সুন্নাহসম্মত নামায : কিছু মৌলিক কথা-৪
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এগার
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নামাযের পদ্ধতিগত কিছু বিষয়ে খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামের আমল থেকেই বিভিন্নতা ছিল। এটা খাইরুল কুরূনেও ছিল এবং পরের যুগগুলোতেও তার ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। এর কারণ সম্পর্কেও ইতিপূর্বে কিছু আলোচনা করা হয়েছে। এই ধরনের ক্ষেত্রে উম্মতের করণীয় কী তা শরীয়তের দলীলের আলোকে ফিকহে ইসলামীতে নির্দেশিত হয়েছে। হাদীস মোতাবেক নামায পড়ার জন্য ওই নির্দেশনা গ্রহণ করার কোনো বিকল্প নেই।
এ ধরনের বিষয়ে উম্মাহর যে নীতি ‘খাইরুল কুরূন’ তথা সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীন-এর যুগ থেকে অনুসৃত তা সংক্ষেপে এই :
১. যে অঞ্চলে যে সুন্নাহ প্রচলিত সেখানে তা-ই চলতে দেওয়া উচিত। এর উপর আপত্তি করা ভুল। কেননা আপত্তি ওই বিষয়ে করা হয়, যা বিদআত বা সুন্নাহর পরিপন্থী। কিন্তু এক সুন্নাহর উপর এজন্য আপত্তি করা যায় না যে, এটা আরেক সুন্নাহ মোতাবেক নয়।
এ প্রসঙ্গে ইসমাঈল শহীদ রাহ.-এর ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। তিনি একবার রুকু ইত্যাদিতে ‘রাফয়ে ইয়াদাইন’ করতে আরম্ভ করেছিলেন। অথচ সে সময় গোটা ভারতবর্ষের সর্বত্র (ক্ষুদ্র কিছু অঞ্চল ব্যতিক্রম ছিল, যেখানে ফিকহে শাফেয়ী অনুযায়ী আমল হত) নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য কোনো স্থানে রাফয়ে ইয়াদাইন না-করার সুন্নতটি প্রচলিত ছিল। শাহ শহীদ রাহ.-এর বক্তব্য এই ছিল যে, মৃত সুন্নত জীবিত করার ছওয়াব অনেক বেশি। হাদীস শরীফে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে-
من تمسك بسنتي عند فساد أمتي فله أجر مئة شهيد
অর্থ : ‘উম্মতের ফাসাদের মুহূর্তে যে আমার সুন্নাহকে ধারণ করে সে একশত শহীদের মর্যাদা পাবে।’
তখন তাঁর চাচা হযরত মাওলানা আবদুল কাদের দেহলবী রাহ. (শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ.-এর পুত্র, তাফসীরে মূযিহুল কুরআন-এর রচয়িতা) তার এই ধারণা সংশোধন করে দেন। তিনি বলেন, ‘‘মৃত সুন্নাহকে জীবিত করার ফযীলত যে হাদীসে এসেছে সেখানে বলা হয়েছে যে, উম্মাহর ফাসাদের যুগে যে ব্যক্তি সুন্নাহকে ধারণ করে তার জন্য এই ফযীলত। আর একথা বলাই বাহুল্য যে, কোনো বিষয়ে যদি দু’টো পদ্ধতি থাকে এবং দু’টোই মাসনূন (সুন্নাহভিত্তিক) হয় তাহলে এদের কোনো একটিকেও ‘ফাসাদ’ বলা যায় না। সুন্নাহর বিপরীতে শিরক ও বিদআত হল ফাসাদ,কিন্তু দ্বিতীয় সুন্নাহ কখনও ফাসাদ নয়। কেননা, দু’টোই সুন্নাহ। অতএব রাফয়ে ইয়াদাইন না-করাও যখন সুন্নাহ, তো কোথাও এ সুন্নাহ অনুযায়ী আমল হতে থাকলে সেখানে রাফয়ে ইয়াদাইনের সুন্নাহ ‘জীবিত’ করে উপরোক্ত ছওয়াবের আশা করা ভুল। এটা ওই হাদীসের ভুল প্রয়োগ। কেননা এতে পরোক্ষভাবে দ্বিতীয় সুন্নাহকে ফাসাদ বলা হয়, যা কোনো মতেই সঠিক নয়।’
এই ঘটনাটি আমি বিশদ করে বললাম। মূল ঘটনা মালফূযাতে হাকীমুল উম্মত খ. ১, পৃ. ৫৪০-৫৪১, মালফুয :১১১২ ও খ. ৪, পৃ. ৫৩৫, মালফুয : ১০৫৬ এবং মাজালিসে হাকীমুল উম্মত পৃ. ৬৭-৬৯ তে উল্লেখিত হয়েছে।
সারকথা এই যে, সালাফে সালেহীন বিদআত থেকে দূরে থাকতেন এবং বিদআতের বিরোধিতা করতেন। আর সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করতেন এবং সুন্নাহকে জীবিত করতেন। কিন্তু কখনও তাদের নীতি ‘ইবতালুস সুন্নাহ বিসসুন্নাহ’ বা ‘ইবতালুস সুন্নাহ বিলহাদীস’ ছিল না। অর্থাৎ তারা এক সুন্নাহকে অন্য সুন্নাহর মোকাবেলায় দাড় করাতেন না। তদ্রূপ ‘সুন্নতে মুতাওয়ারাছা’ দ্বারা প্রমাণিত আমলের বিপরীতে রেওয়ায়েত পেশ করে তাকে বিলুপ্ত করার চেষ্টা করতেন না। এক সুন্নাহর সমর্থনে অন্য সুন্নাহকে খন্ডন করা আর একে ‘মুর্দা সুন্নত জিন্দা করা’ বলে অভিহিত করা তাদের নীতি ছিল না। এটা একটা ভুল নীতি, যা খাইরুল কুরূনের শত শত বছর পরে জন্মলাভ করেছে।
২. যেসব মাসআলার ভিত্তি হল ইজতিহাদ, কিংবা দলীলে নকলী বিদ্যমান থাকলেও তা থেকে বিধান আহরণের জন্য ইজতিহাদের প্রয়োজন সেগুলোকে ‘মুজতাহাদ ফীহ’ বিষয় বলে। এ ধরনের বিষয়ে ফকীহগণের মধ্যে মতভেদ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এজন্য যেসব ‘মুজতাহাদ ফীহ’ বিষয়ে জায়েয-না জায়েযের মতভেদ হয়েছে সেখানেও এই নীতিই অনুসৃত হয়েছে যে, এগুলো ‘নাহি আনিল মুনকার’-এর বিষয় নয়। অর্থাৎ যেভাবে কোনো মুনকার বা গর্হিত বিষয়ের প্রতিবাদ করা হয় এবং তাতে লিপ্ত হওয়া থেকে মানুষকে বিরত রাখা হয় তা এই ধরনের মাসআলায় করা যাবে না। এক মুজতাহিদ অন্য মুজতাহিদের উপর কিংবা অন্য মুজতাহিদের অনুসারীর উপর আপত্তি করবেন না। ‘মুজতাহাদ ফীহ’ মাসাইল নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনা হতে পারে, মতবিনিময় হতে পারে, কিন্তু একে বিভেদ-বিভক্তির বিষয় বানানো যাবে না। তদ্রূপ এর ভিত্তিতে কাউকে গোমরাহ বলা, ফাসিক বা বিদআতী আখ্যা দেওয়াও বৈধ নয়। সাহাবা-তাবেয়ীন যুগ অর্থাৎ খাইরুল কুরূন থেকেই এই নীতি অনুসৃত হয়েছে এবং এতে কারো কোনো দ্বিমত ছিল না। তো জায়েয-নাজায়েযের বিতর্ক যেসব মাসআলায় তাতেই যদি নীতি এই হয় তাহলে যেখানে শুধু উত্তম-অনুত্তমের প্রশ্ন, তার বিধান কী হবে? বালাবাহুল্য যে, এ ধরনের বিষয়কে কেন্দ্র করে বিদ্বেষ ছড়ানো, বিভক্তি সৃষ্টি করা, একে অন্যকে ফাসেক, গোমরাহ, বিদআতী আখ্যা দেওয়া ইত্যাদির কোনো অবকাশ শরীয়তে নেই। তদ্রূপ এ কারণে একজন অন্য জনকে হাদীস-বিরোধী বা সুন্নাহ-বিরোধী বলারও কোনো সুযোগ নেই।
স্বয়ং আইম্মায়ে হাদীস এই ইখতিলাফকে ‘ইখতিলাফুল মুবাহ’ বা ‘ইখতিলাফু তা’আদ্দুদিস সুন্নাহ’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ এমন কিছু পদ্ধতি যেখানে প্রত্যেক পদ্ধতিই ‘মুবাহ’ অথবা ‘মাসনূন’। তাহলে এখানে গোমরাহ বলা, ফাসিক বলা কিংবা হাদীস বিরোধীতার অভিযোগ দায়ের করার কী অর্থ?
আজকাল রুকুতে যাওয়ার সময়, রুকু থেকে ওঠার সময় এবং তৃতীয় রাকাতের শুরুতে রাফয়ে ইয়াদাইন করা নিয়ে, আমীন জোরে বা আস্তে বলা নিয়ে এবং এ ধরনের অন্যান্য বিষয় নিয়ে কোনো কোনো মহলে কত যে ঝগড়া-বিবাদ, চ্যালেঞ্জবাজি, লিফলেটবাজি হতে থাকে তার হিসাব কে রাখে? অথচ এই সব মাসআলায় যে মতভেদ তা হল সুন্নাহর বিভিন্নতা, যেখানে ঝগড়া-বিবাদের প্রশ্নই অবান্তর।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ. হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন, কিন্তু রাফয়ে ইয়াদাইনকে ‘আহাববু ইলাইয়া’ (আমার কাছে অধিক পছন্দনীয়) বলেছেন এবং তার কিছু হিকমতও বয়ান করেছেন। এরপরও লিখেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও রাফয়ে ইয়াদাইন করেছেন, কখনও করেননি। উভয় পদ্ধতিই সুন্নাহ এবং সাহাবা, তাবেয়ীন ও পরবর্তীদের মধ্যে উভয় পদ্ধতিরই অনুসারী ছিলেন। এটা ওই সব মাসআলার অন্যতম যাতে আহলে মাদীনা (মদীনার ফকীহবৃন্দ) ও আহলে কূফা (কূফার ফকীহবৃন্দ)-র মধ্যে মতভেদ হয়েছে। আর প্রত্যেকের কাছেই রয়েছে শক্তিশালী দলীল। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা : খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১০)
অন্যদিকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ.-এর আগের ও পরের অসংখ্য মুহাক্কিক-গবেষক রাফয়ে ইয়াদাইন না-করাকে উত্তম বলেছেন। (আমরাও দলীলের বিচারে এ কথাই বলে থাকি) কিন্তু এই পর্যন্তই। একে কেন্দ্র করে ঝগড়া-বিবাদ কেউ করেননি। সকলেই শাহ ওয়ালিউল্লাহর মতো একে সুন্নাহর বিভিন্নতা বলেই মনে করেছেন।
ইবনুল কাইয়েম রাহ. (৭৫১ হি.) ‘যাদুল মাআদ’ গ্রন্থে ফজরের নামাযে কুনূত পড়া-প্রসঙ্গে পরিষ্কার লেখেন-
وهذا من الاختلاف المباح الذي لا يعنف فيه فاعله ولا من تركه، وهذا كرفع اليدين في الصلاة وتركه، وكالخلاف في أنواع التشهدات وأنواع الأذان والإقامة، وأنواع النسك من الإفراد والقران والتمتع.
অর্থাৎ এটা ওইসব ইখতিলাফের অন্তর্ভুক্ত যাতে কোনো পক্ষই নিন্দা ও ভৎর্সনার পাত্র নন। এটা তেমনই যেমন নামাযে রাফয়ে ইয়াদাইন করা বা না-করা, তদ্রূপ ‘আত্তাহিয়্যাতু’র বিভিন্ন পাঠ, আযান-ইকামতের বিভিন্ন ধরন, হজ্বের বিভিন্ন প্রকার-ইফরাদ, কিরান, তামাত্তু বিষয়ে ইখতিলাফের মতোই।’
শায়খ ইবনে তাইমিয়া রাহ. (৭২৮ হি.) লেখেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের নীতি-আর এটাই বিশুদ্ধতম নীতি-এই যে, ইবাদতের পদ্ধতিগত বিষয়ে (যেসব ক্ষেত্রে ইখতিলাফ রয়েছে তাতে) যে পদ্ধতি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ‘আছর’ রয়েছে তা মাকরূহ হবে না; বরং তা হবে শরীয়তসম্মত। সালাতুল খওফের বিভিন্ন পদ্ধতি, আযানের দুই-নিয়ম : তারজী’যুক্ত বা তারজী’বিহীন, ইকামতের দুই-নিয়ম : বাক্যগুলো দুইবার করে বলা কিংবা একবার করে, তাশাহহুদ, ছানা, আউযু-এর বিভিন্ন পাঠ, কুরআনের বিভিন্ন কিরাআত, এই সবগুলো এই নীতিরই অন্তর্ভুক্ত। এভাবে ঈদের নামাযের অতিরিক্ত তাকবীরসংখ্যা (ছয় তাকবীর বা বারো তাকবীর) জানাযার নামাযের বিভিন্ন নিয়ম, সাহু সিজদার বিভিন্ন নিয়ম, কুনূত রুকুর পরে না পূর্বে, রাববানা লাকাল হামদ ‘ওয়া’সহ অথবা ‘ওয়া’ ছাড়া, এই সবগুলোই শরীয়তসম্মত। কোনো পদ্ধতি উত্তম হতে পারে কিন্তু অন্যটি মাকরূহ কখনও নয়। (মাজমূউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ২৪/২৪২/২৪৩ আরো দেখুন : আল ফাতাওয়াল কুবরা ১/১৪০)
ইবনে তাইমিয়া রাহ. ‘মাজমূউল ফাতাওয়া’-র বিভিন্ন স্থানে এবং ‘ইকতিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম’ গ্রন্থে আরো বিস্তারিত ও প্রামাণিক আলোচনা করেছেন। তিনি পরিষ্কার লেখেন, ‘ইখতিলাফে তানাউউ (অর্থাৎ পদ্ধতিগত বিভিন্নতা)-র ক্ষেত্রসমূহে যে যেই পদ্ধতি অনুসরণ করতে চায় (এই জন্য যে, তার শহরে এই পদ্ধতিটাই প্রচলিত, কিংবা তার মাশাইখ এই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন অথবা তার দৃষ্টিতে ওই পদ্ধতিটাই উত্তম) সে তা করতে পারে। এখানে কারো আপত্তি করার অধিকার নেই। নিজে যে পন্থা ইচ্ছা অবলম্বন করুক কিন্তু অন্যের অনুসৃত পদ্ধতিকে (যা শরয়ী দলীল দ্বারা প্রমাণিত) প্রত্যাখ্যান করার অধিকার নেই; বরং এটা জুলুমের অন্তর্ভুক্ত।
এ বিষয়ে শায়খ ইবনে তাইমিয়ার বিভিন্ন পুস্তিকা ও ফতোয়ার সংকলন ‘রিসালাতুল উলফা বাইনাল মুসলিমীন’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ-এর সম্পাদনায় তা বৈরুত থেকে প্রকাশিত হয়। রিসালাটি অবশ্যই পড়ার মতো।
রাফয়ে ইয়াদাইন, আমীন ইত্যাদি বিষয়ের ইখতিলাফ যে, ‘মুবাহ’ বা ‘সুন্নাহ’র বিভিন্নতা, তা শুধু উপরোক্ত ব্যক্তিদেরই কথা নয়, চার মাযহাবের বড় বড় ফকীহ অনেক আগেই তা বলেছেন। ইমাম আবু বকর আলজাসসাস আলহানাফী (৩৭০ হি.) আহকামুল কুরআনে (খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২০৩-২০৪) এ কথাই লিখেছেন। ইমাম ইবনে আবদুল বার মালেকী ‘আততামহীদ’ ও ‘আলইসতিযকার’ দুই গ্রন্থেই এ কথা বলেছেন। তিনি রাফয়ে ইয়াদাইন-এর আলোচনায় আহমদ ইবনে খালিদের বক্তব্য উদ্ধৃত করেন যে, ‘আমাদের আলিমদের মধ্যে কেউ রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন আর কেউ তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া অন্য কোথাও রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন না। তবে তারা একে অন্যের নিন্দা করতেন না।
فما عاب هؤلاء هؤلاء، ولا هؤلاء على هؤلاء
তিনি তার উস্তাদ আবু উমার আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলতেন, আমাদের উস্তাদ আবু ইবরাহীম ইসহাক সকল ওঠা-নামায় হাত তুলতেন। ইবনে আবদুল বার উস্তাদজীকে বললেন, ‘তাহলে আপনি কেন রাফয়ে ইয়াদাইন করেন না। তাহলে আমরাও আপনার অনুসরণে রাফয়ে ইয়াদাইন করতাম?’ তিনি বললেন, ইবনুল কাসিম ইমাম মালিক রাহ. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাফয়ে ইয়াদাইন শুধু তাকবীরে তাহরীমার সময় হবে। আমাদের অঞ্চলে এই রেওয়ায়েত মোতাবেকই আমল হয়ে থাকে। আর মুবাহ বিষয়ে (অর্থাৎ যেখানে দুটো পদ্ধতিই বৈধ ও মুবাহ, যদিও কারো দৃষ্টিতে একটির তুলনায় অন্যটি উত্তম হতে পারে) সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পথ পরিহার করা আইম্মায়ে সালাফের নীতি ছিল না।
ومخالفة الجماعة فيما قد أبيح لنا ليست من شيم الأئمة
(আততামহীদ খন্ড ৯, পৃষ্ঠা ২২৩; আলইসতিযকার খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ১০২)
ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. আততামহীদের শুরুতে এক ভিন্ন প্রসঙ্গে এই মূলনীতি উল্লেখ করেছেন যে, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কর্তব্য হল তাদের পূর্বসূরীদের তরীকা অনুসরণ করা। ভালো কাজের যে পদ্ধতি তারা অবলম্বন করেছিলেন তাই অনুসরণ করা উচিত, যদিও অন্য কোনো মুবাহ পন্থা অধিক পছন্দনীয় বোধ হয়।
فكل قوم ينبغي لهم امتثال طريق سلفهم فيما سبق إليهم من الخير، وسلوك منهاجهم فيما احتملوه عليه من البر، وإن كان غيره مباحا مرغوبا فيه.
(আততামহীদ খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১০)
এই মনীষীগণ দলীলভিত্তিক ফুরূয়ী ইখতিলাফ বিশেষত ‘ইখতিলাফুল মুবাহ’-এর ক্ষেত্রে যে মূলনীতি উল্লেখ করেছেন এটা তাদের ব্যক্তিগত মত নয়; বরং শরীয়তের দলীল ও ইজমায়ে সালাফের দ্বারা প্রমাণিত। শায়খ ওলিউল্লাহ রাহ. ও শায়খ ইবনে তাইমিয়া রাহ. এ বিষয়ে প্রামাণিক আলোচনা করেছেন। আগ্রহী পাঠক তাদের উপরোক্ত গ্রন্থসমূহে তা পড়ে নিতে পারেন। এ প্রসঙ্গে শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা-কৃত ‘আদাবুল ইখতিলাফ ফী মাসাইলিল ইলমি ওয়াদ দ্বীন’ এবং ত্বহা জাবির-কৃত ‘আদাবুল ইখতিলাফ ফিল ইসলাম’ অত্যন্ত চমৎকার ও প্রামাণিক গ্রন্থ। শেষোক্ত গ্রন্থের শুরুতে শায়খ উমর উবাইদ হাসানা-র ভূমিকাটি বিশেষভাবে অধ্যয়নযোগ্য।
আমি পাঠকবৃন্দকে শুধু একটি বিষয়ে চিন্তা করতে বলব। আজকাল উপমহাদেশের অনেক অঞ্চলে এবং অনেক মসজিদে, আল্লাহ মাফ করুন, যে হই-হাঙ্গামা হচ্ছে, বিশেষ কিছু ফুরূয়ী মাসআলাকে কেন্দ্র করে চ্যালেঞ্জবাজি, লিফলেটবাজি এবং নির্বোধ-পথভ্রষ্ট ইত্যাদি কটুবাক্য ব্যবহারের রীতি যারা আরম্ভ করেছেন তাদের ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা উচিত যে, এই সব মতভেদ তো সাহাবা-তাবেয়ীন আমলেও ছিল কিন্তু তাই বলে-নাউযুবিল্লাহ-এইসব চ্যালেঞ্জবাজি ও ফের্কাবাজি তো দূরের কথা, নিন্দা-সমালোচনাও কখনও হয়নি। আমাদের এই বন্ধুরা যদি একটু চিন্তা করতেন যে, নামাযের একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে তারা যে একেই নবী-নামায ও হাদীসের নামায বলে আখ্যায়িত করছেন আর অন্য সব পন্থাকে হাদীস-সুন্নাহর বিরোধী সাব্যস্ত করছেন এমনকি তাদের কট্টরপন্থী লোকেরা তো অন্য নামাযকে একেবারে বাতিলই বলে থাকে-তাহলে কি খোলাফায়ে রাশেদীন, আশারায়ে মুবাশশারা ও অন্যান্য সাহাবীদের নামাযও সুন্নাহবিরোধী ছিল? প্রশ্নটি এজন্য আসে যে, আমাদের এ সকল বন্ধুরা নামাযের যে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তা সম্পূর্ণরূপে এদের কারো নামাযের সাথেই কিন্তু মিল নেই। তাহলে কি প্রকারান্তরে উপরোক্ত সাহাবীদের নামাযকেও খেলাফে সুন্নত বলা হচ্ছে না?
কয়েক বছর আগের ঘটনা। তখনও শায়খ আলবানী মরহুমের কিতাব ‘ছিফাতুস সালাহ’ পুরো নাম-
صفة صلاة النبي صلى الله عليه وسلم من التكبير إلى التسليم كأنك تراها.
-এর বাংলা তরজমা প্রকাশিত হয়নি। আমার কাছে একজন জেনারেল শিক্ষিত ভাই এসেছিলেন, যাকে বোঝানো হয়েছিল কিংবা তাদের বোঝানোর দ্বারা তিনি বুঝে নিয়েছিলেন যে, এই দেশের অধিকাংশ মুসলমান যে পদ্ধতিতে নামায পড়ে তা হাদীস মোতাবেক হয় না। তিনি আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ‘সুসংবাদ’ দিলেন যে, আলবানী মরহুমের কিতাব বাংলায় অনুদিত হয়েছে! শীঘ্রই তা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে! জিজ্ঞাসা করলেন, এ কিতাব সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা আছে কি না! জানা নেই, তিনি মাসআলা জানার জন্য এসেছিলেন না ‘হেদায়েত’ করার জন্য এসেছিলেন। আমি শুধু এটুকু আরজ করেছিলাম যে, আপনি আপনার শিক্ষকদের কাছ থেকে তিন-চার জন সাহাবীর নাম নিয়ে আসুন যাদের নামায শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলবানী মরহুমের কিতাবে উল্লেখিত নিয়ম অনুযায়ী ছিল! তিনি ওয়াদা করে গিয়েছিলেন, কিন্তু সাত-আট বছর অতিবাহিত হল আজও তাঁর দেখা পাইনি!
একটু চিন্তা করুন। তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া নামাযের অন্য কিছু তাকবীরের মধ্যে রাফয়ে ইয়াদাইন করা যদি আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও অন্য কিছু সাহাবীর আমল হয়ে থাকে তাহলে রাফয়ে ইয়াদাইন না-করা হল তাঁর পিতা খলীফায়ে রাশেদ হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা-এর আমল। তদ্রূপ চতুর্থ খলীফায়ে রাশেদ হযরত আলী ইবনে আবু তালিব রা. ও প্রবীণ সাহাবীদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.সহ সাহাবীদের এক জামাত এই নিয়মেই নামায পড়েছেন। তো এদের মধ্যে কার নামাযকে আপনি খেলাফে সুন্নত বলবেন?
আমাদের যে বন্ধুরা শুধু রাফয়ে ইয়াদাইনকেই সুন্নত মনে করেন এবং রাফয়ে ইয়াদাইন না করাকে ভিত্তিহীন বা খেলাফে সুন্নত মনে করেন তারা ফাতিহা পাঠ সম্পর্কে বলে থাকেন যে, ইমামের পিছনে জোরে ও আস্তে সব কিরাতের নামাযে মুকতাদীর জন্য ফাতিহা পড়া ফরয, না পড়লে নামায হবে না। কোনো কোনো কট্টর লোক তো এমনও বলে যে, ফাতিহা ছাড়া যেহেতু নামায হয় না তো যারা ইমামের পিছনে ফাতিহা পড়ে না তারা সব যেন বে-নামাযী। আর বে নামাযী হল কাফির!! (নাউযুবিল্লাহ)
আমাদের এই বন্ধুরা যদি চিন্তা করতেন যে, যে আবদুল্লাহ ইবনে উমরের রা. হাদীস মোতাবেক তারা রফয়ে ইয়াদাইন করে থাকেন তিনিও তো ইমামের পিছনে কুরআন (সেটা ফাতিহা হোক বা ফাতিহার সঙ্গে কিরাত) পড়তেন না। মুয়াত্তায় সহীহ সনদে এসেছে, তিনি বলেন-
إذا صلى أحدكم خلف الإمام فحسبه قراءة الأمام وإذا صلى وحده فليقرأ.
‘যখন তোমাদের কেউ ইমামের পিছনে নামায পড়ে তখন ইমামের কিরাতই তার জন্য যথেষ্ট। আর যখন একা পড়ে তখন সে যেন (কুরআন) পড়ে।’
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর বিশিষ্ট শাগরিদ নাফে রাহ. তাঁর এই ইরশাদ বর্ণনা করে বলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে উমর ইমামের পিছনে পড়তেন না।’ (মুয়াত্তা পৃ. ৮৬)
ওই বন্ধুদের ‘নীতি’ অনুযায়ী তো আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এরও নামায হত না! আর যখন তাঁর নামায হত না তাহলে রাফয়ে ইয়াদাইন বিষয়ে কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে তাঁর বর্ণনাকৃত হাদীস দ্বারা প্রমাণ দেওয়া যাবে কি? কেননা (তাদের কথা অনুযায়ী আল্লাহ মাফ করুন) বেনামাযীর হাদীস কীভাবে গ্রহণ করা যাবে!
অথচ শরীয়তের দলীল দ্বারা ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা প্রমাণিত যে, তাঁর হাদীস অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। তাহলে এটা কি প্রমাণ করে না যে, এ ধরনের বিষয়ে কারো নিন্দা-সমালোচনা করা কিংবা গোমরাহ ও ফাসেক আখ্যা দেওয়া নাজায়েয ও অবৈধ?
আমীন জোরে বলা হবে না আস্তে-এ নিয়ে আমাদের এই বন্ধুরা ঝগড়া-বিবাদ করে থাকেন। হাদীস ও আছারের গ্রন্থসমূহ তারা যদি সঠিক পন্থায় অধ্যয়ন করতেন তবে জানতে পারতেন যে, সুফিয়ান ছাওরী রাহ., যাঁর রেওয়ায়েতকৃত হাদীসের ভিত্তিতে এরা জোরে আমীন বলে থাকেন স্বয়ং তিনিই আমীন আস্তে বলতেন। (আলমুহাল্লা, ইবনে হায্ম খ : ২, পৃ. : ২৯৫)
যদি বিষয়টা ‘সুন্নাহর বিভিন্নতা’ না হত কিংবা অন্তত ‘মুজতাহাদ ফীহ’ না হত তাহলে এই প্রশ্ন কি আসত না যে, যে ব্যক্তি নিজের রেওয়ায়েতকৃত হাদীসের উপর নিজেই আমল করে না তার রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণগ্রহণ জায়েয হবে কি?
এভাবে অন্যান্য বিষয়েও যদি চিন্তা করতে থাকেন তাহলে এই সব ক্ষেত্রে সাহাবা-যুগ থেকে চলে আসা মতভেদ আপনাকে বিচলিত করবে না। আর একে বিবাদ-বিসংবাদের মাধ্যম বানানোর প্রবণতাও দূর হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ #
(চলবে ইনশাআল্লাহ)