মুহাররম ১৪৩০   ||   জানুয়ারী ২০০৯

সুন্নাহসম্মত নামায : কিছু মৌলিক কথা

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

নামায ঈমানের মানদন্ড। ইসলামের স্তম্ভ ও নিদর্শন। আর কালেমার পরে মুসলমানের সবচেয়ে বড় পরিচয়। খুশু-খুযুর সঙ্গে সঠিক পদ্ধতিতে নামায আদায় করা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য।

নামাযের বিধান যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে এসেছে তদ্রূপ তার নিয়ম-পদ্ধতিও তিনিই উম্মতকে শিখিয়েছেন। দ্বীন ও শরীয়তের ইলম অর্জনের তিনিই একমাত্র সূত্র।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নামাযের পদ্ধতি সর্বপ্রথম শিখেছেন সাহাবায়ে কেরাম। নবীজী তাদেরকে মৌখিকভাবেও শিখিয়েছেন এবং নিয়মিত তাদেরকে নিয়ে নামায আদায় করেছেন। তাঁর ইরশাদ-

صلوا كما رأيتموني أصلي

 তোমরা সেভাবেই নামায আদায় কর যেভাবে আমাকে আদায় করতে দেখ।

এরপর সাহাবায়ে কেরাম থেকে তাবেয়ীন, তাবেয়ীন থেকে তাবে তাবেয়ীন, এভাবে প্রত্যেক উত্তর প্রজন্ম  পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা চলমান থাকবে ইনশাআল্লাহ।

দুই.

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনেক সাহাবী তাঁর সঙ্গে মদীনাতেই অবস্থান করতেন। কিছু  সাহাবী ছিলেন, যারা নিজ অঞ্চলে ইসলাম গ্রহণের পর এক দুই বার মদীনায় নবীজীর সাহচর্যে এসেছেন এবং কিছুদিন অবস্থান করে নিজ এলাকায় ফিরে গিয়েছেন। বলাবাহুল্য যে, এই আগন্তুক সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমল অধিক সময় প্রত্যক্ষ করার এবং সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাননি এবং তারা দ্বীনের বহু বিষয়ের; বরং অধিকাংশ বিষয়ের জ্ঞান সরাসরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে লাভ করেননি। এদিকে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় শরীয়তের বিধি-বিধান মানসূখ বা রহিত হওয়ার ধারাও চলমান ছিল। এজন্য এটা খুবই স্বাভাবিক যে, এই সাহাবীরা কোনো বিধান বা পদ্ধতি প্রত্যক্ষ করেছেন, পরে তা মানসূখ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তাদের পক্ষে সেটা জানার সুযোগ হয়নি। অথচ মদীনার সাহাবীরা খুব সহজেই সে সম্পর্কে অবগত হয়ে যেতেন।

মদীনার সাহাবীরাও সবাই নবীজীর সমান সাহচর্য পেয়েছেন-এমন নয়। কিছু   সাহাবী সার্বক্ষণিক সাহচর্য লাভ করেছেন। তাঁরা খুব কমই অনুপস্থিত থাকতেন। এঁদের মধ্যে প্রবীণ সাহাবীগণ যাদেরকে সাবিকীনে আওয়ালীন ও বদরী মুজাহিদীনের মধ্যে গণ্য করা হয় তাঁরা ছিলেন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সবিশেষ আস্থার পাত্র। সাধারণত তাঁরাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিছনে প্রথম কাতারে নামায আদায় করতেন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ ছিল-

ليلني منكم أولوا الأحلام والنهى

তোমাদের মধ্যে যারা বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার অধিকারী তারা আমার নিকটে দাঁড়াবে। এ নির্দেশ অনুযায়ী এঁরা নামাযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে দাঁড়াতেন।

বলাবাহুল্য যে, এই সাহাবীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামায ও তার দিনরাতের আমল প্রত্যক্ষ করার যতটা সুযোগ পেয়েছেন তা অন্যরা পাননি। আর তাঁরা যেমন সূক্ষ্ম ও গভীরভাবে বিষয়গুলো অনুধাবন করতে সক্ষম হতেন অন্যদের জন্য তা এত সহজ ছিল না।

এই বিশিষ্ট সাহাবীদের মধ্যে খোলাফায়ে রাশেদীন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও আরো অনেকে শামিল ছিলেন। এখানে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি সফরে-হযরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খাদেম ছিলেন। হাদীস ও তারীখে তাঁর উপাধী ছাহিবুল নালাইন ওয়াল বিসাদ ওয়াল মিতহারা অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পাদুকা, তাকিয়া ও অযুর পাত্র-বহনকারী। (সহীহ বুখারী হাদীস ৩৯৬১)

হযরত আবু মূসা আশআরী রা. বলেন, আমরা অনেক দিন পর্যন্ত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও তার মাতাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আহলে বাইত (পরিবারের সদস্য) মনে করতাম। কেননা নবীজীর গৃহে তাদের আসা-যাওয়া ছিল খুব বেশি। (সহীহ বুখারী হাদীস ৩৭৬৯, ৪৩৮৪)

তিন.

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের পর যখন ইসলামী খেলাফতের পরিধি বিস্তৃত হতে লাগল এবং নতুন নতুন অঞ্চল বিজিত হল তখন সাহাবায়ে কেরাম দ্বীন ও ঈমানের তালীমের জন্য দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়লেন। খলীফায়ে রাশেদ হযরত উমর ফারূক রা. বড় বড় সাহাবীকে সাধারণত মদীনার বাইরে যেতে দিতেন না। তবে কাদেসিয়্যা (ইরাক) জয়ের পর যখন কুফা নগরীর গোড়াপত্তন হল তখন সে অঞ্চলে দ্বীন ও শরীয়ত এবং কুরআন ও সুন্নাহর তালীমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.কে পাঠালেন। তিনি কূফাবাসীকে পত্র লিখলেন যে, আমি আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে (রা.) তোমাদের আমীর হিসেবে এবং আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে (রা.) উযীর ও মুয়াল্লিম হিসেবে প্রেরণ করছি। এঁরা দুজনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মনীষী সাহাবীদের অন্যতম এবং বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী। তোমরা তাদের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং তাদের অনুসরণ করবে। মনে রাখবে, আবদুল্লাহকে আমার নিজের প্রয়োজন ছিল কিন্তু আমি তোমাদের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়েছি এবং তোমাদের জন্য তাকে পছন্দ করেছি। (আততবাকাতুল কুবরা, ইবনে সাদ, ৬/৩৬৮; সিয়ারু আলামিন নুবালা ১/৪৮৬)

এই দুই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কুফাতেই আরো পনেরো শ সাহাবী অবস্থান করছিলেন। যাঁদের মধ্যে সত্তর জন ছিলেন বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী। সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা., সায়ীদ ইবনে যায়েদ রা., হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান রা., সালমান ফারেসী রা., আবু মূসা আশআরী রা., প্রমুখ বিখ্যাত সাহাবী সবাই কূফাতেই ছিলেন। হাদীস ও তারীখের ইমাম আবুল হাসান ইজলী রাহ. তারীখ গ্রন্থে লিখেছেন যে, কুফাতে দেড় হাজার সাহাবী এসে বসতি স্থাপন করেন। (ফতহুল কাদীর ইবনুল হুমাম, খন্ড ১, পৃ. ৯১)

খলীফায়ে রাশেদ হযরত আলী ইবনে আবী তালেব রা. তো একে তাঁর দারুল খিলাফা বানিয়েছিলেন।

কূফায় অবস্থানকারী সাহাবীদের নিকট থেকে কূফার অধিবাসীরা দ্বীন ও ঈমান গ্রহণ করেছেন। কুরআন ও হাদীসের ইলম অর্জন করেছেন। নামায, রোযা, হজ্ব-যাকাত ইত্যাদি সকল ইবাদতের নিয়ম-কানূন শিক্ষা লাভ করেছেন। কূফার অধিবাসীরা হজ্ব-ওমরা ও যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মক্কা-মদীনায় যেতেন এবং সেখানকার সাহাবীদের নিকট থেকেও ইলম অর্জন করতেন। লক্ষ করার বিষয় এই যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ও অন্যান্য সাহাবী যেভাবে কূফাবাসীকে নামায পড়তে শিখিয়েছেন তাঁরা মক্কা-মদীনায় গিয়েও সেভাবেই নামায পড়তেন, কিন্তু খলীফা হযরত উমর ফারুক রা. থেকে নিয়ে হারামাইনের কোনো সাহাবী বা কোনো তাবেয়ী তাদের নামাযকে খেলাফে সুন্নত বলেছেন-এমন একটি দৃষ্টান্তও ইতিহাস থেকে দেখানো যাবে না।

এই কূফানগরীতে ইমাম আবু হানীফা রাহ. জন্ম গ্রহণ করেন ৮০ হিজরীতে এবং সেখানেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হন। সে সময় ইসলামী বিশ্বে অনেক সাহাবী জীবিত ছিলেন। কূফাতেও কয়েকজন সাহাবী ছিলেন। আর এটা প্রমাণিত  যে, ইমাম ছাহেব একাধিক সাহাবীর সাক্ষাত এবং তাদের থেকে রেওয়ায়েতের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। এজন্য ইমাম ছাহেব তাবেয়ীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়া একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। এমন অনেক মনীষী এর স্বীকৃতি দিয়েছেন যাদের ফিকহী মাসলাক হানাফী নয়। কয়েক বছর আগে ড. মুহাম্মাদ আবদুশ শহীদ নুমানী দামাত বারাকাতুহুম (প্রফেসর শোবায়ে আরবী, করাচি ইউনিভার্সিটি) রচিত ইমাম আবু হানীফা কী তাবেঈয়্যত আওর সাহাবা ছে উনকী রেওয়ায়াত মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ইমাম ছাহেব বিপুল সংখ্যক তাবেয়ী মনীষীর সাহচর্য পেয়েছিলেন যাঁরা অসংখ্য সাহাবী কিংবা তাদের সমসাময়িক প্রবীণ তাবেয়ীদের সাহচর্য পেয়েছিলেন। এজন্য আমলে মুতাওয়ারাছ অর্থাৎ কর্মগত ধারায় চলে আসা নবী-নামাযকে যতটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ তাঁর হয়েছিল ততটা হাদীস ও ফিকহের অন্য ইমামদের হয়নি। কেননা, তাঁরা সবাই তার পরের যুগের ছিলেন। (ইমাম ইবনু মাজাহ ওয়া কিতাবুহুস সুনান, মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী, পৃ. ৫০-৫৭ ও ৬৭-৭১; ফিকহু আহলিল ইরাক ওয়া হাদীছুহুম, যাহিদ কাওছারী পৃ. ৫১-৫৫; ইবনে মাজা্আওর ইলমে হাদীস, মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী পৃ. ৩৬-৪৩ ও ১১৬-১১৯; আততাআমুল, হায়দার হাসান খান টুংকী)

মোটকথা, উত্তর প্রজন্ম পূর্ব প্রজন্ম থেকে নামায আদায়ের পদ্ধতি প্রকৃতপক্ষে তাআমুল ও তাওয়ারুছের মাধ্যমেই গ্রহণ করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম তাবেয়ীগণকে শেখানোর সময় কখনও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বরাত উল্লেখ করতেন- তাঁর কোনো বাণী কিংবা কর্ম, আবার কখনও বিনা বরাতে শেখাতেন। কিন্তু সর্বাবস্থায় তারা তাবেয়ীদেরকে ওই নামাযই শেখাতেন যা তাঁরা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছ থেকে শিখেছিলেন। কখনও এমন হয়েছে যে, কেউ তাদের সামনে নামাযে কোনো ভুল করেছে, সুন্নতের খেলাফ কোনো কাজ করেছে তো তারা তা সংশোধন করে দিতেন এবং প্রয়োজনে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো হাদীস উল্লেখ করতেন।

যেহেতু নামাযের পদ্ধতি শুধু মৌখিক আলোচনার মাধ্যমে শেখার বিষয় নয়; বরং দেখে শেখার বিষয় এজন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাআমুলের মাধ্যমে শেখানোর ওপরই জোর দিয়েছেন এবং সাহাবায়ে কেরামও এ পদ্ধতিই অনুসরণ করেছেন, তাদের পরে তাবেয়ীনও। এজন্য আপনি দেখবেন, পূর্ণ নামাযের বিবরণ কোনো এক হাদীসে উল্লেখিত হয়নি; বরং দশ-বিশটি বা শ দুইশ হাদীসেও নয়। হাদীসের দু চারটি বা আট-দশটি কিতাব থেকেও যদি কিতাবুস সালাতের  সকল হাদীস একত্র করা হয় তবুও দুই রাকাত নামাযের সকল মাসআলা এবং তার পূর্ণ কাঠামো পরিষ্কারভাবে সামনে আসবে না। এর কারণ তা-ই যা আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি। অর্থাৎ তারা এই হাদীসগুলো নামায শেখানোর সময় প্রয়োজন অনুসারে উল্লেখ করতেন। রেওয়ায়েতের উদ্দেশ্যই এটা ছিল না যে, শুধু মৌখিক বর্ণনার মধ্যে গোটা নবী-নামাযের রূপ-রেখা একই মজলিসে বা এক আলোচনায় পেশ করা হবে।

সারকথা এই যে, নামাযের নিয়ম-কানূন মূলত তাআমুলতাওয়ারুছের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রসঙ্গে মৌখিক বর্ণনার ধারাও অব্যাহত ছিল।

চার.

যখন আল্লাহ তাআলার গাইবী ইশারায় আইম্মায়ে দ্বীন উলূমে দ্বীন সংকলনের প্রতি মনোনিবেশ করলেন তখন আইম্মায়ে হাদীস দ্বীনের অন্যান্য বিষয়ের মতো নামায বিষয়ক সকল মৌখিক বর্ণনাও-নবীজীর বাণী হোক বা কর্ম, সনদসহ সংকলন করতে লাগলেন। প্রথমদিকে মরফূ হাদীসের সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের; বরং তাবেয়ীনের কর্ম ও সিদ্ধান্তও সংকলিত হয়েছে। কেননা, এগুলো প্রকৃতপক্ষে ওই আমলে মুতাওয়ারাছেরই মৌখিক বিবরণ বা তার ব্যাখ্যা ছিল। দ্বিতীয় শতাব্দীর পরে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হল মরফূ রেওয়ায়েত সংকলনের দিকে।

ফুকাহায়ে কেরাম নামায বিষয়ে মৌখিক বর্ণনা এবং সাহাবা-তাবেয়ীনের কর্মধারা দুটোই সামনে রেখেছেন। এ দুয়ের আলোকে একদিকে তারা মাসনূন নামাযের (সুন্নাহসম্মত নামাযের) পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা পেশ করেছেন তেমনি নামায সংক্রান্ত সকল মাসায়েলের সমাধানও পেশ করেছেন। নামাযের এই পূর্ণাঙ্গ কাঠামো ও মাসাইল দু ভাবে বিন্যস্ত হয়েছে : ১. দলীলের উল্লেখ ছাড়া। যেন পঠন-পাঠনে সুবিধা হয়। ২. দলীলসহ বিস্তারিত আলোচনাসহ, যেন নামাযের কাঠামো ও মাসায়েলের সূত্রও মানুষের কাছে সংরক্ষিত থাকে।

এভাবে মুসলিম উম্মাহ সংকলিত আকারে দুইটি নেয়ামত লাভ করেছে : ১. মাসায়েলের উৎস হাদীসসমূহ। ২. ওইসব হাদীস ও অন্যান্য শরয়ী দলীলের নির্যাসরূপে নামাযের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো, প্রত্যেক অংশের প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সংশ্লিষ্ট মাসায়েল ইত্যাদি।

প্রথম নেয়ামত হাদীসের কিতাবসমূহে সংরক্ষিত হয়েছে এবং দ্বিতীয় নেয়ামত সংরক্ষিত হয়েছে ফিকহ, তাফসীর ও হাদীস শরীফের ব্যাখ্যা-গ্রন্থাদিতে।

পাঁচ.

প্রথম বিষয়ের কিছু প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ও সংকলকদের নাম উল্লেখ করা হল।

১. আলমুসান্নাফ, আবদুর রাযযাক ইবনে হাম্মাম (১২৬ হি.- ২১০ হি.) এগারো খন্ডে।

২. আলমুসান্নাফ, আবু বকর ইবনে আবী শায়বা (১৫৯ হি.- ২৩৫ হি.) ২৬ খন্ডে।

৩. আলমুসনাদ, আহমদ ইবনে হাম্বল (১৬৪ হি.-২৪১ হি.) ৫২ খন্ডে।

৪. সহীহ বুখারী;, আবু আবদুল্লাহ বুখারী (১৯৪ হি. -২৫২ হি.)।

৫. সহীহ মুসলিম, মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ (২০৪ হি.-২৬১ হি.)।

৬. আসসুনান, আবু দাউদ সিজিস্তানী (২০২ হি.-২৭৫ হি.)।

৭. আলজামিউস সুনান, আবু ঈসা তিরমিযী (২১০ হি.-২৭৯ হি.)।

৮. আসসুনানুল কুবরা, নাসায়ী (২১৫ হি.-৩০৩ হি.)।

৯. সহীহ ইবনে খুযাইমা,  আবু বকর ইবনে খুযায়মা (২২৩ হি.-৩১০ হি.)।

১০. শরহু মাআনিল আছার, আবু জাফর তহাবী (২৩৯ হি.-৩২১ হি.)।

১১. শরহু মুশকিলিল আছার, আবু জাফর তহাবী (২৩৯ হি.-৩২১ হি.) ১৬ খন্ডে।

১২. সহীহ ইবনে হিববান, আবু হাতিম মুহাম্মাদ ইবনে হিববান (আনুমানিক ২৭১ হি.-৩৫৪ হি.) ১৬ খন্ডে।

১৩. আলমুজামুল কাবীর, ২৫ খন্ডে।

১৪. আলমুজামুল আওসাত, ১১ খন্ডে।

১৫. আলমুজামুস সগীর ১ খন্ডে।

তিনটিই ইমাম তবারানী, আবুল কাসেম সুলায়মান ইবনে আহমদ (২৬০ হি.-৩৬০ হি.)-এর সংকলিত।

১৬. সুনানুদ দারাকুতনী, আলী ইবনে উমর দারাকুতনী (৩০৬ হি.-৩৮৫ হি.)।

১৭. আলমুসতাদরাক আলাস সহীহাইন,  হাকিম আবু আব্দিল্লাহ (৩২১ হি.-৪০৫ হি.)।

১৮. আসসুনানুল কুবরা, আবু বকর বায়হাকী (৩৮৪ হি.-৪৫৮ হি.) দশ খন্ডে।

১৯. আততামহীদ, ইবনু আবদিল বার (৩৬৮ হি.-৪৬৩ হি.) ২৬ খন্ডে।

২০. আলইস্তিযকার, ইবনু আবদিল বার (৩৬৮ হি.-৪৬৩ হি.) ৩০ খন্ডে।

অন্য নেয়ামত অর্থাৎ ফিকহের প্রসিদ্ধ সংকলক হলেন :

১. ইমাম আবু হানীফা, নুমান ইবনে ছাবিত আলকূফী (৮০ হি.-১৫০ হি.)। অর্থাৎ ইমাম বুখারীর জন্মগ্রহণেরও চুয়াল্লিশ বছর পূর্বে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ শাগরিদ দুজন : ইমাম আবু ইউসুফ (১১৩ হি.-১৮২ হি.) এবং ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশশায়বানী (১৩২-১৮৯ হি.) ইমাম আবু হানীফা রাহ. ও তাঁর শাগরিদের সংকলিত ফিকহ আলফিকহুল হানাফী নামে পরিচিত।

২. ইমাম মালিক ইবনে আনাস আলমাদানী (৯৪ হি.-১৭৯ হি.) তাঁর সংকলিত ফিকহ আলফিকহুল মালিকী নামে পরিচিত।

৩. ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইদরীস আশশাফেয়ী (১৫০ হি.-২০২ হি.) তাঁর সংকলিত ফিকহ আলফিকহুশ শাফেয়ী নামে পরিচিত।

৪. ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (১৬৪ হি.-২৪১ হি.) তাঁর সংকলিত ফিকহ আলফিকহুল হাম্বলী নামে পরিচিত।

এই চারজন যেমন ফিকহশাস্ত্রের ইমাম তদ্রূপ হাফেযুল হাদীস হিসেবেও গণ্য। শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ.-এর তাযকিরাতুল হুফফায গ্রন্থে, যা    হাফিযুল হাদীসগণের জীবনী বিষয়ে রচিত,  উক্ত চার ইমামেরই জীবনী আলোচনা করা হয়েছে। একইভাবে তাঁদের বিশিষ্ট শাগরিদ এবং শাগরিদের শাগরিদগণ হাফেযুল হাদীসের মধ্যে গণ্য। যাঁরা এই ইমামদের সংকলিত ফিকহ বিশদভাবে আলোচনা ও সংরক্ষণ করেছেন। ফিকহের প্রসিদ্ধ ইমামগণ হাদীস শাস্ত্রে কীরূপ দক্ষতা ও পান্ডিত্য রাখতেন সে সম্পর্কে বিশদ জানা  যাবে তাঁদের জীবনীতে এবং হাদীস বিষয়ক তাদের কর্ম ও রচনাবলি অধ্যয়নের মাধ্যমে।

সহজ ও সংক্ষেপে এ বিষয়ে ধারণা পেতে চাইলে আলিম-তালিবে ইলমগণ নিম্নোক্ত কিতাবগুলোর কোনো একটি অধ্যয়ন করতে পারেন।

১. মাকানাতুল ইমাম আবু হানীফা ফিল হাদীস, মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী।

২. ইমাম আযম আওর ইলমে হাদীস, মাওলানা মুহাম্মাদ আলী সিদ্দীকী কান্দলভী।

৩. আলইমাম আবু হানীফা ওয়া আসহাবুহুল মুহাদ্দিসূন, যফর আহমদ উছমানী।

৪.মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশশাফেয়ী, খতীব বাগদাদী।

৫. মানাকিবু আহমদ, ইবনুল জাওযী।

৬. তারতীবুল মাদারিক, কাযী ইয়ায (ভূমিকা)।

উম্মতের উপর ফকীহগণের বড় অনুগ্রহ এই যে, তারা শরীয়তের বিধি-বিধানের যেমন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন তদ্রূপ তা সংকলনও করেছেন। বিশেষ করে ইবাদতের পদ্ধতি ও পূর্ণাঙ্গ কাঠামো স্পষ্টভাবে পেশ করেছেন। যা হাদীস ও সুন্নাহ আমলে মুতাওয়ারাছ (যা সুন্নাহর এক গুরুত্বপূর্ণ প্রকার) থেকে গৃহীত। এর বড় সুবিধা এই যে, কোনো মানুষ মুসলমান হওয়ার পর সংক্ষেপে ওই পদ্ধতি তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় আর সে সঙ্গে সঙ্গে নামায পড়া আরম্ভ করে। শিশুদেরকে শেখানো হয়, সাত বছর বয়স থেকেই তারা নামায পড়তে থাকে। সাধারণ মানুষ, যাদের দলীলসহ বিধান জানার সুযোগ নেই এবং শরীয়তও তাদের উপর এটা ফরয করেনি, তাদেরকে শেখানো হয় আর তারা নিশ্চিন্ত মনে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করতে থাকে।

যদি অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণের পরে এবং শিশুকে বালেগ হওয়ার পর বাধ্য করা হত যে, তোমরা নামায আদায়ের পদ্ধতি হাদীসের কিতাব থেকে শেখ, কারো তাকলীদ করবে না, দলীল-প্রমাণের আলোকে সকল বিষয় নিজে পরীক্ষা করে নামায পড়বে তাহলে বছরের পর বছর অতিবাহিত হবে কিন্তু বেচারার নামায পড়ার সুযোগ হবে না। একই অবস্থা হবে যদি সাধারণ মানুষকে এই আদেশ করা হয়।

খুব ভালো করে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন যে, কুতুবে ছিত্তা (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস-গ্রন্থের সংকলক ইমামগণও প্রথমে নামায শিখেছেন ফিকহে ইসলামী থেকেই এরপর পরিণত হয়ে হাদীসের কিতাব সংকলন করেছেন। অথচ হাদীসের কিতাব সংকলন করার পর তারা না ফিকহে ইসলামীর উপর কোনো আপত্তি করেছেন, আর না মানুষকে ফিকহ সম্পর্কে আস্থাহীন করেছেন। বরং তারা নিজেরাও ইসলামের ফকীহগণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থেকেছেন। তবে যেখানে ফুকাহায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ হয়েছে সেখানে তারা নিজেদের বিচার-বিবেচনা মোতাবেক কোনো এক মতকে অবলম্বন করেছেন এবং অন্য মত সম্পর্কে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন।

মোটকথা, হাদীসের কিতাবসমূহের সংকলক এবং হাদীস শাস্ত্রের ইমামগণের যেমন বড় অবদান উম্মতের প্রতি রয়েছে তেমনি ফিকহে ইসলামীর সংকলক ও ফিকহের ইমামগণের ও বড় অবদান রয়েছে। উম্মাহর অপরিহার্য কর্তব্য এই যে, কিয়ামত পর্যন্ত উভয় শ্রেণীর মনীষীদের অবদান স্বীকার করা এবং উভয় নেয়ামত : হাদীস ও ফিকহকে সঙ্গে রেখে চলা। #

 

 

 

advertisement