রবিউল আউয়াল ১৪৩০   ||   মার্চ ২০০৯

সু্ন্নাহসম্মত নামায : কিছু মৌলিক কথা-৩

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

দশ

নামায প্রসঙ্গে হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থ যাদের খোলার অভিজ্ঞতা হয়েছে, অন্তত সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, জামে তিরমিযী, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসায়ী এবং মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বায় যারা নামাযপ্রসঙ্গ অধ্যয়ন করেছেন, অথবা শুধু যদি শরহু মাআনিল আছারেও (তহাবী শরীফ) নামাযের হাদীসসমূহ পড়ে থাকেন তাহলে তাদের জানতে বাকি থাকেনি যে, অনেক বিষয়েই হাদীস শরীফে বাহ্যত বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। অথচ হাদীসের উৎস হল ওহী আর ওহীর ইলমের মধ্যে বিরোধ থাকতে পারে না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শিক্ষায় স্ববিরোধিতা থাকা একেবারেই অসম্ভব। অতএব প্রকৃত বিষয়টা ভালোভাবে বুঝে নেওয়া দরকার।

দেখা যায়, এক রেওয়ায়েতে তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া অন্য কোথাও রাফয়ে ইয়াদাইন না-করার কথা আছে তো অপর রেওয়ায়েতে আরো দুই জায়গায় তা করার কথা এসেছে। কোনো কোনো রেওয়ায়েতে এসেছে আরো অধিক স্থানে করার কথা।

কোথাও বিসমিল্লাহ আস্তে পড়ার কথা আছে, কোথাও আছে জোরে পড়ার কথা।

কোথাও আমীন আস্তে বলার কথা আছে, আবার কোথাও জোরে পড়ার কথা।

কোনো রেওয়ায়েত থেকে বোঝা যায়, ইমামের পিছনে ফাতিহা পড়া চাই অথচ অন্যান্য রেওয়ায়েতে এসেছে কিরাত (ফাতিহা ও সূরা) না পড়ার কথা?

কোনো হাদীসে তাশাহহুদের পাঠ একরকম, অন্য হাদীসে অন্য রকম। তদ্রূপ ছানা, তাসবীহাত, দরূদ ও দুআয়ে কুনূতেরও বিভিন্ন পাঠ রয়েছে। এ ধরনের আরো বহু বিরোধ ও বৈচিত্র্য।

তো প্রকৃত বিষয় সম্পর্কে যারা ওয়াকিফহাল নন তারা কখনও কখনও দিশেহারা বোধ করে থাকেন। আর এটাই স্বাভাবিক। তবে বিশেষজ্ঞরা জানেন যে, এখানে বাহ্যত যে বিরোধগুলো দেখা যাচ্ছে তা এজন্য সৃষ্টি হয়নি যে, -নাউযুবিল্লাহ-ওহীর শিক্ষাতেই কোনো বৈপরিত্য ও স্ববিরোধিতা রয়েছে। কিংবা রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে স্ববিরোধী নির্দেশনা দিয়েছেন! না, কক্ষনও না। ওই বাহ্যিক বিরোধগুলোর প্রকৃত পরিচয় এই :

১. সুন্নাহর বিভিন্নতা। অর্থাৎ অনেক বিষয়ে একাধিক মাসনূন তরীকা রয়েছে। এই হাদীসে যে পন্থাটা এসেছে সেটাও মাসনূন এবং অন্য হাদীসে যা এসেছে তা-ও মাসনূন। যেমন ছানাতে সুবহানাকা ... পড়াও সুন্নাহ, আবার আল্লাহুম্মা ইন্নী ওয়াজজাহতু ... পড়াও সুন্নাহ।

কুনূতে আল্লাহুম্মাহ্দিনী ... পড়াও সুন্নাহ আবার আল্লাহুম্মা ইন্না নাসতাঈনুকা ... পড়াও সুন্নাহ।

কওমাতে রাববানা লাকাল হামদও বলা যায়, রাববানা ওয়ালাকাল হামদও বলা যায়, আল্লাহুম্মা রাববানা লাকাল হামদও বলা যায়। তদ্রূপ নিম্নোক্ত দুআও পড়া যায়। সবগুলোই সুন্নাহ।

 اللَّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ مِلْءَ السَّمَاوَاتِ وَمِلْءَ الْأَرْضِ وَمِلْءَ مَا شِئْتَ مِنْ شَيْءٍ بَعْدُ، أَهْلُ الثَّنَاءِ وَالْمَجْدِ، أحق ما قال العبد : وَكُلُّنَا لَكَ عَبْدٌ، اللهُمَّ لَا مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلَا مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ وَلَا يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ

২. বহু বিরোধ এমন রয়েছে যেখানে দুটো বিষয়ই হাদীস শরীফ কিংবা কোনো শরয়ী দলীলের দ্বারা প্রমাণিত। অর্থাৎ দুটোরই উৎস সুন্নাহ, কিন্তু বিভিন্ন আলামতের ভিত্তিতে কোনো ফকীহ  তাদের একটিকে উত্তম ও অগ্রগণ্য মনে করেন আর অন্যটিকে মনে করেন বৈধ ও অনুমোদিত। আবার অন্য ফকীহ এর বিপরীত মত পোষণ করেন।

এটাও মূলত সুন্নাহর বিভিন্নতারই অন্তর্ভুক্ত। রাফয়ে ইয়াদাইন, আমীন ইত্যাদি বিষয়গুলো এই শ্রেণীর।

৩. কিছু দৃষ্টান্ত এমনও রয়েছে যে, প্রথমে একটা বিষয় মাসনূন বা মুবাহ ছিল পরে তা মানসূখ (রহিত) হয়ে যায়। এর স্থলে অন্য একটি পদ্ধতি প্রদান করা হয় আর প্রথম পদ্ধতি পরিত্যাগ করা হয় বা সেটা মাসনূনের পর্যায় থেকে মুবাহ বা বৈধতার পর্যায়ে নেমে আসে। পরিভাষায় একে নাসিখ-মানসূখ বলে।

ইসলামের প্রথম যুগে নামাযে সালামের জওয়াব দেওয়া যেত। এটা  বৈধ ছিল। তখন প্রয়োজনীয় কথা বলারও অবকাশ ছিল। কিন্তু পরে তা মানসূখ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إن الله يحدث من أمره ما شاء، وإن مما أحدث أن لا نكلوا في الصلاة.

(সহীহ বুখারী : তাওহীদ, পরিচ্ছেদ : ৪২; সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ৯২০)

তদ্রূপ একটা সময় পর্যন্ত রুকুতে দুই হাত একত্র করে দুই হাটুর মধ্যে রাখা ছিল মাসনূন পদ্ধতি। পরে দুই হাতের আঙুল দ্বারা দুই হাটু ধরা মাসনূন সাব্যস্ত হয়। তবে প্রথম পদ্ধতি নাজায়েয করা হয়নি।

৪. কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে একটি পদ্ধতি হল সুন্নাহ আর অন্যটি করা হয়েছিল ওজরবশত। কিন্তু কেউ কেউ একেও সুন্নাহ মনে করলেন। যেমন শেষ বৈঠকে বসার একটি মাসনূন পদ্ধতি রয়েছে যা কারো অজানা নয়। আরেকটি পদ্ধতি হল যেটা মহিলাদের জন্য মাসনূন। কোনো কোনো বর্ণনায় চারজানু হয়েও বসার কথা এসেছে। কিন্তু প্রাসঙ্গিক সকল হাদীস সামনে রাখলে এবং নামাযের পদ্ধতি প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রীতি ও ধারা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে বোঝা যায় যে, পুরুষের জন্য ওই প্রসিদ্ধ পদ্ধতিটাই মাসনূন তরীকা। অন্য পদ্ধতিগুলোও কখনো কখনো অনুসরণ করা হয়েছিল ওজরবশত কিংবা শুধু বৈধতা বোঝানোর জন্য।

৫. এমন কিছু উদাহরণও রয়েছে যেখানে মাসনূন তরীকা একটিই, বিভিন্ন হাদীসে যা উল্লেখিত হয়েছে। আর ভিন্ন পদ্ধতি যা কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় সেটা সহীহ হাদীস নয়, বর্ণনাকারীর ভ্রান্তি। কিন্তু কোনটা সহীহ হাদীস আর কোনটা বর্ণনাকারীর ভুল এই সিদ্ধান্ত শুধু হাদীসবিশারদ ইমামগণই দিতে পারেন। তাঁরা যদি একমত হয়ে কোনো ফয়সালা প্রদান করেন তবে সেটাই নির্ধারিত। আর যেখানে তাদের মধ্যে মতভেদ হয়, এবং অবশ্যই তা যুক্তিসংগত মতভেদ, সেখানে প্রাজ্ঞ ও পারদর্শী ব্যক্তি চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে কোনো এক মত অবলম্বন করবেন। সাধারণ মানুষ অনুসরণ করবেন কোনো একজনের সিদ্ধান্ত।

এবার চিন্তা করুন : এই বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রকৃত অবস্থা উদঘাটন করা যে, কোনটা সুন্নাহর বিভিন্নতা আর কোনটা উত্তম-অনুত্তমের পার্থক্য আর কোথায় সুন্নাহ বনাম ওজরের প্রসঙ্গ-এটা অবশ্যই দলীলের ভিত্তিতেই হতে হবে। কিন্তু এই দলীল, আলামত ও লক্ষণগুলো এত সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নয় যে, যে কারো পক্ষে তা অনুধাবন করা এবং তার আলোকে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব। এটা এমন এক ক্ষেত্র যেখানে ইজতিহাদ ও ফিকহী প্রজ্ঞা অপরিহার্য। প্রথম থেকেই এই গুরু দায়িত্ব উম্মাহর ফকীহ ও আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের উপরই ন্যস্ত ছিল এবং এটা ফিকহে ইসলামীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রসঙ্গ। আর যেহেতু এই ক্ষেত্রগুলো ইজতিহাদ-নির্ভর তাই এখানে দ্বিমত সৃষ্টি হওয়া আশ্চর্যের বিষয় নয়।

৬. অনেক বিষয়ে মতভেদ শুধু এজন্য হয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট হাদীসসমূহে একাধিক ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। এখানে বিভিন্ন লক্ষণ দ্বারা কোনো একটি ব্যাখ্যাকে শুধু অগ্রগণ্যই বলা যায়, এই ব্যাখ্যাটাই সুনিশ্চিত আর অন্যটা ভুল-এটা বলা যায় না। এ ধরনের ক্ষেত্রেও কিতাব ও সুন্নাহর বিশেষজ্ঞ ফুকাহায়ে উম্মাহর (আইম্মায়ে মুজতাহিদীন) মাঝে মতভেদ হওয়া অবশ্যম্ভবী।

কোনো কোনো নুসূসে শরইয়্যাহ তে (দলীলের পাঠ, আয়াত হোক বা হাদীস) একাধিক ব্যাখ্যার যে অবকাশ থাকে সেটা কখনও লুগাত বা ভাষাগত কারণে হয়। অর্থাৎ আরবী ভাষাতেই সে শব্দ বা বাক্যের একাধিক অর্থ রয়েছে। কখনও এজন্যও হয় যে, আলোচ্য বিষয়ে এই নস ছাড়াও অন্যান্য দলীল ও নস বিদ্যমান রয়েছে। সেগুলো সামনে রাখা হলে দেখা যায়, প্রথমে ওই নসের যে অর্থ বোঝা যাচ্ছিল তা আর নিশ্চিত থাকছে না। অন্য ব্যাখ্যারও অবকাশ সৃষ্টি হচ্ছে।

এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন লক্ষণ ও আলামতের মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে, কোন ব্যাখ্যাটা অধিক উপযোগী বা অধিক সামঞ্জস্যশীল। বলাবাহুল্য, যখন লক্ষণ বিভিন্ন হবে তো নসের ব্যাখ্যা নির্ণয়ে মতভেদ হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এ ধরনের মতভেদের দৃষ্টান্ত নবীযুগেও বিদ্যমান ছিল। এখানে এ বিষয়ের প্রসিদ্ধ ঘটনাটি উল্লেখ করছি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গযওয়ায়ে আহযাব (খন্দকের যুদ্ধ)-এর মতো কঠিন গযওয়া থেকে ফিরে আসলেন এবং হাতিয়ার রেখে গোসল করলেন। ইতিমধ্যে হযরত জিব্রীল আ. এসে বললেন, আপনি অস্ত্র রেখে দিয়েছেন? আল্লাহর কসম! আমরা তো এখনও পর্যন্ত অস্ত্র ছাড়িনি। জলদি চলুন। এটাই আল্লাহর আদেশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কোন দিকে যাব? জিব্রীল আ. বনু কুরাইযার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ওই দিকে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে সঙ্গে বের হলেন এবং হযরত বিলাল রা.-কে ঘোষণা দিতে বললেন-

من كان سامعا مطيعا فلا يصلين العصر إلا في بني قريظة.

যে রাসূলুল্লাহর বাধ্য ও অনুগত সে যেন বনু কুরাইযায় যেয়েই আছরের নামায পড়ে।

ঘোষণা শোনামাত্র সবাই অস্ত্র হাতে রওনা হয়ে গেলেন। অনেকেই সময়মতো পৌঁছে গেলেন। আর কিছু সাহাবী রাস্তায় ছিলেন। এদিকে আছরের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছিল। এঁদের মধ্যে মতভেদ হল যে, নামায কোথায় পড়া হবে। কিছু সাহাবী বললেন, আমরা সেখানেই নামায পড়ব যেখানে পড়তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ দিয়েছেন। অন্যরা বললেন, রাসূলুল্লাহর উদ্দেশ্য এই ছিল না যে, আমরা নামায কাযা করি। শেষে কিছু সাহাবী পথিমধ্যেই নামায পড়ে রওনা হলেন, অন্যরা বনু কুরাইযায় পৌঁছে নামায পড়লেন। তখন সূর্য     অস্তমিত হয়েছে। তাঁদের বক্তব্য ছিল, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশ পালন করেছি। অতএব আমাদের কোনো অপরাধ নেই। বর্ণনাকারী বলেন-

فصلت طائفة إيمانا واحتسابا وتركت طائفة إيمانا واحتسابا

 অর্থাৎ যারা পথিমধ্যে নামায পড়েছেন তারাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমানের কারণে ছওয়াবের আশায় নামায পড়েছেন আর যারা কাযা করেছেন তারাও রাসূলুল্লাহর আদেশের উপর ঈমান ও ছওয়াবের আশায় কাযা করেছেন।

পরিশেষে এই ঘটনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে উপস্থাপিত হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকেই ভৎর্সনা করলেন না।

(সহীহ বুখারী, কিতাবুল মাগাযী, হাদীস ৪১১৯; সহীহ মুসলিম কিতাবুল জিহাদ হাদীস ১৭৭০; সীরাতে ইবনে হিশাম খ. ৬, পৃ. ২৮২, ২৮৪; দালাইলুন নুবুওয়াহ বায়হাকী খ. ৪, পৃ. ৬-৭; আলমুজামুল কাবীর তবারানী খ. ১৯, পৃ. ৮০)

এই মতভেদ যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশের অর্থ নির্ধারণ নিয়ে হয়েছিল এবং প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য ছিল নবীজীর আনুগত্য ও আদেশ পালন তাই কোনো দলকেই তিরস্কার করা হয়নি।

ইবনুল কাইয়েম রাহ. ‘‘যাদুল মাআদ’’ গ্রন্থে আলোচনা করেছেন যে, বাস্তবে কাদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। তিনি      বিস্তারিতভাবে লিখেছেন, যারা নামায কাযা করেননি তাদের সিদ্ধান্তই ছিল সঠিক। তারা দুই ছওয়াবের অধিকারী। আর অন্যরাও যেহেতু নস-এর বাহ্যিক অর্থ অনুসরণ করেছেন এবং তাদেরও লক্ষ্য ছিল রাসূলুল্লাহর আনুগত্যই তাই তারা মাযূর এবং এক ছওয়াবের অধিকারী। (যাদুল মাআদ ফী হাদয়ি খাইরিল ইবাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্ড : ৩, পৃষ্ঠা ১১৮-১১৯; হাদয়ুহূ ফিল আমান)

আমি যে বিষয়টি আরজ করতে চাইছিলাম তা এই যে, শরয়ী নস-এর অর্থ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কখনও কখনও সাহাবা-যুগেও মতভেদ হয়েছে এবং যেহেতু তা যুক্তিসংগত ছিল তাই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারো উপরই আপত্তি করেননি।

আমাদের আলোচনা নামাযের নিয়ম সম্পর্কে। এজন্য এ বিষয়েরই আরেকটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি। হাদীস শরীফে এসেছে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

لا صلاة إلا بفاتحة الكتاب

এই হাদীসের শাব্দিক তরজমা হল ফাতিহা ছাড়া কোনো নামায নেই। নামাযের কিরাত প্রসঙ্গে যদি এটিই একমাত্র হাদীস হত এবং এ বিষয়ে অন্য কোনো হাদীস বা শরীয়তের অন্য কোনো দলীল না থাকত তাহলে একথা বলা ছাড়া উপায় থাকত না যে, নামাযে ইমাম ও মুনফারিদের মতো মুক্তাদীরও ফাতিহা পড়া অপরিহার্য। কিন্তু যখন এই হাদীসের সঙ্গে কুরআন মজীদের এই আয়াতও সামনে থাকবে-

وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

এবং ওই হাদীসগুলোও সামনে থাকবে যেগুলোতে বলা হয়েছে-

وإذا قرأ فأنصتوا، وإذا قال غير المغضوب عليهم قولوا : آمين،

من كان له إمام فقراءة الإمام له قراءة.

এবং ওইসব হাদীসও থাকবে যেগুলোতে আস্তে কিরাতের নামাযেও ইমামের পিছনে কিরাত পড়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তখন কি দ্বিধাহীনভাবে বলা যাবে যে, মুকতাদীর জন্যও ফাতিহা পড়া অপরিহার্য? আর এটাই এই হাদীসের বিধান? বরং উল্লেখিত আয়াত ও হাদীসের কারণে বলা হবে যে, প্রথম হাদীস দ্বারা নামাযে ফাতিহা পাঠ জরুরি প্রমাণিত হয়। তবে অন্যান্য হাদীস থেকেই জানা যাচ্ছে যে, ইমামের ফাতিহা পাঠই মুকতাদীর ফাতিহা পাঠ। অতএব সে আলাদা করে ফাতিহা পড়বে না; বরং নিশ্চুপ থাকার ও শ্রবণ করার আদেশ পালন করবে।

সাহাবায়ে কেরাম থেকে নিয়ে প্রতি যুগের বিপুল সংখ্যক ফকীহ উপরোক্ত হাদীসের এই অর্থই গ্রহণ করেছেন। মুকতাদীর জন্যও ফাতিহা পাঠ অপরিহার্য হওয়াকে তারা উপরোক্ত হাদীসের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক মনে করেননি। অন্যদিকে অনেক ফকীহর মত এই ছিল যে, আস্তে কিরাতের নামাযে মুকতাদী ফাতিহা পড়বে, জোরে কিরাতের নামাযে পড়বে না। কেউ কেউ মনে করতেন, মুকতাদী জোরে কিরাতের নামাযেও ফাতিহা পড়বে। বলাবাহুল্য যে, এ বিষয়ের সকল দলীল এবং প্রাসঙ্গিক সকল বিষয় সামনে রাখা হলে এই ব্যাখ্যাগুলোকেও নিশ্চিতভাবে ভুল বলা কঠিন।

কথা দীর্ঘ হয়ে গেল। আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে, নামায বা শরীয়তের অন্যান্য বিষয়ে যেসব ক্ষেত্রে হাদীস শরীফে বাহ্যত বিরোধ দেখা যায় সেখানে ওই বিরোধের ধরন ও তাৎপর্য নির্ণয় করা ছাড়া হাদীসের নির্দেশনার উপর আমল করা মোটেই সম্ভব নয়। এবার বলুন, এই বিষয়ে সমাধান কারা দিতে পারেন? কোনো সন্দেহ নেই যে, এটা ফিকহে ইসলামী ও ফুকাহায়ে উম্মতেরই কাজ। এজন্য সর্বযুগেই হাদীসের সাথে ফিকহও দ্বীনের খাদেম হিসাবে বিদ্যমান ছিল, আছে, থাকবে। আর ওয়ারিছে নবীর কাতারে যখন থেকে মুহাদ্দিসীনে কেরাম ছিলেন ঠিক তখন থেকেই ফুকাহায়ে কেরামও ছিলেন।

প্রসঙ্গত, শরীয়তের রীতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে যাদের সঠিক ধারণা নেই তারা মতভেদ শব্দটি শোনামাত্রই ভ্রূকুঞ্চিত করেন এবং কিছুটা যেন বিব্রত হয়ে পড়েন, বিশেষত নামাযের মতো মৌলিক ইবাদতের বিষয়ে মতভেদ, যা ঈমানের পর ইসলামের সবচেয়ে বড় রোকন, তাদের পক্ষে একেবারেই যেন অসহনীয়!

তাদের জানা থাকা উচিত যে, মতভেদমাত্রই পরিত্যাজ্য নয়। কেননা কিছু মতভেদ আছে, যার প্রেরণা দলীলের অনুসরণ। স্বয়ং দলীলই ওই মতভেদের উৎস। আর কিছু মতভেদ আছে যা সৃষ্টি হয় মূর্খতা ও হঠকারিতার কারণে। দলীল সম্পর্কে অজ্ঞতা  কিংবা দলীলের শাসন মানতে অস্বীকৃতিই এই মতভেদের উৎস। প্রথম মতভেদ শরীয়তে স্বীকৃত আর দ্বিতীয়টা নিন্দিত। বিষয়গত দিক থেকে ঈমানিয়াত ও আকাইদ অর্থাৎ ইসলামের সকল মৌলিক আকীদা এবং শরীয়তের সকল অকাট্য মাসআলা ওই পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত যেখানে দলীলভিত্তিক কোনো ইখতিলাফ-মতভেদ হতেই পারে না। এজন্য দেখবেন, এসব বিষয়ে আইম্মায়ে দ্বীনের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই। এক্ষেত্রে কেউ মতভেদ করলে তা অবশ্যই হঠকারিতা। আর ওই মতভেদকারী হয় মুবতাদি (বিদআতী) কিংবা মুলহিদ (বেদ্বীন)। কিন্তু ফুরূয়ী মাসাইল, এতেও শ্রেণীভেদ রয়েছে, এর ধরনটা ভিন্ন। এখানে দলীলভিত্তিক মতভেদ হতে পারে এবং হয়েছে। শরীয়তে এটা স্বীকৃত এবং শরীয়তই একে বহাল রেখেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ, খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ এবং সাহাবা ও তাবেয়ীন যুগেও এটা ছিল এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।

এই মতভেদের বিষয়ে শরীয়তের বিধান হল তা বিলুপ্ত করার চেষ্টা ভুল এবং একে বিবাদ-বিসংবাদের মাধ্যম বানানো অপরাধ। দলীলভিত্তিক মতভেদ স্বীকৃত; বরং নন্দিত, কিন্তু বিবাদ-বিসংবাদ হারাম ও নিষিদ্ধ।

এই শ্রেণীর ফুরূয়ী ইখতিলাফ (শাখাগত বিষয়ে মতভেদ) প্রকৃতপক্ষে গন্তব্যে পৌঁছার একাধিক পথ। সিরাতে মুস্তাকীমেরই বিভিন্ন পথরেখা। এগুলোর কোনোটাকেই প্রত্যাখ্যান করা কিংবা অনুসরণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ। এটা ইলাহী নীতির বিরোধী, যা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যবান মুবারকে উচ্চারিত হয়েছে-

كلاكما حسن فاقرءا.

দুজনই সঠিক, অতএব পড়তে থাক। (সহীহ বুখারী হাদীস : ৫০৬২)

তদ্রূপ তার কর্ম দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে-

فما عنف واحدا من الفريقين.

অতঃপর কোনো দলকেই তিনি ভৎর্সনা করলেন না।

এ ধরনের আরো বহু দলীলে যা উল্লেখিত হয়েছে।

কেউ যদি প্রশ্ন করেন যে, এই মতভেদ বিদ্যমান রাখার তাৎপর্য কী, তাহলে এর সুনিশ্চিত ও বিস্তারিত উত্তর তো আখিরাতেই আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে জানা যেতে পারে। কেন তিনি দ্বীনের সকল বিষয় এক পর্যায়ের দলীল                  

قطعي الثبوت وقطعي الدلالة.

-এর মাধ্যমে দিলেন না, অভিন্ন গন্তব্যের জন্য বিভিন্ন পথ কেন নির্দেশ করলেন, সিরাতে     মুস্তাকীমে বিচিত্র পথ-রেখার সমাবেশ কেন তিনি ঘটালেন? তিনি কি ইচ্ছা করলে সিরাতে মুস্তাকীমের একটিমাত্র ধারাই জারি  করতে পারতেন না? অবশ্যই পারতেন। কিন্তু এখানে রয়েছে প্রজ্ঞার অতল গভীরতা, যার সবটা জেনে ফেলার আকাঙ্খাই হাস্যকর। তবে যতটুকু তিনি বান্দাদের সামনে প্রকাশ করেছেন তা-ও প্রশান্তির জন্য যথেষ্ট। যারা এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ইচ্ছুক তারা আসবাবুল ইখতিলাফআদাবুল ইখতিলাফ বিষয়ে বিশদ ও গ্রহণযোগ্য কিতাবপত্র অধ্যয়ন করতে পারেন।

মনে রাখা দরকার, যে মতভেদের ভিত্তি দলীলের উপর নয়; বরং মূর্খতা, হঠকারিতা এবং ধারণা ও সংশয়ের উপর, তা আপাদমস্তক নিন্দিত। দ্বীনের স্বতসিদ্ধ বিষয়াদি এবং অকাট্য ও ইজমায়ী মাসআলাগুলোতে দ্বিমত প্রকাশ এই নিন্দিত মতভেদেরই অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে এটা মতভেদ নয়, দলীলের বিরোধিতা। এই বিরোধী ব্যক্তি সিরাতে মুসতাকীম থেকে বিচ্যুত। তার গন্তব্য ও ন্যায়নিষ্ঠ মুমিনের গন্তব্য এক নয়। সে তো এক ভিন্ন লক্ষ্যের অভিযাত্রী, যার পরিচয় হল-

من شذ شذ في النار

বলাবাহুল্য, সিরাতে মুসতাকীমের অর্ন্তগত বিভিন্ন পথ এবং সিরাতে মুসতাকীম থেকে বিচ্যুত বিভিন্ন পথের হুকুম এক নয়। প্রথম ক্ষেত্রে পথরেখা বাহ্যত  বিভিন্ন হলেও প্রকৃত পক্ষে তা একই পথের অন্তর্গত। আর লক্ষ্য ও মঞ্জিল যে অভিন্ন তা তো বলাই বাহুল্য। আর শেষোক্ত ক্ষেত্রে পথ ও ভিন্ন লক্ষ্যও ভিন্ন। প্রথম ক্ষেত্রে পথগুলো নিরাপদ ও স্বীকৃত আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বিপদসঙ্কুল ও পরিত্যাক্ত।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement