রমযান ১৪২৯   ||   সেপ্টেম্বর ২০০৮

এক মহিয়সী মুমিনার শেষ সফর

মাওলানা নজরুল হাফিয নদবী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ঐ সময়েরই কথা। আমি গুন গুন করে গান করতাম। এমনকি নামাযে যাওয়ার সময়েও। একদিন অত্যন্ত মহববতের সাথে তিনি বললেন- বেটা! মানুষ ওযু করে দরুদ শরীফ পাঠ করতে করতে মসজিদে যায় এবং যিকির করতে করতে বের হয়। আর তুমি গান গাইতে গাইতে যাও। কথাটা তিনি এত মহববত ও স্নেহপূর্ণভাবে বলেছিলেন যে, এর পর থেকে ফিল্মি গানের প্রতি আমার ঘৃণা জন্মে গেল।

এমনিভাবে কুসংসর্গের ব্যাপারে তিনি আমাকে এভাবে প্রভাবান্বিত করেছিলেন যে, মন্দ লোকের সঙ্গে মেলামেশার প্রতি আমার স্থায়ীভাবে ঘৃণা জন্মে গিয়েছিল। তিনি এভাবে বলতেন যে, যদি তুমি অমুক লোকের সাথে থাক আর তোমার আববা এটা দেখে ফেলেন তখন তিনি কী মনে করবেন? অন্য  মানুষ তোমাদের ব্যাপারে কী মন্তব্য করবে? স্বীয় পিতা ও খান্দানের বদনামীর চিত্র তিনি এমনভাবে মনের মধ্যে গেঁথে দিয়েছিলেন যে,  আল্লাহ তায়ালার ভয়ের মতো সেই ভয় আজও অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে আছে। ছাত্র যমানায় সব সময় তিনি চিঠির মাধ্যমে আমাদের আদব আখলাকের উৎকর্ষ সাধনে তাগিদ দিতেন এবং তাগিদ দিতেন যেন আমাদের দিন রাতের নিমগ্নতা সম্পর্কে তাকে  সব  সময়  অবগত  করি।     উস্তাদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, তাদের মাধ্যমে বেশি বেশি উপকৃত হওয়া, নেক সোহবত অবলম্বন এবং ভালো বিষয়বস্ত্তর কিতাব মুতালাআ করার প্রতি সর্বদা গুরুত্বারোপ করতেন। ছুটির সময় বাড়ি গেলে তিনি সব সময় আমাদের প্রতি নজর রাখতেন এবং নেগরানী করতেন।

আমার মা চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কেও ভালো ধারণা রাখতেন। অবশ্য নির্বাচনের সময়  ভোট দিতেন না। শুধু একবার আববার পীড়াপীড়িতে তিনি ভোট দিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ভয়ে দুই জায়গায় সিল লাগিয়েছিলেন এবং বাইরে এসে বলেছিলেন, দুইজনকেই ভোট দিয়ে এলাম!

রেডিও পাকিস্তানের সকালের অনুষ্ঠানের কুরআন তিলাওয়াত, তাফসীর এবং হাম্দ-নাত শ্রবণ করতেন। যখন থেকে ক্যাসেটের প্রচলন ঘটল তখন থেকে ক্যাসেট সংগ্রহ করে তার মাধ্যমে কুরআন তিলাওয়াত ও হামদ-নাত  শুনতেন। বিশেষত নাত বিষয়ক মুশায়েরা খুবই আগ্রহের সাথে শ্রবণ করতেন। কবিদের মধ্যে আল্লামা ইকবাল এবং হাফিয জলন্ধরীর কবিতা তার প্রিয় ছিল।  শাহনামা পাঠ করেছিলেন কয়েকবার। হামদ ও মুনাজাত এবং নাত ও কবিতার অনেক কিছু তার মুখস্থ ছিল। অত্যন্ত আবেগ নিয়ে এসব কবিতা ও হামদ-নাত পাঠ করতেন। অবশ্য শেষ দশ বছর শুধু দুআ ও যিকিরের মধ্যেই মশগুল থাকতেন। দরূদ শরীফ এবং এস্তেগফার বেশি বেশি পাঠ করতেন। শেষের দিকে রাতে ঘুম হত না  বলতেন। ছোট বোন, যে তার কামরায় শয়ন করত, তার বক্তব্য হল, যখনই চোখ খুলতাম তখনই তাকে  কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করতে দেখতাম।  রাতের ঘুম তিনি দিনে পুরো করে নিতেন। অবশ্য কখনও গভীর ঘুম হত না। আমার শেষ সাক্ষাত হয়েছিল আটই আগষ্ট, যখন মাত্র চবিবশ ঘণ্টারও কম সময় নিয়ে কোনো এক কারণে  বাড়ি যেতে হয়েছিল। সেবার তিনি  বিদায়ের সময় অভ্যাসের বিপরীত আমাকে দুই বার দম করেছিলেন। দীর্ঘক্ষণ তিনি তার স্নেহের হাত আমার কাঁধে স্থির রাখেন। অতঃপর কপালে চুম্বন করেন এবং ফী আমানিল্লাহ বলে বিদায় জানান। যতক্ষণ পর্যন্ত দৃষ্টির নাগালে ছিলাম ততক্ষণ পর্যন্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমার কি জানা ছিল যে, এটাই তার সাথে আমার শেষ সাক্ষাত? দ্বিতীয় বার আধা সাক্ষাত হয়েছিল এভাবে যে, ওফাতের তিন দিন পূর্বে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে একটি চিঠি লেখেন আমার কাছে। চিঠিটি তিনি দুই দিন যাবত লিখে শেষ করেছিলেন। কেননা, শ্বাসকষ্টের  কারণে তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখতে পারতেন না।

 

প্রিয় নাজিবুর রহমানের হাতে ঐ চিঠিটি তিনি হস্তান্তর করেন,  যেন তিনি তা লক্ষ্ণৌ পৌঁছার পথেই আমার হাতে অর্পণ করেন। কিন্তু তাকদীর ভিন্ন ছিল। তার লক্ষ্ণৌ পৌঁছতে দেরি হয়ে গেল এবং আচানকভাবেই মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেলাম। ঐ চিঠিটি পেয়েছিলাম তাঁর মৃত্যুর পর। লক্ষ্ণৌতে চিঠি খুলে পরিস্কার বুঝতে পেরেছিলাম যে, এতে তার মৃত্যুর ব্যাপারে ইঙ্গিত ছিল এবং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার জীবন-প্রদীপ নিভে যেতে শুরু করেছে। তবে কবে যাবে এতটুকু শুধু জানা বাকি ছিল। মায়ের মুবারক হাতের শেষ চিঠি যা তিনি মৃত্যুর মাত্র দুই দিন আগে লিখেছিলেন তা নিম্নরূপ:

 

প্রিয় বৎস! সালাম রইল। হে আমার কলজের টুকরা! আমি এখন পর্যন্ত আছি, তবে কতদিন আর যিন্দা থাকব তা জানি না। আমরা বাড়ির সবাই ভালো আছি। তুমি তো তোমার বেটির সাথে প্রতি সপ্তাহে কথা বল, কিন্তু আমি তোমার কথা শোনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। তুমি আমাদেরকে যে টাকা পাঠিয়েছিলে তা দিয়ে আমরা কাপড় ও চপ্পল খরিদ করেছি। মায়ের দুআ থাকল যেন আল্লাহ তায়ালা তোমার বয়স, সুস্থতা এবং রিযিকে বরকত দান করেন। আমীন।

আমি কতদিন পর্যন্ত জীবিত থাকব তা কেউ জানে না। তবে পনের দিন যাবত ফজর থেকে বারটা পর্যন্ত শরীর খুবই খারাপ থাকে।  হৃদপিন্ড মনে হয় আর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। খুব দুর্বলতা বোধ হয়। রাত দিন চবিবশ ঘণ্টা চলতে ফিরতে, উঠতে বসতে সদা এই আয়াত মুখে জারি থাকে-

اَلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ تَطْمَىِٕنُّ قُلُوْبُهُمْ بِذِكْرِ اللّٰهِ ؕ اَلَا بِذِكْرِ اللّٰهِ تَطْمَىِٕنُّ الْقُلُوْبُؕ۝۲۸ اَلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ طُوْبٰی لَهُمْ وَ حُسْنُ مَاٰبٍ۝۲۹

এটাই আমার দরদী যবানের ভাষা। আর কী লিখব। তোমার আম্মা। 

 অনুবাদ- আবু বকর সিরাজী

 

 

advertisement