যিলহজ্ব ১৪২৯   ||   ডিসেম্বর ২০০৮

উ ম্মা হ : ওয়াজিরিস্তান হয়ে যাচ্ছে কি গোটা দুনিয়া?

খসরূ খান

উত্তর-পশ্চিম ওয়াজিরিস্তানের ওপর হুকুমত চলছে কার, পাকিস্তান সরকারের, নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের-এ প্রশ্নটি এখন জ্বলন্ত হয়ে ওঠেছে। কারণ, গত আগস্ট মাস থেকে নভেম্বরের শেষ নাগাদ সেখানে চালকবিহীন মার্কিন বিমান থেকে প্রায় ২০ বার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো

হয়েছে। সে হামলায় শহীদ হয়েছেন শতাধিক ধর্মপ্রাণ মানুষ, নারী-শিশু ও বৃদ্ধ। আহত হয়েছেন কয়েকশ মুসলিম। আর ধ্বংস হয়েছে বহু

মসজিদ-মাদরাসা, এতিমখানা ও নিরীহ গ্রামবাসীর বাড়িঘর। প্রায় তিন মাস জুড়ে চলতে থাকা এই অমানবিক বর্বরোচিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকারের প্রধান দু-একজন এবং পাক আর্মি প্রধান এ বিষয়ে টুকটাক কিছু মৌখিক প্রতিবাদ করলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি। হয়তো নিতে সাহসই পাননি।

আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে পানামার প্রেসিডেন্ট নরিয়েগাকে ধরে এনে আমেরিকার জেলে বন্দী করে রাখার ঘটনাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসভ্য ও বর্বর ক্ষমতাচর্চার ইদানিংকার একটি বড় ঘটনা মনে হয়েছিল। এরপর সেনাবাহিনী নামিয়ে দেশ দখল করে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দামকে ধরে লোক দেখানো একটি বিচারের মহড়া দিয়ে ইরাকেরই বুকে ফাঁসি দিয়ে আমেরিকা অতি সাম্প্রতিক বর্বরতা ও সীমালঙ্ঘনের চূড়ান্ত নজির স্থাপন  করেছে। আফগানিস্তান নামের গোটা দেশটাই তারা দখল করে নিল নিছক গোলাবারুদ আর অস্ত্রের জোরে। তাদের দমাতে তখন কোনো দেশ এগিয়ে তো এলই না, উল্টো তাদের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে মদদগারের ভূমিকা গ্রহণ করল অনেকেই। মোশাররফ শাসিত পাকিস্তান ছিল সেসব দেশের অন্যতম। কিন্তু এখন সেই পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের উপরই  পড়েছে শকুনের থাবা। গোটা দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন, বিরোধী রাজনীতিকরা এ ধরনের হামলা মোকাবেলা করতে সরকারকে আহবান জানাচ্ছেন। কিন্তু সাদ্দাম আর নরিয়েগার পরিণতির দুর্ভাবনা সে দেশের সরকারকে হয়তো সাহসী করে তুলতে পারছে না। দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে দেশ ও জাতিরই সবচেয়ে বড় শক্তিগুলো। দখলদার-হানাদারদের গুলি করে মারার পরিবর্তে হানাদারদের নীরব ভাষায় স্বাগত জানিয়ে দেশের মানুষকে মারানো হচ্ছে আজকের   পাকিস্তানে। অভিযোগ রয়েছে যে, ওই অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের বসবাস। কিন্তু এ অভিযোগে বহিরাগত হত্যাকারী অভিভাবককে  জায়গা করে দেওয়ার মানে কী? ৯/১১ এর পর মুসলিম দেশগুলোর ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতাচর্চার এ এক বেদনাদায়ক নতুন মানচিত্র।

এ অবস্থাটি থেকে আমাদের দেশের ভিন্নতা কতটুকু? এখানে এখনও মার্কিন ছত্রীবাহিনী নেমে আসেনি-ব্যাস এতটুকুই। বাস্তবতা এ রকম যে, এ ধরনের ঝুঁকির মধ্যে এ দেশের

নাগরিকরাও এখন বসবাস করছেন। ইসলামের চর্চা যিনি যেভাবেই করুন, বিশ্ব মোড়লশক্তির তাতে সায় ও সম্মতি না থাকলে, সেই ইসলাম-অনুশীলনকে নিজেদের জন্য তারা ঝুঁকি মনে করলে যখন-তখন এদেশের বুকেও তাদের সন্ত্রাস বিরোধী তৎপরতা শুরু করে দিতে পারে তারা। এ এক ভয়াবহ অবস্থা। আমাদের নির্বাচিত-অনির্বাচিত দেশ-মুরবিবরা যদি এ অবস্থার ভয়াবহতা সম্পর্কে ভাবনা না রাখেন, দূরদর্শী চিন্তা না করেন তাহলে যে কোনো সময় ওয়াজিরিস্তানের দুর্ভোগ ও দুর্ভাগ্যের ছায়া এদেশেও নেমে আসতে পারে। সে রকম হলে ক্ষতিটা কার হবে? কেবল কিছু মৌলবাদীর আর সন্ত্রাসীর? নাকি গোটা দেশের সব নাগরিকের জীবনেই ওয়াজিরিস্তানের হতভাগা মানুষদের দুঃখ ও আতংক নেমে আসবে!

আমেরিকার সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ সম্পর্কে আমেরিকান প্রশাসন ও মিডিয়ার ভাষ্য থেকে আমরা জেনেছি। কিন্তু     বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এ যুদ্ধ দেশে দেশে মুসলমান বিরোধী যুদ্ধের একটি রূপ ধারণ করেছে। অজুহাত সন্ত্রাসের, কিন্তু ধ্বংস করা হচ্ছে মসজিদ। হামলা করা হয় সন্ত্রাসীকে টার্গেটের কথা বলে, কিন্তু শহীদ হন নারী-শিশু-বৃদ্ধ। এই বর্বরতার বিরুদ্ধে দেশে দেশে মুসলিম শাসকশ্রেণী সচেতন না হলে অচিরেই একদিন হয়তো মুসলমানদের জগতটাকেই মোড়ল শক্তির হরেক রকম অস্ত্রের নির্বিকার, নির্বিবেক পরীক্ষাক্ষেত্রে

পরিণত করা হতে পারে। তবে এতসব আশংকার পরও সব হিসাব-নিকাশের উর্ধ্বে কুদরতের যে অসীম ক্ষমতা ও কৌশল বিদ্যমান, সে দিকে চোখ রেখে এক শান্তিময়, আদর্শদীপ্ত জীবনের পথ ধরে চলা ছাড়া উম্মাহর সামনে কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প থাকার প্রয়োজনও নেই। কারণ, দুনিয়ার বাহ্যিক সব শয়তানী আয়োজনের বিশালত্ব আল্লাহ তাআলার শক্তির সামনে ধুলাতুল্যও তো নয়। আল্লাহ তাআলার দাসত্বের জীবনে শান্তি ও সত্যের পথে উম্মাহকে চলতে হবে নিজেদেরই আদর্শিক ও নৈতিক গরজে। #

 

 

advertisement