাটের মতো। এখানে এসে এক দল বসে পড়েছে। আরো দক্ষিণে গেটের পাশে মুসাফিরখানার বারান্দায় খাবার সাজানো হয়েছে। দুপুরের খাবার খেতে বসেছি, রুয বোখারীসহ কত রকমের খাবার যে পরিবেশন করা হল, তার হিসাব রাখা কঠিন । মসজিদের পশ্চিম দিকে নতুন করে মেহমানখানা তৈরি হচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অজু ও পেশাবখানা। আর পূর্ব দিকটায় দেয়াল দেয়া আছে। দেয়ালের ওপারে মেহমানের জন্য রান্নাবান্নার এন্তেজাম করা হয়। সেখানে গিয়ে দেখলাম, মা-মেয়ে দুই মহিলা সালোয়ার-কামিজ পরাবস্থায় রান্নাবান্নার কাজ আঞ্জাম দিচ্ছে। মসজিদের দক্ষিণে গাছের নিচে একটি ঝর্ণাও রয়েছে। মেহমানদের জন্য লেপ-তোষকসহ সব রকমের এন্তেজাম আছে। মাযার এলাকা ছাড়িয়ে প্রবেশপথের আশেপাশে বিরাট বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। মসজিদের দেয়ালে একটি হাদীস লেখা রয়েছে। হাদীসটি হচ্ছে-(অর্থাৎ) যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করে সে যেন তার মেহমানের সম্মান করে। মসজিদে লেখা হাদীসটি যেন পরবর্তী অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত বহন করছে। কেননা তার পরই খাবারের ব্যবস্থা শুরু হল।

পর্যটকদের জন্য এখানে কয়েকটি দোকানও বানানো হয়েছে। যাবার সময় রাস্তার দুপাশে গ্রামের অবস্থা যা দেখলাম, তা হল তুলা ও বিভিন্ন শস্যের ক্ষেতখামার আর মাঝে মধ্যে বাড়ি-ঘর। অধিকাংশ বাড়ির চার পাশে দেয়াল, ওপরে টিন দিয়ে দোচালা ঘর দেখতে পেলাম। সামনে একটা উঠোন, তারপর পায়খানা। বাড়িতে কারেন্টের বাতিও রয়েছে।

যিয়ারত শেষে সমরকন্দ শহরে এসে বহু তলা বিশিষ্ট আধুনিক হোটেল ট্যুরিজম এ উঠলাম। বিকেলে সবাই বামা শহর ঘুরে দেখার জন্য বের হল। সমরকন্দ শহরটি অনেক পুরনো শহর। পাহাড়ের উঁচু-নিচু মিলে আমাদের বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সাথে অনেকটা তুলনা করা যায়, তবে এখানে সাগর অথবা নদী নেই। তাশকন্দের মতো গাছগাছালিতে ভরা খুবই সুন্দর দেখতে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে ঝকঝকে তকতকে। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী উলুগ বেগের গবেষণার নিদর্শন স্বরূপ একটি পাহাড়ে অনেক কিছু করা হয়েছে দেখলাম। উলুগ বেগ ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত একজন নক্ষত্র বিজ্ঞানী। তাঁকে তাঁরই ছেলে হত্যা করে। সম্রাট তৈমুর লং ছিলেন উলুগ বেগের দাদা।

সমরকন্দ শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্ত্ত ছিল আমাদের কাছে শাহী যিন্দা নামে পরিচিত হযরত কুছাম ইবনে আববাস রা.-এর মাযার। তিনি ছিলেন আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আপন চাচা হযরত আববাস রা.-এর ছেলে। যতদূর জানা গেছে, ঐ অঞ্চলে ইসলামের প্রথম বাতি তিনিই প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন। রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত বড় বড় প্রদেশগুলোতে মুসলমানদের যে প্রাধান্য দেখা যায়, এটা হয়তো তাঁরই অবদান। একসময়ের ইসলামী গবেষণা ও ইসলামী চেতনায় বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী এসব এলাকার অবদানও হয়তো এই শাহী মিনারগুলো। তাঁর এন্তেকালের কথা শুনেই তাঁর ভাই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. পথিমধ্যে সাওয়ারী থেকে অবতরণ করে দুই রাকাত নামায পড়েছিলেন এবং বলেছিলেন, আল্লাহ যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই আমল করলাম। আল্লাহ বলেছেন- তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাও।

আমিও তাই করলাম।

শহরের মাঝখানে একটু উঁচুতে খানিকটা হেঁটে গেলেই যিন্দা শাহীর মাযার। পথে রাস্তার দুপাশে তৈমুর লং এর পারিবারিক কবর। তৈমুর লং হয়তো হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচাতো ভাই এই মহান সাহাবী হযরত কুছাম ইবনে আববাস রা. কে সামনে রেখে গোটা পরিবারকেই ধন্য করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, খোদ তৈমুরের কবর এখানে হয়নি। বরং শহরের অন্য জায়গায় তাঁরই ওসিয়ত অনুযায়ী তাঁর উস্তাদের পায়ের তলায় হয়েছে। অনেক আরবী লেখা সুসজ্জিত হয়ে আছে দেখলাম। তৈমুরের কবরের পাশে উলুগ বেগের কবর রয়েছে।

হযরত কুছাম ইবনে আববাস রা.-এর মাযারের পাশে একটি বিরান মসজিদ দেখলাম। বিরান দেখে তাতে দুই রাকাত নফল নামায পড়ে নিলাম। মাযারের পাশে গিয়ে আবারো কান্নাকে ধরে রাখতে পারলাম না। তিনি কত বড় সাহাবী, স্বয়ং হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচাতো ভাই। মাওলানা মিসবাহ সাহেব আমাদের সাথে বাসে বের হননি। তিনি পরে প্রাইভেটকারে করে সেখানে গিয়েছেন এবং আযান দিয়ে ঐ মসজিদে মাগরিবের নামায আদায় করেছেন। মাযার থেকে বের হলে পাশে আছে সুবিখ্যাত মুহাদ্দিস খাজা আহমাদ দায়লামীর মাযার। শহরের মধ্যস্থলে অনেক জায়গা জুড়ে পার্ক ও দেখার মতো কিছু বড় বড় দেয়াল ও ভবনের ভগ্নাংশ দেখানো হল। বলা হল, এখানে বড় বড় তিনটি মাদরাসা ছিল। একটির নাম মাদরাসা উলুগ বেগ। আরেকটার নাম মাদরাসা তেল্লাকারী। অন্যটির নাম মাদরাসা শেরদৌর। তিনটি মাদরাসাই এমনভাবে তৈরি ছিল যে, সব কটির প্রবেশপথ এক দিকে ছিল। অর্থাৎ সামনে খুব বড় ধরনের একটা উঠোন, যার এক পাশ মুক্ত আর বাকি তিন দিকে মাদরাসা।

এই হল সমরকন্দ। কবি হাফিয  যার সম্পর্কে লিখেছিলেন-

ভারতবর্ষের মেয়েদের গালে যে তিলক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে থাকে তার বিনিময়ে আমি সমরকন্দ এবং বোখারা রাজ্য দান করতেও প্রস্ত্তত আছি।

সমর অর্থ ফল আর কন্দ অর্থ হচ্ছে সুমিষ্ট। তাহলে অর্থ দাড়াল সুমিষ্ট ফল। আসলে তাই, আঙ্গুর, নাশপাতি, আনার ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে হয় সেখানে।

আজ একুশ বছর পর লেখাটি লিখতে গিয়ে মনে খুব আনন্দ অনুভব করছি এ জন্য যে, আজ আর সেই সমরকন্দ-বোখারা সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার অধীনে নেই। তারা এখন স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। #

 

 

advertisement