শাবান-রমযান ১৪২৯   ||   আগস্ট ২০০৮

বোঝানোর নানা পন্থা

আবিদা

পিতা তার সন্তানের কাছে যা কামনা করেন তা দুভাবে পেতে পারেন। চাপ প্রয়োগ করে কিংবা আলোচনার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করে। তবে ফলাফলের বিচারে এই দুই পন্থার মাঝে অনেক ব্যবধান হয়ে যায়। নিম্নোক্ত পদ্ধতি প্রয়োগ করে আমরা নিজেরাও তা অনুমান করতে পারি।

বিগত এক মজলিসে আপনাদের আমি শুনিয়েছিলাম যে, এক গ্রীষ্মের ছুটিতে নানাজী একটি মনোরম বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, পরিবারের সবাইকে নিয়ে একত্রে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপন করা। সেবারই প্রথম নানাজীর পরিবারের সবাই ওই বাড়িতে একত্র হয়েছিল। যদিও এর আগে প্রতি গ্রীষ্মে আমরা তাঁর সাক্ষাত পেয়েছি, কিন্তু সেটা ছিল সাধারণ সাক্ষাত। তিনি দামেশকে নিজ বাড়িতে অবস্থান করতেন, আমরা আমাদের বাড়িতে। প্রতিদিন হয় তাঁকে আমরা দেখতে যেতাম কিংবা তিনি আমাদেরকে দেখতে আসতেন। কিন্তু সে বছর গ্রীষ্মে আমরা সবাই এক বাড়িতে     ছিলাম। নানাজী ও খালাম্মাদের সাহচর্যে অত্যন্ত আনন্দের মধ্য দিয়ে আমাদের ওই দিনগুলো অতিবাহিত হয়েছে। শুধু একটাই অভিযোগ ছিল। তা এই যে, কোনো কোনো সময় আমাদের ওপরও ঘরোয়া কিছু কাজকর্মের দায়িত্ব অর্পিত হত। এটা আমাদেরকে খুবই বিরক্ত করত। হয়তো খুব মন দিয়ে কোনো বই পড়ছি কিংবা পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাচ্ছি ইতোমধ্যে কোনো কাজের জন্য ডাক আসত। আর বই পড়ার মজাটাই মাটি হয়ে যেত। অথবা পাশের বাগানে খেলা করছি। খেলাটাও মাত্র জমে উঠেছে-এমন সময় বড়দের ডাক আসত। এ সময় আমাদের মনের অবস্থা কেমন হত তা তো বলাই বাহুল্য। তাছাড়া ওই ঘরের কাজ-কর্মে তো আনন্দেরও কিছুই নেই।

আমাদের অভিযোগ ও বিরক্তি বাড়তে থাকে ...

একদিন নানাজী আমাদের মধ্যে একজনকে বললেন, সে যেন বাড়ির চারপাশে ঘুরে ঘুরে ঘোষণা করে যে, নানাজীর কামরায় একটি বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। শুধু ছোটরাই সেখানে উপস্থিত হতে পারবে। বড়রা যেন কোনোভাবেই না আসেন।

এই ঘোষণায় আমরা খুব কৌতূহলী হয়ে ওঠলাম এবং এই ভেবে এক ধরনের উত্তেজনাও বোধ করলাম যে, শুধু আমাদেরকেই ডাকা হচ্ছে, বড়দের এখানে প্রবেশ নিষেধ! আমরা খুব উত্তেজনা ও কৌতূহলের সঙ্গে নানাজীর কামরায় এসে উপস্থিত হলাম। দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল এবং আমরা সবাই আসন গ্রহণ করলাম।

নানাজী খুব শান্তভাবে কথা বলতে আরম্ভ করলেন : আমি তোমাদেরকে এখানে সমবেত করেছি একটি বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। তা এই যে, ঘরোয়া কাজকর্মে তোমাদের অংশ নিতে হয়, এতে তোমাদের কষ্ট হয় এবং বিরক্তি আসে। আজ আমরা যারা এখানে উপস্থিত হয়েছি চল সবাই মিলে যুক্তি ও ইনসাফের মানদন্ডে বিষয়টি বিবেচনা করি।

প্রথমত দেখ, তোমরা সারাদিন খেলাধুলা করছ। কিন্তু এতে তোমাদের মধ্যে কোনোরূপ ক্লান্তি ও বিরক্তি আসছে না। তাহলে ঘরের সামান্য কাজের দায়িত্ব যদি তোমাদের ওপর আসে তাহলে ক্লান্তি বোধ করা কি যুক্তিসংগত?

তাছাড়া শরীর চালনা হয় এমন যেকোনো কাজই ব্যায়াম হিসেবে গণ্য। কেননা এতে শরীরের পেশীগুলো সঞ্চালিত হয়। তবে তোমাদের এ কাজে দুধরনের সুফল রয়েছে। শরীর চালনার সুফল এবং মায়েদের কাজে সহযোগিতার সুফল। এতে মায়েরাও সন্তুষ্ট হন আর এ কারণে আল্লাহ তাআলারও সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।

তিন. ভেবে দেখ তো শুধু উপভোগ করার বেলায় আমরা অংশ নিব, কিন্তু কর্মের বেলায় অংশ নিব না-এটা কি ন্যায়সঙ্গত? আমরা সবাই যদি শুধু খাওয়া ও ঘুম এবং বিশ্রাম ও খেলাধুলার মাঝে সময় কাটাতে চাই তাহলে রান্না-বান্না, থালা-বাসন মাজা, বিছানা গোছানো, কাপড় ইস্ত্রি করা-এইসব কাজ কে করবে? অতএব কর্ম ও উপভোগ দুদিকেই আমাদের অংশগ্রহণ থাকা চাই। তা না করে আমরা যদি সব কাজ মায়েদের জন্য রেখে দেই তাহলে তাদের প্রতি অবিচার করা হয়।

চার. আমাদের মতো মায়েদেরও এই কাজগুলোতে কষ্ট হয়, তাদেরও বিরক্তি আসে। কিন্তু তাঁরা দায়িত্ব মনে করে এগুলো সম্পন্ন করে থাকেন। বুদ্ধিমান ব্যক্তি কি দায়িত্বে অবহেলা করতে পারে?

আর এটাই কিন্তু জীবনের নিয়ম। প্রত্যেককেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হয়। তো মায়েরা যখন আরাম ও আনন্দের কথা ভুলে গিয়ে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট রয়েছেন তখন আমাদেরও কি এ বিষয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত নয়?

সর্বশেষ কথা এই যে, কর্ম হল জীবনেরই অংশ। আর আমরাও কি এতে অভ্যস্ত নই? যখন আমাদের মাদরাসা খোলা ছিল তখন তো আমরা নির্ধারিত পড়াশোনা, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি অনেক কাজ করতাম। হ্যাঁ, খেলাধুলা ও বিশ্রামের মাধ্যমে আমরা আমাদের ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করতাম।

তাহলে এখন কেন কাজ করা আমাদের জন্য কঠিন হবে? এখন তো আমাদের ওপর নির্ধারিত কোনো দায়িত্বও নেই। যেকোনো সময় আমরা বড়দের সাহায্য করতে পারি।

প্রিয় পাঠক, অনুমান করতে পারেন, এই অধিবেশনের ফলাফল কী হয়েছিল? নানাজীর আলোচনা সমাপ্ত হওয়ার পর আমরা সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের চিন্তা-ভাবনায় আমূল পরিবর্তন এসে গিয়েছিল। ঘরের কাজকর্ম আগে আমাদের মনে বিরক্তি সৃষ্টি করত আর এখন আমরা তা খুশি মনে গ্রহণ করতে প্রস্ত্তত।

এই সমাধানের মূলে ছিল নানাজীর জাদুকরী আচরণ। তাঁর আচরণ ও সম্বোধনে আমাদের মনে হয়েছে যে, আমাদেরও গুরুত্ব রয়েছে এবং আমাদের সঙ্গে বড়দের মতো আচরণ করা হচ্ছে। (একথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, প্রত্যেক শিশু কামনা করে, সে বড় হবে এবং তার সঙ্গে বড়দের মতো আচরণ করা হবে।) এই মনস্তাত্বিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে তিনি আমাদেরকে মানসিকভাবে প্রস্ত্তত করেছেন। কোনো ধরনের জোরজবরদস্তির পথে তিনি অগ্রসর হননি। বলাবাহুল্য, মানসিক প্রস্ত্ততি কঠিন কাজকেও সহজ করে দেয়।

এখন একটি সমস্যাই শুধু রয়ে গেল। তা এই যে, ঘরের কাজ তো বিভিন্ন ধরনের রয়েছে। আমরা কে কোন কাজ করব? এই সমস্যারও সমাধান নানাজী করলেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে। আগামী মজলিসে সেটা আমরা আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। 

 

 

advertisement