শাওয়াল ১৪২৯   ||   অক্টোবর ২০০৮

নারীর প্রকৃত অবদানের মূল্যায়নই নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার যথার্থ উপায়

ইবনে নসীব

কোনো একজন লেখকের লেখায় পড়েছিলাম, তিনি সমাজজীবনে নারী ও পুরুষকে তুলনা করেছেন পানির দুটি উপাদান অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের সাথে। পানির অস্তিত্বের জন্য যেমন এ দুটি উপাদানের স্বাভাবিক অবস্থা বজায় থাকা অপরিহার্য তেমনি নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে যে সমাজ সেখানে উভয়ের স্বাভাবিকতাকে সংরক্ষণ করা অতি জরুরি। নারী বা পুরুষ কারো প্রকৃতিকে বিকৃত করে সুশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজের কথা কল্পনাও করা যায় না।

জগতের সকল বস্ত্ততেই এই কথা প্রযোজ্য। বস্ত্তসমূহের স্বাভাবিকতাকে বিকৃত করা হলে এবং যে কাজের জন্য তা সৃষ্ট তা ছাড়া অন্য কোনো কাজে তাকে ব্যবহার করা হলে সেটা কখনও যথার্থ ব্যবহার হয় না এবং এর প্রকৃত সুফল পাওয়া যায় না, উপরন্ত নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। দুধ পান না করে তা দিয়ে হাত ধোয়ার চেষ্টা করা হলে একে বুদ্ধিমানের কাজ বলা যাবে কি? হাত পরিষ্কার হবে কি না-এই তর্কে না গিয়েও একথা স্পষ্টভাবেই বলা যায় যে, জিনিসটা নষ্ট করা হল। এই সহজ কথাটাই আলোচ্য বিষয়েও বলতে চাই। মানবসমাজের অবিচ্ছেদ্য দুটি অংশ নারী ও পুরুষ। এদের কর্ম ও দায়িত্ব ভিন্ন ভিন্ন। সেই দায়িত্ব পালনের উপযোগী দৈহিক ও মানসিক গঠন দিয়েই তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। পুরুষের মৌলিক দায়িত্বের ক্ষেত্র যেহেতু বহির্জগৎ, তাই সেখানকার পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য উপযুক্ত শক্তি ও দৃঢ়তা তাকে দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে স্বভাবজাত কোমলতা দিয়ে। দৈহিক গঠনের দিক দিয়েও মাতৃত্বের যোগ্যতা কেবল নারীরই আছে, পুরুষের নেই। নারীর মৌলিক দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পাদন করার উপযোগী করেই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। পবিত্র কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে- (তরজমা) আমাদের পালনকর্তা তিনি যিনি সকল বস্ত্তকে তার (উপযুক্ত) আকৃতি দান করেছেন; এরপর (কর্ম ও দায়িত্বের প্রতি) পথ দেখিয়েছেন।-সূরা ত্বহা ৫১

অন্যর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- (তরজমা)এবং তিনি সকল বস্ত্তকে সৃষ্টি করেছেন। এরপর প্রত্যেক বস্ত্তর পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন। -সূরা ফুরকান ২

আজকের পাশ্চাত্য পন্ডিতবৃন্দ অনুভব করতে আরম্ভ করেছেন যে, স্বভাব ও প্রকৃতির সঙ্গে বিদ্রোহ করে কখনই সফল হওয়া সম্ভব নয়। এই বিদ্রোহের কুফল এত অসংখ্য জটিলতার আকারে প্রকাশ পায় যে, বাঞ্ছিত সুফল তো দূরের কথা, এই জটিলতাগুলোরই মোকাবেলা করা তখন একমাত্র মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপের একজন প্রখ্যাত লেখক ইউরোপীয় নারীদের চিত্রাংকন করেছেন এভাবে-কুদরত যে উদ্দেশ্যে তাদের সৃষ্টি করেছে এবং যে দায়িত্ব সম্পাদনের উপযুক্ত করে তাদের শরীর ও মানসকে তৈরি করেছে তারা তা বিস্মৃত  হয়েছে। তাদের মধ্যে সেই সব বৃত্তি ও বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণরুপে অনুপস্থিত যা তাদের সমবয়সী নারীদের মধ্যে দৃষ্টিগোচর হয়। বাস্তবিকপক্ষে এদেরকে না পুরুষ বলা যায়, না নারী। তারা যেন তৃতীয় কোনো জাতির নমুনা।

পুরুষের দৈহিক ও মানসিক গঠন এবং পুরুষোচিত বৈশিষ্ট্যাদি থেকে শূন্য হওয়ার কারণে তারা যদি পুরুষ না হয়, তবে তাদেরকে নারীও এজন্য বলা যাবে না যে, তাদের কাজকর্ম নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ইউরোপের বিজ্ঞানীরা এই বিশাল সামাজিক ত্রুটি নিয়ে যা প্রকৃতির নিয়মের সম্পূর্ণ পরিপন্থী চিন্তাভাবনা করেছেন। যদি এই বিশৃঙ্খল অবস্থা আরো কিছু দিন চলতে থাকে তবে বুঝতে হবে অতি শীঘ্রই  এমন এক সামাজিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে, যা জীবনের ভিত্তিমূলকেই নড়বড়ে করে দিবে।-মুসলমান আওরাত ৪৩-৪৪

সাপ্তাহিক টাইমস  ঞববহ ঝঁরপরফব  (কিশোরদের আত্মহত্যা) শিরোনামে আমেরিকার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সেই রিপোর্টে  দেখানো হয়েছিল যে, আমেরিকাতে ১০ থেকে ২০ বছরের কিশোরদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পেছনে কী কারণ কার্যকর ছিল তা ওই রিপোর্ট থেকেই শুনুন- ‘‘বারবারা হুইলার বলেন, আমার মনে হয় না আত্মহত্যার সময় এই বাচ্চারা ভাবে যে, আমরা মরতে যাচ্ছি; বরং তারা মনে করে এটা বেদনা উপশমের এবং সমস্যা সমাধানের একটি পন্থা

‘‘এলিন লীডার বলেন, আমরা সবাই এমনই দৌড়ঝাপের মধ্যে রয়েছি যে, আমাদের এতটুকু সময়ও নেই যে, আমরা আমাদের সন্তানদের কথাবার্তা শুনতে পারি। &

‘‘বারবারা ওলিয়ারি বলেন, যখন আমি এ ধরনের কোনো ঘটনা শুনি তখন আমি আমার সন্তানদের ব্যাপারে চিন্তায় পড়ে যাই। আমার তখন ইচ্ছা হয় আমি তাদেরকে সঠিকভাবে প্রতিপালন করি। এটা তাদের জীবনের ভয়ংকর সময়। আপনি সব সময় বুঝতেই পারবেন না তাদের মাথায় কী খেয়াল চক্কর দিচ্ছে’’ -খাতুনে ইসলাম ১২৩

তদ্রূপ নারীর নিজ কর্মক্ষেত্র যেখানে তার প্রয়োজন রয়েছে তা ছেড়ে দিয়ে যেখানে তার প্রয়োজন নেই তাতে প্রবেশ করার ফলাফল কী তাও টাইমসের রিপোর্ট থেকেই জেনে নিন।

আমেরিকার নারী আন্দোলনের প্রসিদ্ধ নেত্রী রোডা লেরম্যান ইন্ডিয়ান টাইম্সকে দেওয়া তার এক সাক্ষাতকারে বলেন- ‘‘আমি অত্যন্ত খারাপ সংবাদ নিয়ে এসেছি।’’ সমাজে নারীর পরিবর্তনশীল অবস্থান সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমেরিকাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৭৭ শতাংশ হল নারী ও শিশু। এর কারণ হিসেবে তিনি নারী ও পুরুষের উপার্জনের অসাধারণ ব্যবধানের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘‘পুরুষের তুলনায় নারীর উপার্জন ৬২ শতাংশ। কেননা তাদেরকে হালকা ধরনের কাজ দেওয়া হয়। একই ধরনের কাজের সুযোগ এবং একই ধরনের বেতন কেবল কল্পনা বিলাস মাত্র।’’ -খাতুনে ইসলাম ১২৯

বলাবাহুল্য, এমন হওয়াই স্বাভাবিক। যেখানে যার প্রয়োজন নেই সেখানে তার মর্যাদা কখনও অক্ষুণ্ণ থাকতে পারে না। নারীর মর্যাদা তার নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকার মধ্যেই নিহিত এবং একজন নারী সমাজকে তা-ই দিতে পারে যার উপযুক্ততা দিয়ে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত তিক্ত বাস্তবতা এই যে, নারীর বন্ধুবেশী শত্রুরা নারীর ওই স্বাভাবিক অবদানকে খাটো করে তাকে হীনম্মন্যতাগ্রস্ত করে দিয়েছে। আমাদের ভুলেগেলে চলবে না যে, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সত্যিকারের উপায় হল তার প্রকৃত অবদানকে মূল্যায়ন করা। নারীর প্রকৃত বন্ধু তারাই যারা তার প্রকৃত অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন করে।

 

 

advertisement