শাওয়াল ১৪২৯   ||   অক্টোবর ২০০৮

আল-কুরআনের এই কি মর্যাদা আমাদের কাছে!

মুহাম্মদ হেদায়াতুল্লাহ

প্রিয় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-আহসানুল কালামি কালামুল্লাহ (সর্বোত্তম কালাম আল্লাহর কালাম) অন্যত্র বলেছেন- খাইরু বিকাঈল আরদি মাসাজিদুহ (জমিনের সর্বোত্তম স্থান মসজিদ)।

আলকুরআনের এই শ্রেষ্ঠত্বের কথা শুধু মুসলমানরাই নয়, বরং পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সেই জাহেলী ভাষাবিদদের আত্মসমর্পণের ঘোষণা লাইসা হাযা-মিন কালামিল বাশার-এর সূত্র ধরে এযাবত বিশ্বের যে কোনো ধর্মাবলম্বী কুরআনের শত্রু-মিত্র সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।

আমরা মুসলমানরা বাস্তব জীবনে যতটুকুই মানি আর না মানি, কথাটি কিন্তু মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। অন্তত যারা মসজিদের মুসল্লী তারা তো অবশ্যই বিশ্বাস করে যে, জীবনে-মরণে প্রধান অবলম্বন আলকুরআন এবং একমাত্র কেন্দ্রস্থল সেই বাইতুল্লাহর প্রতিচ্ছবি মসজিদ ঘর।

আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যাদের অন্তরে কুরআন থাকবে জাহান্নামের আগুন তাদেরকে স্পর্শ করবে না। আর যাদের অন্তর মসজিদের সাথে লেগে থাকবে হাশরের ময়দানে তারা আরশের ছায়া পাবে। তাই কুরআনের সঙ্গে এবং মসজিদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আত্মার সম্পর্ক এবং হৃদয়ের গভীরের সম্পর্ক।

 

কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্য ও আফসোসের ব্যাপার হল আমাদের মসজিদগুলোতে কুরআন মজীদের দুরবস্থার দিকে তাকালে  তা বিশ্বাস হয় না; বরং এমন অবস্থা হয়ে থাকে যা দেখলে শত্রুদেরও করুণা না হয়ে পারবে না। শত্রুদেরও করুণা হবে কুরআনের প্রতি। করুণা হবে মসজিদের প্রতি-সর্বোপরি আমাদের মুসলমান নামের মানুষগুলোর প্রতি। কারণ, না মানলেও কুরআনের মর্যাদা সম্পর্কে এখন তারাও অনেকটা অবগত। একদম অজপাড়া গাঁয়ের জীর্ণ ছাপড়ার মসজিদ বলুন আর শহরের অভিজাত এলাকায় কোনো আলীশান মসজিদ বলুন, অধিকাংশ মসজিদে ঢুকলেই কুরআন মজীদগুলোর যে করুণ দৃশ্য চোখে পড়ে তা অবাক করার মতো এক লজ্জাজনক ব্যাপার।

কিছু ছেড়া-ফাড়া, কিছু বাঁধাই ছুটা, সেলাই খোলা- এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। আর ধুলামলিন যে কী পরিমাণ হয় তা তো সবার চোখের সামনে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর হাত না লাগলে যা হবার তাই হয়ে থাকে। ধুলা-বালি জমতে জমতে ময়লার এমন স্তর পড়ে যায়, যা শুধু মসজিদের মতো পবিত্র জায়গাই নয় মানববসতির যেকোনো একটি সাধারণ পরিবেশেও বেমানান। যে মসজিদের এমন করুণ পরিস্থিতি এবং যে কুরআন মজীদ আমাদের হাতে এমন নিগ্রহের শিকার সেই মসজিদে গিয়ে সেই কুরআন থেকে কীভাবে আমরা আত্মার পরিশুদ্ধির দীক্ষা নিব? অন্তরের পরিচ্ছন্নতার খোরাক পাব?

 

নিশ্চয়ই কুরআন ও মসজিদের সঙ্গে ভালবাসার বিষয়টা ঈমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু তবুও বলতে হয় এবং বাস্তবতাও এটাই যে, একটি মসজিদে শত শত নিয়মিত মুসল্লী আসেন। একজন মুসল্লীও যদি এমন থাকতেন যার অন্তরে কুরআন ও মসজিদের কিংবা যেকোনো একটির পূর্ণ ভালোবাসা আছে অথবা তার গুরুত্বের উপলব্ধিটুকু অন্তত আছে তাহলেও মনে হয় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারত না। কারণ আমরা যারা শহরের বসতিতে কিংবা গ্রামের জীর্ণ কুটিরে বাস করি তাদের কারো ঘরেই আমার মনে হয় সাধারণ একটি বই কিংবা একটি খাতা এমন অযত্ন অবহেলায় ধুলামলিন হয়ে পড়ে থাকার কোনো সুযোগ কখনো পায় না। পড়ে থাকা বস্ত্তটা যদি আদবযোগ্য হয় তাহলে অন্তত কুঁড়ে ঘরের শ্রী রক্ষার জন্য হলেও তা সঙ্গে সঙ্গেই গুছিয়ে রাখা হয়। আর আমরা যারা আলীশান প্রাসাদের বাসিন্দা তাদের প্রাসাদে  তো এমন দৃশ্য কখনো কল্পনা করাও কঠিন। অথচ যে মসজিদের কথা বলছি আমরা কিন্তু সে মসজিদেরও বাসিন্দা। শুধু ইহকালের নয় চিরকালের বাসিন্দা।

একটু লক্ষ করে দেখুন তো আপনার বুকসেলফে গল্প-উপন্যাসের যে বইগুলো আছে তার উপরও কি এরকম ধুলাবালি কখনো জমেছে যা আপনার মসজিদের কুরআন মজীদের উপর জমে আছে। আপনার কোনো অসুস্থতার সময় বা জীবনের সবচে ব্যস্ততার সময়েও কি আপনার বসবাসের কামরা এবং কামরার বইপত্র বা অন্য কোনো আসবাবপত্র এমন এলোমেলো হয়ে পড়েছিল যেমন এলোমেলো হয়ে বছরের পর বছর পড়ে আছে আপনার মসজিদের কুরআন মজীদগুলো।

এখন যদি আমরা ভাবি যে, এটা আসলে কুরআনের প্রতি মসজিদের প্রতি আমাদের হৃদ্যতার অভাব, ভালোবাসার অভাব, সর্বোপরি আমাদের ঈমানের দুর্বলতা তবে কি আমাদের এ ভাবনা অমূলক হবে? অবশ্য শহরের এবং গ্রামের বিশেষ বিশেষ মসজিদগুলো যেহেতু সাধারণ সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা এবং কার্যকরী কমিটির অধীনে থাকে তাই এ সমস্যার সমাধানে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার হয় তা যেকোনো সাধারণ মুসল্লীর পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে একক ও পরিপূর্ণভাবে নেওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। যদিও যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকুও আমরা সাধারণত করি না।

 

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কিছু সচেতন ও রুচিশীল মুসল্লী বা কমিটির দায়িত্বশীলদের সজাগ দৃষ্টির ফলে বেশ কিছু মসজিদ এর ব্যতিক্রম আছে। আমরা তাদের কর্মকে প্রশংসার সঙ্গে স্মরণ করছি। বিশেষত মুহিউস সুন্নাহ হযরত মাওলানা আবরারুল হক হারদুঈ রাহ.-এর একান্তই আন্তরিক চেষ্টার বদৌলতে আমাদের দেশের বেশ কিছু মক্তব ও মসজিদ-মাদরাসায় এ অবস্থার অবসান হয়েছে। এবং তাঁর সাথে সম্পৃক্ত লোকদের মাঝেও এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব ও তৎপরতা দেখা যায়। তাদের মধ্যে হযরত প্রফেসর মুহাম্মদ হামীদুর রহমান দামাত বারাকাতুহুম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমার এ লেখার বীজও সম্ভবত তাঁর মাধ্যমে হযরত হারদুঈ রাহ.-এর দিলের ব্যাকুলতার দ্যুতিচ্ছটা হয়ে থাকবে। আল্লাহ তাঁকে এবং তাদের সকলকে উত্তম জাযা দান করুন। আমীন। তো যে কথা বলছিলাম যে, আমাদের মসজিদে মসজিদে কুরআন মজীদগুলো যে দুরবস্থায় পড়ে থাকে তা সত্যিকার অর্থেই এক ভয়ংকর ও অমার্জনীয় অপরাধ, যার দায় ও পরিণাম গোটা সমাজের উপর বর্তায়। তাই এ অবস্থার পরিবর্তনে সাধ্যমতো সচেষ্ট হওয়া সমাজের প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব। যদিও মসজিদ-কর্তৃপক্ষ বিশেষত ইমাম-মুয়াজ্জিন ও খাদেমের দায়িত্ব এখানে প্রধান। এ অনাকাঙ্খিত অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার মূলে অন্তর্নিহিত যে কারণটি সক্রিয় তা  অতি  দুঃখজনক  হলেও  বাস্তব। তা হল আমাদের ঈমানী দুর্বলতা এবং আল্লাহর কালামের প্রতি আমাদের যথাযথ আযমত ও মুহাববতের অভাব। কারণ কোনো বস্ত্তর ভালবাসা কারো অন্তরে থাকলে ঐ বস্ত্তর আদর-কদরের কথা তাকে বলে দিতে হয় না। তাই আমাদের প্রথম কাজ এবং প্রধান কাজ হবে আমাদের জংধরা অন্তরের ঈমান তাজা করা এবং তাতে আল্লাহর ভালবাসা এবং তাঁর দ্বীন ও দ্বীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুর ভালবাসা বৃদ্ধির চেষ্টা করা।

এজন্য আমরা সকল এলাকায় মসজিদভিত্তিক কুরআন তেলাওয়াতের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে এর অনেক ফায়দা পেতে পারি। যেহেতু এ সমস্যার প্রকৃত কারণ হল আমাদের ঈমানী দুর্বলতা এবং আমাদের অন্তরে কুরআনের আযমত ও মুহাববতের অভাব তাই এই অভাব দূর হয়ে একদিনেই তেলাওয়াতের পরিবেশ তৈরি হয়ে যাবে না। এর জন্য আমাদেরকে দীর্ঘমেয়াদি ও ধারাবাহিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে হবে।

 

এ উদ্দেশ্যে আপাতত আমরা যে পদক্ষেপগুলো হাতে নিতে পারি তা এরকম-

 

(ক) প্রত্যেক মসজিদে শিশুদের কুরআন শিক্ষার এমন ব্যবস্থা করা যাতে ধনী-গরীব সকলের সন্তানই অংশগ্রহণ করতে পারে। এখানে একটি লক্ষণীয় বিষয় হল, বিশেষত শহরের মসজিদগুলোতে কোথাও কোথাও এ ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে দেখা যায় একান্ত গরীব কিংবা খুব বেশি হলে মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরাই শুধু অংশগ্রহণ করে।  ধনীরা তাদের  সন্তানকে সেখানে পাঠাতে লজ্জা বা অসম্মান বোধ করেন। তারা কেন এমন বোধ করেন তা আমাদের জানা নেই, তবে বাহ্যত যা মনে হয় তা হল মসজিদ বা কুরআন শিক্ষার মক্তবগুলোতে সাধারণত তেমন উন্নত পরিবেশ থাকে না। সাদামাটা পরিবেশে চাটাইয়ে বসে পড়তে হয় এবং গরীবদের সাথে একই পরিবেশে একই মানের সবকিছুতে সমানভাবে থাকতে হয়। যারা এজন্য তাদের সন্তানকে কুরআন শিক্ষা ও দ্বীন শিক্ষা থেকে দূরে রেখেছেন তাদের প্রতি প্রথম কথা হল, পরিবেশের দোহাই একটা ছুতামাত্র। আসল কথা হল আমাদের অন্তরের পরিবেশ  অন্তরে কুরআনী পরিবেশ তৈরি করে দেখুন- কুরআন শিক্ষা করার  এবং সন্তানদেরকে শিক্ষা দেওয়ার অনেক পরিবেশ পাওয়া যাবে।

 

দ্বিতীয় কথা হল, আমাদের      সন্তানের লেখাপড়ার পরিবেশ যদি না থাকে তাহলে তা তৈরি করার দায়িত্ব কার? কুরআন শিক্ষার বেলায় একথা কি কখনো ভেবেছি? আমরা যারা জাগতিক শিক্ষার জন্য একটি শিশু-সন্তানের পেছনে মাসে পাঁচ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা বা আরো বেশি ব্যয় করি, মায়েরা বাচ্চার জন্য দৈনিক দুই বার স্কুলে যাওয়া-আসা করি, ছায়াহীন মাঠে বা ফুটপাথে বসে রোদে পুড়ে সন্তানের ছুটির অপেক্ষা করি। স্কুল-কর্তৃপক্ষের যাবতীয় শর্ত সন্তানের কল্যাণ-চিন্তায় সাদরে গ্রহণ করি, সেই সন্তানটিরই যখন কুরআন শিক্ষার প্রশ্ন আসে, তখন আমরা সে মা-বাবারাই তার একদশমাংশ ঝামেলা বহন করতেও কি প্রস্ত্তত থাকি?

 

এটা আমাদের নিয়তির অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক সত্য যে, আমরা যে যত বড় বিত্তবান হই সে তত গুরুত্বহীন মনে করি সন্তানের কুরআন শিক্ষা তথা দ্বীন শিক্ষার   বিষয়টিকে।  অনেকে  তো  সন্তানদেরকে এ বিষয়ে এতই মূর্খ রেখে দেয় যে, সে যে মুসলমান একথার ভিত্তি মুসলমানের সন্তান মুসলমান-এছাড়া আর কিছুই সে জানে না। এমনকি কালিমা তাইয়্যিবা কী, তার নবী কে তা-ও সে জানে না।

প্রিয় পাঠক! মনে রাখবেন, এই কোমলমতি কচি শিশু আমাদের হাতে আল্লাহর মহান আমানত। ইচ্ছা করলে আমি তাকে জাহান্নামের লাকড়ী হওয়ার সমূহব্যবস্থা করে দিতে পারি আর চাইলে জান্নাতের পথে আগুয়ান হওয়ার পরিবেশেও লালন-পালন করতে পারি।

আল্লাহ কিন্তু তাঁর মহান আমানত শুদ্ধভাবেই আমাদের কাছে পেশ করেছেন। হাদীসের ভাষ্যমতে প্রতিটি মানবশিশুই সত্য স্বভাব নিয়ে জন্মলাভ করে। তারপর তার পিতা-মাতাই ঈমান ও সত্য থেকে তাকে বিচ্যুত করে, ইহুদী নাছারা বা অগ্নিপূজারি কিংবা তাদের অনুগামী বানায়।

 

একটু চিন্তা করুন। যারা সন্তানের ষাট বছর জীবনের কল্যাণচিন্তায় পাগলের মতো ছুটে বেড়ান সেই সন্তানের অসীম জীবনের কথাও একটু ভাবুন। ভেবে দেখুন, আপনার সন্তানকে আপনার সামনে আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। কেমন হবে তখন? সুতরাং সে জীবনের কথা চিন্তা করে নিজের কর্মপন্থায় পরিবর্তন আনুন। তার কচি হৃদয়ে একটু হলেও ঈমানের বীজ লাগিয়ে দিন। কুরআনের সামান্য আলো জ্বেলে দিন। যাতে কিয়ামতের দিন সে আপনার বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের না করে -

(তরজমা) হে আমাদের প্রতিপালক! যেসব জ্বিন ও মানব আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে তাদেরকে দেখিয়ে দাও আমরা তাদের পদদলিত করব যাতে তারা লাঞ্ছিত হয়। -সূরা হা-মীম সাজদা ২৯

(খ) প্রতি মসজিদে বয়স্কদের কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ যারা সময়মতো কুরআন পড়া শিখেননি এবং এখন কর্মব্যস্ততার কারণে তা করছেন না বা করতে পারছেন না তাদের জন্য এ কোর্সের ব্যবস্থা করা। এ কাজে অনেকে তো নিজ থেকেই শরীক হবেন। কিন্তু যারা শরীক হবেন না তাদেরকেও বুঝিয়ে সুজিয়ে শরীক করতে হবে।

(গ) প্রত্যেক মসজিদে কাতারের ফাঁকে ফাঁকে কুরআন মজীদ রাখার জন্য রেকের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে নামাযের আগে দুই চার মিনিট সময় পেলে বা নামাযের পর  যেকোনো সময়ই যে কেউ সহজেই তেলাওয়াত করার সুযোগ পায়।

(ঘ) মাঝে মধ্যে কুরআনের মুহাববত, কুরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব, ফযীলত ইত্যাদির উপর ব্যাপক আকারে মাহফিল বা সাধারণ মজলিস ও আলোচনাসভার আয়োজন করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত : বাহ্যিক যে কারণগুলো এখানে বিদ্যমান তাতে একটু পেছনের দিকে তাকালে বাহ্যত দূরবর্তী দুটি কারণ পাওয়া যায়। যথা, এক. নিম্নমানের কাগজে নিম্নমানের ছাপা। অর্থাৎ কিছু প্রকাশনা আছে, যারা (জানি না কী উদ্দেশ্যে) এত নিম্নমানের কাগজ এবং এত নিম্নমানের ছাপার কোরআন মজীদ প্রকাশ করেন যা খুবই অরুচিকর এবং কুরআন মজীদের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। এরকম কুরআন মজীদ হাতে নিয়েও অনেকে তেলাওয়াতের আগ্রহ হারিয়ে তা রেখে দেয়।  ফলে দিনের পর দিন মাসের পর মাস তা পরিত্যক্ত হয়ে ধুলামলিন হতে থাকে। আমার ধারণা বর্তমান বাজারে খোঁজ নিলে কুরআন মজীদের যত নিম্নমানের কাগজের কপি অহরহ পাওয়া যাবে এই মানের দ্বিতীয় আর কোনো বইয়ের কপি হয়তো পাওয়া যাবে না।

 

আমরা প্রথমে সেই ভাইদেরকে অনুরোধ করব দয়া করে আপনারা একাজ থেকে বিরত থাকুন। আপনাদের উদ্দেশ্য  কী, জানি না। হয়তোবা গরীবদের হাতে কুরআন পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু আমরা মনে করি এর কোনোই প্রয়োজন নেই। দ্রব্যমূল্যের এই চরম উর্ধ্বগতির মুহূর্তেও গরীব বাংলাদেশের গরীব জনগণ যারা কুরআন পড়েন, ভালোবাসেন তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা- ভুল বলছি, বলা দরকার, তাদের মানসিকতা এখনো এই অবস্থায় পৌঁছেনি যে, ৬০/৭০ টাকার পরিবর্তে যখন এক কপি কুরআন মজীদের সর্বনিম্ন হাদিয়া হবে ১০০/১২০ টাকা তখন তারা অতিরিক্ত ৪০/৫০ টাকার জন্য এক কপি কুরআন সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকবেন; বরং আমার ধারণা যদি  দুই শ টাকাও হয় এক কপি কুরআন মজীদের সর্বনিম্ন হাদিয়া, তবুও একজন রিক্সাচালক কিংবা যেকোনো স্তরের দিনমজুরের    সন্তানও যখন বাবাকে বলবে আমার আমপারা শেষ হয়েছে এখন কুরআন মজীদ লাগবে তখন সে আনন্দের সাথেই তা সংগ্রহ করে দিবে। এর জন্য কুরআনের প্রতি যে পরিমাণ ভালবাসা এবং সে অনুপাতে যে পরিমাণ স্বচ্ছলতা দরকার তা এখনো সর্বসাধারণের অন্তরে বিদ্যমান আছে।

 

আর যদি কেউ অতি মুনাফার উদ্দেশ্যে এমনটি করে থাকেন তাহলে আমরা তাকে অনুরোধ করব অন্তত কুরআনের খাতিরে অধিক মুনাফার লোভটা সংবরণ করুন। কারণ বর্তমান বাজারে প্রকাশনা জগতের ব্যবসায়িক দিক যতটা অগ্রগতি পেয়েছে তাতে আপনি যদি কুরআনের আযমত ও মহববতের দাবি আদায় করে এবং কুরআনের শান ও মান বজায় রেখে কুরআনের কপি ছাপেন তাহলেও আপনার ব্যবসা অবশ্যই চলবে।

 

তাছাড়া কুরআনের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ঈমানের সম্পর্ক, আত্মার সম্পর্ক, হৃদয়ের গভীর ভালবাসার সম্পর্ক এবং আখেরাতের ব্যবসার সম্পর্ক; দুনিয়ার ব্যবসার নয়।

 

দ্বিতীয় কারণটি  হল কথায় কথায় মসজিদে কুরআন মজিদ দান করা। অর্থাৎ কিছু লোক আছে যারা কোনো দান-সদকার প্রশ্ন আসলেই মসজিদে মোমবাতি আর কুরআন মজীদ দেওয়ার মান্নত করে বসেন এবং কারো সঙ্গে পরামর্শ না করেই ৩০০ টাকার এক কপি কিংবা দুই কপি কুরআন মজীদ না  কিনে বেশি দেওয়ার মানসে বাজারের সবচে কম দামের পাঁচ কপি কিনে বসেন। ফলে দেখা যায় প্রত্যেক মসজিদে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি কপি জমা হয়ে তা অযত্ন ও অব্যবহারের শিকার হয়।  এতে কুরআনের অযত্নের পাশাপাশি অর্থেরও অপচয় হয়।

তাই আমরা যারা এমন করি তাদের উচিত যেখানে দান করব প্রথমে সেখানকার কোনো কর্তর্ৃপক্ষ কিংবা কোনো আলেমের সঙ্গে পরামর্শ করা। যাতে আমার দানটা যথাস্থানে খরচ হয়ে অধিক থেকে অধিক কাজে লাগে এবং আমিও অধিক ছওয়াবের অধিকারী হতে পারি। কারণ এখানে আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে কুরআন মজীদ দান করলে যে বেশি ছওয়াব পাওয়া যাবে, বিষয়টি এমন নয়; বরং ক্ষেত্র বিশেষে অন্য খাতে ব্যয় করেও বেশি ছওয়াব পাওয়ার অনেক পথ রয়েছে।

এরপর আমরা যারা মসজিদ-কর্তৃপক্ষ বা সাধারণ মুসল্লী তাদের কর্তব্য  হবে প্রথমে ব্যবহারের অনুপযোগী ছেঁড়াফাড়া যে কপিগুলো থাকবে সেগুলো সযত্নে মসজিদের দৃশ্যমান খোলা জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলা। সরিয়ে সসম্মানে সম্ভব হলে কোথাও সংরক্ষণ করেও রাখা যেতে পারে। অথবা কোনো পবিত্র কাপড়ে পেঁচিয়ে সঙ্গে ভারি কোনো পাথর দিয়ে নদীর পরিষ্কার পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এরপর ব্যবহার উপযোগী যে কপিগুলো থাকবে সেগুলোতে সামর্থ্যবান কেউ বা কয়েকজন মিলে ভালো গিলাফ লাগিয়ে নিয়মিত তেলাওয়াত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখতে পারি। পরিষ্কার করার কাজ যে শুধু মসজিদের খাদেম বা মুয়াজ্জিন সাহেবকেই করতে হবে এমন নয়; বরং এমন একটি পুণ্যের কাজে  আমরা যে কেউ অংশ গ্রহণ করে নিজের ভাগ্যের দুয়ার খুলতে পারি। আর খাদেম-মুয়াজ্জিনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যদের জন্য তো এর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা খুবই জরুরী। #

 

 

advertisement