রজব ১৪২৯   ||   জুলাই ২০০৮

পৃথিবীটা ভালো মানুষে ভরে গেলে ক্ষতি কী?

হা মীম কেফায়েত

 

মানুষের এই পৃথিবীতে যেখানে এবং যেইখানে মাটি আছে, সেখানেই কিন্তু চাষ হচ্ছে না। গড়ে উঠছে না সজীব রঙিন ফুল-ফল। তেমনিভাবে পৃথিবীর সব পরিসরে ভালো কাজ হচ্ছে না। অথচ পৃথিবীটা ভালো কাজের জায়গা- এখানে ফুল হেসে হেসে ঝরে আর জোছনারা হাসিমুখে মিলিয়ে যায়। না, পৃথিবীটা কখনও এমন ছিল না। ভালোমন্দের সমানতলায় তার পুরোটাই পড়ে আছে। কিন্তু এই যে মন্দের কথা বলছি, জিনিসটা এলো কোত্থেকে। কারা-ই বা বলে কয়ে মন্দের জাল বুনে চলেছে ধীরে? একটি মাত্র মন্দ প্ররোচনায় মন্দেরা বেশ জেগে ওঠে।

 

  শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের পিছু পিছু দৌড়োয় মন্দের ছায়া। এই ছায়া কখনো শীতল নয়, এই ছায়া কখনো সুশীতল হয় না- জাহান্নামের আগুনের মতোই তা তাপদাহ। তবে আশার কথা, সকল দেশে এবং সব শহরেই ভালো মানুষ আছে- এই বাংলাদেশেও শুনেছি ভালো মানুষ বাস করে! কিন্তু মানুষের ভালো কাজ সবসময় ভালো হয়ে উঠছে না, আবার কখনো হয়ে উঠছে মন্দের ভয়াবহ উপমা। এই দেশ এবং শহরটার ব্যাপারেও ঠিক তা-ই। প্রতিদিন গড়ে উঠছে ভালো কাজের মেলা স্বপ্ন এবং ঐশ্বর্য। কিন্তু আলাহতায়ালার বিচার যে বড়ো কঠিন এবং সবচে সহজ। ভালো কাজ গ্রাহ্য হয় কি সহজেই, সবচে সহজেই তো তার কাছে ভালো কাজ গ্রাহ্য হয়। ...ভালো কাজ চিনবার চোখই বা কোথায়?

 

চোখের পর্দায় মন্দের পাহাড় দেখতে দেখতে প্রশ্ন জাগে, রূপকথার মতো করে শোনা ভালো কাজে ভরপুর সেই পৃথিবী কি এখন আর নেই? ইদানীং একেবারেই এমনটি চোখে পড়েনি যে। আমরাই তো দেখতে পাই না। তবে হ্যাঁ, কেউ ভালো কাজকে দেখছে সুন্দর, সে দিনরাত ভালো কাজের পথে ছুটছে। কেউ দেখছে মন্দ কাজকে সুন্দর, সে সেই দিকেই চলেছে। কিন্তু দুজনেরই মনে রয়েছে সুন্দর কাজ অথবা সুন্দর রকমের অকাজ। এই যে আত্মনির্বাচিত সৌন্দর্য, বড়ই ভয়ঙ্কর। বিচারবিশ্লেষণ এক্কেবারেই না বুঝতে বুঝতে বিষয়টি বাগধারার মতোই হয়ে গেছে। কেউ কেউ কহেন ভয়ঙ্কর সুন্দর। কাব্যগ্রন্থের নাম হয়ে যায় সৌন্দর্য হে ভয়ানক

কবি বলেছেন, মানুষ যখন মানুষ ছিল মানুষ ছিল ভালো। ওইসব ভালো মানুষ দেখতে ফেরেশতার মতো। ফেরেশতা কখনো দেখিনি। তবু বলবো, তারা ফেরেশতার মতো। এখন তারা নেই, থাকার কথাও নয়। তবে মনে মনে তাদেরকে খুঁজে ফিরি এখানে আর ওখানটায়। মনে মনে তাদের দিকে তাকাই, বারবার দেখলেও আমার দেখা যেন শেষ হয় না। খুব কাছ থেকে, দূর থেকে- প্রতিবারের দেখায় আমি নতুন করে আনন্দ পাই এবং ভালো মানুষের স্বভাব ও আনন্দকে আবিষ্কার করি। সময়ের কথা ভুলে গিয়ে দেখতে থাকি প্রিয় সেইসব মানুষের মুখ। আমার মনে হয়, আধুনিক সভ্যতার এই পৃথিবীতে যারা নেই, তারা নেই বলেই পূর্ণাঙ্গ বই রচিত হয়ে যায় মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারাল

আজ পর্যন্ত তো অনেক কিছুই হারালাম। ভালো কাজের ইচ্ছা ও প্রার্থনা আমাদের মাঝে যতটুকুই যা রয়েছে তার সবটুকুই প্রকাশ করছি মন্দের পথ ধরে। অথচ এ সকল মন্দের পথ স্থায়িত্বের জন্য নির্মিত হয়নি, ভালো তো মন্দকে দূরীভূত করবেই। ভালো আর মন্দের পার্থক্যটা অন্তত প্রতিটি মানুষের ব্যাপারেই বিচার্য। চিন্তার ব্যাপার তো আছেই, ভালোর কাছাকাছি আমরা কীভাবে থাকব আর মন্দের আশপাশে যেন না যেতে হয় সে ব্যবস্থাটাই বা নির্মিত হওয়ার পথ ও পাথেয় কী?

এই পৃথিবীতে সর্বক্ষেত্রেই ধর্ম এবং ধর্মের বিচারই মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছে ভালোমন্দের পরিচয়। জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম চিরকালের জন্যই ভালোমন্দের পার্থক্যটা বুঝিয়ে দিয়েছে। মানুষের সংখ্যা এবং এ নিয়ে ভাবনার খেইগুলো হচ্ছে ওপরের এইসকল কথা। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যে প্রশ্নটা ধাঁ করে মাথায় চাপে সেটা হচ্ছে পৃথিবীটা ভালো মানুষে ভরে গেলে ক্ষতি কী? কারও কাছে মনে হতে পারে, প্রশ্নটার কোনো মাথামুন্ডু নেই। অবান্তর কিছু না। নিজেকে নিজেই জিজ্ঞাসা করেছি এই প্রশ্নটার মানে কী? একে কি আক্ষরিক অর্থে বুঝতে হবে নাকি এটা কোনো বিমূর্ত প্রশ্ন? আক্ষরিক অর্থে হলে আঙুলে গুণে সেটা বের করা যাবে যে, মানুষের সংখ্যা এত্তো বেশি হয়ে গেছে, ভালো থাকাটা মুশকিল। ভালো করাটাও সমস্যার ব্যাপার। সংখ্যাটা অধিক হলে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু কথা হচ্ছে, গাণিতিক হিসেব মতে সংখ্যা অধিক হলে মন্দ থাকাটা মুশকিল নয় কেন? মন্দ হওয়াটাও সমস্যার ব্যাপার নয় কেন? আর যাঁরা আঙুলে গুণতে নারাজ তাঁদের জন্য ভিন্ন প্রসঙ্গে বলার কিছু রইল?

আবুল কালাম শামসুদ্দীন একবার ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,  ...আপনি কেন এতগুলো সন্তান নিলেন? প্রশ্ন তো অবশ্যই। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তরটা দিতে হবে বিশদ ব্যাখ্যায়, ধীরে সুধীরে। তাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে শহীদুল্লাহ সাহেব বলেছিলেন আমি এতগুলো সন্তান না নিলে মুর্তজা বশীর হতো না, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি এতগুলো সন্তান না নিতেন তাহলে রবীন্দ্রনাথকে পেতাম কোথায়? পিতার পঞ্চদশ সন্তান রবীন্দ্রনাথ পরিপূর্ণ রবীন্দ্রনাথ হবার পর বঙ্গমাতা কবিতায় লিখে গেছেন সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী,/রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।

আধুনিক জগৎটাই বড়ো তাজ্জবের জায়গা। যারা এখানে মন্দের জাল বুনে তারাই কিন্তু ভালোর সবচে বড়ো নির্মাতা। সাদা মনের মানুষ তারা খুঁজে বের করে, পদক দেয়। যারা দেয়, তাদের পরিচয়টাও বড় অদ্ভূত- উহারা হইতেছে বহুজাতিক কোম্পানী। মানে, বহুদেশীয়  বাবাদের   প্রজেক্ট।  এক  সন্তানের জন্মদাতা পিতা একাধিক হলে যা হয়, তা-ই হয়েছে এইসব ক্ষেত্রে। তবে সন্দেহ নেই, এই বহুর কারণেই তাদের ব্যবসাটা চাঙ্গা থাকে সবসময়। এই বহুর ফল তারা ঠিকই ভোগ করে, এর ফল দিয়ে বিলাস করে। আবার বহুসংখ্যককে চোখ রাঙায়। মনে হয়, এক্ষুণি জনসংখ্যাকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে। জনসংখ্যায় ভরপুর দেশের দিকে তাকালে আবার তাদের করুণা (?) হয়। কত কষ্টে তারা বাঁচে, কত কষ্টে ঘুমায়- আর এত্তো মানুষ খাবেটাই বা কী? জায়গাটা মুসলমানদের জন্য সমস্যা না। উহাদের অনেক আছে, তাই খুব বেশি নাই নাই। আমাদের আছেটা কম, তাই নাই নাইটাও এক্কেবারে কম। বেঁচে থেকে মাথা গুজবার ঠাঁই আর সেজদার জায়গা এবং মরে গেলে কবরের জায়গাটা ছাড়া চাওয়ার আছেটাই বা কী?

পৃথিবীর প্রতিটি পরতেই এখন বহুজাতিক কোম্পানির অধিকার সবচে বেশি। তারা চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে যখন-তখন। তবে তাদের এই পারা-না পারাটা প্রকৃত অর্থেই ক্ষুদ্র আকৃতির। কিন্তু কথাবার্তার বেলায় তারা স্বচ্ছ নয়। ভীষণ গ্যাঞ্জাম পাকিয়ে পাকিয়ে তারা কথা বলে। কেন এত্তো কথা বলে, নিজেরাও ভালো করে জানে না। এই দেশে তারা জন্মনিয়ন্ত্রণের কথা বলে, মানুষ মরে যাক এটাও তারা চায়। অন্যদিকে আবার বেশ গর্ব নিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়- আমাদের মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা দেড় কোটি। এ দেশের মানুষ তিনবেলা খেয়ে-নেয়ে বাঁচুক এটাও তাদের কাছে অপ্রত্যাশিত। কিন্তু তাদের প্রত্যাশার ব্যাপারটা হচ্ছে- একজন কৃষকও যেন দাঁড়িতে শ্যাম্পু করে, ক্ষেতে সার দেয়, বাচ্চার জন্যে লোশন কিনে আনে...

গ্রামের হাটে-বাজারের ছোট্ট হোটেলের মালিক দুপুরের খাবারটা হোটেলেই সেরে নেয়। যা বিক্রি হচ্ছে হোটেলে, তা দিয়েই সে খাবার খেয়ে নেয়। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানির উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তাই কিন্তু নিজেদের কোনো পণ্য ব্যবহার করে না- অন্তত নিজের সাথে তো কেউ বেঈমানি করতে চায় না। কারণ এটাই! হোটেল মালিকের ব্যবসায় বেঈমানি নেই। তাই সে মানুষকে যা খাওয়াচ্ছে, নিজেও তা খাচ্ছে। কিন্তু ওরা নিজেদের পণ্য ব্যবহার করতে পারছে না, কারণ তাদের ব্যবসাটা বেঈমানিতে ভরপুর। মদ-গাঁজা-হেরোইনের মতো করে তাদের পণ্যও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। এবং জনসংখ্যার প্রাচুর্যই হচ্ছে তাদের সবচে বড় পুঁজি। পরিবার পরিকল্পনা বলে তারা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের যেই বিষয়টা প্রচার করে এটা কেবলই ভন্ডামি। তবে তারা ভন্ডামিটাও নিঃস্বার্থ ভাবে করে না, এখানেও তাদের বিজ্ঞাপন এবং পণ্যবিক্রির বিষয় জড়িয়ে আছে।# 

 

 

 

advertisement