শাওয়াল ১৪২৯   ||   অক্টোবর ২০০৮

প্র তি বে শী : সাগরের সম্পদে সবার চোখ

পথচারী

প্রতিবেশীর হক যে সহযোগিতা, ভারতের পাশে বাংলাদেশের অবস্থা লক্ষ করলে সেটি ভুলে যেতেই হবে; কোনো উপায় নেই। বরং ভারতের মতো দেশের প্রতিবেশী হওয়ার মানে যে, সর্বক্ষণ আগ্রাসনের শিকার হওয়ার অনিবার্য দুশ্চিন্তায় থাকা আর মাঝে মাঝে সীমান্ত অঞ্চলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা পড়া-এ বাস্তবতাটিই বড় হয়ে সামনে চলে আসে। গত জুলাই-আগস্টে এই প্রতিবেশী দুটি রাষ্ট্রের ইস্যু ছিল এরকম যে, পাখির মতো গুলি করে বড় প্রতিবেশী হত্যা করেছে ছোট্ট প্রতিবেশীর দুজন সীমান্ত রক্ষীসহ কজন নিরীহ নাগরিককে। বড়র ক্ষমতাও বড়। তাই এসব হত্যাকান্ডের কোনো বিচার হয়নি। প্রথমে তো হত্যার বিষয়টি স্বীকারও করেনি ভারত। সেরকম রক্তারক্তি পরিবেশে দু দেশের মাঝে পররাষ্ট্র আবার সচিব পর্যায়ে বৈঠকও হয়েছে এবং দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সে বৈঠকে বাংলাদেশের বুকের উপর দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার জোর দাবিও ভারতীয় পক্ষ থেমে ওঠানো হয়েছিল। কিন্তু  তাজা রক্তপাত আর ঠান্ডা লাশের পাহাড় অতিক্রম করে সে দাবি আলোচনার টেবিলে কোনো ফলোদয় ঘটাতে পারেনি।

সেই জুলাই আর আগস্ট পার হওয়ার পর এলো সেপ্টেম্বর। এই সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখে আবার ঢাকায় বসলো দু দেশের সমুদ্রসীমা ঠিক করা নিয়ে বৈঠক। বড় প্রতিবেশী বলে কথা। একদিক ফুটা হলেও আরেক দিকে পট্টি দিয়ে সম্পর্ক মধুর রাখতে চেষ্টা করতেই হয়। সে চেষ্টার ধারাবাহিকতাতেই প্রায় ২৮ বছর পর সসুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। একদিন, দুদিন, তিনদিন পার হয়েছে, ইস্যুগুলো সামনে এসে দাঁড়াতেই আলোচনার দম এবারের মতো ফুরিয়ে গেছে। সামনে আবার আলোচনা হবে, আবার আশাব্যঞ্জকফলপ্রসূ আলোচনার সম্ভাবনা ব্যক্ত হবে। তবে এবারের আলোচনা শেষ হয়ে যাওয়ার পর যে সত্যটি স্পষ্ট হয়ে গেছে সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের সীমানায় জেগে ওঠা দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মালিকানার দাবি ভারত সহজে ছাড়ছে না। কোন্ জায়গা থেকে এ দেশের সমুদ্রসীমা ধরা হবে এটাও যেমন এখনও সাব্যস্ত করা যায়নি, তেমনি হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর প্রবাহের গতিও চুড়ান্ত করা যায়নি। আর এই অস্পষ্টতার সুযোগটাই ভারতের হাতকে প্রলম্বিত করছে। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ নিজস্ব জলসীমায় ১২ নটিক্যাল মাইল, এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন এলাকায় ২০০ নটিক্যাল মাইল এবং কান্টিনেন্টাল সেলফে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল এলাকার অধিকার রাখে। তবে এখনও পর্যন্ত জরিপকাজ শেষ করতে না পারায় এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ার আশংকায় রয়েছে বাংলাদেশ। আগামী ২০১১ সালের ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে সমুদ্রসীমার ব্যাপারে বাংলাদেশের দাবির পক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত জাতিসংঘে জমা দিতে হবে। অপর দিকে লক্ষযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ভারত ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার ১৯ হাজার বর্গমিটার এলাকা লংঘন করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাচ্ছে। এজন্য আমাদের সমুদ্রসীমা দ্রুত বুঝে নেওয়ার প্রয়োজনীয় সব ধাপ অতিক্রম করা ছাড়া আমাদের সামনে কোনো পথ খোলা নেই।

গত ১৬ সেপ্টেম্বরের একটি দৈনিকে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগকে ইতিবাচক বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন, সমুদ্রসীমার বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বঙ্গোপসাগরে যে সম্পদ রয়েছে তার প্রতি সবার দৃষ্টি রয়েছে। আমাদের যৌক্তিক দাবি প্রতিষ্ঠা করার এখনই সময়। এরপর খ্যাতিমান এই কূটনীতিক কিছুটা কূটনৈতিক ভাষার ব্যবহার করে বলেছেন, ভারতের সঙ্গে যে আলোচনা শুরু হল তা ইতিবাচক। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে একমত হতে দু দেশের দুই যুগেরও বেশি সময় লেগেছে। সুতরাং একদফা আলোচনার মাধ্যমে সেসব সমস্যার সমাধান হবে- তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এটা নিয়ে আরো আলোচনা হবে। সমুদ্রসীমা নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত আছে । গত ৫/৬ বছরে এ ব্যাপারে বেশ অগ্রগতি হয়েছে।

বঙ্গোপসাগরে যে সম্পদ রয়েছে তার প্রতি সবার দৃষ্টি রয়েছে শমসের  মবিন চৌধুরীর এ বক্তব্যটির জের ধরেই বলা যেতে পারে যে, জল বা স্থলের যে কোনো স্থানের কোনো অংশ হাতছাড়া হওয়ার আশংকাই এখানে একমাত্র কথা নয়, লক্ষনিয় বিষয়টি হচ্ছে, নিজস্ব বিপুল সুপ্ত সম্পদের ওপর লোভাতুর কোনো শক্তির হাত বাড়ানোকে মেনে নেওয়া-না নেওয়ার বিষয়টি। যদি সম্ভাবনার সমুদ্রকে প্রতিবেশীর হাতে লুট হয়ে যেতে দেখেও আমরা ভয়ে কিংবা উদাসীনতায় নির্বিকার থাকার দৃষ্টান্ত পেশ করি তাহলে ভবিষ্যতের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে যেতে পারে।  শুধু নটিক্যাল মাইলের হিসাবের মারপ্যাঁচ তখন অজুহাত হবে না, প্রাপ্তির সম্ভাবনার ঘ্রাণ পেলেই ছুতানাতা যে কোনো অজুহাতে বড় প্রতিবেশী আধিপত্যের ফ্ল্যাগ উড়িয়ে দিবে। এভাবে একবার জিহবা বড় করতে দিলে এরপর নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা অনেক কঠিন হয়ে যাবে।

সেজন্যই মমতাহীন বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনার সৌজন্য চালিয়ে যেতে হলেও বাস্তবে নিজেদের দাবি ও  অধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক যুক্তি ও প্রমাণ, সবরকম কৌশল ও প্রয়াস এক সঙ্গে প্রয়োগ না করে সুফল পাওয়ার কোনো আশাই করা যায় না।

এজন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, নিশি্ছদ্র ও গ্রহণযোগ্য জরিপ পরিচালনা ও তার ফলাফল বের করা, আন্তর্জাতিক প্রচার কৌশলকে কাজে লাগানো, পৃথিবী বিখ্যাত সাংবাদিক-ভূগোলবিদদের দেশে এনে বাস্তব চিত্র দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে অনুকূল মতামত পরিবেশন করা এবং পৃথিবীর শক্তিশালী লবিং ফার্মগুলোর সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করা যেতে পারে। অমীমাংসিত সমুদ্রসীমার বিষয়টিকে আর হেলাফেলা করার সময় নেই। ছোট্ট এ স্বাধীন মুসলিম দেশটিতে আল্লাহ তাআলার দেওয়া কোনো বরকত-সমৃদ্ধি যেন হাতছাড়া না হয়-সেদিকে আমাদের নীতি নির্ধারকদের সতর্ক দৃষ্টি কামনা করতেই হয়। 

 

 

advertisement