রমযান ১৪২৯   ||   সেপ্টেম্বর ২০০৮

সাম্য ও ইনসাফ

আবিদা

সন্তানদের মধ্যে শ্রেণী-বিভাগ করা একটি চরম ভুল, যা অনেক পিতা-মাতা করে ফেলেন। এ বিষয়টি পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ এবং ভাই-বোনদের মধ্যে বিরাগ-বিতৃষ্ণা প্রকাশকে অপরিহার্য করে তোলে। অতএব কোনো সন্তানকে এটা ভাবতে দিবেন না যে, সে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কিংবা সে নিচু ও অবহেলিত। শাস্তি ও পুরস্কার এবং দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা সকল ক্ষেত্রে সমতা ও ইনসাফ অবলম্বন করুন।

 

বিগত মজলিসে আমি আপনাদেরকে বলেছিলাম, কীভাবে নানাজী ঘরের কাজে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং আমরা তা বুঝে শুনে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছি। তবে একটি সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তা এই যে, আমরা কর্মবণ্টনে বৈষম্য ও অসমতার শিকার বলে নিজেদের ভাবছিলাম। প্রত্যেকে ভাবছিলাম যে, তার উপরই কঠিন ও বিরক্তিকর কাজগুলোর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে অথচ অন্যরা সহজ ও আনন্দের কাজগুলো করছে।

আমরা এই অভিযোগ আমাদের গ্রীষ্মকালীন বিচারপতি নানাজীর আদালতে উত্থাপন করলাম এবং প্রত্যেকে তর্কের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেষ্টা করলাম যে, ঘরের কাজের বড় অংশ তার উপরই ন্যস্ত হয়েছে। এই যুক্তি-তর্কে আমরা প্রত্যেকেই অবাস্তব ও অতিরঞ্জিত অনেক কিছু বললাম, কিন্তু নানাজী চুপচাপ আমাদের সবার বক্তব্য শুনলেন। বিতর্কের পর্ব শেষ হওয়ার পর নানাজী ঘোষণা করলেন যে, বিষয়টি তিনি ন্যায়সংগতভাবে সমাধান করবেন। এতে কারো প্রতি বৈষম্য করা হবে না এবং একজনকে সহজ ও হালকা কাজ দিয়ে অন্যজনকে কঠিন ও ভারি কাজ দেওয়া হবে না। তিনি একখন্ড কাগজ নিলেন এবং প্রতিদিনের কাজগুলোর তালিকা তৈরি করলেন। এরপর তা আমাদের সামনে পেশ করলেন, যেন আমরা নিজ নিজ পছন্দ মতো কাজ বেছে নেই। যার কাছে যে কাজ অপছন্দনীয় তাকে সে কাজ দিলেন না এবং প্রত্যেকের বয়স ও সামর্থ্যের প্রতি লক্ষ রেখে-যদিও আমরা বয়সের দিক থেকে সবাই খুব কাছাকাছি- যে সবার বড় তাকে তুলনামূলক বেশি কাজের দায়িত্ব এবং যে বয়সে ছোট তাকে তুলনামূলক হালকা ও অল্প কাজের দায়িত্ব দিলেন।

নানাজী যখন নিশ্চিন্ত হলেন যে, কাজকর্ম ন্যায়সংগতভাবেই বণ্টিত হয়েছে, কারো প্রতি কোনো ধরনের অবিচার বা পক্ষপাতিত্ব করা হয়নি তখন তিনি একটি সূচি তৈরি করলেন। ডান দিকে আমাদের নাম অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও সুন্দর ছুলুছ লিপিতে লিখলেন । আমি ইতোপূর্বে বলেছিলাম যে, নাসখ্, দিওয়ানী ইত্যাদি সকল লিপিতেই তিনি পারদর্শী ছিলেন তবে তার সবচেয়ে পছন্দের লিপি হল ছুলুছ

ডান দিকে আমাদের নাম লিখে বাম দিকে লিখলেন আমাদের কাজগুলো। এরপর তা আমাদেরকে দেখালেন। আমরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করলাম এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ নামের পাশে স্বাক্ষর করলাম। এরপর নানাজী সূচিটি বারান্দার দেয়ালে ঝুলিয়ে দিলেন, যেখান দিয়ে সারাদিন আমাদের যাতায়াত হয়ে থাকে।

আমরা প্রত্যেকে প্রতিদিন সকালে ওই কাজগুলো সন্তুষ্টচিত্তে করে ফেলতাম । কেননা, আমরা নিজেরাই তা বেছে নিয়েছিলাম।

* * *

সাম্য ও ইনসাফ মানুষের একটি মৌলিক চাহিদা। আর এ বিষয়ে ছোট-বড়তে কোনো তফাৎ নেই। যখন আমরা নানাজীর কাছ থেকে ন্যায়সংগত সমাধান পাব বলে নিশ্চিত হয়েছিলাম তো আমাদের অন্তর প্রশান্ত হয়েছিল। আর এটাই ছিল তাঁর নীতি। আচার-ব্যবহারে তিনি তার নাতীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতেন না। কারো সঙ্গে প্রাধান্যমূলক আচরণ করতেন না এবং কারো প্রতি অনাগ্রহ প্রদর্শন করতেন না। প্রত্যেকের প্রতিই তাঁর সমান মনোযোগ ছিল এবং প্রত্যেকে বিশ্বাস করত যে, সে নানাজীর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। কেউ এটা কখনোই ভাবত না যে, সে নানাজীর নিকটে অন্যের তুলনায় কিছুটা কম প্রিয়। আমি নিজেও কখনো অনুভব করিনি যে, তিনি একজনকে অন্যজনের উপর প্রাধান্য দিচ্ছেন। 

এরপর যখন বড় হয়েছি এবং জেনেছি যে, কোনো কোনো দৌহিত্রের প্রতি তার অধিক ভালবাসা ছিল তখন এটা ছিল আমার জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা। না, এই জন্য নয় যে, তিনি একজনকে অন্যজনের চেয়ে বেশি ভালবাসেন, কোনো কোনো শিশু আল্লাহপ্রদত্ত এমন কিছু গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে থাকে যা তাকে বড়দের কাছে অন্যের তুলনায় অধিক প্রিয়পাত্র করে তোলে। অতএব এটা আশ্চর্যের কিছু নয়। আমার কাছে যে বিষয়টি নতুন বলে মনে হয়েছে তা এই যে, এ বিষয়টি তাঁর কোনো নাতী-নাতনী কখনোই বুঝতে পারেনি, না উপহার, উপঢৌকনের মাধ্যমে না স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যমে, না তাঁর আচার-আচরণের মাধ্যমে।

 

আমরা যদি হই মা কিংবা বাবা কিংবা মুরববী তাহলে আমাদের আচরণও যেন এমন হয় এতে ছোটদের অন্তরে মহববত ও কল্যাণের বীজ রোপিত হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, যদিও আমদের অধিকার রয়েছে যুক্তিসংগত কারণে একজনকে অন্যজনের চেয়ে অধিক স্নেহ করার, কিন্তু তাদেরও অধিকার এই যে, এই অনুভূতিটা যেন আমাদের হৃদয়ের গহীনেই ডুবন্ত থাকে এবং কোনো ধরনের অবহেলামূলক বা বৈষম্যমূলক আচরণের মাধ্যমে তা প্রকাশিত না হয়ে যায়। 

 

 

advertisement