রজব ১৪২৯   ||   জুলাই ২০০৮

সং স্কৃ তি : চূড়ান্ত চারিত্রিক দুর্ঘটনা কীভাবে বন্ধ হবে

খসরূ খান

বরিশালে নারী ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং কারণ ও প্রতিকারের উপায় চিহ্নিত করে গত ১৭ জুন ঢাকার একটি দৈনিকে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত বছর প্রথম ৫ মাসে ধর্ষণের সংখ্যা যেখানে ছিল ৫৯টি এ বছর প্রথম ৫ মাসে সে সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯৭ টি। ফরেনসিক বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী ৯৭ টি ধর্ষণের খবর পাওয়া গেলেও বাস্তবে এর সংখ্যা অনেক বেশি বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সচেতন মহল। পারিবারিক ও সামাজিক সম্মানবোধের কথা চিন্তা করে অনেকেই এত বড় ঘটনা গোপন রাখারই চেষ্টা করেন। ধর্ষণ বিষয়ক এ রিপোর্টটির শিরোনাম করা হয়েছে-অপসংস্কৃতির কারণে বরিশালে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। রিপোর্টটির সমাপনী পর্বটি ছিল স্থানীয় একজন মানবাধিকার নেত্রীর বক্তব্য। ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, অপসংস্কৃতি আর সামাজিক অস্থিরতার কারণে যুব সমাজ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, দুর্বল আইনের কারণে অনেক অভিযুক্ত পার পেয়ে যাচ্ছেন। নৈতিক অবক্ষয় ও চূড়ান্ত চারিত্রিক দুর্ঘটনার বর্ণনায় ভারী হয়ে থাকা ওই রিপোর্টটি যে কোনো সুক্ষ্ম  চিন্তার অধিকারী মানুষকে বেদনাহত ও বিমর্ষ করে তুলবে। ওই রিপোর্টটি ভাবনা ও বিবেচনার যোগ্য কয়েকটি বিষয়কে জাগ্রত করে তুলেছে।

এক. ধর্ষণের সংখ্যা বা হার বেড়ে যাওয়ার এ ঘটনা কি গোটা দেশের মধ্যে কেবল বরিশাল জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? এক্ষেত্রে বরিশালের দুর্ঘটনার খবরটি ঘটনার চক্র নয়? এ ধরনের পিলে চমকানো ও হৃদয় কাঁপানো ঘটনা কি গোটা দেশের বিভিন্ন স্থানেই অহরহ ঘটে চলছে না? যে কোনো জেলার হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের দেওয়া এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা কি  বাস্তব ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি রকম কম নয়? তাহলে বছরের প্রথম পাঁচ মাসে একটি বিভাগীয় শহরের প্রধান একটি হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী এ রকম ঘটনার সংখ্যা যদি শখানেক হয় তাহলে গড় হিসেবে গোটা বছরে এর সংখ্যা প্রায় আড়াই শর মতো। দেশের উল্লেখযোগ্য বিশটি হাসপাতালে এ রকম ঘটনার রিপোর্ট তৈরি হয় সে হিসেবে প্রায় পাঁচ হাজার। এটি হয়েছে হাসপাতালের ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী আনুমানিক গড় সংখ্যা। বাস্তব ঘটনা যদি এর চেয়ে চারগুণ বেশি ঘটে থাকে তাহলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় বিশ হাজারের মতো। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলের একটি মুসলিমপ্রধান দেশে বছরে জোর জবরদস্তিমূলক চূড়ান্ত চারিত্রিক দুর্ঘটনা বা ধর্ষণের সংখ্যা যদি এত বিশাল হয়ে থাকে তাহলে এ দেশের অনৈতিকতা ও হিংস্র যৌনতার চিত্র, কুফল নিয়ে এখনই কার্যকর দুশ্চিন্তা শুরু করা উচিত সমাজ পরিচালকদের।

 

দুই. পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টটিতে যদিও গত ২০০৭ ও ২০০৮-এর প্রথম পাঁচ মাসের সংখ্যা তুলে ধরে গত বছরের তুলনায় এ বছরে এ ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি চিহ্নিত করা হয়েছে বাস্তবে এটিকে কি কেবল গত বছর আর এ বছরের বিষয় মনে করে নেওয়া ঠিক হবে? এটিকে কি অবক্ষয়িত একটি সমাজের ক্রমবর্ধমান অনৈতিকতা ও হিংস্রতার আলামত হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত নয়? নিঃসন্দেহে এটি একটি ভয়াবহ আতংকের পদধ্বনি।

 

তিন. অপসংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে এ কথাটির তাৎপর্য কী? ভাবনা ও বিবেচনারযোগ্য এই তৃতীয় বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।

অপসংস্কৃতির কারণে যদি ধর্ষণের হার বেড়ে থাকে তাহলে সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতির স্বরূপ নিয়েই নতুন করে ভাবা উচিত বলে মনে করা যেতে পারে। এর সঙ্গে আসে প্রচলিত বিনোদনের নানা মাত্রা ও উপায় অবলম্বনের কথাও। কারণ, গত পাঁচ মাসে বরিশালে ভিন্ন এমন কী অপসাংস্কৃতিক ঘটনা বিশেষভাবে ঘটেছে যার জন্য সেখানে ধর্ষণের হার বেড়ে গেছে? রিপোর্টটিতে যে মানবাধিকার নেত্রীর বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে তাকে একজন এডভোকেট হিসেবে পরিচিত করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বলা হয়নি, প্রচলিত সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতি কিংবা বিনোদন নিয়ে তার কোনো ভিন্ন চিন্তা আছে। এমনকি তিনি হুজুর বা ইসলামী ঘরানার কোনো ব্যক্তিত্ব বলেও বোঝা যায়নি। তাহলে তার কথাটিকে আমরা একটি বাস্তব উপলব্ধি হিসেবে গ্রহণ করে নিতে পারি! সে হিসেবে বলা যেতে পারে, বিচ্ছিন্নভাবে বরিশাল নয়, আমাদের দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই সংস্কৃতিবিনোদনের চিত্রটি ভালো ও সুস্থ নেই। বিশেষত ব্যাপক খোলামেলা ডিশ কালচারের বিষাক্ত ছোবলে তরুণপ্রজন্মের মাঝে চারিত্রিক দুর্ঘটনার মাত্রা বেড়ে গেছে। পশ্চিমা সমাজের কথা বাদ থাকুক দেশেরই উচ্চবিত্ত সমাজে চারিত্রিক দুর্ঘটনাগুলোর বেশিরভাগ ঘটে থাকে সমঝোতার ভিত্তিতে। সেখানে প্রেম কিংবা লেনদেন এর যে কোনো প্রক্রিয়া অবলম্বিত হয়। এবং ব্যাপকভাবে হয়। এধরনের দুর্ঘটনা মধ্যবিত্ত সমাজেও সমঝোতার ভিত্তিতে ঘটে থাকে। কিন্তু নিম্নবিত্ত বিপথগামী তারুণ্যের সামনে খোলামেলা নৃত্যগীত কিংবা দূষিত ছবি ও কালচার চোখ দিয়ে গলাধঃকরণ করার পর কান্ডজ্ঞানহীন হিংস্রতায় লিপ্ত হওয়ার বাসনা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এরপর কিছুটা অসহায়, কিছুটা অরক্ষিত, দরিদ্র নারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া তার রিপু তাকে স্বস্তি দেয় না। চূড়ান্ত চারিত্রিক দুর্ঘটনাগুলোর সংখ্যা এভাবেই বাড়তে থাকে। এটা বরিশালেও যা, চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকাতেও তা-ই।

সুতরাং ডিশ কালচার, সিডি-ভিসিডির নীল দংশন আর গান বাদ্যের খোলামেলা বিনোদনের মধ্য দিয়ে যে মরণমুখী অপসংস্কৃতির বিকাশ এখন দেশজুড়ে, কীভাবে তা নিয়ন্ত্রন করা যায়, কীভাবে ধর্ষণ ও যৌন হিংস্রতার বিষাক্ত থাবা থেকে দেশ, মানুষ, নারীকে বাঁচানো যায় সে ব্যাপারে সতর্ক, সচেতন ও তড়িৎ সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপ গ্রহণ এখন কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্ব। 

 

 

advertisement