সফর ১৪৩০   ||   ফেব্রুয়ারী ২০০৯

ন্যায়ের বিষয়ে আপোষহীনতা

আবিদা

আপনার সন্তানকে শেখান যে, পরিবেশ যেমনই হোক, আল্লাহর আদেশ সময়মতো পালন করতে হবে। তার মনে এই বিশ্বাস গেঁথে দিন যে, ভালো ও মন্দ একমাত্র আল্লাহ তাআলার হাতে। অতএব আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করা যাবে না।

আমাদের স্কুলে জোহরের আযানের কিছু পরেই ক্লাস শুরু হয়ে যেত এবং কোনো বিরতি ছাড়া মাগরিবের আগ পর্যন্ত চলত। জোহর ও আসর এই দুই নামাযের ওয়াক্ত পড়ত আমাদের ক্লাসের সময়ে। কিন্তু আমার শ্রেণীতে আমি একজনকেও পেলাম না, যে স্কুলে কোনো নামায আদায় করে। আমি যখন ক্লাসের ফাঁকে নামায পড়তাম তো অন্য ছাত্রীরা হাসাহাসি করত এবং বিদ্রূপ করত।

এদের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে উপদেশ দিত যে, মাগরিবের সময় একসঙ্গে সকল নামায পড়ে ফেললেই পার। এখানে ক্লাসের মধ্যে নামায না পড়লেই কি নয়?

এরপর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও আমাকে ক্লাসরুমে নামায পড়তে নিষেধ করা হল।

আমি বিষয়টা আম্মাকে জানালাম এবং জানতে চাইলাম যে, আমি কি প্রতিদিন জোহর-আসর একত্রে পড়তে পারি? তিনি বললেন, না, এটা জায়েয নয়। এরপর তিনি আমাকে স্কুলেই সময়মতো নামায আদায় করার নির্দেশ দিলেন। এটা ছিল নানাজীর শিক্ষা। তিনি তখন সফরে ছিলেন। আমার আম্মা ও খালাম্মাদের তিনি শিখিয়েছেন, তারা যেন সাহসী হন এবং ন্যায়ের উপর অটল থাকেন। আল্লাহ তাআলার আদেশ পালনে কারো নিন্দা-ভৎর্সনার পরোয়া না করেন।

অতএব আমাকেও এই আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। আমি যেন আল্লাহর আদেশ পালন করতে গিয়ে কারো নিন্দা-কটাক্ষের ভয় না করি-এই সাহস আমাকে অর্জন করতে হবে। আম্মা আমাকে নানাজীর জীবনের কিছু ঘটনা শোনালেন যে, বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার পরও শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে অবিচল থাকার কারণে কীভাবে তাঁর প্রতি আল্লাহর নুসরত হয়েছে। এরপর বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে যে কথাটা বললেন তা এই যে, যে আল্লাহকে নারাজ করে মানুষকে রাজি করতে চায় আল্লাহ তো তার উপর নারাজ হনই উপরন্তু মানুষকেও তার প্রতি নারাজ করে দেন। এরপর বললেন, একটি হালকা বিছানা সঙ্গে রাখবে এবং বিশ্রামকক্ষে তা বিছিয়ে ওয়াক্তের মধ্যেই নামায আদায় করবে। তার কথায় আমি সাহস পেলাম এবং সংকল্প  করলাম যে, আমি আমার মতো নামায পড়ব, কারো ঠাট্টা-বিদ্রূপের পরোয়া করব না।

কিছুদিন পরই পরিবেশ বদলে গেল। যারা বিদ্রূপ করত তাদের দৃষ্টিতেও শ্রদ্ধার ভাব ফুটে উঠল। এতে আমি গর্ব বোধ করলাম এবং আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল।

সত্যিই যারা মানুষের নিন্দা-সমালোচনার পরোয়া না করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে তাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হন এবং বান্দাদেরকেও সন্তুষ্ট করে দেন।

ধীরে ধীরে অন্যান্য শ্রেণীর নামাযী মেয়েরাও উৎসাহিত হল এবং আমরা পালাক্রমে ওই বিছানা বিছিয়ে নামায পড়তে লাগলাম। বিছানাটা ছোট হওয়াতে সবাই একসঙ্গে নামায পড়তে পারতাম না।

***

এটাকে আমি নানাজীর একটি বড় শিক্ষা বলে মনে করি। কেননা, ন্যায় ও অধিকার সম্পর্কে দৃঢ়তা অবলম্বনের দ্বারাই অন্যায়-অবিচার দূর করা যায় এবং অধিকার আদায় করা যায়। মুসলিমগণ আজ যদি এই বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে তাহলে তারা অনেক কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে।

আমি খুব অবাক হয়ে ভেবেছি যে, কীভাবে নানাজী তাঁর মেয়েদেরকে এই গুণে গুণান্বিত করেছেন, যে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁরা তা সঞ্চারিত করছেন তাদের সন্তানদের মধ্যে!

বস্ত্তত যারা সংকটের মুখে সাহস হারিয়ে ফেলে তাদের পক্ষে ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা সম্ভব হয় না। আর তারা শুধু নিজের অধিকার থেকেই বঞ্চিত হয় না অন্যদের অধিকারও বিনষ্ট করে।

পরে আমি খুব যত্নের সঙ্গে চেষ্টা করেছি, যাতে আমার সন্তানদের মধ্যেও সৎসাহস সৃষ্টি হয়। তারা যেন কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ না করে। একটি ছোট্ট ঘটনা বলি।

স্কুলে ছাত্ররা সবাই সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে আছে। এমন সময় একটি ছাত্র বাইরে থেকে এসে সারিতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করল। সে সময় যে ছেলেটি এর প্রতিবাদ করেছে সে আমার কনিষ্ঠ পুত্র। সে কোনোমতেই ওই ছেলেকে লাইনে ঢুকতে  দেয়নি। যদিও ছোট্ট ঘটনা, কিন্তু আমি এই ভেবে আনন্দিত হয়েছি যে, যেখানে প্রতিবাদ করা প্রয়োজন সেখানে সে প্রতিবাদ করেছে এবং নিশ্চুপ থাকাকে অবমাননাকর বলে মনে করেছে।

***

যার সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয় আল্লাহ  তাকে নুসরত করেন এবং সকল প্রতিকূলতা দূর করে দেন। আমি যে অভিজ্ঞতাগুলো পেশ করেছি এগুলো কি প্রমাণ করে না যে, কেউ যদি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার চারপাশের পরিবেশকে চ্যালেঞ্জ করে তবে অবশ্যই আল্লাহ তাকে নুসরত করে থাকেন?

 

 

 

 

advertisement