শাওয়াল ১৪২৯   ||   অক্টোবর ২০০৮

বাইতুল্লাহর মুসাফির-১৪

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সূর্য যখন পূর্ণ অস্ত গেলো, হযরত তখন গাড়ীতে আরোহণ করলেন। যদিও গাড়ীর চালক তাড়াহুড়া করছিলো, কিন্তু হযরত সূর্যাস্তের পর রওয়ানা দেয়ার বিষয়ে অবিচল ছিলেন। এমনকি হযরত একবার সাফ বলে দিলেন, গাড়ীওয়ালাকে চলে যেতে বলো, আমরা নিজেদের ইন্তিযামে যাবো। গাড়ীর চালক তখন আপসে আপ ঠান্ডা হয়ে গেলো। হযরতের ইসতিগনা ও তাওয়াক্কুলের এরকম আরো কিছু নমুনা সফরের বিভিন্ন সময় আমরা দেখতে পেয়েছি। কিন্তু এখানেও সেই এককথা, দেখতে পাওয়া যথেষ্ট নয়। যা দেখো তা গ্রহণ করো এবং মান্য করো। নচেৎ তোমার দেখা সাক্ষি হয়ে যাবে তোমারই বিপক্ষে।

গাড়ীতে ওঠার সময় হযরত নিজেও তালবিয়া বললেন, আমাদেরও বলালেন-

লাববাইক, আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা শারীকা লাকা লাববাইক। ইন্নাল হামদা ওয়াননিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাক।

গাড়ী চলতে শুরু করলো আরাফা থেকে মুযদালিফা অভিমুখে। আমরা একা তো নই; লাখ লাখ হাজী, হাজার হাজার গাড়ী। সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও কিছু কষ্ট, কিছু সমস্যা তো হবেই; কিছু গোলযোগ, কিছু বিশৃংখলা তো থাকবেই! কিন্তু তুমি যদি এসে থাকো প্রেম ও ভালোবাসার স্বাদ গ্রহণ করার জন্য, তোমার দিল যদি উন্মুখ থাকে ইশক ও

মুহাববাতের লয্যত হাছিল করার জন্য তাহলে অবশ্যই তুমি ভাববে  তেমন করে যেমন  ভেবেছেন আমাদের হযরত এবং ভেবেছেন যুগে যুগে আল্লাহর নেকবান্দারা!

একটু এগিয়েই গাড়ী যখন থেমে গেলো, হযরত তখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। দূরের পাহাড়গুলো তখন আবছা দেখা যায়। হযরত বললেন, আরাফার ময়দান বোধ হয় আমাদের ছাড়তে চায় না; আমরাও কি ছাড়তে চাই! তবু যেতে হবে, কারণ মাওলার ডাক এসেছে মুযদালিফা থেকে। তবে গাড়ী যতক্ষণ চলবে না ততক্ষণ ভাববো, কোন এক বাহানায় মাওলা আমাদের আরো কিছুক্ষণ রাখতে চান আরাফার ময়দানে, জাবালে রাহমাতের ছোহবতে!

 শোনো, আল্লাহর পাগল কী বলে শোনো! দেখো, মাওলার আশেক মজনু যারা তাদের ভাবনা কেমন হয় দেখো! এমন করে যদি ভাবতে পারো, এমন করে যদি বলতে পারো তাহলে সার্থক তোমার বাইতুল্লাহর সফর।

 থেমে থাকা গাড়ী আবার সচল হলো। আমি তাকালাম বাইরে, আমার প্রিয় আরাফার পাহাড়গুলোর দিকে। বিদায় আরাফা, বিদায়! জীবনের অত্যন্ত মধুর একখন্ড স্মৃতি বুকে ধারণ করে তোমাকে বিদায়! আমার উপস্থিতি তোমাকে মলিন করেছে, তবু তুমি আমাকে বরণ করেছো, তবু তোমার প্রশস্ত বুকে আমাকে তুমি ধারণ করেছো, সে জন্য কৃতজ্ঞচিত্তে তোমাকে আমি ভালোবাসবো; আজীবন ভালোবেসেই যাবো। প্রিয় আরাফা, আমি কি পারবো আবার ফিরে আসতে তোমার বুকে! আমি জানি না, তিনি জানেন; তিনি যদি দয়া করেন! তবে আবার আমি শুরু করবো নতুন করে স্বপ্ন দেখা! স্বপ্ন ছাড়া জীবন তো কখনো হয় না জীবনের মত! আমি স্বপ্ন দেখবো। যিনি আমাকে স্বপ্ন দেবেন, তিনিই স্বপ্নকে পূর্ণতা দান করবেন।

পিঁপড়ের গতিতে এগুচ্ছে গাড়ীর দীর্ঘ সারি। হেঁটে গেলে অনেক আগে পৌঁছে যাওয়া যায়; যাচ্ছেনও আল্লাহর অনেক বা-হিম্মত বান্দা! ছোট ছোট সামান পিঠে, কাঁধে বা মাথায় নিয়ে আমাদের গাড়ী অতিক্রম করে করে চলে যাচ্ছেন তারা, অনেক মহিলাও আছেন, পিঠে থলিয়ার ভিতর ঝুলছে তাদের শিশু! শুধু মাথাটা বের করে আছে, আর অবাক চোখে তাকিয়ে আছে জনস্রোতের দিকে! দেখতে বড় ভালো লাগে। এরা অধিকাংশ নাইজেরিয়ান, কিংবা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের! এদের দিলটা খুব সাদা, হাস্যোজ্জ্বল মুখের দাঁতগুলো যেমন!

একসময় বাস যেখানে এসে আটকা পড়লো তার একটু সামনে মসজিদে নামিরা। মসজিদের কিছু অংশ মাওকিফের অন্তর্ভুক্ত, আর কিছু অংশ বাতনে ওরায়নার

অন্তর্ভুক্ত, যা মাওকিফ নয়। শুনেছি মসজিদের ভিতরে মেঝেতে লাল দাগ দিয়ে মাওকিফবহির্ভূত অংশকে চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে। দিনের বেলা দূর থেকে মসজিদের মিনার দেখেছি, মসজিদের জামাতে শরীক হওয়ার তাওফীক হয়নি। হজ্বের ইমাম এই মসজিদে যোহরের সময় যোহর ও আছর একত্রে পড়ান, তারপর হজ্বের গুরুত্বপূর্ণ খোতবা দান করেন। এখানেই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফাদিবসের ঐতিহাসিক খোতবা দান করেছেন, যা বিদায় হজ্বের ভাষণ নামে পরিচিত।

এখন হজ্বের খোতবা কখন হয়, কিভাবে হয় তা বোঝার উপায় নেই। আরাফায় অবস্থানকারী হাজীদের খুব কম অংশই মসজিদে নামিরায় হাযির হতে পারে, তদুপরি রয়েছে ভাষার সমস্যা। আরাফার ময়দানে হজ্বের খোতবা সকলে শুনতে পারে এবং বুঝতে পারে তার উপযুক্ত কোন ব্যবস্থা অবশ্যই হওয়া দরকার।

থামতে থামতে এবং চলতে চলতে অবশেষে অনেক রাত করে আমাদের গাড়ী মুযদালিফায় পৌঁছলো। মিনা থেকে মুযদালিফা হয়ে আরাফায় যেতে হয়। আরাফা থেকে ফেরার পথে মুযদালিফায় রাত যাপন করে ভোরে মিনায় ফিরে আসতে হয়। মক্কা থেকে মিনা, মুযদালিফা ও আরাফা; আবার আরাফা থেকে মুযদালিফা, মিনা ও মক্কা; এই হলো হজ্বের সফর। মক্কা থেকে মিনার দূরত্ব তিন মাইল, মিনা থেকে আরাফার দূরত্ব ছয় মাইল। সুতরাং মক্কা থেকে আরাফার দূরত্ব নয় মাইল।

আবু হানীফা (রহ) এর মাযহাব মতে মুযদালিফায় রাত যাপন করা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ,

পক্ষান্তরে ফজরের পরে এবং সূর্যোদয়ের পূর্বে অবস্থান করা হলো ওয়াজিব। অর্থাৎ

মুযদালিফায় রাত্রি যাপন এবং ফজরের পর অবস্থান গ্রহণ, দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। যারা ফজরের আগেই মুযদালিফা থেকে বের হয়ে যায় তারা হজ্বের একটি ওয়াজিব তরক করে, সুতরাং তাদেরকে ওয়াজিব তরকের ক্ষতিপূরণরূপে দম দিতে হবে।

আরেকটি বিষয়, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরিবারের দুর্বলদেরকে চাঁদ অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিনায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে তারা ভিড়ের কষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে এবং আগে ভাগে রামী করে ফেলতে পারে। তবে তিনি তাদেরকে সূর্যোদয়ের পরে রামী করার আদেশ করেছিলেন। এদের মাঝে ছিলেন উম্মুল মুমিনীন হযরত সাওদা, উম্মে সালামা ও উম্মে হাবীবা (রা) এবং বালক আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা)।

ইবনে আববাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আববাসকে বললেন, আপনি আমাদের দুর্বলদের এবং আমাদের নারীদের নিয়ে চলে যান; তারা যেন মিনায় ফজর পড়ে।

নারী, বালক ও অক্ষম বৃদ্ধরাই হলো দুর্বল। অসুস্থরাও এর

অন্তর্ভুক্ত হবে, এমনকি যারা এদের নিয়ে যাবে তারাও। সুতরাং এদের উপর কোন দম ওয়াজিব হবে না এবং গোনাহও হবে না, বরং নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদত্ত এই অবকাশ গ্রহণ করাই উত্তম। শরীআতের প্রতিটি বিধানেই এভাবে বান্দার প্রতি রয়েছে অশেষ দয়া ও করুণা।

মুযদালিফায় পৌঁছার পর হযরত জামাতের সাথে মাগরিব ও এশার নামায আদায় করলেন, যেমন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন।

সারা জীবন আছর পড়েছি আছরের সময়, আজ আছর পড়লাম যোহরের সঙ্গে যোহরের সময়। সারা জীবন মাগরিব পড়েছি মাগরিবের সময়, আজ মাগরিব পড়লাম মুযদালিফায় এশার সঙ্গে এশার সময়। কারণ এটাই আল্লাহর হুকুম। আর আমি  তো আল্লাহর আশিক বান্দা। আমি তো শরীআতের নির্দিষ্ট কোন আহকাম ও বিধানের অনুগত নই, আমি শুধু আল্লাহর অনুগত বান্দা। তাঁর হুকুমে আমি আজ সারা জীবনের অভ্যস্ত আমলও ছেড়ে দেবো। আশিক ও প্রেমিক তো দেখে শুধু, তার মাশুক ও প্রেমাস্পদের কী ইচ্ছা!

আমরা তো নগণ্য উম্মত; শ্রেষ্ঠ রাসূল এবং শ্রেষ্ঠ আশিক হাবীবে খোদা ও মাহবূবে ইলাহী মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এভাবেই আল্লাহর আদেশ পালন করেছেন এবং আল্লাহর ইচ্ছা পূর্ণ করেছেন। তাই আরাফার দিনে কোন মূর্খ যদি আছরের সময় আছর এবং মাগরিবের সময় মাগরিব পড়ে তাহলে সে হবে মহাপাপী, মহানাফরমান।

আমার ধারণা ছিলো মাগরিব ও এশার পর হযরত নফল নামাযে দাঁড়িয়ে যাবেন এবং যিকির ইবাদতে মশগুল হবেন। কিন্তু না, তিনি বরং বিশ্রামের আয়োজন শুরু করলেন। আমি অবাক হলাম। কারণ হযরতের বয়সের কোন বৃদ্ধের জন্য এটা স্বাভাবিক হলেও রাতের ইবাদতের ক্ষেত্রে আমরা তো তাঁকে তরুণদের চেয়েও তরুণ দেখে এসেছি! তাই হযরতকে এ রাতের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। হযরত মৃদু হাসলেন। ছোটদের যে কোন অবুঝ প্রশ্নের ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম উত্তর হতো এই মৃদু-মধুর হাসিটুকু! তিনি বললেন, মিয়াঁ! প্রত্যেক কাজে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করার মাঝেই হলো কামিয়াবি। আর মুযদালিফার রাতে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজর পর্যন্ত বিশ্রাম করেছেন। তারপর ফজর আদায় করে সূর্যোদয় পর্যন্ত অকূফ করেছেন। এমনকি আজকের রাত্রে তিনি তাহাজ্জুদও পড়েননি! উম্মতের আরামের কথা চিন্তা করে তিনি এই সুন্নত জারি করেছেন। কারণ যোহর থেকে মাগরিব পর্যন্ত কেটেছে আরাফায় দুআ-মুনাজাত ও রোনাযারিতে। আবার পরদিন মিনায় রয়েছে রামী ও কোরবানির কঠিন আমল, তারপর মক্কায় গিয়ে তাওয়াফে যিয়ারাত। সুতরাং আজকের রাত্রে বিশ্রাম করাই উত্তম। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ...

 তোমার শরীরেরও রয়েছে তোমার উপর হক

সুবহানাল্লাহ! হযরতের বক্তব্যে পেয়ারা নবী রাহমাতুল লিল আলামীন ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের নতুন একটি সৌন্দর্য আমার সামনে উদ্ভাসিত হলো।

মুযদালিফায় খোলা আকাশের নীচে রাত যাপনের স্বাদ ও আনন্দই আলাদা। তদুপরি এই স্বাদ ও আনন্দকেই শরীআত বলেছে ইবাদত!

হযরত শুয়ে পড়লেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন। এটা হযরতের সারা জীবনের নেক আদত। যে কোন স্থানে যে কোন অবস্থায় তিনি শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়তেন, আবার সময় হওয়ামাত্র  চোখ খুলে যেতো। তখন তাঁকে মনে হতো একদম তাজাদম।

একটু দূরে কিছুটা একা হয়ে আমি ঘুমোতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম আসে না, আসে বিভিন্ন রকম

চিন্তা। উপরে আমার তারাভরা আকাশ এবং একটি প্রায়পূর্ণ চাঁদ; নীচে মুযদালিফার মরুভূমির বালু। আকাশের সৌন্দর্য আমাকে যেমন মুগ্ধ করলো তেমনি বালুর কোমল শয্যা আমাকে অন্য রকম একটি সুখের অনুভূতি দান করলো। লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন মুযদালিফার ময়দানে, কিন্তু কোথাও তেমন কোন সাড়া-শব্দ নেই। নৈশব্দের আশ্চর্যরকম এক আনন্দদায়ক পরিবেশ। তারাভরা আকাশ আরো দেখেছি জীবনে; পূর্ণিমার চাঁদের সৌন্দর্যও উপভোগ করেছি বহুবার, কিন্তু মুযদালিফার আকাশে তারাদের সৌন্দর্য মনে হলো অন্যরকম। যেন আমাকে উদ্দেশ্য করেই মিটিমিটি হাসছে! এত আপন মনে হয়নি আকাশের তারাকে কখনো। আর চাঁদ! দশ তারিখের চাঁদ যেন পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে সুন্দর এবং উজ্জ্বল! চারদিকে বিদ্যুতের আলোর প্লাবনে জোসনার স্নিগ্ধতা অনুভব করার সুযোগ নেই, কিন্তু সেই রাত্রে তো এখানে বিদ্যুতের আলো ছিলো না, ছিলো শুধু জোসনার স্নিগ্ধ আলো! আমার হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতিকে একত্র করে আমি কিছুটা হলেও অনুভব করতে চাইলাম মুযদালিফার সেই রাত্রের স্নিগ্ধতা! সেই রাত্রের নূর ও নূরানিয়াত! অদ্ভুত এক ভাব ও ভাবনা এবং চিন্তা ও কল্পনা আমাকে আচ্ছন্ন করলো। আমার মনে হলো, যুগ যুগ ধরে প্রতিবছর এই রাত্রে মুযদালিফার আকাশ যেন এখানে রাত্রিযাপনকারীদের বিমুগ্ধ দৃষ্টির সামনে তুলে ধরে সেই রাত্রের মুযদালিফা-ভূমির চিত্র! একটি চাঁদ এবং তাকে ঘিরে লক্ষ তারার সমাবেশ। সেই রাত্রে মুযদালিফার এই মাঠেও তো ছিলেন একজন মানব-চাঁদ এবং সোয়া লক্ষ মানব-তারকা! সুতরাং তুমি যদি দেখতে চাও তাহলে আজকের মুযদালিফার চাঁদ-তারায় ঝলমল আকাশে অবশ্যই দেখতে পারো সেই রাত্রের মুযদালিফাভূমির সেই আলোকিত দৃশ্য! কারণ আকাশের এই চাঁদ দেখেছিলো সেই রাত্রে মুযদালিফার বালুভূমিতে নিদ্রিত সেই চাঁদকে! এবং এই তারকারা দেখেছিলো সেই তারকাদের!

আমি লক্ষ্য করিনি কখন মাওলানা হাবীবুল্লাহ মেছবাহ আমার পাশে এসে শয্যা রচনা করেছেন। আমার চোখে ঘুম নেই, তিনিও বিনিদ্র! এবং মুখের আয়নায় বোঝা গেলো, তারও হৃদয়রাজ্যে চলছে ভাব ও ভাবনার নানা রকম তরঙ্গ! তিনি  কৌতুক করে বললেন, কী হলো, ঘুম আসে না, দুকলা জেগে রই!

আমি অবাক হয়ে বললাম, আচ্ছা! এমন কবিও তাহলে বাস করে আপনার অন্দর মহলে!

তিনি মৃদু হেসে বললেন, আসুন দুই মিছবাহ কিছুক্ষণ সঙ্গবিনিময় করি।

আমি বললাম, এক মিছবাহ প্রজ্বলিত, অন্য মিছবাহ নির্বাপিত। ভালোই হবে, প্রদীপ থেকে প্রদীপ প্রজ্বলিত হবে!

মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিছবাহ বয়সে আমার বড়, জ্ঞানে আরো বড়, আর অন্তর্জ্ঞানে তো অতুলনীয়! মুযদালিফার রাতে তাঁর সামান্য সময়ের সঙ্গ-সাহচর্য আমার জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর হয়েছিলো। হজ্ব সম্পর্কে তাঁর অনুভব অনুভূতি আমাকে অভিভূত করেছিলো। আমার কিছু বলার ছিলো না, আমি শুধু তাঁর কথা শুনেছি এবং অন্তরে অনুভবে সমৃদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছি।

মুযদালিফার ঐ সামান্য সময়ের সঙ্গ দুই অন্তরের মাঝে আল্লাহর জন্য ভালোবাসার যে বন্ধন সৃষ্টি করেছিলো তা তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত অটুট ছিলো। পরে মাদরাসাতুল মাদীনায় তিনি তাঁর এক পুত্রের তালীম ও তারবিয়াতের দায়িত্ব আমার হাতে অর্পণ করেছিলেন। আমি তাকে আপন পুত্রের মতই ভালোবাসতে চেয়েছিলাম এবং চেয়েছিলাম তার কিছু উপকার করতে।

ফজর হয়ে গেলো এবং হযরত ঠিক সময়ে আপন নিয়মে জাগ্রত হলেন। নিদ্রা থেকে সদ্য উত্থিত হযরতের তরতাজা চেহারা দেখে হঠাৎ আমার অন্তরে একটি চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। আমি

ভাবলাম, মুমিনের স্বপ্ন যদি হয় নবুওয়তের ছেচল্লিশ ভাগের একভাগ, তাহলে মুমিনের ঘুমের মাঝে কি ঘটে না নবুওয়তের নিদ্রার সামান্য ছায়াপাত! আর তিনি যদি হন আলউলামাউ ওয়ারাছাতুল আম্বিয়া-এর

অন্তর্ভুক্ত তাহলে কি আলআয়নু তানামু ওয়াল কালবু ইয়াকাযান-এর আলো এখানেও কিছুটা প্রতিবিম্বিত হয় না!

আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে মুযদালিফার সেই রাত্রে ঘুম থেকে জেগে ওঠা আমাদের হযরতের ঝলমল চেহারা দেখে কেন জানি এই রকম একটা চিন্তা আমার মনে এসেছিলো। আমার মনে হয়েছিলো, নবীজীর যারা হাকীকী ওয়ারিছ তাঁদের চক্ষু ও হৃদয়ের ক্ষেত্রে এ সত্যের কিছু না কিছু প্রতিফলন হয়ত ঘটে থাকে। তাঁদের চক্ষু নিদ্রিত হয়, কিন্তু হৃদয়ে জাগৃতির সামান্যতম হলেও ছায়াপাত ঘটে। চক্ষুর সঙ্গে হৃদয়ও যদি নিদ্রার ঘোরে থাকে তাহলে কি জাগ্রত হওয়ার পর চেহারা এমন স্নিগ্ধ, সজীব ও উদ্ভাসিত হতে পারে!

ধীরে ধীরে পুরো মুযদালিফা জেগে উঠলো এবং অযু-ইস্তিনজার অকল্পনীয় এক পেরেশানির সম্মুখীন হলো। আমাদের দুই মিছবাহের ভাগ্য ভালো; ঘুম আসেনি, তাই অযুভঙ্গ হয়নি। সঙ্গী মিছবাহকে হাসতে হাসতে বললাম, একরাত্রের জন্য হলেও আমরা ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর যোগ্য অনুসারী হয়ে গেলাম। তিনি কত বছর যেন এশার অযু দিয়ে ফজর পড়েছেন! একরাত্রের জন্য হলেও তো আমাদের এশা ও ফজর এক অযুতে হলো। মিছবাহ সংশোধনী এনে বললেন, আমরা কিন্তু এক ধাপ এগিয়ে আছি; মাগরিবের অযু দিয়ে এশা ও ফজর আদায় করেছি।

মিছবাহ নিজেই আবার আমাকে সতর্ক করে বললেন, এমন পবিত্র স্থানে এধরনের লঘু আলোচনা ঠিক নয়। আমি লজ্জিত হয়ে ইস্তিগফার করলাম।

হযরত বোতলের পানি দিয়ে শুধু অযু করলেন এবং নামাযের পর জরুরত থেকে ফারিগ হলেন। অন্যদের অভিজ্ঞতা ছিলো খুবই ভয়াবহ।

মিনা, আরাফা ও মুযদালিফায় লক্ষ লক্ষ মানুষের এত বিশাল সমাবেশে মানবীয় দুর্বলতার এ বিষয়টি কেন যে যথাযথ গুরুত্বের সাথে ভাবা হচ্ছে না, তা আমি বুঝতে পারি না। কষ্ট অনেক রকমের আছে এবং সেগুলো আনন্দের সঙ্গে বরণ করে নেয়ার জন্যই হজ্বের সফর। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্বলতা ও পাকপবিত্রতার বিষয়টি অন্যরকম। এটা কষ্ট নয়, যন্ত্রণা এবং এই অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে আল্লাহর মেহমানদের মুক্ত রাখা আল্লাহর ঘরের খাদেমদের কর্তব্য।

হজ্বের সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের কয়েকদিন পর বিদায়ী রাষ্ট্রদূত হিসাবে জনাব ফুয়াদ আব্দুল হামীদ আল খতীব নুরিয়া মাদরাসায় এসেছিলেন হযরত হাফেজ্জি হুযূরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হজ্বের সফর কেমন হয়েছে? আমি তাকে এই যন্ত্রণার কথা বলেছিলাম এবং অনুরোধ করেছিলাম, তিনি যেন বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের নযরে আনেন।

যাক, এগুলো তো হলো অন্যকথা। ফজরের জামাত হলো। আমাদের কাফেলার কয়েকজনকে নিয়েই মুখতাছার জামাত শুরু হয়েছিলো, কিন্তু সালাম ফেরানোর পর দেখি বিশাল এক জামাআত!

এখনই শুরু হবে মুযদালিফার অকূফ। হযরত আমাদের বললেন, এখন খুব অল্প সময়, কিন্তু খুব মূল্যবান সময়। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসময় মুযদালিফায় অকূফ করেছেন এবং উম্মতের জন্য দুআ করেছেন। হযরত আববাস বিন মিরদাস (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার সন্ধ্যায় তাঁর উম্মতের জন্য মাগফিরাতের দুআ করেছেন। তখন তাঁর দুআ (এভাবে) কবুল করা হলো (যে, আল্লাহ বললেন,) আমি উম্মতকে মাফ করে দিলাম, তবে যালিমকে নয়, বরং যালিম থেকে আমি মাযলূমের পক্ষে (বদলা) নেবো। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরয করলেন, আয় রাবব! আপনি যদি ইচ্ছা করেন তাহলে মযলূমকে জান্নাত থেকে দান করে যালিমকে মাফ করে দিতে পারেন।

কিন্তু আরাফার সন্ধ্যায় তাঁর এ আব্দার কবুল করা হয়নি। যখন তিনি মুযদালিফায় ছোবাহ যাপন করলেন তখন তিনি সেই দুআর পুনরাবৃত্তি করলেন এবং একসময় হেসে দিলেন! আবু বকর এবং ওমর (রা) তা দেখে আরয করলেন, আপনার প্রতি আমাদের আববা-আম্মা কোরবান হোন, এ তো এমন মুহূর্ত যখন আপনার হাসবার কথা নয়! তাহলে আপনার হাসির রহস্য কী! আপনার দন্তকে আল্লাহ হাস্যোজ্জ্বল রাখুন।

তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর দুশমন (শয়তান) যখন জানতে পারলো যে, আল্লাহ আমার দুআ কবুল করেছেন এবং আমার উম্মতকে মাফ করে দিয়েছেন তখন সে মাথায় মাটি নিক্ষেপ করতে লাগলো এবং নিজের মওত ও বরবাদি চাইতে লাগলো, আর তার বিলাপ দেখে আমার হাসি পেয়ে গেলো।

হযরত বললেন, মুযদালিফার অকূফ এমনই বরকতপূর্ণ যে, এর উছিলায় আল্লাহ তাআলা উম্মতের যালিমদেরও মাফ করেছেন। আমাদের মাঝে এমন কে আছে যে, দাবী করতে পারে, জীবনে কখনো সে কারো উপর কোন যুলুম করেনি এবং কখনো কারো কোন হক নষ্ট করেনি! সুতরাং এই মওকাকে গনীমত মনে করতে হবে এবং সারা জীবনের সমস্ত যুলুম থেকে আজ আল্লাহর দরবারে মাগফিরাত চাইতে হবে এবং প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, বাকি জীবন জেনেশুনে আমরা কারো উপর কোন যুলুম করবো না। আর অতীতে বান্দার কোন হক নষ্ট করার কথা যদি আমাদের জানা থাকে তাহলে তার প্রতিকারের চেষ্টা অবশ্যই করবো, অন্তত মাযলূম থেকে মাফ নেয়ার চেষ্টা করবো।

এর পর শুরু হলো অকূফ, শুরু হলো হযরতের দুআ-মুনাজাত। তাতে সে কী কাকুতি-মিনতি! সে কী রোনাযারি-আহাযারি! যেন গতকাল সন্ধ্যায় যা বাকি ছিলো আজ তিনি তা পূর্ণ করেই ছাড়বেন! এ যেন শেষ মুহূর্তের প্রার্থনা ও মিনতি!

আমরা হযরতের মুনাজাতে শরীক হলাম শুধু বাইরে থেকে! কারণ তাঁর অন্তর্জগতের স্পর্শ লাভ করা তো আমাদের সাধ্যের বাইরে! হে আল্লাহ, আজ এই মুযদালিফার ময়দানে তোমার যত বান্দা হাযির হয়েছেন, যত লক্ষ হাজী এখানে তোমার দরবারে হাত তুলেছেন তাদের মাঝে আমার চেয়ে বড় যালিম আর কেউ নেই। কতভাবে কত মানুষের উপর যুলুম করেছি! কতভাবে কত মানুষের হক নষ্ট করেছি! বিশেষ করে হে আল্লাহ কত তালিবে ইলমের আমানত আমার দ্বারা খেয়ানত হয়েছে! হে আল্লাহ, তুমি সবাইকে আমার পক্ষ হতে উত্তম বিনিময় দান করো এবং দয়া করে আমাকে মাফ করে দাও।

 হে আল্লাহ, এখানে তোমার যত বান্দা হাত তুলেছে সবাইকে তুমি মাফ করে দাও। আমার আম্মা-আববাকে মাফ করে দাও। আমার আপনজনদের মাফ করে দাও। হে আল্লাহ, উম্মতের সকল

নর-নারীকে মাফ করে দাও।

এই ছিলো হযরতের দুআ! আমরা শুধু আমীন, আমীন বলেছি, আর আশা করেছি, নিজেকে যিনি বড় যালিম বলেছেন তাঁর সান্নিধ্যের বরকতে আমাদের মত ছোট যালিমদেরও আল্লাহ মাফ করে দেবেন, ইনশাআল্লাহ! এই মুযদালিফায় একটি জোড়া হাতও যদি কবুল হয়ে থাকে তবে তার বরকতে অন্যসব হাতও ইনশাআল্লাহ কবুল হয়ে যাবে। কবুল না করার জন্য কি আসমান থেকে এত বড় দাওয়াত, এত বিশাল আয়োজন! কবুল না করার জন্যই কি এই উন্মুক্ত আকাশ, এই ঝিরঝির  বাতাস!

সূর্যোদয়ের পূর্বে হযরত গাড়ীতে উঠলেন এবং উচ্চ কণ্ঠে তালবিয়া বললেন-

লাববাইক, আল্লাহুম্মা লাববাইক, লা শারীকা লাকা লাববাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাক।

আল্লাহর রহমতে আমাদের সঙ্গে রাবেতার পক্ষ হতে প্রদত্ত গাড়ী ছিলো তাই সুন্নত সময়ে মুযদালিফা থেকে রওয়ানা দেয়া আমাদের জন্য সহজ হয়েছিলো। অনেকে শুধু গাড়ী সমস্যার কারণে সূর্যোদয়ের অনেক পরে মুযদালিফার সীমানা অতিক্রম করেছেন। মজবূরির বিষয় তো আলাদা, অন্যথায় যাদের হাঁটার সুযোগ আছে তাদের অবশ্যই চেষ্টা করা উচিত সূর্যোদয়ের পূর্বেই মুযদালিফার সীমানা পার হয়ে মিনায় প্রবেশ করা। এটা সুন্নত।

জাহেলিয়াতের যুগে লোকেরা সূর্যোদয়ের আগে মুযদালিফা থেকে রওয়ানা হতো না। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধাচরণ করে সূর্যোদয়ের পূর্বে রওয়ানা হয়েছিলেন। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই আমাদের কর্তব্য হলো কাফির-মুশরিকদের আচার-আচরণের বিরোধিতা করা। না হলে বুঝতে হবে যে, হজ্বের মূল শিক্ষা হতেই সে বঞ্চিত হয়েছে।

আমরা মুযদালিফা থেকে মিনায় যাওয়ার পথে গাড়ী থামিয়ে রামীর কংকর সংগ্রহ

করেছিলাম। কারণ হযরত বললেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফা থেকে মিনায় যাওয়ার পথে (ইবনে আববাস, মতান্তরে ফযল বিন আববাস)-কে কংকর কুড়িয়ে নেয়ার আদেশ করেছিলেন।

কংকর অবশ্য মুযদালিফা থেকেই রাত্রে সংগ্রহ করে নেয়া যায় এবং সেটাই ভালো। কারণ পথে তো আর গাড়ী থামানো সম্ভব নয়! এমনকি মিনা থেকে সংগ্রহ করলেও সমস্যা নেই, তবে রামীর স্থান থেকে কংকর সংগ্রহ করা মাকরূহ।

মুযদালিফা থেকে মিনায় যাওয়ার পথে পড়ে একটি উপত্যকা, যার নাম ওয়াদি মুহাচ্ছাব। এর গভীর অংশটাকে বলে বাতনে মুহাচ্ছাব। এটি মূলত মিনা ও মুযদালিফার মধ্যবর্তী একটি স্থান। মিনার অংশ নয়, আবার মুযদালিফারও অংশ নয়। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফা থেকে মিনায় যাওয়ার পথে বাতনে মুহাচ্ছাবে এসে তাঁর সওয়ারির উটনীকে দাবড়িয়েছিলেন এবং চলার গতি দ্রুত করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিলো আযাবের স্থান তাড়াতাড়ি পার হওয়া।

আমাদের হযরত এ পর্যন্ত ত্রিশবারের বেশী হজ্ব করেছেন। আধুনিক যুগের হাওয়াই জাহাযের হজ্ব যেমন করেছেন তেমনি পুরোনো যুগের পানির জাহায এবং উটের পিঠে সওয়ার হওয়ার হজ্বও করেছেন। হজ্বের যাবতীয় আহকাম ও বিধান যেমন তাঁর জানা তেমনি হজ্ব পালনের সমস্ত স্থানও তাঁর পরিচিত। আমি লক্ষ্য করলাম, হযরত একবার ডানের জানালা দিয়ে, একবার বামের জানালা দিয়ে খুব উৎকণ্ঠিতভাবে তাকাচ্ছেন, যেন কোন স্থান চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। হযরতের অস্থিরতা দেখে আমি অবাক হলাম। কেননা অস্থিরতার উৎস আমার জানা ছিলো না। আমিও হযরতের দৃষ্টি অনুসরণ করে এদিকে ওদিকে তাকাতে লাগলাম এবং একটু পরে সবকিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো। আমি একটি সাইনবোর্ডের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, হযরত, এই যে, বাতনে মুহাচ্ছাব! সেদিকে তাকিয়েই হযরতের চেহারা যেন  ফেকাশে হয়ে গেলো। ভয়ার্ত কণ্ঠে তিনি আমাকে আদেশ করলেন, ড্রাইভারকে বলো আরো জোরে গাড়ী চালাতে। আমি চালককে বললাম। কিন্তু তাকে বোঝাতে বোঝাতে এবং সে বুঝতে বুঝতে বাতনে মুহাচ্ছাব পার হয়ে গেলো। হযরত তখন শান্ত হলেন। কিতাবে হজ্বের অধ্যায়ে পড়েছি বাতনে মুহাচ্ছাবের কথা এবং পড়িয়েছি কয়েকবার। কিন্তু বাতনে মুহাচ্ছাবকে এমন করে ভয় পেতে হবে তা বুঝতে

পারলাম আজ হযরতের ভয় পাওয়া দেখে! সেই পরম সত্য আজ আবার উদ্ভাসিত হলো আমার সামনে, যা অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী আল্লাহর বান্দাগণ বলে আসছেন যুগ যুগ ধরে, কিতাবের ইলম তোমাকে দান করবে শুধু বাহ্যিক জ্ঞান, যদি তুমি অর্জন করতে চাও অন্তর্জ্ঞান এবং আত্মার পরিশুদ্ধি তাহলে তোমাকে গ্রহণ করতে হবে এমন কারো ছোহবত যিনি তা অর্জন করেছেন অন্য কারো ছোহবত থেকে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ স্থানটি যে উৎকণ্ঠা ও ভয়ভীতির সাথে দ্রুত অতিক্রম করেছেন তা দেখেছেন ছাহাবা কেরাম। ফলে সে ভয় ও উৎকণ্ঠা তাদেরও মাঝে সংক্রমিত হয়েছে। তাই তাঁরাও সেরকম ভয় ও উৎকণ্ঠা নিয়ে দ্রুত পার হতেন বাতনে মুহাচ্ছাব। এভাবে আজ পর্যন্ত চলে এসেছে এই ভয় ও উৎকণ্ঠা, অবশ্য ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে। তবু চলে আসছে এবং তা কিতাব থেকে নয়, ছোহবত থেকে। কিতাব থেকে শুধু তথ্য আসে, তত্ত্ব নয়।

মুহাচ্ছাব মানে অবরুদ্ধ। ইয়ামানের আবরাহা যে হস্তিবাহিনী নিয়ে বাইতুল্লাহ ধ্বংস করার মতলবে এসেছিলো সে তার

বাহিনীসহ এখানেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলো। এখানেই আল্লাহ তাআলা দাম্ভিক আবরাহা ও তার হস্তিবাহিনীকে ক্ষুদ্র আবাবীল পাখী দ্বারা ধ্বংস করেছিলেন। আবাবীল পাখীর ঝাঁক ঠোঁটে করে ছোট ছোট কংকর এনে হাতির পালের উপর বর্ষণ করেছিলো, যেন বোমারু বিমানের বোমা বর্ষণ! বিরাট বিরাট হাতি ও তার আরোহী মরে সাফ হয়ে গিয়েছিলো ক্ষুদ্র আবাবীল পাখীর আরো ক্ষুদ্র কংকরের আঘাতে। এ ঘটনা ঘটেছিলো আমাদের পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মগ্রহণের চল্লিশ দিন আগে। সে ঘটনা আল্লাহ তাআলা বর্ণনা করেছেন সুরাতুল ফীলে।

আযাবের স্থানগুলো পার হওয়ার সময় আল্লাহর নবী এমনই ভয়গ্রস্ত ও উৎকণ্ঠিত হতেন, যেমন বর্ণিত আছে তাবুকের সফরে কাউমে ছামূদের বিরান বস্তি পার হওয়া সম্পর্কে। আমাদের হযরতের আজকের ভয় ও উৎকণ্ঠার মাঝে আমি যেন নববী ভয় ও উৎকণ্ঠারই ছায়া দেখতে পেলাম।

বাতনে মুহাচ্ছাবের সতর্কীকরণ ফলক দেখে বুঝতে পারলাম, গত রাতে হযরতের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিলো। আমরাই শুধু শুধু তাঁকে পেরেশান করেছি। ঘটনা ছিলো এই, আরাফা থেকে আসার পর আমরা মুযদালিফার যে স্থানে প্রথম অবস্থান করলাম সেখানে মাগরিব ও এশা আদায় করার পর হঠাৎ শোর উঠলো, বাতনে মুহাচ্ছাব! বাতনে মুহাচ্ছাব! অমনি শুরু হলো হুড়াহুড়ি ও ছোটাছুটি। তাতে বোঝা গেলো, চিলে কান নেয়ার প্রবাদ শুধু বঙ্গ-সন্তানের জন্য নয়!

হযরত অবশ্য তাঁর সফরসঙ্গীদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, এটা বাতনে মুহাচ্ছাব হতে পারে না। কারণ আমরা নেমেছি মুযদালিফার মাঝামাঝি অংশে, আর বাতনে মুহাচ্ছাব হচ্ছে মিনার দিকে মুযদালিফার শেষ

প্রান্তে। কিন্তু আমীরের কথায় মামুরদের ইতমিনান হলো না। হযরত ত্রিশবার হজ্ব করেছেন তো কী হলো, তারাও কি আর দুচারবার হজ্ব করেননি! সুতরাং তাদের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত হযরত  আরো দূরে সরে এসে রাত্রিযাপন করলেন।

এখন যখন বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেলো তখন আমি পেলাম আরেকটি শিক্ষা। হযরত একবারও বললেন না, গত রাতে শুধু শুধু তোমরা আমাকে পেরেশান করেছো; হযরতকে দেখে মনে হলো, যেন গত রাতে কিছুই হয়নি!

অন্যরাও একটিবার বললেন না, আমরা ভুল করেছি, আমাদের কারণে আপনার পেরেশানি হয়েছে;  তাদের অবস্থা দেখে মনে হলো, যেন গত রাতে কিছুই ঘটেনি!

বারবার দেখেছি এবং ভালো ভালো মানুষকে দেখেছি, তারা হযরতের চেয়ে বেশী বুঝতেন এবং তা আশ্চর্য রকম ভাষায় প্রকাশও করতেন! এই বেশী বুঝ কত বার যে কত বিড়ম্বনা সৃষ্টি করেছে তা ভেবে এখনো আমি বেদনাহত হই। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে হযরতের সহনশীলতা ছিলো সত্যি বিস্ময়কর ! মুযদালিফার সেই ঘটনা এখন আমাকে অনেক শিক্ষা দান করে এবং প্রয়োজনের সময় আমি হযরতের সহনশীলতা থেকে সামান্য শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করি।

আমরা যদি মুরববীর চেয়ে একটু কম বুঝি তাহলে জীবনে অনেক বিড়ম্বনা থেকে বেঁচে যাই। কিন্তু খুব সহজে এ দুষ্ট ব্যাধি থেকে আমাদের মুক্তি আছে বলে মনে হয় না। শুধু কামনা করি, আল্লাহ যেন তাওফীক দান করেন। আমীন।

মিনায় আমরা পৌঁছে গেলাম বেশ সকাল সকাল। নিজেদের খিমা বা তাঁবু তালাশ করে পেতে অবশ্য কিছুটা বিলম্ব হলো। তারপরো গতকালের পেরেশানি থেকে আল্লাহ হেফাযত করেছেন।

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হজ্ব বর্ণনাকারীগণ বলেছেন-

তিনি মুযদালিফা থেকে রওয়ানা হয়ে জামরাতুল আকাবায় উপস্থিত হলেন এবং সূর্যোদয়ের পর সওয়ার অবস্থায় জামরাতুল আকাবায় রামী করলেন। একটির পর একটি (এভাবে সাতটি) কংকর তিনি নিক্ষেপ করলেন। প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় তিনি তাকবীর বললেন। আর প্রথম কংকরটি নিক্ষেপের পূর্ব পর্যন্ত তালবিয়া অব্যাহত রাখলেন।

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রামীর বয়ান দিয়ে হযরত আমাদের বললেন, রামীর সমস্ত আদাব যেন আমরা রক্ষা করি এবং যদি সম্ভব হয় তাহলে জামারার একেবারে নিকটে গিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলের পিঠে কংকর রেখে শাহাদাত আঙ্গুলের সাহায্যে যেন প্রতিটি কংকর নিক্ষেপ করি।

জামারাহ মোট তিনটি। মক্কা থেকে মিনার দিকে আসার সময় প্রথম যে জামারাহ পড়ে সেটি হলো জামরাতুল আকাবাহ। আজ দশ তারিখে শুধু জামরাতুল আকাবায় রামী করতে হবে। জামরাতুল আকাবাহ থেকে সোজা মিনার দিকে একটু দূরে দ্বিতীয় জামরাহ। মিনার দিকে আরেকটু সরে হলো তৃতীয় জামরাহ। এগারো ও বারো তারিখে তিনটি জামারায় রামী করতে হয়; প্রথমে তৃতীয়টি, তারপর দ্বিতীয়টি, তারপর প্রথমটি। কারণ মিনার দিক থেকে তৃতীয়টি হয়ে যায় প্রথম।

হযরতের সঙ্গে আমরা তিনজন রওয়ানা হলাম। অন্য দুজন হলেন মাওলানা আতাউল্লাহ ও মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিছবাহ। আমাদের তাঁবু ছিলো জামরাহ থেকে বেশ দূরে, এক মাইলের কম নয় কিছুতেই। হাজার হাজার মানুষ যাচ্ছে কংকর নিক্ষেপ করতে, আবার হাজার হাজার মানুষ একই পথে ফিরে আসছে কংকর নিক্ষেপ করে। ফলে এমন প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হচ্ছে যে, দুর্বল লোকদের জন্য তা রীতিমত আশংকাজনক। আসা ও যাওয়ার পথ আলাদা হলেই কিন্তু অর্ধেক চাপ কমে যেতো।

আমরা উচ্চ স্বরে তালবিয়া পড়ছি, আর হযরতকে ভিড়ের চাপ থেকে সরিয়ে এগিয়ে চলেছি। অন্তরে তখন অদ্ভুত এক উত্তেজনা! শয়তান আমাদের খোলা দুশমন। শয়তানের ধোকায় পড়ে কত মানুষ যে বরবাদ হয়েছে, আর সামনেও যে কত মানুষ বরবাদ হবে কে তার হিসাব রাখে! আমার জীবনে যত ভুল ও বিচ্যুতি ঘটেছে, যত অন্যায়-অপরাধ এবং পাপ ও গোনাহ আমি করেছি তা সবই শয়তানের এবং নফসের প্ররোচনায়। শয়তানই আমার ভিতরের নফসের মাধ্যমে আমাকে গোমরাহ করে। কিন্তু মানুষ ভুলে যায় যে, শয়তান তার বড় দুশমন। শয়তান হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আ)কে জান্নাত থেকে বের করেছে। শয়তানই এখানে মিনার ময়দানে হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল (আ)কে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে একে একে তিনবার তিন জামারার স্থানে। কিন্তু তাঁরা কংকর মেরে মেরে শয়তানকে বিতাড়িত করেছেন। শয়তানের সাথে মানুষের চিরদুশমনির সেই স্মৃতিকে জাগ্রত করার জন্যই আজ আমরা চলেছি জামরাতুল আকাবার উদ্দেশ্যে। শয়তানের প্রতীকরূপে যে স্তম্ভটি স্থাপন করা হয়েছে, শয়তানকে উদ্দেশ্য করে তাতে আমরা কংকর নিক্ষেপ করবো।

জামরাহ যতই নিকটবর্তী হচ্ছে, জনসমুদ্রের ঢেউ ততই প্রচন্ড থেকে প্রচন্ডতর হচ্ছে। কিন্তু বরাবরের মত এখানেও হযরতকে মনে হলো শান্ত এবং নিজের মাঝে নিজে সমাহিত। পথ চলতে কখনো তাঁর দৃষ্টি উপরে ওঠে না; এখানেও তাঁর দৃষ্টি অবনত। তবে বোঝা যায়, ভিতরে তাঁর আলোড়িত হচ্ছে একটি মুজাহাদার চেতনা এবং দুশমন শয়তানকে পরাভূত করার দৃপ্ত প্রতিজ্ঞা! আমি হযরতের কাছে কাছে থাকার চেষ্টা করলাম যাতে তাঁকে ভিড় থেকে দূরে রাখা যায়। তার চেয়ে বড় কথা, যেন তাঁর পবিত্র স্পর্শ থেকে আমারও মাঝে রাময়ুল জামরাহর সত্যিকার চেতনা সঞ্চারিত হয়।

দীর্ঘ পরিশ্রম এবং মাঝে মাঝে বিশ্রাম গ্রহণের পর হযরতের সঙ্গে আমরা জামরাহর নিকটে পৌঁছলাম। জামরাহ আমি তো আগে দেখিনি, এই প্রথম। দেখে কিন্তু হতবুদ্ধি হলাম! শুধু একটি গোল স্তম্ভকে কেন্দ্র করে এত বিশাল জনসমুদ্র! প্রত্যেককে পৌঁছতে হবে এর নিকটে এবং একে একে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করে আবার ফিরে আসতে হবে একই পথে। প্রথমে আমার কাছে মনে হলো এক অসম্ভব বিষয়! দ্বিতলব্যবস্থা বলে কিছুটা রক্ষা। তারপরো মনে হলো হযরতের বয়সের কোন মানুষের পক্ষে এতে রয়েছে রীতিমত জীবনের ঝুঁকি! কিন্তু দেখা গেলো, যাকে নিয়ে আমাদের এত চিন্তা তিনি নিশ্চিন্ত! এবং আরো পরে দেখা গেলো, তাঁরই বরকতে আমাদের কংকর নিংক্ষেপও সম্পন্ন হলো নিরাপদে। কতটা নিরাপদে তা বুঝতে পেরেছিলাম বারো তারিখের রামী করতে এসে। সে প্রসঙ্গ পরে।

হযরত বললেন, নীচে দিয়ে চলো। আমরা তাঁকে অনুসরণ করলাম, যদিও আমার মনে হয়েছিলো, উপর দিয়ে অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। বারো তারিখে সেই মনে হওয়ার উপর আমল করতে গিয়েই পড়েছিলাম চরম বিপদে।

হযরতকে আল্লাহ কী গুণ দিয়েছিলেন তা আল্লাহই ভালো জানেন; আমরা শুধু বাইতুল্লাহর তাওয়াফের মত এখানেও সেই গুণের আশ্চর্য প্রকাশ দেখতে পেলাম। দেখলাম এবং অভিভূত হলাম। হযরত এক পা এক পা করে অগ্রসর হন আর সামনে একটু একটু করে ফাঁক তৈরী হয়! পিছন থেকে, ডান ও বাম থেকে প্রচন্ড হতে প্রচন্ডতর একেকটি চাপ আসে, যা শক্ত সমর্থ জোয়ানকেও কাবু করে ফেলার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সব চাপ যেন হযরতকে আলতো করে ছুঁয়ে চলে যায়।

....

আগে হাজী ছাহেবানদের মুখে শুনেছি, আজ নিজের চোখে দেখলাম, হজ্বের আহকাম ও মাসায়েল সম্পর্কে কত মর্মান্তিক অজ্ঞতা ও বেখবরি উম্মতের! কী আরব, কী আজম, কী তুর্কী-আফগান, কী ইরান-তুরান, সবার একই অবস্থা! একই রকম দুর্দশা! ভিন্ন শুধু পরিমাণ ও মাত্রা! সারা জীবনের একমাত্র ফরীযা আদায় করতে এসেছে জ্ঞানে ও মনমানসে কতটা অপ্রস্ত্তত অবস্থায়! কথাগুলো যদিও খুব সহজে লিখছি, কিন্তু একটি বেদনাদায়ক সত্য লিখছি, প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ হাজী তো হয়ে যায়, তবে নিছক আহকাম ও মাসায়েলের দিক থেকে খুব কম মানুষেরই হজ্ব ছহীহ শুদ্ধ হয়। তাই আবারো বলতে ইচ্ছে করছে, অন্য দেশের কথা তো আমি বলতে পারবো না, আমাদের দেশ থেকে এত কষ্ট করে হজ্বের সফরে যারা আসবেন, হোক ফরয বা নফল, তারা যেন নির্ভরযোগ্য কোন আলিমের তত্ত্বাবধানে পূর্ণ প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে আসেন, আহকাম ও মাসায়েলের দিক থেকে যেমন তেমনি ভাব ও ভাবনা এবং চিন্তা ও চেতনার দিক থেকেও। তাহলে অন্তত হজ্বের ন্যূনতম শুদ্ধতা নিশ্চিত হয় এবং হজ্বের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও অর্জিত হয়। সবচে ভালো হয় প্রতিটি কাফেলায় একজন বিজ্ঞ আলিমের উপস্থিতি যদি নিশ্চিত করা যায় এবং এটা কঠিন কিছু নয়, যদি বিষয়টিকে অপরিহার্য প্রয়োজন বলে গ্রহণ করা হয়।

যা বলছিলাম, জীবনের প্রথম জামারার আবেগময় স্থানে একটা অদ্ভূত অবস্থা প্রত্যক্ষ করলাম। অনেকেই সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে জামারার স্তম্ভের কাছে যাওয়ার কষ্ট করতে রাজী নয়। যেন খুব তাড়া! দূর থেকেই ঝটপট কংকর ছুঁড়ে ফিরে যেতে হতে হবে! জামারার স্তম্ভকে ঘিরে যে বৃত্ত, সবগুলো কংকর সেই বৃত্তের ভিতরে পড়ছে না, পড়ছে হাজী ছাহেবদের মাথার উপর। তাতে রামীর আমল ছহী হচ্ছে না, রামীর শিক্ষা, জামারার দীক্ষা সে তো পরের কথা! কিন্তু কে করে সেই চিন্তা!

আরো ভয়াবহ ব্যাপার হলো, অনেকে বড় বড় পাথর ছুঁড়ে মারছেন, তাতে শয়তানের কপাল তো ফাটে না, কপাল ফাটে কোন  বেচারা হাজী ছাহেবের, আর কপাল ভাঙ্গে যে পাথর ছুঁড়ছে তার নিজের!

ছাতা ও জুতা-চপ্পলের তো রীতিমত বৃষ্টিবর্ষণ! শয়তানের প্রতি এরূপ যুদ্ধংদেহী আক্রোশ বাহ্যত প্রশংসারই বিষয়! যেন সারা জীবন শয়তানের হাতে যত ভোগান্তি হয়েছে, আজ এই সুযোগে মনের ঝাল মিটিয়ে তারই শোধ তুলে নেয়ার চেষ্টা! হাসিও পায়, কান্নাও আসে! চোখের সামনে দেখলাম একজন হাজীর মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে! বেচারাকে ধরাধরি করে যে একপাশে নিয়ে যাওয়া হবে তারও উপায় নেই। আল্লাহ সবাইকে রহম করুন এবং ছহীহ বুঝ দান করুন। শয়তানকে মারতে এসে শয়তানের ফাঁদে পড়ে আমল বরবাদ করার এ দৃশ্য সত্যি দুঃখজনক!

আমরা অনেকটা কাছে এসে পড়েছি, তবু হযরত অপেক্ষা করলেন। একটু একটু ফাঁক হয়, আর তিনি একটু একটু অগ্রসর হন। কোন ব্যস্ততা নেই, কোন তাড়া নেই, এমনকি নেই কোন ভাবাবেগেরও প্রকাশ!

দূর থেকে যা মনে হয়েছিলো অসম্ভব, একটু সময় লাগলেও খুব আসানির সাথেই তা হয়ে গেলো সম্ভব! জামারার স্তম্ভের চারপাশে দেয়ালের যে বৃত্ত, হযরত একেবারে তার কাছে পৌঁছে গেলেন। তাঁর মত বৃদ্ধ বয়সের আর কাউকে আশেপাশে দেখা গেলো না। তিনি পূর্ণ ইতমিনানের সাথে সুন্নাত মোতাবেক একটি একটি করে কংকর নিক্ষেপ করলেন, আর আল্লাহু আকবার বললেন। ছাহাবা কেরাম তো নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রামী লক্ষ্য করেছিলেন এবং তাঁকে অনুসরণ করেছিলেন! আমি বিশ্বাস করলাম, আমাদের হযরতের রামী সেই সুন্নাতেরই অনুসরণের সুদীর্ঘ ধারাবাহিকতা। এ বিশ্বাস নিয়েই কিতাবে কী পড়েছি তা ভুলে গিয়ে তাঁকে অনুসরণ করে আমি আমার রামী সম্পন্ন করলাম। এখনো ভাবলে অন্তরে বড় প্রশান্তি জাগে, হযরত হাফেজ্জী হুযূর ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলের মাথায় একটি কংকর রেখে আল্লাহু আকবার বলে শাহাদত আঙ্গুলের সাহায্যে রামী করছেন, আর তাঁর একান্ত পাশে দাঁড়িয়ে আমি অধম হুবহু তাঁকে অনুসরণ করছি! আহ কী প্রাণ ছিলো, কী মধুরতা ছিলো সেদিনের সেই রামীতে! ইশকের উষ্ণতা থেকে বঞ্চিত যারা তাদেরও অন্তরে কী অপূর্ব উত্তাপ সৃষ্টি করে একজন আশিকের ছোহবত ও সান্নিধ্য!

প্রিয় ভাই, আমি প্রার্থনা করি, জীবনের সফরে এবং বিশেষ করে হজ্বের সফরে আল্লাহ যেন তাঁর কোন আশিক বান্দার ছোহবত ও সান্নিধ্য তোমাকে নছীব করেন, আমীন।

আল্লাহর শোকর, কংকর নিক্ষেপ করার পর নিরাপদেই বের হয়ে এলাম উত্তাল জনতরঙ্গের ভিতর থেকে। তাঁবুতে ফেরার জন্য আবার দীর্ঘ পথচলা। আমরা ক্লান্তিতে ক্লান্তিতে জর্জরিত। দেহের সবটুকু শক্তি যেন নিঃশেষিত! ইচ্ছে করছে এখানেই কোথাও বসে পড়ি এবং যতক্ষণ না ক্লান্তি দূর হয় বসেই থাকি! হযরতও ক্লান্ত ছিলেন এবং ক্লান্তির ছাপ তাঁর চেহারায় ছিলো। কিন্তু বলতেই হয়, ক্লান্তির মাঝেও তিনি ছিলেন সজীব সতেজ! এই সজীবতা সেই প্রেমিকের যিনি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একটি মধুর অভিসারের স্বাদ লাভ করেছেন এবং ফেরার পথে সেই স্বাদ-আনন্দেই বিভোর হয়ে আছেন।

ইফরাদ হজ্বে কোরবানি ওয়াজিব নয়। সুতরাং এখন মাথা মুড়ালেই মোটামুটি হজ্বের ইহরাম থেকে মুক্ত হওয়া যায়। সব ঘটনা কত দ্রুত ঘটে যায়! সময়ের স্রোত কত দ্রুত বয়ে যায়! সেদিন পেয়ারা হাবীবের প্রিয় মদীনা থেকে বিদায়কালে যুলহোলায়ফার মসজিদে হজ্বের ইহরাম শুরু হলো। লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক-এর সমধুর ধ্বনি কণ্ঠে কণ্ঠে উচ্চারিত হলো। লাববাইকের সেই সুর মুর্ছনায় যেন বিভোর ছিলাম একটি দিন! কী অপূর্ব তরঙ্গ শিহরণ প্রবাহিত হতো হৃদয়ের পরতে পরতে! দেখতে দেখতে আরাফার সূর্য অস্ত গেলো, জাবালে রহমতের সান্নিধ্য থেকে বিদায় নিতে হলো, তবু ছিলো লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইকের সমধুর ধ্বনি!

দেখতে দেখতে মুযদালিফার রাত ভোর হলো, মিনার পথে সূর্য উদিত হলো, প্রেমিকের বিরহী হৃদয়ের জন্য তবু ছিলো লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইকের আশ্বাসবাণী!

এখন জামারার পর লাববাইকের ধ্বনি আর নেই! হঠাৎ করে যেন সকল প্রাণপ্রাচুর্য ফুরিয়ে যাওয়ার মত! ছিলো লিবাসুল ইহরামের শুভ্রতাটুকু, তাও এখন শেষ হওয়ার পথে!

কী ছিলো ইহরামের হাকীকত! সেই হাকীকত কতটুকু উপলদ্ধি করতে পেরেছি আমি! ইহরামের হাকীকত তো হলো জীবন ও জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহ তাআলার ইশক ও মুহববতে নিজেকে ফানা ও বিলীন করে দেয়া! ফানাইয়্যাত তো অনেক দূরের কথা, আমি কি পেরেছি ইশক ও মুহাববাতের সাধারণ কোন মাকাম হাছিল করতে! আমি কি পেরেছি এই প্রতিজ্ঞাটুকু গ্রহণ করতে যে, আগামী জীবন হজ্বের শিক্ষা ও দীক্ষা নিজের মাঝে ধারণ করার সাধনায় আত্মনিয়োগ করবো! তাহলে কিসের ইহরাম হলো! আরাফা মুযদালিফায় কিসের অকূফ হলো! কিসের লাববাইক হলো! কিসের হজ্ব হলো!

কিন্তু না, দিলের এ বেচায়ন হালাতের মাঝে আমাদের হযরতের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো অন্য রকম এক সান্ত্বনা। তিনি বললেন, কিছু হয়নি, অন্তর থেকে একথা মনে করতে পারা হাকীকতে কিছু হওয়ার আলামত! মাওলা যাকে কিছু দান করেন তাকেই কিছু না হওয়ার অনুভূতি দান করেন। জানা-অজানা যা কিছু ভুলত্রুটি হয়েছে সে জন্য আল্লাহর দরবারে শরমিন্দা হও এবং ইস্তিগফার করো, আর আল্লাহর রহমতের কাছে আশা করো যে, মেহেরবান আল্লাহ আমার টুটাফাটা আমল কবুল করেছেন। ভয় করন চাই এবং ভয়ের সঙ্গে আশাও করন চাই। শুধু ভয় এবং শুধু আশা দুটাই শয়তানের হাতিয়ার। ভয় দ্বারা শয়তান নিরাশ করে, আর আশা দ্বারা গাফেল করে। অন্তরে যখন ভয় ও আশা দুটাই জাগরূক থাকে তখন আল্লাহর দরবারে কবুলিয়াত হাছিল হয়।

হযরতের মুখে এই স্বান্ত্বনাবাণী শুনে আমার যেন হুঁশ হলো।

আস্তাগফিরুল্লাহ! আমি তাহলে শয়তানের হামলার শিকার হয়েছিলাম! শয়তান তাহলে আমার অন্তরে নিরাশার অন্ধকার সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালিয়েছিলো! একজন কামিল রাহবারের হিদায়াত ছাড়া শয়তানের এসকল সূক্ষ্ম চক্রান্ত সম্পর্কে সতর্ক হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।

যাক, হযরতের সান্ত্বনা আমার

অন্তর থেকে নিরাশার অন্ধকার দূর করে দিলো এবং আশা ও প্রত্যাশার স্নিগ্ধ আলো জ্বেলে দিলো। আমি প্রশান্ত চিত্তে মাথা মুড়িয়ে ইহরাম থেকে মুক্ত হলাম।

হঠাৎ এমন একটি ঘটনার কথা মনে পড়লো যা আমার মন থেকে একেবারেই মুছে গিয়েছিলো! প্রথম লেখার সময়, এমনকি প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সম্পাদনার সময়ও মনে পড়েনি। এখন হঠাৎ করে মনে পড়ে গেলো এবং এমন স্পষ্টভাবে, যেন এই গতকালের ঘটনা। মিনায় তখন মাথা মুড়ানোর জন্য কিছুৃ কিছু

পাকিস্তানি ও হিন্দুস্তানি ক্ষুর-ব্লেড নিয়ে ঘুরতো এবং যেখানে সেখানে বসেই তিন রিয়ালের বিনিময়ে মাথা মুড়িয়ে দিতো। আমার মাথা যিনি মুড়িয়েছিলেন তিনি 

হিন্দুস্তানের কেরালার অধিবাসী, জামালুল ইসলাম। মাথা মুড়ানো চলছে হঠাৎ মনে হলো মাথায় একফোঁটা গরম পানি পড়লো! অবাক হয়ে মাথা তুলে তাকালাম, জামালুল ইসলামের চোখে পানি! মায়া হলো; নিশ্চয় অনেক দিন হয়েছে দেশ থেকে এসেছেন। স্ত্রী-সন্তানের কথা মনে পড়ছে। কিন্তু না, ছয় বছর হলো জামালুল ইসলাম পাক ভূমিতে এসেছেন। তেমন কোন কাজ পায় না, সে জন্য তার দুঃখ নেই। কারণ ছয়বারই সে হজ্ব করেছে এবং বলতে গেলে বিনা খরচে, বিনা মেহনতে! তাহলে তার কষ্ট কিসের! কষ্ট হলো, বুড়ো মা-বাবাকে সে হজ্ব করাতে চায়, কিন্তু তার তো সে সঙ্গতি নেই! প্রতিবার যখন হজ্ব করেন তার খুব কষ্ট হয়, বুড়ো মা-বাবার কথা ভেবে! দেশে নাকি তার শুখা রুটির ইন্তিযাম ছিলো, তবু বুড়ো মা-বাবা তাদের একমাত্র

সন্তানকে পাঠিয়েছে এ আশায় যে, তাদের আল্লাহর ঘরে আসার একটা না একটা ব্যবস্থা হবে। বুড়ো মা-বাবার দিলের খাব এখনো পুরা করা সম্ভব হলো না, মনে হলেই না-লায়েক বেটার চোখে পানি এসে যায়। আজও তাই হয়েছে। কী যে হলো, আমারও চোখে পানি এসে গেলো এবং আবেগের আতিশয্যে নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বের হয়ে গেলো, কেঁদো না আমার ভাই! দেখে নিও আল্লাহ চাহে তো আগামী বছরই তোমার মা-বাবার হজ্বের ইনতিযাম হয়ে যাবে।

 কেন আমার মুখে এ কথা এসেছিলো, আমি তো জানি না! সেই বুড়ো-বুড়ির আল্লাহর ঘরের যিয়ারত নছীব হয়েছিলো কি না, তাও জানি না! জামালুল ইসলামের মুখের ছবি এবং চোখের পানি সবই মুছে গিয়েছিলো আমার স্মৃতি থেকে। আজ হঠাৎ মনে পড়লো খুব স্পষ্টভাবে। আমি শুধু আশা করতে চাই, জামালুল ইসলামের বুড়ো মা-বাবা একদিন পানির জাহাযে চড়েছিলো এবং রহমতের দরিয়া পাড়ি দিয়ে পাক যমিনে হাযির হতে পেরেছিলো, আর মাথা মুড়িয়ে কোনভাবেই তিনটি রিয়াল নিতে রাজি না হওয়া জামালুল ইসলামের চোখে খুশির ঝিলিক দেখা দিয়েছিলো।

মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিছবাহকে আল্লাহ রহম করুন। হজ্বের সফরে তার সঙ্গ আমার বড় উপকারে এসেছিলো। আমরা একসঙ্গে মাথা মুড়িয়েছিলাম। তখন তিনি একটি সুন্দর ঘটনা শুনিয়েছিলেন, যা পরে কিতাবেও পড়েছি-

এক বুজুর্গ নয় তারিখের রাতে মিনায় স্বপ্ন দেখেন; দুজন ফিরেশতা, একজন অপরজনকে জিজ্ঞাসা করছেন, এবার কত মানুষ হজ্ব করতে এসেছে? অপর জনের উত্তর, ছয় লাখ। প্রথম জন জিজ্ঞাসা করলেন, এদের মাঝে কত জনের হজ্ব মাকবূল হয়েছে? অপর জনের উত্তর, মাত্র ছয়জনের।

বুজুর্গের চোখ খুলে গেলো। তিনি এমন ভীত-সন্ত্রস্ত হলেন যে, সারা শরীর ঘামে ভিজে গেলো। মনে মনে ভাবলেন, এ ছয়জন ভাগ্যবানের তালিকায় আমার নাম আর কীভাবে আসবে! আমার সব কষ্ট-সাধনা তাহলে বেকার গেলো! হায়, আমার তাহলে কী উপায় হবে!

দশ তারিখের রাত্রে মুযদালিফায় বুযুর্গ আবার স্বপ্ন দেখেন, ঐ দুজন ফিরেশতা; একজন জিজ্ঞাসা করছেন, শুধু ছয়জনের হজ্ব কবুল হলো, আর সবার হজ্ব বেকার গেলো! দ্বিতীয় ফিরেশতা বললেন, না, বরং এই ছয়জনের ওছিলায় পুরো ছয় লাখের হজ্ব আল্লাহ তাআলা কবুল করে নিয়েছেন।

সুবহানাল্লাহ! রাববুল আলামীনের রহমতের দরিয়ায় যখন জোশ আসে তখন এমনই হয়! রহমতের একেকটি মউজ আসে, আর বান্দার সব গান্দেগি ও নাপাকি ভাসিয়ে নিয়ে যায়; ছয়জনের বাহানায় ছয় লাখ পার হয়ে যায়! সুতরাং আল্লাহর রহমত থেকে কখনো নিরাশ হয়ো না। তিনি যখন দয়া করে এনেছেন তখন কিছু না কিছু দিয়েই বিদায় করবেন। তাই তো আল্লাহর পেয়ারা হাবীব বলেছেন, সবচে গোনাহগার ঐ ব্যক্তি যে আরাফায় হাযির হলো এবং অকুফ করলো, তারপরো এই ধারণা করলো যে, আল্লাহ হয়ত তাকে মাফ করেননি।

আল্লাহর পেয়ারা হাবীব আরো বলেছেন, বান্দা আল্লাহ সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে, আল্লাহ বান্দার সঙ্গে সে আচরণই করেন।

হাদীছে কুদসীতে স্বয়ং আল্লাহ বলেন, আমি তো বান্দার ধারণার কাছে থাকি!

সুতরাং আমি আমার আল্লাহর রহমতের কাছে আশা করি, তিনি আমার হজ্ব কবুল করেছেন এবং সমস্ত গোনাহ মাফ করে আমাকে সেই দিনের মত নিষ্পাপ করে দিয়েছেন যেদিন আমার মা আমাকে জন্মদান করেছিলেন।

আরাফার ময়দানের সবচে গোনাহগার বান্দাও আল্লাহর রহমতের কাছে এ আশা করতে পারে এবং আল্লাহ তাতে খুশী হন, তবে শর্ত হলো, বেয়াদুবি করো না, গাফলাতের মাঝে ডুবে থেকো না, ঝগড়া-বিবাদ করো না, আর আল্লাহর নেক বান্দাদের মনে কষ্ট দিও না। তাহলে অন্তত তাঁদের ওছিলায় তোমার হজ্ব কবুল হয়ে যাওয়ার আশা তুমি করতে পারো।

পঁচিশ বছরের জীবনে আমার কখনো কোরবানি করার খোশ নছীব হয়নি; এবারও হলো না। আববাকে কোরবানি করতে দেখেছি। আববার সঙ্গে কোরবানির হাটে গিয়েছি বহুবার; প্রথমের অবুঝ আনন্দের আকর্ষণে, পরবর্তীতে কিছুটা অনুভব-অনুভূতি সঙ্গে করে। কোরবানির হাটে আববাকে আমি দেখেছি। কেমন দেখেছি তা হয়ত বুঝিয়ে বলতে পারবো না, শুধু বলতে পারি, আববার মত কাউকে কোরবানির হাটে কখনো আমি দেখিনি। কোরবানির হাটে রওয়ানা হওয়ার আগে আববা দুরাকাত নামায পড়েন। সে নামাযে আববার দাড়ি তো ভেজে, জায়নামাযও ভেজে। মোনাজাতে সেকি কাকুতি-মিনতি! আমি দেখেছি, শিখতে পারিনি। খরিদ করার পর আববার প্রথম কাজ হলো পশুটিকে আদর করা এবং আশ্চর্য! কোন পশুকে আমি দেখিনি আববার আদর প্রত্যাখ্যান করতে। একবার দেখেছি - আববার তখন খুব বিপর্যস্ত জীবন এবং জীবনে সেই একবার তিনি শরিকে কোরবানি করেছেন - চোখে ধরে এমন একটি গাভীর দিকে মায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলছেন, আমার বড় তামান্না তোকে বাড়িতে নিয়ে কোরবানি দেই, যাবি আমার সঙ্গে! আমার হয়ত তাওফীক হবে না তোকে সঙ্গে নেয়ার। প্রিয় পাঠক, এমন বাবাকে আমি কি বলতে পারি!

আববা কোরবানির পশু বাড়িতে আনেন ঈদের দুএকদিন আগে। সেই পশুকে তিনি এমন আদর যত্ন করেন যেন তাঁর আদরের

সন্তান! কত বার যে তাঁর তিরস্কার শুনেছি গরুটার ঠিকমত খেদমত হচ্ছে না বলে! কোরবানির গরুর চারপাশে কয়েল জ্বেলে দেন, যাতে মশা কষ্ট না দেয়। একবার তো রীতিমত মশারি টানানোর ব্যবস্থা করেছিলেন! হাসছো তুমি! আমি কিন্তু সত্য কথা বলছি!

 কোরবানির দিন আমরা গোসল করি; আববা কোরবানির পশুকে স্নান করান। ঈদের নামায পড়ে আসার পর আববা একেবারে বদলে যান! আববা আমার কাছে একেবারেই অচেনা হয়ে যান। কোরবানির পশুকে যখন শোয়ানো হয় আববার চোখে তখন পানি এসে যায়, কখনো শব্দ করে কেঁদে ওঠেন। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে তিনি যখন ছুরি চালান তখন তাঁর অস্থির ও বেচায়ন অবস্থা হয় দেখার মত; যেন পশুর গলায় নয়, তিনি ছুরি বসিয়েছেন আপন

সন্তানের গলায়! এমন কোরবানি আমি আর কারো দেখিনি! এমন মমতার সঙ্গে ছুরি হাতে নিলেই হয় কোরবানি, নইলে হয়ে যায় কসাই ও জবাই। কোরবানির প্রতিটি পশুকে আল্লাহ যেন দান করেন আমার বাবার মত কোরবানি কারনেওয়ালা!

হয়ত প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়েছি। তবু কথাগুলো কেন বললাম জানো! গত বছর কোরবানির হাটে একটি দৃশ্য দেখেছিলাম, আমার মনে হয়েছিলো, একটি পশু একটি পশুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে! কোরবানির প্রতিটি পশুকে আল্লাহ যেন এমন পশু থেকে রক্ষা করেন।

 হে ভাই! তুমি যখন কোরবানির হাটে যাবে, কোরবানির পশু খরিদ করবে এবং কোরবানির পশুর গলায় ছুরি চালাবে তখন আমার এ কথাগুলো মনে রেখো।

যাক, মূল কথায় ফিরে আসি। আল্লাহ তার গোনাহগার বান্দাকে কোরবানির স্মৃতিবিজড়িত মিনায় হাযির করেছেন, অথচ আমার কোরবানি করার তাওফিক নেই! মনটা বড় বিষণ্ণ ছিলো। আমার যদি সামান্যতম তাওফিকও থাকতো, অবশ্যই আমি মিনার ময়দানে কোরবানি করতাম! এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে যে, আল্লাহর খলীল ইবরাহীম (আ) এর কোরবানির সঙ্গে তোমার কোরবানির একটি ন্যূনতম সাদৃশ্য স্থাপিত হবে! আল্লাহর পেয়ারা হাবীব এই মিনার ময়দানে কোরবানি করছেন, সেই সুন্নাতের অনুসরণ হয়ে যাবে! আর তাতে তুমি মুহূর্তের মাঝে ফরস থেকে আরশে পৌঁছে যাবে! কিন্তু হায়, সে তাওফিক কোথায় আমার!

হঠাৎ মনে হলো, কোরবানি আমি নিজে করতে না পারি, আল্লাহর নেক বান্দারা যে কোরবানি করছেন তাদের কোরবানি করা দেখতে তো পারি! কোরবানি করতে না পারা যদি হয় আফসোসের বিষয়, কোরবানির দৃশ্য দেখতে পারা তো অবশ্যই হবে সৌভাগ্যের বিষয়! কেয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে অন্তত বলতে তো পারবো, হে আল্লাহ, আমার তাওফিক ছিলো না, তাই কোরবানি করতে পারিনি, তবে ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরে অনেক দূর পথ পাড়ি দিয়ে আমি পৌঁছেছিলাম মিনার কোরবানিগাহে এবং তোমার পেয়ারা বান্দারা যে কোরবানি করেছেন, মুহাববাতের সঙ্গে তাদের কোরবানি করার দৃশ্য দেখেছিলাম!

মাথা মুড়িয়ে যখন ইহরাম থেকে মুক্ত হলাম এবং গোসল করে নতুন লিবাস পরলাম তখন হযরত বললেন, মিয়াঁ আবু তাহের! খোশবু ইস্তিমাল করো না কেন! নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হজ্বের বয়ানে তো রয়েছে, কোরবানি করার পর তিনি মাথা মুড়িয়ে ইহরাম থেকে বের হলেন এবং লেবাস পরার পর খোশবু ইস্তিমাল করলেন।

মিয়াঁ, তোমার হজ্ব তো তখনই হজ্ব হবে যখন অন্তত বাহ্যিকভাবে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হজ্বের সঙ্গে তার কিছু না কিছু মিল হবে। অনেক কিছুর মিল তো এখন আর সম্ভব না, যেগুলো সহজেই সম্ভব সেগুলো তো আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত না!

প্রিয় পাঠক, এবার বোঝো, আল্লাহর নেক বান্দারা কিভাবে হজ্ব করেন এবং তাঁদের ছোহবতে হজ্ব আদায় করা কত কল্যাণকর!

আমার কাছে আতর ছিলো না, তার চেয়ে বড় কথা, খোশবু ব্যবহার করার কথা মনেও ছিলো না। আমি খুব লজ্জিত হলাম এবং আমার অভ্যাসমত হযরতের উদ্দেশ্যে বলে উঠলাম, জাযাকাল্লাহ!

হযরত মৃদু হেসে আমাকে তাঁর আতরের শিশিটি হাদিয়া দিলেন এবং আমি আতর ব্যবহার করলাম। আমার সৌভাগ্য, হযরতের কাছ থেকে জীবনে অনেকবার অনেক কিছু হাদিয়া পেয়েছি। সবচে মূল্যবান হলো দুআর হাদিয়া, যা বিভিন্ন সময় কারণে, কিংবা বিনা কারণে খুশী হয়ে আমাকে দান করেছেন। তারপর সবচে প্রিয় হাদিয়া আমার কাছে মনে হয়েছে মিনার ময়দানে কোরবানির দিন এই আতরের হাদিয়া!

হযরত এখন দুনিয়াতে নেই, তাঁর কাছ থেকে পাওয়া অনেক হাদিয়াও আমার কাছে নেই, তবে আতরের শিশিটি আছে। ছোট্ট একটি শিশি এবং হয়ত খুব সাধারণ, কিন্তু পৃথিবীর কোন সম্পদের বিনিময়ে তোমাকে আমি তা দেবো না। যদি বলো, আল্লাহর ওয়াস্তে তাহলে অবশ্য দিয়ে দেবো। তবে আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি তা চাইতে যেয়ো না।

সুযোগ পেয়ে আরয করলাম, হযরত! আমার বড় ইচ্ছা, কোরবানিগাহে গিয়ে হাজী ছাহেবানদের কোরবানি করা দেখি। হযরত খুশী হয়ে ইজাযাত দিলেন। আমি তাঁবুর নম্বর এবং অন্যান্য চিহ্ন ঠিক রেখে একাই রওয়ানা হলাম। মিনার একপ্রান্তে অবস্থিত মানহার বা কোরবানি ক্ষেত্র আমাদের তাঁবু থেকে অনেক দূরে ছিলো।

জামরাতুল আকাবার রামী করার পর ক্লান্ত ছিলাম। সুতরাং এখন ক্লান্তি বোধ করা স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু তখন আমার কোন ক্লান্তিবোধ ছিলো না; অন্তরে বরং উৎসাহ-উদ্দীপনার এবং আবেগ ও জাযবার অদ্ভুত এক তরঙ্গদোলা অনুভব করছিলাম। সেই মুহূর্তে ক্ষণিকের জন্য মনে হয়েছিলো, আমার বাবা যদি আজ আমাকে আল্লাহর মুহাববাতে কোরবানি করতে চান, কিংবা আমাকে যদি বলা হয়, তোমার কলিজার টুকরোটিকে আল্লাহর জন্য কোরবানি করো তাহলে হয়ত খুশিমনেই আমি রাজী হয়ে যাবো।

তবে সঙ্গে সঙ্গে আমি চমকে উঠলাম এবং ভয়ে কম্পিত হলাম। এ ধরনের চিন্তা নিশ্চয় আদবের খেলাফ এবং শয়তানি ওয়াসওয়াসা! শয়তান কতভাবে যে আমাদের কমযোর দিলের উপর হামলা চালায়! আমি মনে মনে এবং জোরে জোরে

ইস্তিগফার পড়লাম।

প্রায় একঘণ্টা হাঁটার পর মানহারে পৌঁছলাম। আশেকানে খালীল সেখানে হাজার হাজার। কেউ  যাচ্ছেন কোরবানি করতে, কেউ ফিরে যাচ্ছেন কোরবানি করে। যারা যাচ্ছেন তাদের মুখমন্ডলে আবেগ ও জাযবার অপূর্ব এক দীপ্তি! ঠিক কোন শব্দে সেটাকে প্রকাশ করা যায়, আমি ঠিক জানি না। যারা ফিরে যাচ্ছে তাদের মুখাবয়বে যেন কী এক প্রাপ্তির তৃপ্তি! কিসের প্রাপ্তি এবং কেমন তৃপ্তি তা প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই। তবে দুই চেহারায় দুরকমের অনুভূতি আমি স্পষ্ট অনুভব করছিলাম। যারা টোকেনের মাধ্যমে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে কোরবানি করার প্রস্তাব রাখছেন তারা শুধু নষ্ট হয়ে যাওয়া গোশতের কথা ভাবছেন, কিন্তু একবারও ভেবে দেখছেন না যে, তখন কি কোরবানিকারীদের অন্তরে জাগ্রত হবে এমন রূহানি জাযবা ও আবেগ-অনুভূতি! আমরা কি তাদের মুখমন্ডলে দেখতে পাবো ত্যাগের মহিমার এই উদ্ভাস এবং প্রাপ্তির তৃপ্তির এই আভাস! তখন হয়ত সেটা হবে পশু জবাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা, কিন্তু কোথায় যাবে কোরবানির রূহানিয়াত ও নূরানিয়াত!

ভিড়ের ফাঁক খুঁজে খুঁজে মানহারের ভিতরে প্রবেশ করলাম। বিরাট জায়গা এবং আধুনিক ব্যবস্থা, তবে অবব্যবস্থার কারণে প্রথম দিনেই যেন প্রতিটি ব্যবস্থা তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। একদল দক্ষ ও নিবেদিত প্রাণ কর্মী যদি এখানে নিযুক্ত হতো তাহলে পরিবেশ থাকতো পাকছাফ এবং কোরবানির পবিত্রতায় ভাবগম্ভীর!

মিনার কোরবানিগাহে হাযির হয়ে সেদিন আমি যে শিক্ষা লাভ করেছিলাম এবং যে আবেগ-অনুভূতি অর্জন করেছিলাম সেটা ছিলো আমার জীবনের মূল্যবান এক সঞ্চয়। আল্লাহ যদি আমার অন্তরে এই ইচ্ছাটুকু জাগ্রত না করতেন! কোরবানির দৃশ্য অবলোকনের উদ্দীপনায় যদি এখানে হাযির না হতাম, তাহলে অনেক কল্যাণ থেকেই আমি বঞ্চিত হতাম।

আরবের ভূমিতে আমি কোন উট দেখিনি, আজ দেখলাম। শত শত নয়, হাজার হাজার এবং অনেক হাজার! দুই তিন সারিতে দাঁড়িয়ে আছে, বসে আছে। এখানে সেখানে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়ও রয়েছে কিছু উট। গ্রামের বেদুঈনরা নিয়ে এসেছে; কেউ পাঁচটা, কেউ দশটা, কেউ আরো বেশী। এই বেদুঈনরা যে তেলসমৃদ্ধ এবং সম্পদ উপচে পড়া সউদী আরবের নাগরিক, পোশাকে ও চেহারাসুরতে তা বোঝার কোন উপায় নেই। আসলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য  আছে সর্বত্র এবং তার চেহারা অভিন্ন। তবে স্বীকার করতে হবে যে, উটের লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বেদুঈনদের আচরণ ছিলো খুব সহজ-সরল এবং অকপট। বাইরে ভিতরে দৈন্য নেই; দুই দারিদ্রে্যর মাঝে পার্থক্যটা এখানেই।

প্রথমেই যে বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ করলো তাহলো উটগুলোর শান্ত স্বভাব এবং চোখের গভীর চাহনী। হয়ত নিছক আমার কল্পনা, কিন্তু আমার মনে হলো, এখানে আসার, বা আনার উদ্দেশ্য এরা জানে। বংশপরম্পরায় যেমন হয়ে এসেছে, তেমনি আজ এখানে এদেরকে আল্লাহর নামে কোরবানি করা হবে। কিন্তু তাদের মাঝে ভীতির কোন ছাপ নেই, বরং চোখের চাহনীতে যেন আত্মসমর্পণের ছায়াপাত। অথচ যারা কোরবানি করতে এসেছে তাদের অনেকের মাঝে তা ছিলো অনুপস্থিত। সেখানে অট্টহাসি ছিলো, শোরগোল ছিলো, আর ছিলো দামদস্ত্তর নিয়ে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়। তাতে মিনার কোরবানগাহে উপস্থিত একজন হাজী হিসাবে আমি ব্যথিত ও লজ্জিত হয়েছি এবং মনে মনে পশুগুলোর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছি।

বিদায় হজ্বে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোরবানির বর্ণনায় এসেছে, কিছু উট তাঁর দিকে ছুটে ছুটে আসতে লাগলো এ আকাংক্ষায় যে তাদের কাকে দিয়ে তিনি কোরবানি শুরু করবেন!

এখানেও কিছু উটের মাঝে আমার মনে হলো, দেখতে পেলাম কোরবানি হওয়ার সেই আকুতির ছায়াপাত! কে জানে, এরা সেই উটগুলোর বংশধর কি না!

এক বৃদ্ধ আরব হৃষ্টপুষ্ট বিরাট দুটি উট খরিদ করলেন। তিনি দরদস্ত্তর করলেন না, উল্টো বেদুঈন উটওয়ালাকে কিছু রিয়াল বেশী দিলেন, বেদুঈন বেহদ খুশী হয়ে বারবার বারাকাল্লাহু ফী উযহিয়াতিকা বলে বৃদ্ধকে দুআ দিতে লাগলো।  আমি অবাক হলাম এবং ভাবের তরঙ্গদোলায় আপ্লুত হলাম। বৃদ্ধকে তেমন কোন সচ্ছল ব্যক্তি মনে হলো না, অথচ হৃদয়ের সচ্ছলতা!

আমি তার কাছে এগিয়ে গেলাম এবং বললাম, যদি কিছু মনে না করেন, আমি জানতে চাই, আপনি দরদস্তুর করেননি, বরং মূল্যের অতিরিক্ত দান করেছেন, এমনটা তো কেউ করে না, আপনি করলেন, কারণ কী?!

কিছুক্ষণ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, যেন বুঝতে চাইলেন, অন্তরের কথাটা আমাকে বলা যায় কি না! শেষে বললেন, বেটা! এই পশু তো আমার সন্তানের ফিদয়া; আমার পুত্রের বদলি কোরবানি! এটা নিয়ে দামদস্ত্তর করা আমার অন্তর কীভাবে বরদাশত করতে পারে!

আমি শ্রদ্ধায় অভিভূত হলাম। আমার মন বলে উঠলো, এ রকম দুএকজন কোরবানি কারনেওয়ালার অছিলায় হয়ত আল্লাহ তাআলা আর সবার অনুভূতিহীন কোরবানিও কবুল করে নেবেন!

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement