রবিউল আউয়াল ১৪৩১   ||   মার্চ ২০১০

সম্ভাবনা ও ফলাফল

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

যারা সময়ের অপচয় করেননি; বরং সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন তারা জীবনে সফল হয়েছেন। খুব সহজ-সুন্দর কথা। কিন্তু আমল করা কঠিন। আমরা মনে করি, যে যেই কাজে আছি তা না করতে পারলে সময়ের অপচয় হল। আর তা করতে পারলে সময় কাজে লাগল। যেমন আমি লেখালেখির কাজে আছি। আমার যদি লেখা চলতে থাকে, বই বের হতে থাকে, আমি ভাবি, সময় কাজে লাগছে। আরেকজন ব্যবসা করছে, তার ব্যবসায় যদি লাভ হতে থাকে তাহলে সে ভাবে, সময় কাজে লাগছে। আর ব্যবসা না চললে মনে করে যে, সময় কাজে লাগছে না। এটা একটা মোটা দাগের হিসাব। কিন্তু আসল কথা হল, আমি যে কাজ করছি তা যদি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য করতে পারি তাহলে সময়টা কাজে লাগল। পক্ষান্তরে কাজের খুব রওনক হল, চারদিকে সুনাম হল, কিন্তুআল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়ত ছিল না তাহলে সময়টা কাজে লাগেনি; বরং নষ্ট হল। আরেকটি কথা হল, যার যে পরিমাণ কাজ করার যোগ্যতা ছিল সে পরিমাণ কাজ না করলে বলতে হবে, সে জীবনকে ঠিকমতো কাজে লাগায়নি। মনে করুন, আমি কাজ করেছি এক মণ, কিন্তুআমার সামর্থ্য ছিল দশ মণ, তাহলে আমি সময়কে কাজে লাগাইনি। অন্যজনের সামর্থ্য ছিল এক মণ, সে কাজও করেছে এক মণ, সে আমার চেয়ে অনেক বেশি সফল। সে সময়কে ঠিকমতো কাজে লাগিয়েছে। আর আমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে সময়ের অপচয় করেছি। সময়ের সদ্ব্যবহার করলে আরো নয় মণ কাজ করতে পারতাম। সুতরাং আমার জীবনটা ব্যর্থ। আমরা এ হিসাবটা করি না। সম্ভাবনার দিকে না তাকিয়ে আমরা শুধু কাজের দিকে তাকাই, আর খুশি হয়ে যাই। অথচ দেখা যায় যে, আমার কাজ এবং আমার একজন তালেবুল ইলমের কাজ সমান। আমি নিজেও জীবনের অনেক অপচয় করেছি। সময়কে ঠিকমতো কাজে লাগাইনি। সম্ভাবনার তুলনায় কাজ কিছুই হয়নি। এখন শুধু আফসোস করি! আমার বড় আফসোস হয় যখন দেখি যে, আমার তালিবুল ইলমরা সামান্যতেই খুশি হয়ে যায়। অথচ তারা দুনিয়ার বিষয়ে সামান্যতে খুশি হয় না। দুনিয়ার বিষয়ে আমরা সব সময় উপরের দিকে তাকাই এবং ঈর্ষা করি। আফসোস করি। অথচ দ্বীনের বিষয়ে অল্পতে খুশি হয়ে যাই। আসলে করণীয় হল, সামান্যতে খুশি না হয়ে সময় ও সম্ভাবনাকে যথাযথ কাজে লাগানো। শয়তানের হাতিয়ার নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে কখনো সংক্ষিপ্ত ধারণা করো না। ভেবো না যে, আমার যোগ্যতা আর কতটুকু, যতটুকু কাজ হয়েছে অনেক হয়েছে। এটা হচ্ছে শয়তানের নূরানী হাতিয়ার। তাই নিজের যোগ্যতার বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে এবং সম্ভাবনার প্রতি লক্ষ রেখে ফলাফলের বিচার করতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে যে, আত্মতুষ্টি শয়তানের বিরাট অস্ত্র। আমি প্রায়ই বলে থাকি যে, তুমি এভারেষ্টের চূড়ায় উঠতে পারতে, কিন্তু ময়নামতির চূড়ায় উঠেই আত্মতৃপ্তি লাভ করছ এবং ভাবছ, বিরাট কিছু হয়ে গিয়েছ। আল্লাহ তাআলা যাদেরকে এই অনুভূতি দেননি তারা তো খুশি হতে পারে, শান্তিতে থাকতে পারে, কিন্তু আমি এই সম্ভাবনাগুলোর এমন নির্দয় অপচয় হতে দেখে কীভাবে খুশি হতে পারি! আমার অনেক তালিবুল ইলম তো শুধু ইমামতি পেয়েই খুশি! অথচ তাদের মাঝে কাজ করার অনেক যোগ্যতা ছিল। নিজের সম্পর্কে এই অজ্ঞতা নিয়ামত, না গযব আমি জানি না। তবে তাদের তৃপ্তি দেখে আমার গিবতা হয়। আমি সবাইকে শুধু একথাটা বুঝাতে চেষ্টা করছি যে, কেউ নিজের বিষয়ে তৃপ্ত থেকো না; বরং নিজের সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা কর। চিন্তার সূত্র চিন্তা করার একটি দিক এই যে, তুমি যাদের কাছে পড়েছ, যাদের সোহবত পেয়েছ তাদের সোহবতের ও তাদের কাছে পড়ার যে ফলাফল তোমার ইলমী ও আমলী যিন্দেগীতে হওয়ার কথা ছিল তা হয়েছে কি না? তুমি যে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছ সে অনুযায়ী কাজ হয়েছে কি না। নাকি তোমার এবং যারা এমন সুযোগ-সুবিধা পায়নি তাদের কাজ সমান! এভাবে চিন্তা করলে আত্মতৃপ্তি দূর হয়ে যাবে। আর আত্মতৃপ্তি দূর হলে সামনের সময়টা কাজে লাগানোর সুযোগ হতে পারে। অন্যথায় অলসতা চলতেই থাকবে। সাথে সাথে পিছনের ব্যর্থতাগুলোও স্মরণ করবে। এতে সামনের সময়টা কাজে লাগানোর প্রেরণা জাগ্রত হতে পারে। অন্যথায় আত্মতৃপ্ত অবস্থায় বাকি যিন্দেগীও কেটে যাবে। তো আমরা নিজেদের জীবনের অপচয়ের কথা চিন্তা করব এবং যে সম্ভাবনা ছিল তা কতটুকু কাজে লাগিয়েছি তা ভাবব। তাহলে ইনশাআল্লাহ সামনের সময়গুলোর হিফাযত করার আগ্রহ সৃষ্টি হবে। আমার কলমে যে পরিমাণ লেখা এসেছে তার দ্বিগুণ লেখা আসার যদি সম্ভাবনা থাকে তাহলে আমি খুশি হই কীভাবে! আমার বহু তালিবুল ইলম নিজেদের প্রতি খুব খুশি এবং অন্যরাও তাদের প্রতি খুশি। অথচ আমি তাদেরকে দেখে শুধু আফসোস করি। অন্যরা খুশি হতে পারে, কিন্তু নিজে কীভাবে খুশি হই। নিজের সম্ভাবনা একটু তলিয়ে দেখি। আসলে আমরা গাফলতের মধ্যে আছি। গাফলত দূর করার চেষ্টা করি এবং অন্যের প্রশংসা দ্বারা বিভ্রান্ত না হই। মানুষতো প্রশংসা করবে এবং করা উচিত। কিন্তু আমাদের কর্তব্য হল প্রশংসা দ্বারা বিভ্রান্ত না হওয়া। যতটুকু আল্লাহ দান করেছেন তার জন্য শোকর করা। আর যা নিজে অপচয় করেছি তার জন্য আফসোস করা এবং ইস্তিগফার করা। আল্লাহর কাছে দুআ করা, হে আল্লাহ! সামনের যিন্দেগীটা ঠিকমতো কাজে লাগানোর এবং পিছনের সকল ক্ষতি পূরণ করার তাওফীক দান কর। সময়ের হিসাব আমরা সময় হিসাব করে ব্যয় করি না। তিন বেলা খেতেই অনেক সময় নষ্ট করে ফেলি। অথচ আমাদের পূর্ববর্তীরা রুটি খাবেন না ছাতু খাবেন সে হিসাব করতেন। গতকাল এ যামানার একজন কলেজছাত্রীর বিস্ময়কর ঘটনা শুনলাম। সেও নাকি সময় বাঁচানোর জন্য রুটি না খেয়ে ছাতু পান করে নাস্তা করে। আমি দেখি, এ যামানার লোকেরা দুনিয়ার লেখাপড়ার জন্য আমাদের চেয়ে অনেক বেশি মেহনত করে। এই মাদরাসাতুল মদীনায় ঐ কলেজ ছাত্রীর মতো মানসিকতার একজন ছাত্রও কি পাওয়া যাবে? ছাত্রদের মধ্যে কেন, আমি নিজেও তো এমন নই। মোটকথা, সময়কে হিসাব করে ব্যয় করা দরকার। শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ.-এর দ্বারা উম্মত অনেক ফায়দা পেয়েছে। দুই দিক থেকে : সরাসরি তার কাছ থেকে এবং তার তারবিয়তকৃত লোকদের কাছ থেকে। তিনি তার আত্মজীবনীতে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি এক রাতে কাব্য-প্রতিযোগিতায় মগ্ন ছিলেন এবং অজান্তে এভাবেই রাত শেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন যে, আমি ঐ রাতটার জন্য সারা জীবন আফসোস করি। সময় কীভাবে অপচয় হয় তা আমি ঐ রাতে বুঝতে পেরেছি। অথচ তা ছিল একটা ইলমী মজলিস। তিনি বলেন, আমি ঐ রাতটাকে কাব্য-প্রতিযোগিতার চেয়ে শতগুণ ভালো কাজে ব্যয় করতে পারতাম। অর্থাৎ সেই একই কথা-সম্ভাবনা ও ফলাফল। আমরা অনেক সময় সাধারণ ভালো কাজে লিপ্ত থেকে খুশি হয়ে যাই। অথচ এর চেয়ে অনেক ভালো কাজে যে মশগুল থাকতে পারতাম সেটা ভাবি না। এভাবে আমাদের প্রচুর সময় অপচয় হয়ে যায়। এটা আবার একা একা বোঝা যায় না। এটা বুঝতে হলে ঐ কাফেলার এবং ঐ পথের যারা অভিজ্ঞ পথিক তাদের জিজ্ঞেস করতে হয়। আরেকটা কথা হল, যিকির, তেলাওয়াত, ইস্তিগফার, রোগীর সেবা, ঘরের কাজে স্ত্রীকে সহযোগিতা করা ইত্যাদি জরুরি কাজ। এগুলোতে সময় ব্যয় করা সময়ের অপচয় নয়। এ সময়গুলোকে অপচয় বলা মানে আল্লাহর গায়রাতকে ডাক দেওয়া। অথচ আমরা বেখেয়ালে বলে ফেলি যে, লেখছিলাম হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। আর সময়টা নষ্ট হয়ে গেল। অথচ আমি তখন যিকির ও ইস্তিগফার করেছি। তো আমরা যেন এ সময়গুলো অপচয় মনে না করি।

 

advertisement