রজব ১৪২৯   ||   জুলাই ২০০৮

একজন ব্যতিক্রমী আলেম-অনুরাগী ধনাঢ্য ব্যক্তির মৃত্যু

ইসহাক ওবায়দী

জনাব আলহাজ আব্দুল ওয়াদুদ খান তার সময়ের একজন প্রসিদ্ধ দানশীল ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। খেদমতে দ্বীনের জযবা এবং ওলামায়ে কেরামের মহববত ছিল তার জীবনের অনুষঙ্গ। তার মধ্যে এমন অনেক গুণ ছিল যা কমপক্ষে প্রত্যেক যুগের বিত্তবানদের জন্য অনুসরণীয়। এবং এ বিষয়টাই আলকাউসারের পাতায় তার ব্যাপারে কলাম লেখার মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে।

তার সদকায়ে জারিয়ার অন্যতম হল, তার গ্রামের মাদ্রাসাটি, যা তিনি তৎকালীন সময়ের আকাবেরে আহলে ইলমের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অর্থাৎ খেড়িহর মাদ্রাসা। দীর্ঘ দিন যাবত আমার শ্রদ্ধেয় ওয়ালিদ ছাহেব (দা.বা.) ঐ মাদ্রাসার মোহতামিমের পদে অধিষ্ঠিত আছেন। আমি ঐ মাদ্রাসা ইবতেদায়ী জামাত থেকে মেশকাত পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। আমার মুহতারাম বড় ভাইও সেখানে কয়েক বছর লেখাপড়া করেছেন।

মরহুম খান সাহেবের ওয়ারিশগণ ও তার শুভাকাঙ্খীগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, তার জীবনী নিয়ে বিস্তৃত আকারে একটি স্মারকগ্রন্থ সংকলন করবেন। এখানে সংক্ষিপ্তাকারে প্রাথমিক কিছু কথা পেশ করা হল মাত্র। ইনশাআল্লাহ আমি আমার স্মৃতিচারণ বিস্তারিতভাবে উক্ত স্মারকগ্রন্থের জন্য লিখিত প্রবন্ধে উল্লেখ করব। এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় শুধু দুটি কথা আরজ করতে চাই।

এই ঘটনা আমি আমার ওয়ালিদ ছাহেব (দা.বা.)-এর কাছ থেকে নিশ্চিত হয়েছি যে, একবার হাজী সাহেব স্বপ্নে দেখেন যে, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-খোলাফায়ে রাশেদীনসহ খেড়িহর মাদরাসায়-মাদরাসার উত্তর দিক দিয়ে তাশরীফ এনেছেন এবং দক্ষিণ দিকে পুকুরের কাছাকাছি গিয়ে কিছুক্ষণ অবস্থান করেছেন। যেখানে এখন মাদরাসার পশ্চিমের দালানের শেষ সীমানা। মাদরাসার হাম্মামখানা উত্তর দিকে বানানোর সিদ্ধন্ত ছিল কিন্তু এরপর হাজী সাহেব একদিন বললেন, এটা হতে পারে না। কেননা, এদিক দিয়ে তো রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ এনেছিলেন। এজন্য তিনি মাদরাসার অন্যপাশের জমি দ্বিগুণ দামে খরিদ করে সেখানে হাম্মামখানা তৈরি করেন। উত্তর দিকে বর্তমানে হেফজ খানা ও মেহমানখানার অবস্থান।

একবার মাদরাসার পুকুর থেকে মাছ ধরা হচ্ছিল। আমার সামনের ঘটনা। একটি মাছ তার বাড়িতে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় কিন্তু তিনি তাতে রাজী হচ্ছিলেন না। পরবর্তীতে পাল্লাপাথর দিয়ে মেপে মূল্য নির্ধারণ করা হলে তিনি সেই মাছ গ্রহণ করতে রাজি হন।

আসলে আল্লাহর রাস্তার জন্য খরচ এমনিই হওয়া উচিত যে, শতকরা একশ ভাগ আখেরাতের জন্যই রাখা হবে। দুনিয়াতে কোনো আকারেই এর ন্যূনতম বদলা গ্রহণ করার ফিকির করা হবে না।

মারকাযুদ দাওয়াহর সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক এই ছিল যে, যখন মুহাম্মদপুরে মুহাম্মদী হাউজিংয়ে মারকাযের ইজারাকৃত ভবনের মেয়াদ শেষ হয়ে এল তখন অন্য বাড়ি পেতে বিলম্ব হচ্ছিল। ঘটনাক্রমে ঐ সময়ে তেজগাঁওয়ের পূর্ব তেজতুরী পাড়ার বাজারে অবস্থিততার ৬ তলা ভবনের উপর তলা খালি পড়ে ছিল। তিনি আনন্দ চিত্তে মারকাযুদ দাওয়াহকে সেখানে সাময়িকভাবে স্থানান্তরিত করার অনুরোধ জানান। ছয় মাস পর্যন্ত মারকায সেখানেই অবস্থান করে। হাজী সাহেবের জীবনী থেকে যেমন শেখার অনেক কিছু আছে তেমনি ইবরত হাসিল করারও অনেক কিছু আছে।  মনে রাখার মতো একটি কথা এই যে, ওলামায়ে কেরামের মুহাববতের পাশাপাশি চিন্তা ও কর্মের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য খেদমতের সাথে সাথে তাদের সোহবত-সান্নিধ্যে থাকাও জরুরি।

হাজী সাহেব সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন খতীবে আযম হযরত মাওলানা সিদ্দীক আহমদ রাহ.-এর মাধ্যমে। তিনি ছাড়াও মাওলানা নুরুল্লাহ সাহেব নোয়াখালী এবং  আপন চাচা মাওলানা কালিমুল্লাহ সাহেবের উদ্ধৃতি বেশি দিতেন  ওই দুইজনই ছিলেন হযরত শাহ ছাহেব রাহ.-এর শাগরেদ। আল্লাহ তাআলা হাজী সাহেবের ত্রুটি বিচ্যুতি ক্ষমা করুন এবং তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসে স্থান দিন। তার পরিবার-পরিজনকে সবরে জামীলের তাওফীক দান করুন। তার সদকায়ে জারিয়া সমূহকে কেয়ামত পর্যন্ত চালু রাখুন। আমীন। # তত্ত্বাবধায়ক

একজন বিশিষ্ট সাহাবী তাঁর প্রতি হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর-যত্ন ও ভালোবাসার আধিক্য দেখে মনে করে বসলেন যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনে হয় তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। তাঁর এই ধারণা কতদূর সঠিক, তা যাচাই করার উদ্দেশ্যে একদিন তিনি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, হুজুর সবচেয়ে বেশি কাকে ভালোবাসেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, আয়েশাকে। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, পুরুষদের মধ্যে কাকে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবু বকরকে। আবারো প্রশ্ন করলেন, হুজুর! তারপর কাকে? হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, ওমরকে। সাহাবী আবারো প্রশ্ন করায় এবার হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো কয়েকজনের নাম বললেন। এই কজনের মধ্যে যখন উক্ত সাহাবী নিজের নামটি পেলেন না তখন তিনি ভয়ে আর প্রশ্নই করলেন না যে, না জানি হুজুরের ভালোবাসার তালিকায় তাঁর নামটি কোথায় গিয়ে ঠেকে!

প্রতিটি মানুষের প্রতিই হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যবহার ও ভালোবাসা এমন পর্যায়ের ছিল যে, প্রত্যেকেই মনে করে বসত, আমাকেই হুজুর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। এই ছিল নববী আখলাক। এই নববী আখলাকে ধন্য একজন ব্যতিক্রমী আলেম-দোস্ত, ধনাঢ্য ব্যক্তির সাথে আমার অনেক মধুর সম্পর্ক থাকায় আমিও নিজেকে ধন্য বলে মনে করি। তাঁর ব্যবহার এমন ছিল যে, একজন অপরিচিত আগন্তুক ব্যক্তিও ভাবতে শুরু করত, তিনি আমাকেই মনে হয় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। উচ্ছল হাসি-ঠাট্টা ও গভীর জ্ঞানের আলোচনা সবই ঐ ব্যক্তির সাথে করতেন এবং দস্তরখানের আপ্যায়ন থেকে নিয়ে মুখপ্রদ সব রকমের আপ্যায়নই তিনি ঐ অপরিচিত ব্যক্তিটির সাথে করতেন। ফলে ঐ আগন্তুক জীবনের তরে তাঁর খুব কাছের লোক হয়ে যেত। টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত ও বাড়ি-গাড়ির এতসব ঐশ্বর্যের মাঝে প্রতিপালিত একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি যখন একজন সাধারণ ব্যক্তির সাথে এই ব্যবহার ও আচরণ করে তখন ঐ ব্যক্তিটি জীবনে কখনো আর তাঁকে ভুলে থাকার সুযোগ পায় না। তার সুখে-দুঃখে জীবনের প্রতিটি বাঁকে এই মহান ব্যক্তিটির কাছে আসতে পারা ও তাঁর সাথে পরামর্শ করাকে নিজের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় মনে করে। আমি নিজে এ ধরনের বহু ঘটনাই স্বচক্ষে দেখেছি। ফলে তাঁর কাছে আমিই প্রথম প্রিয় ব্যক্তি বা ভালোবাসার পাত্র নই।

ঢাকা ধানমন্ডির পুরাতন ২২ নাম্বার রোডে পাশাপাশি অবস্থিত দুইটি বাড়ির মালিক আলহাজ্ব আবদুল ওয়াদুদ খান সম্পর্কেই আলোচনা করছি। যিনি এ.ডব্লিউ খান নামেই সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন। প্রাইমারি স্কুল ও মাদরাসা দুয়ে মিলে মাত্র দুই-তিন ক্লাশ বা জামাত পড়ার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। এরপরেই তাঁকে নামতে হয়েছে কঠিন জীবন সংগ্রামে। চাঁদপুর-শাহরাস্তির সাবেক এম.পি. প্রায় ২৯ বার  হজ্ব-ওমরাকারী এই মহান ব্যক্তিটি খুব নিচু অবস্থান থেকে এত ওপরের তলায় নিজের স্থানটি পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসা ও পটিয়া মাদরাসাসহ এমন বড় মাদরাসা মনে হয় খুব কমই আছে, যেখানে তাঁর অনুদান পৌঁছেনি। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামা-মাশায়েখও এমন খুব কমই পাওয়া যাবে, যাদের খেদমত করে তিনি ধন্য হননি। কত আলেমকে যে তিনি হজ্ব বা ওমরা করিয়েছেন তার সঠিক হিসাব কারো জানা নেই। মরহুম খানের একজন অত্যন্ত প্রিয়ভাজন আলেমে দ্বীন এই সেদিন আমাকে বললেন, তাকেই শুধু তিনি তিন-চার বার হজ্ব করিয়েছেন। তিনিই আমাকে বললেন, খান সাহেবের জীবনে হজ্ব ও ওমরা

মিলে প্রায় ২৯ বার গমন হয়েছে পবিত্র মক্কা-মদীনায়। এত বারের সফরের কোনো একটি সফরও মনে হয় তিনি একা করেননি। কোনো বড় বুযুর্গ আলেমকে অথবা বৌ-বাচ্চাদের কাউকে অথবা আমার মতো গরীব কোনো আলেমকে নিয়েই তিনি এসকল সফর করতেন। এত ব্যয়বহুল সফরগুলোর সমস্ত খরচই তিনি বহন করতেন।

এক রমযানে আমি তাঁকে একটু ভৎর্সনার সুরে বললাম, এতগুলো টাকা খরচ করে নফল হজ্বে যাওয়ার যুক্তি কোথায়? টাকাগুলো অভাবী গরীব-মিসকীনদেরকে দিয়ে দিলেই তো ভালো হয়। তিনি করুণভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, রমযান ও হজ্বের মৌসুম আসলে আমার মনের অবস্থা যে কেমন হয়, তা কাউকে ভাষায় বোঝানো যাবে না।

আমার পবিত্র হজ্বের সিংহ ভাগ খরচই তিনি বহন করেছিলেন। পৃথিবীতে আমার মুহসিনের সংখ্যা অনেক, কিন্তু এত বড় এহসান, হারামাইন শরীফের যিয়ারতের ব্যবস্থা করে দেয়া কজন করতে পারে? মহান আল্লাহ তাঁকে উত্তম জাযা দান করুন।

তিনি আল্লাহ ও রাসূলের এমন আশেক ছিলেন যে, হজ্ব ও ওমরার সময় পাগলপারা হয়ে ছুটে যেতেন পবিত্র ভূমি মক্কা-মদীনার পানে। তিনি সর্ববিষয়ের আলোচনায়ই পারঙ্গম ছিলেন। তবে আল্লাহ ও রাসূলের আলোচনার সময় তাঁর মুখ ও অন্তর থেকে প্রেমের যে সুধা ঝরতো তা সব  শ্রোতারই হৃদয়-অন্তরকে শীতল করার মতো ছিল।

তাঁর মধুঝরা প্রেমের এসব আলোচনা তন-মন দিয়েই সকলে শুনত ও অনুভব করত।

তিনি মহান দানবীর ছিলেন। যাকাত যে বছর ফরজ হত না তখনো দেখতাম, রমযানের ২১ তারিখ থেকে ২৬ শে রমযান পর্যন্ত বাড়ির ভেতরে অবস্থিত তাঁর মসজিদটিতে ব্রিফকেইস নিয়ে বসতেন। শত শত মাদরাসা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসে লাইন দিয়ে একের পর এক খাতা খুলে টাকা নিয়ে যেত। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত অবস্থিত বহু মাদরাসা তাঁর অনুদান দুহাতে গ্রহণ করত। তিনি আবার খুব সুশৃঙ্খল ছিলেন। এ ব্যাপারে সময়ের খুব পাবন্দী করতেন। মাদরাসার রেকর্ড দেখার কাজ একজন করত আর টাকাটা তিনি নিজে দিয়ে রেকর্ড খাতায় দস্তখত করে দিতেন। অনেককে আবার ইফতারের দাওয়াত দিতেন। আছরের পর থেকে ইফতারের এন্তেজাম চলত। এত এত খাদেম-খোদামার সহযোগিতা সত্ত্বেও ইফতারির ব্যবস্থাপনায় তিনি নিজেই সব কাজ করতেন। ইফতারের সময় বিশেষ বিশেষ খাবার নিজ হাতে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গকে আবার বন্টন করতে দেখা যেত। মেহমানদারীর মাধ্যমে তিনি কী আনন্দ পেতেন তা স্বচক্ষে কেউ না দেখলে লেখার ভাষায় তা প্রকাশ করা কখনো সম্ভব নয়।

খান সাহেবের একাডেমিক কোনো সনদ না থাকলেও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান তাঁর ছিল। ধর্মনীতি, রাজনীতি থেকে নিয়ে যাবতীয় জ্ঞান তাঁর আত্মস্থ ছিল। স্মরণ শক্তি এত প্রখর ছিল যে, যখন কোনো বিষয়ে কোনো বক্তব্য শুনতেন তা জীবনের জন্য তাঁর মনে গাঁথা হয়ে যেত।

বহু বছর আগে ফখরে বাঙ্গাল হযরত মাওলানা তাজুল ইসলাম রাহ.কর্তৃক কাওরান বাজার মসজিদে অনুষ্ঠিত নিয়মিত তাফসীর মাহফিল বন্ধ হওয়ার পর অধম লেখক এবং বুযুর্গ আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা আবদুস সাত্তার সাহেব ও খান সাহেবের প্রচেষ্টায় হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ সাহেবকে দিয়ে আবার অনুষ্ঠানটি চালু করা হয়েছিল। কয়েক মসজিদ হয়ে শেষ পর্যন্ত সাত রাস্তার মোড়ে অবস্থিত ডি.এল.আর মসজিদে প্রতি ইংরেজি মাসের প্রথম শুক্রবারে এই মাহফিলটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। প্রথম থেকে ধারাবাহিকভাবে তাফসীর হতে হতে ২০-২২ পারা পর্যন্ত সমাপ্ত হবার পর মাওলানা মিসবাহ সাহেব অসুস্থ হয়ে গেলে তাঁরই পরামর্শে মুফতী দেলাওয়ার হুসাইন সাহেব তা সমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন বলে শুনেছিলাম। কিন্তু আসল উদ্যোক্তা খান সাহেব অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাও নাকি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

ঐ তাফসীর মাহফিলটি চলার দিন আমাদের নিয়ম ছিল, তাফসীর শেষে খান সাহেবের ধানমন্ডির বাসায় রাত্রি যাপন করা। প্রতি মাসের সেই রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর খান সাহেবের এসি হলরুমে আরেকটি মজলিস বসত জমজমাটভাবে। অনেক রাত পর্যন্ত ঐ আসর চলতে থাকত। ঐ মজলিসে দ্বীনের বিভিন্ন আলোচনা, বুযুর্গ-মনীষীদের আলোচনা, আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক সব ধরনের আলোচনাই জমে উঠত। তখন দেখতাম, এই উম্মী ব্যক্তিটির বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি কত বিস্তৃত। তাঁর স্মরণশক্তি-ধীশক্তিও খুব বেশি ছিল। বিশেষ করে আকাবিরে দেওবন্দ সম্পর্কে তাঁর স্মরণশক্তি ও মনোমুগ্ধকর আলোচনা হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. কর্তৃক ফুটনোটসহ সংকলিত আরওয়াহে সালাসা গ্রন্থের প্রথম অংশের রাবী (বর্ণনাকারী) আমীর খান সাহেবকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিত। আকাবিরে দেওবন্দের ঘটনাবলি তাঁর মুখ থেকে শোনার মজাই আলাদা ছিল। যেমন তাঁর স্মরণশক্তি তেমনি তাঁর অগাধ ভক্তি-শ্রদ্ধা মিশ্রিত বর্ণনাভঙ্গি।

তিনি ওলি-বুযুর্গদের খেদমত করাকে নিজের সৌভাগ্যের কারণ মনে করতেন এবং নিজের বাড়িতে তাদের মেহমানদারী করার জন্য উদগ্রীব থাকতেন। দেশ ও বিদেশের অনেক ওলি-বুযুর্গ তার অনুরোধে তাঁর বাসায় এসেছিলেন। ক্বারী তৈয়ব ছাহেব রাহ., আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী রাহ., খতীবে আযম হযরত মাওলানা সিদ্দীক আহমদ রাহ., চরমোনাই পীর হযরত মাওলানা ইসহাক সাহেব রাহ., হাটহাজারী মাদরাসার শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আবদুল আজিজ রাহ., হযরত মাওলানা আবদুল হালীম সাহেব রাহ. ও হযরত মাওলানা এহসানুল হক সাহেব দামাত বারাকাতুহুম সকলেরই আগমন ঘটেছিল ঐ বাসায়।

 

খান সাহেব অনেক সময় হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে স্বপ্নযোগে মোলাকাত করতেন বলে আমাদেরকে বলতেন। আমাদেরকে এও জানিয়েছেন যে, এক বারের স্বপ্নে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীনকে তার গ্রামে তারই হাতে প্রতিষ্ঠিত  খেড়িহর মাদরাসায় উপস্থিত হতে দেখেছেন। তাঁর ঐ মাদরাসায় দেশের প্রায় ওলি-বুযুর্গদের কদম পড়েছে বহুবার। অধম লেখকেরও কয়েকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। মাদরাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা শামসুল হক দামাত বারাকাতুহুম অত্যন্ত বুযুর্গ ব্যক্তি।

হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ সাহেব ও আমার খরিদকৃত একটুখানি জায়গায় জামেয়া ফারুকিয়া মাদরাসা নামে একটি মাদরাসার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। সেখানে খান সাহেব সহ আমরা অনেকেই গিয়ে কুরআন খানিও করেছিলাম। কিন্তু মাতুয়াইলের ঐ জায়গা একোয়ারভু্&ক্ত হওয়ায় তা স্থানান্তরিত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। খান সাহেব আমাদেরকে বললেন, আমার প্রায় ২-৩ কোটি টাকার একটি বিল আটকা পড়ে আছে। তোমরা দুআ করো, টাকাগুলো উদ্ধার হলে মাদরাসার একটা ব্যবস্থা আমি করে দিব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর কি মর্জি, কিছুদিন পর তাঁর টাকাগুলো উদ্ধার হয়েছে দেখে আমি তাঁকে বললাম, কৈ, আমাদের মাদরাসা কোথায়? তিনি বললেন, পাগলায় আমার দুই বিঘা জমি আছে সেখানে মাদরাসা হয় কি না দেখ। মাওলানা মিসবাহ সাহেব ও আমি তা দেখে এলাম। দেখলাম, সরকারের পয়ঃনিষ্কাষনের জন্য যে বিশাল প্রজেক্ট করা হয়েছে তার একে বারে কোল ঘেষে জায়গাটির অবস্থান। মিসবাহ সাহেব বললেন, এই দুর্গন্ধময় জায়গার পাশে মাদরাসা করা যাবে না। খান সাহেবকে বিষয়টি আমরা অবহিত করার পর জালকোড়িতে জায়গা দেখার সিদ্ধান্ত হল। বৃহস্পতিবার রাতে আমি তাঁর বাসায় থাকলাম। পরদিন সকালে জালকোড়িতে জায়গা দেখার জন্য সকালে ঘুম থেকে উঠেই চিৎকার শুরু করে দিলেন-ওবায়দী ভাই, ওবায়দী ভাই! কাজ হয়ে গিয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কী? কে এসেছেন? তিনি বললেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামদের নিয়ে হযরত ওমর রা. কে স্বপ্নে দেখলাম এক জায়গায়। জায়গাটি কোথায় অবস্থিত তা বুঝতে পারলাম না। চল দেখি আমরা জায়গা দেখতে বের হই। আমরা তাঁর পাজেরো গাড়িতে ভুঁইগড়ে একটি জায়গা দেখলাম। মাত্র দশ কাঠা হওয়াতে জায়গাটি তাঁর পসন্দ হল না। তিনি আমাকে বললেন, মাওলানা মুস্তফা হুসাইনী সাহেব যে জায়গার কথা বলেছেন তা কোথায়? আমি বললাম, ঐ যে দূরে দেখা যায়, প্রায় আদমজীর কাছে। তিনি বললেন, চল সেখানে যাব। সিদ্ধিরগঞ্জ হয়ে কাঁচা রাস্তায় প্রবেশ করার পরই তিনি বলতে আরম্ভ করলেন, রাতে স্বপ্নে দেখা জায়গাটির

মতোই তো মনে হচ্ছে। আমাদের উদ্দিষ্ট জায়গা দশ পাইপে গাড়ি থামার সাথে সাথে তিনি বললেন, ঠিক এই জায়গাতেই হযরত ওমর রা. দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে মনে হচ্ছে। যেহেতু তাঁর নামের মাদরাসা, তাই হয়তো তিনি আগে আগে ছিলেন। তোমরা এর চতুর্পার্শ্বে জায়গা দেখতে থাক। দুই একদিন পর আমিও দুবার হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঐ জায়গার আশে পাশে স্বপ্নে দেখতে পেলাম। আল্লাহ পাকের অশেষ মেহেরবানিতে ঐ জায়গাতেই প্রায় সাত লক্ষ টাকা দিয়ে একটা জায়গা খরিদ করা হল এবং পুরা রমজান মাসে খাটা-খাটনি করে একটি মাদরাসা ভবন তৈরি করা হল। রমযানের পর আল্লাহর দয়ায় আমি হজ্বে রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমার হজ্বের পঞ্চান্ন হাজার টাকাই খান সাহেব দিলেন। ইতিমধ্যে জামেয়া স্থানান্তরিত হল এবং পড়া-শোনার কাজ আরম্ভ করা হল। আলহামদুলিল্লাহ ঐ মাদরাসাখানা এখনো সুচারুরূপেই চলছে বলে জানি। তখন সনটি ছিল ১৯৯৫ ইং।

খান সাহেব আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখদের সাথে একটু বে-তাকাল্লুফ কথা বলতে পারতেন। যে সমস্ত বুযুর্গদের সামনে আমরা ভয়ে জড়সড় হয়ে কথাই বলতে পারি না খান সাহেব তাঁদের সাথে বে-ধড়ক কথা-বার্তা বলতে এবং তাঁদেরকেও হাসিয়ে মাতিয়ে দিতে পারতেন। আসলে তারা তার মুহাববত ও দ্বীনী জযবার কদর করে তাকে ছাড় দিতেন। মুফতীয়ে আযম হযরত মুফতী ফয়জুল্লাহ সাহেব রাহ.কেও একবার মেখল গিয়ে তাই করেছিলেন। মসজিদের চতুর্পার্শেব ছোট ছোট হুজরাগুলোতে পড়াশোনার কাজ চলতে দেখে খান সাহেব হযরতকে বললেন, হুযুর! আশপাশের জায়গাগুলো আপনাদের মাদরাসার জন্য খুব দরকার, হুযুর হাত ওঠান, আমরা সাথে সাথে আমীন বলব। হযরত মুফতী আযম সাহেব তাই করেছিলেন। পরে যখন জায়গার ব্যবস্থা হতে লাগল, বড় হুযুর হযরত মাওলানা আজিজুল্লাহ সাহেবকে বললেন, ঢাকার ঐ ব্যবসায়ী ভদ্রলোককে খবর দাও। হযরতের নির্দেশ খান সাহেবকে জানানো হলে খান সাহেব ঐ সব জায়গা ও ভবন তৈরির ব্যাপারে বড় রকমের একটা অংক দান করেছিলেন।

ধন-দৌলত এই দেশে অনেকেরই আছে তবে খান সাহেবের ধনের মতো মানুষের উপকারে বিশেষ করে আলেম-ওলামা ও ইসলামের কাজে তার ব্যবহার কজনের আছে? তা সত্যিই চিন্তার বিষয়। তাঁর ধন এত এত মাদরাসা ও আলেমদের কাজে লেগেছে, অথচ তাঁর কোনো ছেলে আলেম হবে না এ কেমন কথা? তিনি এ ব্যাপারে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। চেষ্টার ফল কোনো না কোনোভাবে প্রকাপশ পেতে পারে। খান সাহেব বৃদ্ধ বয়সে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত হয়েছিলেন এবং অনেকটা ভেঙ্গেও পড়েছিলেন তাঁর বিবাহিত বড় ছেলে জাহাঙ্গীরের আকস্মিক মৃত্যুতে। মিজান চৌধুরী নাকি একদিন জিজ্ঞসা করেছিলেন, খান! তুমি কেমন আছ? খান সাহেব উত্তরে বলেছিলেন, বাবাকে রেখে ছেলের মৃত্যু হলে ছেলের জানাযা বাবাকে পড়তে হলে ঐ বাবার আর বেঁচে থাকার সাধ কোথায়?

আমি আগেই বলেছি, খান সাহেব ছিলেন সত্যিকারের একজন আশেকে রাসূল। তাই প্রতি বছর ছুটে যেতেন মদীনা যিয়ারতে। স্বপ্নে বারবার সাক্ষাত হওয়া সত্ত্বেও  তাঁর সাধ মিটত না বলেই তিনি ছুটে যেতেন পাক মদীনার দিকে। রওজা পাকের খাছ খাদেমের সাথে খুব সখ্যতা অর্জন করে রওজা পাকের ঝাড়ু দেয়া বালু-কণার একটু অংশ নিজের জন্য বরাদ্দ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমাকে একবার বললেন, ঐ ধুলা-বালিগুলো আমি রেখে দিয়েছি, যাতে করে আমার কাফনে তা দেয়া যেতে পারে।

হঠাৎ করেই সেদিন টেলিফোন করেছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক সাহেব। চমকে উঠে প্রশ্ন রাখলাম, অধমকে এভাবে স্মরণ করার বিশেষ কি প্রয়োজন হল হঠাৎ? তিনি বললেন, আপনি জানেন কি না? আপনার খুব কাছের ও প্রিয় মানুষ আলহাজ্ব আবদুল ওয়াদুদ খান সাহেব ইন্তেকাল করেছেন? কথাটা শুনে আমি রীতিমতো লাফিয়ে উঠলাম। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়ে আদ্যপান্ত সব জিজ্ঞাসা করলাম। কখন, কোথায় মুত্যুবরণ করলেন? কোথায় দাফন করা হল? ইত্যাদি। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত খেড়িহর মাদরাসার মসজিদের দক্ষিণ পাশে ফুল বাগানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে শুনে মনে মনে খুশি হলাম। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন, মরহুম সম্পর্কে কিছু স্মৃতিচারণ করতে। তাই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

মরহুম হাজী সাহেবকে তাঁর যাবতীয় নেক আমলের উসিলায় মহান আল্লাহ মাফ করে দিন এবং তাঁকে গরীকে রহমত করুন। আমীন। # 

 

 

advertisement