রজব ১৪২৯   ||   জুলাই ২০০৮

পিতামাতার সঙ্গে উত্তম ব্যবহার

আবিদা

শৈশবে যে অভ্যাস তৈরি হয় বার্ধক্যেও তাই বহাল থাকে। তাই যদি প্রথম দিন থেকেই পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের শিক্ষা না দেওয়া হয় তাহলে পরে আর কোনো পন্থাই কার্যকর হয় না। নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় সমস্যা। পিতামাতার অবাধ্যতা ও তাঁদের সঙ্গে মন্দ আচরণ এমন কবীরা গুনাহ, যাকে আল্লাহ শিরকের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।

নানাজী তার কন্যাদের যেমন ভালোবাসতেন ও যত্ন নিতেন তেমন আর কোনো পিতাকে দেখিনি। এজন্য তাকে অনেক কষ্টও পোহাতে হত।

কনকনে শীতের রাতে ঘুম থেকে জেগে নিজ কক্ষ থেকে নেমে আসতেন। তিন তলায় ছিল তার শোবার ঘর। আর তার কন্যারা ঘুমাতেন নিচ তলায়। সে আমলে দামেশকের বাড়িগুলো এভাবে নির্মিত হত যে, উপর তলা থেকে নিচে নেমে আসতে অনেকটা খোলা জায়গা অতিক্রম করতে হত। প্রচন্ড শীতে, কখনো বা বৃষ্টির মধ্যে তিনি কন্যাদের দেখতে আসতেন এবং একে একে প্রত্যেকের গায়ে কম্বল-চাদর ঠিক করে দিতেন। কাউকে যদি দেখতেন সর্দি লেগেছে, কিংবা কাশিতে কষ্ট হচ্ছে, তাই সে ঘুমুতে পারছে না, তাহলে তাকে বসার ঘরে নিয়ে যেতেন এবং হিটার জ্বালিয়ে ঘর গরম করতেন। এরপর তার জন্য এক কাপ কফি তৈরি করতেন এবং কিছু ঔষধপত্র খাওয়াতেন। তার আরামবোধ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে সঙ্গ দিতেন এরপর তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজ কক্ষে ফিরে যেতেন।

আগেই বলেছি, কন্যাদের সম্পর্কে তার মতো এতখানি উদ্বিগ্ন হতে আমি আর কাউকে দেখিনি। কোনো সময় যদি তাদের কারো রাতে ঘুমাতে দেরি হয়ে যেত তাহলে পরদিন আর তাকে ক্লাসে যেতে দিতেন না। এতে যদি মেয়ের কষ্ট হয়ে যায়! যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে! এটা তার আশ্চর্য নিজস্বতা ছিল। প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষিকা যেহেতু এমন অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না তাই একদিন তার বিরক্তি প্রকাশই করে ফেললেন। আমার আম্মার হাত ধরে ক্লাসরূমে নিয়ে গেলেন এবং সমবেত ছাত্রীদের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, দেখ তো, এখানে কত ছাত্রী রয়েছে। শুধু তোমার আববুই কি তার কন্যাকে ভালোবাসেন আর এদের আববুরা এদেরকে ভালোবাসেন না?

বাস্তবিকই নানাজীর এই আচরণগুলো ছিল তাঁর নিজস্ব বিষয়। কন্যাদের শান্তি ও আরামের চিন্তা তার মধ্যে সর্বক্ষণ কাজ করত। রাতভর তাদের জন্য   চিন্তা-ভাবনা করতেন। তাদের সঙ্গে যদি কেউ মন্দ ব্যবহার করত তাহলে তাকে ভৎর্সনা করতেন। তাদের উপর কেউ বাহাদুরি করলে তিনি রাগান্বিত হয়ে যেতেন।

জ্ঞানী লোকেরা বলেন, কিছু কিছু মন্দ বিষয় শুভফল দান করে। এটা সত্য কথা। কন্যাদের সম্পর্কে তাঁর সজাগ-সচেতন দৃষ্টি এবং তাদের প্রতি অনুরাগ-ভালোবাসা তাকে অন্য আরেকটি বিষয়েও সংবেদনশীল করেছিল। তা এই যে, আমাদের (নাতী নাতনীদেরকে) তিনি সর্বদা মায়েদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে এবং তাদের অনুগত থাকতে নির্দেশ দিতেন। যখনই সুযোগ হত তিনি এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন।

এ বিষয়ে তাঁর নির্দেশনার একটি পদ্ধতি উল্লেখ করছি। অনেক সময় আমাদের ছোটদের মনে হত, মায়েরা সব সময় আমাদেরকে উপদেশ দান করেন, ধমক দেন, আমাদের ইচ্ছাগুলো পূরণ হতে দেন না-আমাদের উপর খুব জুলুম করা হচ্ছে। বড়দের কাছে আমাদের ইচ্ছাগুলোর কোনোই মূল্য নেই। যেমন প্রত্যেক শিশুই ভেবে থাকে। নানাজী আমাদের এই অভিযোগ ও অনুভুতি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলতেন, ঠিক বলেছ, তোমাদের জায়গায় আমি হলে আমারও এমনই লাগত। কেননা, তখন শুধু আমার নিজের ইচ্ছা ও অনিচ্ছাই আমার সামনে থাকত। আচ্ছা, এখন একটা কথা বলি, বিষয়টি আমাদের মায়েরা যেভাবে ভেবেছেন সেভাবে কি আমরা ভেবেছি? মায়েদের মতো করে ভাবলে কিন্তু আমাদের এই অভিযোগ আর থাকবে না। মায়েদের যে হক্ব ও অধিকার আমাদের উপর রয়েছে তা কি মনে রেখেছি?

এই কথাগুলো বারবার নানাজী আমাদেরকে বলতেন। সব সময় বলতেন এবং বিভিন্নভাবে বলতেন। কখনো হাদীস শরীফ শোনাতেন। কখনো তার নিজস্ব ঢংয়ে সাহাবীদের বিভিন্ন গল্প বলতেন। তাঁদের মায়েদের সঙ্গে তাঁদের আচরণ। আমরা যদি মায়েদের অবাধ্য হই তাহলে দুনিয়াতেই আমাদের উপর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে শাস্তি আসতে পারে- সে সম্পর্কে আমাদেরকে সাবধান করতেন। আর যদি বাধ্য অনুগত হয়ে চলি তাহলে দুনিয়াতেই এর সুফল লাভ করতে পারি- সে সম্পর্কে আমাদেরকে আগ্রহী করতেন। কেননা পিতামাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার সন্তানকে তার কর্মজীবনে সফল হতে সাহায্য করে, তার দুআ কবুল হয় এবং  তার সন্তানও তার বাধ্য ও অনুগত হয়।

 

তিনি আমাকে যে উপদেশপত্র দান করেছিলেন এবং সর্বদা স্মরণ রাখতে বলেছিলেন তার শেষ কথাটি এই ছিল যে, আমি যেন আম্মার বাধ্য ও অনুগত থাকি এবং তাঁর মর্যাদা ও হক্ব সম্পর্কে সচেতন থাকি।

 

তার কোনো নাতী বা নাতনীকে যদি দেখতেন, তাঁর মা কর্মব্যস্ত রয়েছেন আর সে তাঁর কোনো ধরনের সাহায্যে না এসে অলসভাবে বসে রয়েছে... কিংবা কেউ তাঁর মায়ের আদেশ ছাড়াই তাঁর চেয়ে উত্তম স্থানে বসেছে তাহলে খুব রাগান্বিত হতেন এবং তিরস্কার করতেন। তিনি আমাদেরকে আদেশ করতেন, আমরা যেন নাস্তার পর মায়েদের সম্মানে চা-কফি বানিয়ে উপস্থিত করি। আর রান্নাঘর গুছিয়ে নানাজীর ওই মজলিসে শামিল হই।

তিনি পসন্দ করতেন, আমরা প্রত্যেকে যেন স্বনির্ভর হই এবং যে কাজ নিজে করা সম্ভব তাতে অন্যকে কষ্ট না দেই। এজন্য তিনি খুব দ্রুত ব্যক্তিগত অপরিহার্য বিষয়গুলো শিখে নিতে উদ্বুদ্ধ করতেন। যেন এসবের কারণে আমাদের মায়েদের কষ্ট না পেতে হয়। ফলে আমরা ঘুম থেকে ওঠার জন্য নিজেরাই ঘড়িতে এলার্ম দিতাম। নিজেদের পোশাক নিজেরাই ইস্ত্রি করতাম, কাপড় রিফু করতাম এবং জুতা পালিশ করতাম।

নানাজী নিজেও তার মাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাঁর মধ্যে আমরা দেখেছি মাতৃভক্তির অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। যখনই তিনি তাঁর মায়ের কথা স্মরণ করতেন তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকত। এমনকি তাঁর মায়ের ইন্তেকালের পঞ্চাশ বছর পরও। ফলে আমারও মনে এই শঙ্কা সৃষ্টি হত যে, আমিও কি আমার মাকে হারাব আর তাঁকে কষ্ট দেওয়ার কথা মনে করে অশ্রুবিসর্জন দিব? এই ভাবনা আমাকে উদ্বুদ্ধ করল আম্মাজীর এমন অনুগত হতে যা তাঁকেও সন্তুষ্ট করে এবং আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে।

সম্মানিত পাঠক! আজকাল       সন্তানের অবাধ্যতা ও অসৎ ব্যবহারের অভিযোগ খুব বেশি শোনা যায়। পিতা-মাতা তাদের এই ব্যাধি নিরাময়ের কোনো উপায় খুজে পাচ্ছেন না। কেননা, শৈশবে যে অভ্যাস তৈরি হয় বার্ধক্যেও তাই বহাল থাকে। তাই যদি প্রথম দিন থেকেই পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের শিক্ষা না দেওয়া হয় তাহলে পরে আর কোনো পন্থাই কার্যকর হয় না। নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় সমস্যা। পিতামাতার অবাধ্যতা ও তাঁদের সঙ্গে মন্দ আচরণ এমন কবীরা গুনাহ, যাকে আল্লাহ শিরকের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। এজন্য নানাজী শৈশব থেকেই আমাদের তরবিয়ত করেছেন। 

 

 

advertisement