যিলকদ ১৪২৯   ||   নভেম্বর ২০০৮

ইবাদত ও শিআরের ভাষান্তরের পরিবর্তে সবার হওয়া চাই আরবীর ছাত্র : কিছুটা আরব

দ্বীনের শিআর বা অপরিহার্য যেসব বৈশিষ্ট্য, আমল কিংবা ইবাদতের প্রচলন আরবী ভাষায়  দান করা হয়েছে অনারব ভাষায় সেগুলোর রূপান্তরের প্রয়াস ও প্রস্তাবকে দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা ও মুহাববতের প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। এটি বোধহীন একটি হঠকারী চিন্তা ও প্রয়াস। যেসব কথিত চিন্তাবিদ ব্যক্তিরা বুঝে কিংবা না বুঝে এধরনের চিন্তা লালন ও প্রকাশ করেন তারা মূলত ইসলামের মূল উৎস থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যেই এসব করে থাকেন। অন্তঃসারশূন্য এসব চিন্তার বুদবুদ দেখে কারো মুগ্ধ হওয়ার অবকাশ নেই।

বোঝা, জানা এবং মানার বিষয় এটি যে, জানা-অজানা অসংখ্য হেকমতের ভিত্তিতে আল্লাহ তাআলা আরবীকে ইসলাম এবং ঈমানের ভাষা বানিয়েছেন। আরবী ভাষাকে কেন দ্বীন ও ঈমানের বাহন বানানো হল, অন্য কোনো ভাষাকে কেন বানানো হল না-এ প্রশ্ন এ পর্যায়ে একটি নিরর্থক প্রশ্ন। দেখা যাচ্ছে, হেদায়েতের আখেরী আসমানী কিতাব (কুরআন শরীফ) নাযিল করা হয়েছে যেমন আরবী ভাষায়, তেমনি তার আমলী শরাহ বা প্রায়োগিক ব্যাখ্যা-সুন্নাহও আরবী ভাষায় অভিব্যক্ত। দ্বীনের মৌলিক সব উৎসও আরবী ভাষায় লিপিবদ্ধ। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের ভাষা আরবী। পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা বা তাফসীরের মৌলিক গ্রন্থসমূহের ভাষা আরবী, হাদীসের জগদ্বিখ্যাত ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ-গুলোও লিখিত হয়েছে আরবী ভাষায়। সীরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আকরগ্রন্থগুলোও আরবীতে লেখা। আছারে সাহাবা, (সাহাবা বাণী), ইলমে ফিকহ ও ইসলামী ইতিহাসের অনুসরণযোগ্য গ্রন্থ থেকে নিয়ে এতদসংশ্লিষ্ট প্রায় সব উপাদান ও পঠন-সামগ্রির ভাষাই আরবী।

সুতরাং আরবী ভাষার সাহায্য থেকে সরে আসা কিংবা সবকিছুতে তার অনারব ভাষায় (হোক সেটা বাংলা কিংবা অন্য কোনো  ভাষা) রূপান্তরের চিন্তা করা একটি অজ্ঞতাপ্রসূত চিন্তা ও ধারণা।

ইসলামের সঙ্গে মুসলমানদের নিত্যদিনের যে সম্পর্ক, যে করণীয় ইবাদতগুলোর সঙ্গে মুসলমানদের জীবন আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িত সেসবের ভাষাও আরবী। মূলত আল্লাহ রাববুল আলামীন আর তাঁর বান্দার মাঝের সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বহিঃপ্রকাশ-ইবাদত, সে ইবাদতের ভাষাও আল্লাহ তাআলা রেখেছেন আরবী। মুসলমান তার ইসলামে বিশ্বাসের ঘোষণা দেয় কালিমার মাধ্যমে। সে কালিমার ভাষা আরবী, মুসলিম নব জাতকের জন্মের সময় আযান এবং মৃত মুসলমানের কাফন-দাফনের সময় পঠিতব্য দুআর ভাষাও আরবী। পবিত্র কুরআনের তেলাওয়াত করতে চাইলে আরবীতেই তা করতে হবে। নামায ও হজ্বে পঠিত তেলাওয়াত-দুআ থেকে নিয়ে সাধারণ যিকির-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, দুআ-দরূদ ও খুৎবা সবকিছুর ভাষাই রাখা হয়েছে আরবী করে। এক নজরে এসবের প্রতিটি বিষয়ের দিকে লক্ষ করলে সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব যে, ইসলামে আরবী শেখার গুরুত্ব অপরিসীম। আরবী শেখা দরকার সব মুসলিমের। ভাষান্তরের চিন্তা, বাংলায় রূপান্তরের প্রয়াস এর সবগুলোর ক্ষেত্রে সম্ভবও নয়, অনুমোদনও নেই, অতীতেও এরকম অনুশীলনের কোনো নজির নেই।

 

তারপরও দেখা যায়, এদেশের একশ্রেণীর কথিত বুদ্ধিজীবী কিংবা অতিচিন্তাশীল মানুষ ইবাদত ও শিআরসমূহে ব্যবহৃত প্রত্যেক স্থানের আরবী পাঠের বাংলা ভাষান্তরের সক্রিয় প্রস্তাব ও ভাবনা-চিন্তা পেশ করে থাকেন। তাদের বক্তব্যে তারা বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, এদেশের সর্বশ্রেণীর মানুষ আরবী পড়তেও পারে না, অনেকে বুঝেও না, তাই এ বিষয়গুলোতে মাতৃভাষায় চর্চার ধারা চালু করা হলে সবারই আবেগ ও উপলব্ধি সজাগ হতো এবং প্রতিটি ইবাদতের মর্ম অনুধাবন করা সবার পক্ষে সহজ হতো। কিন্তু তারা মর্ম উপলব্ধির এ প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে গিয়ে কখনও বলেন না যে, সবারই আরবী ভাষা কিছু পরিমাণ শেখা দরকার।

আরবী থেকে সরে এসে মাতৃভাষায় চর্চা করলেই যে সর্বস্তরের সবাই সব শব্দ ও বাক্যের মর্ম অনুধাবন করে ফেলবে এই যুক্তিই বা কতোটা সঠিক? বাংলা ভাষায় ক্লাসিক কিংবা আধুনিক গদ্য-পদ্যের সমঝদার পাঠক হওয়ার যোগ্যতা এ সমাজের কজন শিক্ষিত মানুষের রয়েছে? বঙ্কিমের গদ্য কিংবা রবি ঠাকুর ও  নজরুলের কাব্য খুব সহজেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন-এ সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর মাঝে কি এরকম ১০% লোক আছেন? তাই মাতৃভাষায় ইবাদত কিংবা ইবাদতের বাক্যাবলি রূপান্তরিত হলেই সবার বোধগম্য হয়ে যাবে-এ যুক্তি যেমন খোঁড়া, তেমনি এ যুক্তিও একদম অপ্রয়োজনীয় যে, ইবাদতের সব আরবী বাক্য বোধগম্য হতেই হবে। এজন্যই মাতৃভাষায় কিংবা যে কোনো অনারব ভাষায় ইবাদত ও ইবাদতে পঠিত বাক্যাবলির ভাষান্তরের পক্ষে যারা সরগরম, তাদের অন্তরে দ্বীনের প্রতি ভালবাসা ও মুহাববতের বিষয়টি নিয়ে সংশয় বিদ্যমান। তারা বুঝেই এ খাতে মনোযোগ দিয়ে থাকুন কিংবা না বুঝে-তাদের প্রস্তাবিত এসব চিন্তা বাস্তবতার মুখ দেখলে শেষ পর্যন্ত মুসলমানদেরকে তাদের দ্বীনের  উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন করার কাজটিই সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন হবে, অন্য কিছু নয়। নির্দ্বিধায় বলা যায়, এটা তাদের একটি উল্টামুখী চিন্তা।

তাদের এই উল্টামুখী চিন্তা কেবল এতটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা দ্বীন ও ইবাদতের নানা অংশে রূপান্তর বা আধুনিকতার হরেক রকম চিন্তার ফানুস উড়িয়ে যেতে পছন্দ করেন। তাদের মাঝেই মর্ম অনুধাবন প্রীতি, বাংলা প্রীতির এত কষ্ট কসরত ইবাদতের ক্ষেত্রে দেখা গেলেও প্রযুক্তি, ব্যবসা, যোগাযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা বাংলা নির্ভরতা ত্যাগ করে ব্যাপকভাবে ইংরেজী চর্চার প্রতি উৎসাহিত করে থাকেন। বলেন না যে, এসব ক্ষেত্রেও ভাষান্তরের আশ্রয় নিয়ে সবকিছু আমরা বাংলাতেই করব; বরং উল্টো করে বলেন, ইংরেজী না শিখলে এ অঙ্গণগুলো থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। এক্ষেত্রে তাদের এই চিন্তা  ও বোধকে আমরা অপ্রাসঙ্গিক মনে করি না। বৈধ জাগতিক প্রয়োজনে বৈধ উপায় অবলম্বনে কোনো নিষেধাজ্ঞা ইসলাম আরোপ করে না। জাগতিক ক্ষেত্রের প্রয়োজনটা এত তীব্রভাবে অনুধাবন করতে পারলেও মুসলমানদের জীবনের মূল লক্ষ্য ও টার্গেট : আখেরাতের উপযোগী শ্রম-সাধনার জন্য আরবী শেখাটাকে তারা গুরুত্বের মধ্যেই আনতে চান না। তাদের অনীহাই সেখানে প্রধান হয়ে ওঠে। মূলত এটা অনুধাবন ও দৃষ্টিভঙ্গিগত আকাশ-পাতাল পার্থক্যেরই ফল। মুসলমানদেরকেও যদি ইহকালীনতা সর্বস্ব প্রাণী মনে করা হয় তাহলে চিন্তার ধারা এরকমই হতে পারে। হচ্ছেও তাই। কিন্তু এ চিন্তাকে সঠিক বলার কি উপায় আছে?

একটি দীর্ঘ ও সবিস্তার আলোচনার ছায়াস্বরূপ উপস্থাপিত এ সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে এ প্রসঙ্গে শেষ যে কথাটি আরয করা দরকার, সেটি হচ্ছে, আরবীতে ইসলামের অনেক মৌলিক বিষয়ের নাম, শব্দ ও মর্ম উল্লেখ আছে। শাব্দিক তরজমা কিংবা ভাষান্তরের কোনো পর্যায়েই যার মর্ম উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। এজন্য আরবী শেখা যেমন দরকার, তেমনি সেসব শব্দ বা বিষয়ের মূল মর্ম অনুধাবনের জন্য আলেম-ওলামার সান্নিধ্য কিংবা ইলমী পরিবেশের আবহে যাতায়াত দরকার। সবকিছুই তো তরজমাযোগ্য নয়। এজন্য এসবের তরজমা কেন আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না কষ্ট-মেহনতহীন আরাম কেদারায় বসে এ ধরনের অনুযোগ প্রকাশ মূলত নিজেদের দায় ও দোষ অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার একটি ফাঁকিবাজিমূলক প্রয়াস। এ থেকে আমাদের প্রয়োজনেই আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত।

দ্বীনের শিআর ও ইবাদতসমূহের ভাষান্তর-চিন্তা ত্যাগ করে আমাদের হওয়া উচিত আরবীর ছাত্র, কিছুটা আরব। দ্বীন ও ইবাদতের প্রাণে প্রবেশ করতে চাইলে এর কোনো বিকল্প নেই।

 

[মাওলানা মুহাম্মাদ আবুদল মালেক ছাহেবের নির্দেশনা ও পরামর্শে আলকাউসার ডেস্ক কর্তৃক প্রস্ত্তত]

 

 

 

advertisement