রজব ১৪২৯   ||   জুলাই ২০০৮

মেরী ‘ইলমী ও মুতালা‘আতী যিন্দেগী

মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী

মাশায়েখ ও বুযুর্গানের মালফুযাত ও বাণী-সংকলনেও চোখ বুলানোর সুযোগ হয়েছে। চিশতী সিলসিলার বুযুর্গদের মধ্যে মাহবুবে ইলাহী  হযরত খাজা নিযামুদ্দীন আওলিয়া-এর মালফুযাত ফাওয়াইদুল ফুয়াদ এবং নকশবন্দী সিলসিলার বুযুর্গদের মধ্যে হযরত শাহ গোলাম আলী রাহ.-এর মালফুযাত দুররুল মাআরিফ অন্তরকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। যদিও আমার হাদীস শরীফ অধ্যয়ন ও একটি বিশেষ চিন্তাগত তরবিয়ত ও মুতালাআর ফলে কিছু কিছু বিষয়ে আদবের সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলাম তবে বুযুর্গানে দ্বীনের বিভিন্ন ঘটনা, স্বতোৎসারিত বাক্যরাজি এবং নিঃস্বার্থ হৃদয়ের উত্তাপ ও বিনম্রতা  সর্বদা অনুভব করেছি।

তাসাউফ-দর্শন ও চরিত্র-দর্শনের যে তাত্ত্বিক বিষয়গুলো পরবর্তী সুফীদের রচনাবলিতে পাওয়া যায়, তা দিল-দেমাগকে কখনো প্রভাবিত করেনি। তবে দরদ ও মুহাববত এবং জ্বালা ও অন্তর্জ্বালায় পরিপূর্ণ বাক্যসুধা কখনো ক্রিয়াহীন থাকে না। এই তীর খুব কমই লক্ষ্যচ্যুত হয়। তাই দরদ ও মুহাববতের উত্তপ্ত পংক্তিগুলো দিল-দেমাগে অঙ্কিত হয়ে যেত।

ہم نے اپنے آ‎شیانہ کے لئے + جو چبھے دل میں وہی تنکے لئے

বুযুর্গানে দ্বীনের এই মাজালিস ও মালফুযাত প্রসঙ্গে সন-তারিখের ধারাবাহিকতা ছাড়াই একটি বিষয় আলোচনা না করে অগ্রসর হতে পারছি না। অনেক দিন পর হযরত মাওলানা শাহ ইয়াকুব ছাহেব মুজাদ্দেদী ভূপালী-এর মজলিসে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল এবং তাঁর কৃপা ও সুদৃষ্টি লাভে ধন্য হয়েছিলাম। সে সময় তাঁর যবান থেকে ধর্মীয় তত্ত্ব ও বর্ণনা এবং তাসাউফের নিগুঢ় আলোচনা শুনে বিস্মিত হয়েছি। আল্লাহ তাআলা তাঁর মালফুযাতমাজালিস লিপিবদ্ধ করারও তাওফীক দান করেছেন। আমার মনে হয়, কোনো রকম অতিরঞ্জন ছাড়াই এ কথা বলতে পারি যে, ইহসান ও দ্বীনী তত্ত্বজ্ঞানের এরূপ গভীর ও মূল্যবান বাণী বহুদিন পর্যন্ত শ্রুতিগোচর হয়নি।

والغيب عند الله

ছাত্র জীবনের সমাপ্তির কিছু আগে রায়বেরেলী জেলার এক উর্বর অঞ্চল ছালূন যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে দুটি কুতুবখানা দেখেছি। একটি সচল ও সবাক, অন্যটি স্থির ও নির্বাক। সবাক কুতুবখানা হল মাওলানা শাহ হালীম আতা ছাহেব। আর নির্বাক কুতুবখানা হল তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ। শাহ ছাহেবের সহযোগিতায় হাফেয ইবনুল জাওযী, হাফেয ইবনে তাইমিয়া, হাফেয ইবনুল কাইয়েম, হাফেয ইবনে রজব  ও ইবনে আবদুল হাদী প্রমুখের কিছু কিতাব দেখি। এরপর বাড়ি ফিরে ইরাকী রাহ-এর তাখরীজ সম্বলিত ইহইয়াউল উলূম, ফযলু ইলমিস সালাফি আলাল খালাফ, দাফাইনুল কুনুয, তালবীছে ইবলীস, মুখতাসারু মিনহাজিল কাসিদীন ইত্যাদি কিতাব সংগ্রহ করি। তালবীছে ইবলীস অধ্যয়নে পর্যালোচনামূলক মানসিকতা তৈরি হয়।

আমার সর্বশেষ মুহসিন কিতাবগুলোর আলোচনার আগে এ পর্যায়ে আমি সন-তারিখের ধারাবাহিকতা ছাড়া এমন কিছু কিতাবের  কথা বলব, যেগুলো কোনো বিশেষ দিক থেকে দিল-দেমাগে প্রভাব ফেলেছে এবং উল্লেখযোগ্য কোনো ইলমী সুফল প্রদান করেছে অথবা চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন সাধন করেছে।

আগেও বলেছি, পাঠ্যসূচি ও পাঠদান পদ্ধতি বিষয়ে সংশোধিত ও নতুন চিন্তা-ভাবনার বীজ রোপিত হয়েছিল শায়খ খলীল আরব ও শায়খ তকীউদ্দীন হেলালী-এর মাজালিসে দরস থেকে। এরপর দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার পরিবেশ ও রচনা-সম্ভার এই চিন্তাধারায় জল-সিঞ্চন করেছে। নদওয়াতুল উলামার স্বপ্ন, দ্বীন ও দুনিয়ার সহাবস্থান এবং সমাজ পরিচালনায় উলামা ও দ্বীনদার শ্রেণীর নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গভীরভাবে অনুভব করেছিলাম নওয়াব সদর ইয়ার জঙ্গ  মাওলানা  হাবীবুর রহমান খান শেরওয়ানী রাহ.-এর একটি ভাষণ থেকে, যা তিনি ১৯২৪ হিজরীতে দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা সম্মেলনে পাঠ করেছিলেন। পরে তা মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হলে আমি আবারো অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে তা পাঠ করি। এরপর অধ্যয়নের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পায়। আর এই দুটি বিষয় আমার ইলমী চিন্তা ও দর্শনের অঙ্গীভূত হয়ে যায়।

পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও জীবন-ব্যবস্থা সম্পর্কে অশ্রদ্ধা ও অভক্তি মূলত সৃষ্টি হয়েছে বড় ভাইজান ড. হাকীম সাইয়েদ আবদুল আলী ছাহেব মরহুম, (বি.এস.সি, এম.বি.বি.এস)-এর সাহচর্য ও মজলিস থেকে। এ সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল। পাশ্চাত্য-শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও এ শিক্ষার কঠোর নিন্দা ও সমালোচনা তিনি করতেন। আর এটা শুধু তার মৌখিক সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না তার আপাদমস্তক প্রাচীন ইসলামী তাহযীবেরই বিজয় ঘোষণা করত আর পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও পরিবেশের পরাজয়।

এই ঘৃণা এতদিন ছিল অনুভূতিমূলক, মাওলানা আবদুল মাজেদ ছাহেব দরিয়াবাদী রাহ-এর সাময়িকী ছাচছিদ্ক একে দৃঢ়মূল ও যুক্তিভিত্তিক বানিয়ে দেয়।

পাশ্চাত্য-সভ্যতার ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে এবং দ্বীনহীনতা ও বস্ত্তবাদিতার এই বিপুল বিকাশের মূল কারণগুলো অনুধাবনের ক্ষেত্রে প্রচুর তথ্য ও সাহায্য পেয়েছি ড্রেপারের প্রাচীন রচনা মারেকা তাহযীব ও সায়েন্স (অনুবাদে মাওলানা যফর আলী খান মারহুম) এবং লেকীর তারীখে আখলাকে ইউরোপ (অনুবাদে মাওলানা আবদুল মাজেদ ছাহেব দরয়াবাদী) থেকে। এগুলো পরে আমার রচনা ও আলোচনায় অনেক কাজ দিয়েছে।

পাশ্চাত্য-সভ্যতার চেহারা-ছবি ও তার চারিত্রিক ত্রুটিগুলো সম্পর্কে এবং ইসলামী সভ্যতার সঙ্গে তার মৌলিক বিরোধ আর এই দুয়ের সহাবস্থানের অসম্ভবতা সম্পর্কে সবচেয়ে পরিষ্কার ও সারগর্ভ রচনা, আমার কাছে মনে হয়েছে, মুহাম্মদ আসাদ-Islam at the Crossroads কে। রচনাটির প্রতিটি ছত্র হৃদয়ে প্রবেশ করে। বহু দিন পর তার হৃদয়গ্রাহী ও চিন্তাজাগানিয়া দ্বিতীয় গ্রন্থ-Road to Mecca-প্রকাশিত হয়। এর আরবী তরজমা-আতত্বরীক ইলা মাক্কাহ- তিনি আমাকে অনুগ্রহ করে পাঠিয়েছিলেন। যে ভাবনা প্রথমোক্ত গ্রন্থে অনুভুতির বীজ আকারে ছিল শেষোক্ত গ্রন্থে তা অঙ্কুরিত ও পল্লবিত হয়ে ছায়া বিস্তার করেছিল । আমি তার  অনুমতিক্রমে এর সারাৎসার তরজমা তূফান ছে ছাহেল তক নামে প্রকাশ করি। পুস্তকটি প্রত্যেক সত্যান্বেষী ও রুচিশীল পাঠকের পড়ার বস্ত্ত।

১৯৩৮-৩৯ ঈসাব্দে মিসরী লেখক ড. আহমদ আমীন-এর ফজরুল ইসলাম (খ : ১) ও যুহাল ইসলাম (খ : ৩) পড়ার সুযোগ হয়েছিল। এটা হল নবীযুগ এবং উমাইয়া ও আববাসী শাসনামলের চিন্তা ও সাহিত্য এবং রাজনীতি ও নৈতিকতার ইতিহাস। গ্রন্থ দুটি রচয়িতার বিচার-বিশ্লেষণের উত্তম সাক্ষর বহন করে। যদিও তার রচনা আধুনিক ও পাশ্চাত্য        চিন্তাধারার প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয় এবং তা হাদীস শরীফের ব্যাপারে পাঠকের মনে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করে-এমনকি হাদীস শরীফের কিছু কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বের ব্যাপারেও ভক্তি ও শ্রদ্ধা দুর্বল করে দেয় অথচ তা একজন মুসলিমের অন্তরে থাকা চাই, যদিও এই কুফলগুলো তাতে রয়েছে কিন্তু আমার সরলতা বলুন কিংবা পর্যবেক্ষণের দুর্বলতা, রচনার এই ত্রুটিগুলোর পূর্ণ অনুভুতি ওই সময় আমার হয়নি। এ বিষয়ে সঠিক অনুভুতি ও অবগতি তখনই হল এবং আমি মর্মাহত হলাম যখন ড. শায়খ মুস্তফা আস সিবায়ী-এর গ্রন্থ আসসুন্নাতু ওয়া মাকানাতুহা ফিত তাশরীয়িল ইসলামী পড়ি। হাদীসের প্রত্যেক তালিবে ইলমের জন্য এ গ্রন্থ অধ্যয়নের সুপারিশ করছি। এ সত্ত্বেও বিভিন্ন বিষয়ে ড. আহমদ আমীনের সঙ্গে চিন্তাধারার অভিন্নতা লক্ষ করেছি। কিছু জায়গায় টীকায় মত বা দ্বিমত প্রকাশ করেছি। কিংবা লেখককে বাহবা দিয়েছি। তবে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছি তার কোমল-সুমিষ্ট ভাষা ও রচনার আলিমসুলভ মার্জিত আঙ্গিক থেকে। এ বিষয়ে সমসাময়িকদের মধ্যে আহমদ আমীনের বিশিষ্টতা ছিল।

মাওলানা আবুল কালাম আযাদ রচিত তাযকিরা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও মুহাদ্দিসীনের ভঙ্গি-শ্রদ্ধা দিলদেমাগে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাযকিরাআলহেলাল-এর ভাষার যাদু মন-মগজকে আচ্ছন্ন করেছিল। তরজমাতুল কুরআন-এর দ্বিতীয় খন্ড থেকে তাফসীর ও কুরআন-চিন্তার কিছু নতুন দিক সামনে আসে এবং চিন্তার প্রশস্ততা লাভ হয়। সূরা ইউসুফ সম্পর্কে তার লেখা শুধু কুরআনী তত্ত্ব-জ্ঞানেরই সুন্দর দৃষ্টান্ত নয়, সাহিত্যেরও জীবন্ত সজীব নমুনা।

যখন দারুল উলূমে তরজমায়ে কুরআন ও তাফসীর পাঠদানের দায়িত্ব অর্পিত হল তখন মাওলানা শাববীর আহমদ উছমানী রাহ-এর তাফসীরের মাহাত্ম্য বুঝে আসে। এতে তিনি মুফাসসিরীনের বক্তব্যের সারাৎসার এবং তাদের চিন্তা-গবেষণার ওই অংশ পেশ করে দিয়েছেন যা এ যুগের শুদ্ধ মস্তিষ্ক খুব সহজেই গ্রহণ করে। এতে মাওলানার সুচিন্তা, সুনির্বাচন ও রচনার সুমিষ্টতার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। আমি দেওবন্দের এক সাক্ষাতে মাওলানাকে আমার এ অনুভুতি জানিয়েছিলাম। তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন এবং অন্যদের কাছেও তা নকল করেছিলেন। 

 

 

advertisement