শাওয়াল ১৪২৯   ||   অক্টোবর ২০০৮

‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসিয়ত’ শীর্ষক পুস্তিকা : একটি প্রশ্নোত্তর

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

প্রশ্ন : জনাব! কিছুদিন আগে আমি একটি পুস্তিকা পেয়েছি, যার নাম নবী করীম সা.-এর অসিয়ত। প্রথম পৃষ্ঠায় আল্লামা আবুল ফযল আবদুর রহমান সুয়ূতীকে এর সংকলক বলা হয়েছে। পুস্তিকাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত। প্রথম প্রকাশ জুন-২০০০ এবং দ্বিতীয় প্রকাশ জানুয়ারি-২০০৩-এ। আমার কাছে দ্বিতীয় এডিশনের একটি কপি রয়েছে।

পুস্তকটির দুটি অংশ : ১. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসিয়ত হযরত আলী ইবনে আবী তালেব রা.-এর উদ্দেশ্যে। ২. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসিয়ত হযরত আবু হুরায়রা রা.-এর উদ্দেশ্যে।

অনুবাদকের ভূমিকায় বলা হয়েছে যে, এ পুস্তকের মাখতূতা (পান্ডুলিপি) মাকতাবাতুল হারামিল মক্কিয়িশ শরীফ মক্কা মুকাররমাতে সংরক্ষিত রয়েছে।

আমার প্রশ্ন এই যে, বাস্তবিকই এই অসিয়ত কি সুয়ূতী রাহ.-এর সংকলিত? সুয়ূতী রাহ. এই অসিয়ত কোথায় পেয়েছেন? এর শুরুতে বা শেষে কোনো সনদও আমি পাইনি। তাছাড়া এই উভয় অসিয়তের মধ্যে যেমন ভালো ভালো কিছু কথা আছে তেমনি কিছু কথা মুনকার ও  আপত্তিকরও মনে হয়েছে। এজন্য সন্দেহ হচ্ছে যে, সম্ভবত অসিয়তটি উপরোক্ত দুই সাহাবীর নামে তৈরি করা হয়েছে। আশা করি, প্রকৃত বিষয়টি অনুসন্ধান করবেন এবং আমাদেরকে অবহিত করবেন।

 

আবু লুবাবা

চাঁদপুর

২০ এপ্রিল-২০০৫

উত্তর : আপনার আগেও একজন এ পুস্তিকার ফটোকপি আমাকে দিয়েছিলেন এবং একই  প্রশ্ন তিনিও করেছিলেন। উসূলে হাদীস এবং জায়েযায়ে মাখতূতাত (পান্ডুলিপি-সমালোচনা)-এর নীতিমালার আলোকে সে সময়ই এর  উত্তর দেওয়া যেত, কিন্তু আমি সম্পূর্ণ বিষয়টি ভালোভাবে অবগত হওয়ার জন্য মাকতাবুল হারামিল মক্কীতে সংরক্ষিত পান্ডুলিপি সরাসরি দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। এজন্য উত্তর লিখতে বিলম্ব হয়েছে। এখন আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিয়েছেন, মাকতাবাতুল হারামিল মক্কী, যা আযীযিয়াতে জামেয়া উম্মুল কুরার কাছে মুছতাশফাত তিউনিসীর উল্টোদিকে অবস্থিত, তাতে এই পান্ডুলিপি সচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছে।

এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে একথাটা জেনে নেওয়া উচিত যে, এই দুই অসিয়তনামার কোনোটিই আবুল ফযল (জালালুদ্দীন) সুয়ূতীর সংকলন বলে প্রমাণিত নয়। একে তাঁর সংকলন বলে দাবি করা পরিষ্কার ভুল। না আলী রা. বা আবু হুরায়রা রা. এটা বর্ণনা করেছেন আর না রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এটা দান করেছেন। এটা সাহাবা-যুগের অনেক পরের বস্ত্ত। কোনো মিথ্যুক বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু ভালো ভালো কথা সংগ্রহ করে, কিছু কথা সহীহ হাদীস থেকে চয়ন করে, আর কিছু ভিত্তিহীন কথাবার্তা গল্প-কাহিনীকারদের কাছ থেকে নিয়ে কিংবা নিজে বানিয়ে একটা বিশেষ বিন্যাসে সংকলন করেছে। এরপর একে অসিয়্যতুন নবী লি আলী আবী ইবনে আবী তালেব নামে চালিয়ে দিয়েছে। আরেক মিথ্যুক বা একই লোক এরকম আরেক পুস্তিকা তৈরি করে অসিয়্যতুন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লি আবী হুরায়রা নামে চালিয়ে দিয়েছে।

এজন্য এই পুস্তিকার প্রচার-প্রসার এবং একে রাসূলের হাদীস বা নবীজীর অসিয়ত হিসেবে বর্ণনা করা হারাম। এ পুস্তিকায় বিদ্যমান আছে বলেই কোনো কথাকে হাদীস মনে করা যাবে না; বরং আহলে ইলমের কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে যে, একথাটা কোনো সহীহ হাদীসে এসেছে কি না কিংবা কোনো শরয়ী দলীলের দ্বারা প্রমাণিত কি না।

পুস্তিকাটি জাল কেন?

এই পুস্তিকা জাল কেন-এ বিষয়ে শাস্ত্রীয় আলোচনা করতে গেলে অনেক কথা বলা যায় এবং অনেক দলীল পেশ করা যায়, কিন্তু সংক্ষিপ্ততা ও সহজবোধ্যতার উদ্দেশ্যে আপাতত কয়েকটি মৌলিক কথা পেশ করছি।

১. কোনো মাখতূতা (পান্ডুলিপি) অমুকের রচিত-এই দাবি করার জন্য যে শর্তগুলো অপরিহার্য তা এখানে অনুপস্থিত। যথা-পান্ডুলিপির লিপিকর ছিকা (নির্ভরযোগ্য) হওয়া, পূর্ববর্তী কোন কপি থেকে এই কপিটি তৈরি হয়েছে তা জানা থাকা এবং সেই আদর্শ কপিটি নির্ভরযোগ্য হওয়া। স্বাক্ষরিক পান্ডুলিপি অর্থাৎ রচয়িতার নিজ পান্ডুলিপি পর্যন্ত এ কপির অবিচ্ছিন্ন সূত্র বিদ্যমান থাকা। প্রতিলিপি তৈরি হওয়ার পর আদর্শ কপির সঙ্গে সঠিক পদ্ধতিতে মুকাবালা করা। এ শর্তগুলো বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য। আরেকটি পদ্ধতি হল রচনাটি উল্লেখিত রচয়িতার বলে তাওয়াতুরের মাধ্যমে প্রমাণিত হওয়া কিংবা অন্তত আহলে ইলমের মাঝে বিষয়টা স্বীকৃত হওয়া।

উপরোক্ত মাখতূতায় (পান্ডুলিপিতে) এই শর্তগুলোর সবগুলোই অনুপস্থিত। লিপিকর ছিকাহ হওয়া তো দূরের কথা, তারাজিম ও তবাকাতের গ্রন্থাদিতে তার কোনো খোঁজই পাওয়া যায় না। তবে পান্ডুলিপির পুষ্পিকা  (Colophon) থেকে অনুমিত হয় যে, বেচারা একজন অনারব, আরবী ভাষার সঙ্গেও যার কোনোরূপ যোগসূত্র নেই। যেমন প্রথম অসিয়তের পুষ্পিকায় লেখা রয়েছে-

تمت الوصية النبي عليه التحية إلى حضرت علي رضي الله عنه، كرم الله وجهه، على يد شيخ الحاج محمد بشكطاش المولوي في أواخر شهر محرم الحرام سنة خمس وثلاثين ومئة وألف.

আহলে ইলম বন্ধুরা দেখতেই পাচ্ছেন এ বাক্যগুলোতে আরবী ভাষার ওপর কীরূপ অত্যাচার করা হয়েছে। এখান থেকে এটাও জানা যাচ্ছে যে, পান্ডুলিপিটির লিপিকাল হল ১১৩৫ হি.; ১০৩৫ হিজরীর নয়, যা ফাউন্ডেশনের অনুবাদের ভূমিকায় দাবি করা হয়েছে।

দ্বিতীয় অসিয়তের পুষ্পিকায় লেখা হয়েছে-

... سلخ شهر محرم الحرام سنة خمس وثلثين ومئة وألف، على يد الحقير الفقير الحاج شسخ محمد المولوي ابن علي الشيخ، في زاوية المولوية ببشكطاس، غفر لهما وعفي عنهما.

দুটো উদ্ধৃতিই হুবহু পেশ করা হয়েছে। ভুলত্রুটি বা অসঙ্গতিগুলোকে পাঠক যেন মুদ্রনের ভুল মনে না করেন।

এগুলো ছাড়াও পান্ডুলিপির শুরু বা শেষে কোথাও আদর্শ পান্ডুলিপিরই (Exemplar) নাম-পরিচয় নেই, স্বাক্ষরিক পান্ডুলিপি (Autograph) বা লেখকের কপি পর্যন্ত এ কপির সূত্র বিদ্যমান থাকার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া পান্ডুলিপির কোথাও জালালুদ্দীন সুয়ূতীর দিকে নিসবতের উল্লেখ নেই। শুধু এক কোণায় রিসালায়ে ইমাম সুয়ূতী শব্দটা লিখিত আছে। কিন্তু এ শব্দ কার লেখা-এটা জানা নেই। আলামত থেকে অনুমিত হয় যে, এটা কোনো সাধারণ পাঠকের প্রক্ষেপ বা সংযুক্তি। মোটকথা, এ শব্দ কার লেখা-এটা অজানা।

তাছাড়া যদি উপরোক্ত বাক্যের অর্থ এই হয় যে, এই অসিয়তটি সুয়ূতীর রিসালা তাহলে এর মাধ্যমে লেখকের অজ্ঞতা প্রকাশিত হয়। কেননা, এই অসিয়ত সুয়ূতীর বর্ণনা হলে একে জুয বলা হত, রিসালা নয়। এরপর কী দলীলের ভিত্তিতে একে সুয়ূতীর রিসালা বলে মতপ্রকাশ করা হয়েছে তারও উল্লেখ সেখানে নেই। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বক্তার নাম-পরিচয় অজানা, মন্তব্য অজ্ঞতাপূর্ণ এবং দাবি দলীলবিহীন। এভাবে কি কোনো পান্ডুলিপির রচয়িতার পরিচয় প্রমাণ হয়?

 

এরপর তাওয়াতুরতালাক্কী বিল কবুল-এর যে পন্থা উপরে উল্লেখিত হয়েছে সে পন্থায় উপরোক্ত দাবি প্রমাণ হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না; বরং এর বিপরীতে আহলে ইলমের মাঝে এ বিষয়টা স্বীকৃত যে, এই অসিয়তনামা সুয়ূতীর সংকলন হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সুয়ূতী তাঁর রচনাবলির তালিকা নিজেই প্রস্ত্তত করে গেছেন এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরাও তা করেছেন। কোনো তালিকাতেই এই অসিয়তনামার উল্লেখ নেই। শুধু তাই নয়; বরং খোদ জালালুদ্দীন সুয়ূতী তাঁর রচিত আল লাআলিল মাছনূআ ফিল আহাদীসিল মওজুআ গ্রন্থে, যা তিনি জাল ও প্রক্ষিপ্ত বর্ণনাসমূহের স্বরূপ আলোচনার জন্য লিখেছেন, এই দুই অসিয়ত মওযু ও জাল হওয়ার কথা পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ করেছেন।

সুয়ূতী আললাআলিল মাছনূআ (খন্ড ২, পৃ. ৩৭৪; কিতাবুল মাওয়ায়িজ ওয়াল ওছায়া) তে প্রথম অসিয়তনামার প্রথম দিকের বাক্যগুলো উল্লেখ করেছেন, যেখানে মুমিন, তাকাল্লুফকারী, রিয়াকার, জালেম, মুনাফিক এবং অলস প্রভৃতি লোকদের তিনটি করে বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে, এরপর অসিয়তনামার অন্যান্য বিষয়ের কিছু বাক্য উল্লেখ করে বলেন-

موضوع، والمتهم به حماد بن عمرو، وهو كذاب وضاع.

অর্থাৎ এই অসিয়তনামা মওযূ। এ সম্পর্কে অভিযুক্ত হচ্ছে হাম্মাদ ইবনে আমর, যে একজন মিথ্যুক ও  জাল বর্ণনা প্রস্ত্ততকারী।

এ প্রসঙ্গে সুয়ূতী রাহ. ইমাম বায়হাকী রাহ.-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, তিনিও এই অসিয়তনামাকে মওযূ বলেছেন।

৩. ইমাম বায়হাকীর মন্তব্য তাঁর কিতাব দালায়েলুল নুবুওয়াহতে (৭/২২৯) রয়েছে। মূল আরবী পাঠ নিম্নরূপ :

 

... عن حماد بن عمرو النصيبي، عن السري بن خالد، عن جعفر بن محمد، عن أبيه عن جده، عن علي بن أبي طالب رضي الله عنه، عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال : يا علي أوصيتك بوصية فاحفظها، فإنك لا تزال بخير ما حفظت وصيتي يا علي، يا علي إن للمؤمن ثلاث علامات : الصلاة والصيام والزكاة، فذكر حديثا طويلا في الرغائب والآداب، وهو حديث موضوع، وقد شرطت في أول الكتاب ألا أخرج في  هذا الكتاب حديثا أعلمه موضوعا.

... يححي بن معين يقول : حماد بن عمرو النصيبي ممن يكذب ويضع الحديث ... .

বায়হাকী রাহ.-এর উপরোক্ত মন্তব্যের সারকথা এই যে, এই অসিয়তনামায় আদাব ও ফাযায়েল সংক্রান্ত বিষয়াদি যদিওবা রয়েছে তবে তা মওযূ। এর সনদে হাম্মাদ ইবনে আমর আননাসীবী নামক একজন রাবী রয়েছে, যার সম্পর্কে রিজাল শাস্ত্রবিদগণের সিদ্ধান্ত এই যে, সে হাদীসের নামে মিথ্যা কথাবার্তা তৈরি করে বর্ণনা করত। (দালায়েলুন নুবুওয়াহ ৭/২২৯)

অসিয়তের অনুবাদের শুরুতে সনদের দু একটি নাম উল্লেখিত হয়েছে, কিন্তু পান্ডুলিপির ভুল সম্পর্কে অনুবাদক অবগত না থাকায় সেখানে খালেদ ইবনে জাফর ইবনে মুহাম্মাদ লেখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তা হবে ছারী ইবনে খালেদ আন জাফর ইবনে মুহাম্মাদ। প্রশ্ন  এই যে, ছারী ইবনে খালেদ যে এটা বর্ণনা করেছেন-এই তথ্যটা কোথায় পাওয়া গেল? এই তথ্যটা দিচ্ছে হাম্মাদ ইবনে আমর, যার সর্ম্পকে ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সে একজন মিথ্যুক ও জাল বর্ণনা প্রস্ত্ততকারী।

মোটকথা, বায়হাকী রাহ. ও সুয়ূতী রাহ. যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সকল হাদীস বিশারদের সিদ্ধান্তও তাই। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন :

আলমাছনূ ফী মারিফাতিল হাদীসিল মওযূ-মোল্লা আলী কারী ২৩৪-২৩৭;তানযীহুশ শরীয়াতিল মারফূআ ইবনে আররাক ২/৩৩৯; আলমওযূআত ইবনুল জাওযী ২/৩৬২; আলফাওয়াইদুল মাজমূআ শাওকানী ৪২৪ ইত্যাদি।

 

৪. এ আলোচনাগুলো ছিল প্রথম অসিয়তনামা সম্পর্কে। দ্বিতীয় অসিয়তনামা সম্পর্কেও হাদীস বিশারদগণের সিদ্ধান্ত অভিন্ন। মুহাদ্দিস ইবনুল জাওযী (৫৯৭ হি.) কিতাবুল মওযূআতে (খন্ড ২, পৃ. ৩৬৪-৩৬৫) এই অসিয়তনামার কিছু বাক্য উল্লেখ করে মন্তব্য করেন যে, ‘‘বর্ণনাকারী পুরো অসিয়ত বর্ণনা করেছে। এটা একটা দীর্ঘ বর্ণনা, যা এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। বর্ণনাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সনদে একাধিক রাবী এমন রয়েছে যারা একেবারে মাজহুল, যাদের কোনো নাম-পরিচয় পাওয়া যায় না। কোনো সন্দেহ নেই যে, এটা কোনো জাহেল কাহিনীকারের প্রস্ত্ততকৃত বর্ণনা। সনদ তৈরিতেও সে আশ্চর্য জগাখিচুরি পাকিয়েছে। সনদে পরিচিত রাবী হাম্মাদ ইবনে আমর। তবে সে হল ওই ব্যক্তি যার সম্পর্কে ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন বলেছেন, এ লোক মিথ্যা বলত এবং মিথ্যা হাদীস তৈরি করত। ইবনে হিববান বলেছেন, ছিকা রাবীদের নামে সে মিথ্যা বর্ণনা তৈরি করতে থাকত।’’

সুয়ূতী রাহ.ও একে মওযূ বর্ণনা বিষয়ক গ্রন্থ আললাআলিল মাছনূআ (২/৩৭৭-৩৭৮)তে উল্লেখ করেছেন এবং সংক্ষেপে ইবনুল জাওযীর মন্তব্য উল্লেখ করে তা বহাল রেখেছেন। আরো দেখুন :

 

আলমাছনূ ফিল হাদীসিল মওযূ ২/২০৯-২১১ (টীকা); তানযীহুশ শরীয়াতিল মারফূআ ২/৩৪০

মোটকথা, যখন খোদ আবুল ফযল সুয়ূতী রাহ এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদগণ উভয় অসিয়তনামাকে মওযূ বলছেন তখন এটা কীভাবে সম্ভব যে, সুয়ূতী নিজেই তা নবীজীর অসিয়তনামা হিসেবে সংকলন করবেন এবং তা মানুষের সামনে পেশ করবেন?

৫. অনুবাদক অসিয়তনামার দ্বিতীয় অংশের শুরুতেও সনদের একটি অংশ উল্লেখ করেছেন। এটা দেখে বিভ্রান্ত হওয়া ঠিক হবে না। কেননা ওই সনদটাও জাল ও প্রস্ত্ততকৃত। এ প্রসঙ্গে হাদীসবিশারদদের মন্তব্য ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর পান্ডুলিপির ত্রুটির কারণে অনুবাদক সনদের নামগুলো সঠিকভাবে পড়তে পারেননি। যেমন একটি নাম লেখা হয়েছে হাম্মাদ ইবনে আতিয়্যা অথচ প্রকৃত পাঠ হাম্মাদ ইবনে আমর। ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, এ একজন মিথ্যুক রাবী। আরেকজনের নাম এভাবে লেখা হয়েছে সালামা ইবনে মীম মাকান শামী থেকে। প্রকৃত কথাটা হবে- মাসলামা ইবনে আমর মাকহুল শামী থেকে।

দেখুন : কিতাবুল মওযূআত ইবনুল জাওযী- ২/৩৬৪; আললাআলিল মাছনূআ ২/৩৭৭

 

৬. প্রথম অসিয়তনামার অনুবাদে শেষের কয়েকটি বাক্য বাদ দেওয়া হয়েছে। ওই বাক্যগুলোর অনুবাদ পেশ করা হয়নি। সেগুলোর অনুবাদ করা হলে অসিয়তনামাটি জাল হওয়ার প্রসঙ্গ আরো পরিষ্কার হয়ে যেত। আহা! অনুবাদক যদি অন্তত ওই কথাগুলো থেকে, যেগুলো অনুবাদ করাও তিনি সমীচীন মনে করেননি, উপলব্ধি করতে সক্ষম হতেন যে, এটা নবীজীর অসিয়তনামা নয়; বরং পরের যুগের বানানো বস্ত্ত!!

 

এখানে কারো এই প্রশ্ন হওয়া উচিত নয় যে, এই দুই অসিয়তনামা যদি আগাগোড়া মওযূ ও জালই হয়ে থাকে তবে কেন এর পান্ডুলিপি সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে, উপরন্তু মাকতাবাতুল হারামিল মক্কীর মতো কুতুবখানায়? কেননা, এটা খুব সহজ কথা যে, কোনো কুতুবখানায় কোনো পান্ডুলিপি বা মুদ্রিত কিতাব সংরক্ষণ করার অর্থ এই হয় না যে, কিতাবটি বিশুদ্ধ বা সেই কিতাবের সকল তথ্য নির্ভরযোগ্য। কুতুবখানায় জাদুঘরের মতো সব ধরনের বস্ত্তই সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষিত বস্ত্তর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও নির্ভরযোগ্যতা কতটুকু সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এ বিষয়ে নির্ধারিত নীতিমালা রয়েছে, যার আলোকে বিচার করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। এজন্য কুতুবখানায় জাল পুস্তিকাও থাকে, মুলহিদ ও বেদ্বীন লোকদের ইসলাম বিরোধী বইপত্রও সংরক্ষিত থাকে। জাল বর্ণনাসমূহের কোনো সংকলন যদি কেউ জেনে বা না জেনে তৈরি করে এবং তার কপি কোনো কুতুবখানার দায়িত্বশীলরা পেয়ে যান তবে অবশ্যই তারা তা সংরক্ষণ করবেন। তবে তা এজন্য নয় যে, এটা তাদের কাছে একটা প্রমাণিত বস্ত্ত বা এর তথ্যাবলি নির্ভরযোগ্য; বরং এজন্য যে, জালকারীর কর্মের দলীল হিসেবে এবং একে সহীহ মনে করে যারা এর প্রতিলিপি প্রস্ত্তত করে তাদের মূর্খতার দলীল হিসেবে একে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন রয়েছে।

অতএব কোনো সাদাসিধে লোক যদি কোনো গ্রন্থশালায় এরূপ কোনো পান্ডুলিপি পেয়ে যায় এবং আগপিছ বিচার না করেই একে সহীহ মনে করে ও তা প্রকাশ করে তবে এর দায় ওই গ্রন্থশালার দায়িত্বশীলদের ওপর বর্তায় না।

শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও কিছু মূর্খ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রকাশক প্রথম অসিয়তনামা আরবী ভাষায় প্রকাশ করেছে।

আরবের মুহাদ্দিস শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এর নিন্দা করে লেখেন- (তরজমা) সাইয়্যেদেনা আলী রা.-এর সঙ্গে সম্বন্ধকৃত এই অসিয়তনামা, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মিথ্যারোপ, .... একাধিকবার মুদ্রিত হয়েছে এবং এখনও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। অসচেতন ও উদাসীন প্রকৃতির লোকেরা এটা সংগ্রহ করে থাকে। যে মিথ্যুক এটা প্রস্ত্তত করেছে সে পাপী, অভিশপ্ত! এর প্রকাশক পাপী অভিশপ্ত! এর বিক্রেতা পাপী অভিশপ্ত এবং একে যে সত্য মনে করে সেও পাপী অভিশপ্ত! আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তির মন্দ করুন যে নিজের দ্বীন-ধর্ম ও বিচার-বুদ্ধির ব্যাপারে বোধহীন। -আলমাসনূ ২৩৫ (টীকা)

একটি জরুরি সতর্কীকরণ

 

এই অসিয়তনামাকে মওযূ বলার অর্থ হচ্ছে, এ ধরনের কোনো অসিয়তনামা মৌখিকভাবে বা লিখিত আকারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রা.কে বা হযরত আবু হুরায়রা রা.কে কিংবা অন্য কোনো সাহাবীকে প্রদান করেননি। আর না ওই দুই সাহাবী বা অন্য কোনো সাহাবী বিভিন্ন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছ থেকে শোনা নসীহতগুলো একত্রে সংকলন করেছেন। কোনোটাই হয়নি। এটা খায়রুল কুরূনের অনেক পরে কোনো মিথ্যুকের রচনার মাধ্যমে অস্তিত্ব লাভ করেছে।

তবে এই মিথ্যুক রচনাকার যেহেতু অনেক কথা সহীহ হাদীস থেকে গ্রহণ করেছে এবং জ্ঞানী লোকদের কিছু জ্ঞানগর্ভ বাণীও এখানে সংযু্ক্ত করেছে এজন্য উভয় অসিয়তনামাতেই কিছু সঠিক কথা পাওয়া যাবে : কিছু জ্ঞানগর্ভ বাক্যমালা, যা সাধারণ বিচার-বুদ্ধি ও শরীয়তের সাধারণ নীতিমালার আলোকে সঠিক, আর কিছু বিষয়, যা সরাসরি হাদীস শরীফে এসেছে। যেমন প্রথম অসিয়তনামার প্রথম বাক্যটি সহীহ হাদীসে এসেছে এবং ইমাম মুসলিম রাহ. তা কিতাবুস সহীহতে বর্ণনা করেছেন। আরবী পাঠ এই-

أنت مني بمنزلة هارون من موسى، إلا أنه لا نبي بعدي.

অর্থাৎ হারূন মুসার পক্ষ থেকে যে দায়িত্ব লাভ করেছিলেন তুমিও আমার পক্ষ থেকে তেমন দায়িত্ব লাভ করছ তবে আমার পরে কোনো নবী নেই। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪০৪

এটা হল অনেক প্রতারকের ব্যবহৃত একটা পুরানো কৌশল। তারা যখন কোনো জুয প্রস্ত্তত করে তখন যেমন বিভিন্ন ভিত্তিহীন বর্ণনার সাহায্য গ্রহণ করে কিংবা নিজের পক্ষ থেকে মনগড়া কথাবার্তা উদ্ধৃত করে তেমনি জ্ঞানীদের জ্ঞানগর্ভ কিছু কথা কিংবা সহীহ হাদীস থেকেও কিছু কিছু বিষয় নিয়ে সেখানে সংযুক্ত করে। আলোচিত দুই অসিয়তনামার প্রস্ত্ততকারী মিথ্যুকরাও এই কৌশল অবলম্বন করেছে।

পাঠকবৃন্দের করণীয় এই যে, তারা এই অসিয়তনামা পাঠ করা থেকে  বিরত থাকবেন এবং কারো কাছে এর কোনো কপি থাকলে তাকে নির্ভরযোগ্য মনে করবেন না। তবে এমনও করবেন না যে, উক্ত অসিয়তনামার অন্তুর্ভুক্ত প্রতিটি কথাকেই নির্দ্বিধায় ভুল বা ভিত্তিহীন বলে দিবেন; বরং করণীয় হল, যা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি, এ বিষয়ে আহলে ইলমকে জিজ্ঞাসা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

আপাতত এ কয়েকটি কথা পেশ করেই আলোচনা সমাপ্ত করছি। আল্লাহ তাআলা কবুল করুন এবং মাকবুলিয়ত দান করুন।

৯-৯-১৪২৯ হিজরী

১০-৯-২০০৮ ঈসায়ী

অনুবাদে : মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

 

 

 

advertisement