সফর ১৪৩০   ||   ফেব্রুয়ারী ২০০৯

সু্ন্নাহসম্মত নামায : কিছু মৌলিক কথা -২

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আট.

বাস্তবতা এই যে, উম্মতের যে শ্রেণী খাইরুল কুরূনের মতাদর্শের উপর বিদ্যমান রয়েছে তারা সর্বদা হাদীস ও ফিকহ এই দুই নেয়ামতকে একত্রে ধারণ করে অগ্রসর হয়েছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত এই ধারাই অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ। তাদের কারো মনে শয়তান এই কুমন্ত্রণা দিতে পারেনি যে, হাদীসের হুকুম-আহকাম ফিকহের আকারে সংকলিত হয়ে যাওয়ার পর হাদীস শরীফের পঠন-পাঠন, চর্চা ও গবেষণার কোনো প্রয়োজননেই। (নাউযুবিল্লাহ) তদ্রূপ শয়তান এই প্রশ্নও সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি যে, হাদীস শরীফ  থাকা অবস্থায় ফিকহ ও ফুকাহার প্রয়োজন কী? কেননা, তাদের কাছে এটা পরিষ্কার ছিল যে, কুরআন মজীদের পরে দ্বীনের সবচেয়ে বড় ও বিস্তৃত দলীল সুন্নাহর সবচেয়ে বড় সূত্র হচ্ছে হাদীস শরীফ। এটা দ্বীনের দ্বিতীয় দলীল ও দ্বীনী বিধি-বিধানের দ্বিতীয় সূত্র। অতএব এর প্রয়োজন কখনও ফুরোবে না। একইভাবে এটাও তাদের সামনে পরিষ্কার ছিল যে, ফিকহে ইসলামী হাদীস শরীফ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়; বরং হাদীস শরীফ ও শরীয়তের অন্যান্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত বিধিবিধানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, বিন্যাস ও সংকলন। খোদ হাদীস শরীফেও ফিকহের গুরুত্ব ও ফকীহর মর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে এবং স্বয়ং হাদীস বিশারদ ইমামগণও ফকীহদের শরণাপন্ন হতেন এবং অন্যদেরকেও এর পরামর্শ দিতেন। এজন্য এই প্রশ্নই অবান্তর যে, হাদীস শরীফ থাকা অবস্থায় ফিকহের প্রয়োজন কী?

প্রত্যেক যুগে যারা সঠিক উদ্দেশ্যে ও সঠিক পন্থায় হাদীস শরীফ অধ্যয়ন করেছেন তারা ফিকহ ও ফুকাহার প্রয়োজন বোধ করেছেন প্রচন্ডভাবে। হাদীস থাকতে ফিকহের প্রয়োজন কী এই প্রশ্নটা তখনই এসেছে যখন হাদীস চর্চার উদ্দেশ্য ও পদ্ধতিতে ভ্রান্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

নয়.

উদাহরণস্বরূপ নামাযের পদ্ধতি সম্পর্কেই চিন্তা করুন। ছিফাতুস সালাত বা সালাত-পদ্ধতি বিষয়ক যত বেশি হাদীস আপনি সংগ্রহ করবেন এবং তাতে যত বেশি চিন্তা-ভাবনা করবেন পাশাপাশি আপনার প্রতিদিনের নামায আদায়ের পদ্ধতি এবং এতদসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে যতবেশি ভাববেন ততই ফিকহ ও ফুকাহার প্রয়োজন আপনার সামনে পরিষ্কার হতে থাকবে।

কিছু সহজ বিষয় লক্ষ করুন :

গোটা নামাযের পদ্ধতি ধারাবাহিকভাবে কোনো এক হাদীসে নেই।

পূর্ণ নামাযের ধারাবাহিক নিয়ম হাদীসের এক দুই কিতাব নয়, ছয় বা দশ কিতাবেও বিদ্যমান নেই।

নামাযের মধ্যে বা নামায সম্পর্কে অনেক নামাযীর এমন সব সমস্যা সৃষ্টি হয়, যার কোনো শিরোনাম তারা হাদীসের কিতাবে খুঁজে পানা না।

বহু বিষয় এমন রয়েছে যা হাদীস শরীফে বিদ্যমান থাকলেও হাদীসের কিতাবসমূহে তা শিরোনাম করা হয়নি। কেননা, সকল হাদীস ওইসব কিতাবেই সংকলিত হয়নি যা হাদীসের কিতাব নামে পরিচিত। সীরাতের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে, এবং সীরাতের অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোতেও হাদীস বিদ্যমান রয়েছে। হাদীসের একটি বড় অংশ আমলে মুতাওয়ারাছের মাধ্যমে বর্ণিত হয়ে এসেছে।

ফিকহের ইমামগণ যখন নামাযের নিয়ম কানূন ধারাবাহিকভাবে সংকলন করেছেন তখন তারা শুধু হাদীসের দুচার কিতাবেই সীমাবদ্ধ থাকেননি; বরং হাদীস ও সুন্নাহর গোটা ভান্ডার তাদের সামনে বিদ্যমান ছিল। এ জন্য তাঁরা ছিফাতুস সালাত বা নামাযের পদ্ধতি বিষয়ক ওইসব দিকও উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন যেগুলো শুধু হাদীসের কিতাব থেকে কেউ বের করতে পারবে না। যেমন কওমাতে দুই হাত বাধা থাকবে না ছেড়ে দেওয়া হবে, রুকু-সিজদার তাসবীহাত, আত্তাহিয়্যাতু, দরূদ ও দুআ  আস্তে পড়া হবে না জোরে, মুকতাদী এক রোকন থেকে অন্য রোকনে যাওয়ার তাকবীর আস্তে বলবে না জোরে ইত্যাদি।

নামাযের বিভিন্ন কাজকর্মের ফিকহী বিধান যেমন ফরয, ওয়াজিব, সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ, সুন্নতে গায়রে মুয়াক্কাদা, আদব, মুস্তাহাব ইত্যাদির বিবরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হাদীস শরীফে উল্লেখিত হয়নি তদ্রূপ নামাযে বর্জনীয় বিষয়াদি যেমন, মাকরূহে তাহরীমী, মাকরূহে তানযীহী, বা নামায বিনষ্টকারী কাজকর্মও অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে নেই। একটি উদাহরণ দিচ্ছি : হাদীস শরীফে এটা আছে যে, রাসূলুলস্নাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযের শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ, দরূদ ও দুআ পড়তে বলেছেন কিন্তু এদের মধ্যে কোনটা ফরয বা ওয়াজিব আর কোনটা সুন্নত বা মুস্তাহাব তার বিবরণ হাদীস শরীফে নেই।

কিংবা বলুন, নামাযের কাজকর্মের মধ্যে কোনটা পরিত্যাগ করলে নামায নষ্ট হয় এবং পুনরায় নামায আদায় করা ফরয বা ওয়াজিব হয় আর কোনটা ছেড়ে দিলে নামায বিনষ্ট হয় না তবে ছওয়াব কমে যায়-এই বিষয়গুলো বিবরণ আকারে হাদীস শরীফে বলা হয়নি। অথচ সচেতন মুসল্লীদের অজানা নয় যে, নামাযীকে নামাযের কাজকর্মগুলোর শ্রেণী ও গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত হওয়াও অপরিহার্য। এ বিষয়গুলো হাদীস শরীফ থেকেই পাওয়া যাবে। কিন্তু এত সহজ বিবরণ আকারে নেই যে, হাদীস শরীফের তরজমা পাঠ করলেই সব জানা যাবে। হাদীস শরীফ থেকে এই বিষয়গুলো আহরণ করার জন্য ইজতিহাদের যোগ্যতা এবং ফকীহ ও মুজতাহিদের অর্ন্তদৃষ্টি প্রয়োজন।

উপরোক্ত পাঁচটি বিষয়ের সারকথা এই যে, হাদীস শরীফ অধ্যয়নের পরও আমাদের ফিকহ ও ফুকাহার শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এই সমাধানগুলো আমরা তাঁদের কাছেই পাই। যদি হাদীসের কোনো কোনো ভাষ্যগ্রন্থে কিংবা ফিকহুল হাদীসের আলোচনা সম্বলিত হাদীস শরীফের কোনো বিশদ গ্রন্থে এ বিষয়ক কিছু সমাধান পাওয়া যায় তবে দেখা যাবে যে, এই গ্রন্থের সংকলকগণ তা ফিকহে ইসলামী ও ফকীহদের নিকট থেকেই গ্রহণ  করেছেন। এজন্য ফিকহের প্রয়োজন আজও ঠিক তেমনি আছে যেমনি গতকাল ছিল। এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা বিদ্যমান থাকবে।

আগামী আলোচনা থেকে বিষয়টা আরো স্পষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

 

advertisement